সাদিয়া হুমায়রা: কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করত সমুদ্র ভালো লাগে, নাকি পাহাড়? নির্দ্বিধায় বলতাম সমুদ্র। কিন্তু শ্বেতশুভ্র তুষারে মোড়ানো পাহাড়চূড়ায় ওঠার যে মোহ, উত্তেজনা, চলতি পথের রহস্য উদ্ঘাটনের রোমাঞ্চ, তা আসলেই ভিন্ন। এখন যদি কেউ সেই প্রশ্নটি করে, তাহলে আমার উত্তর হবে—পাহাড়। আমাদের নরওয়ে ভ্রমণের একটি অংশ ছিল বরফজমাট ট্রলটাঙ্গা পর্বতে ট্রেকিং। ট্রলটাঙ্গার শাব্দিক অর্থ দানবের জিহ্বা। নরওয়ের হরডাল্যান্ড বিভাগের অড্ডাতে অবস্থিত এই ট্রলটাঙ্গা। মূল পাহাড় থেকে ট্রলটাঙ্গা সমান্তরালভাবে অভিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ‘রিঙ্গেডালসভেটনেট’ হ্রদের ওপর। পাহাড় থেকে অভিক্ষিপ্ত অংশটুকু দেখলে নামকরণের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৩ হাজার ৬০৯ ফুট। যাওয়া-আসা মিলিয়ে ২২ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়।
২৯ মার্চ ২০১৮। স্টাভেঙ্গার থেকে ট্রলটাঙ্গার স্টার্টিং পয়েন্টে আমরা এজেন্টের দল আসার আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। সব ট্রেকার এসে পৌঁছালে ‘ট্রলটাঙ্গা অ্যাকটিভ’ নামের ট্যুর এজেন্সির আউটলেট থেকে আমরা পানিরোধী ইনস্যুলেটেড হাইকিং বুটস, হাইকিং স্টিক ভাড়া নিলাম। তখন বাজে প্রায় সকাল আটটা। ট্রেকিং নিয়ে ট্রেকারদের উদ্দেশে ব্রিফিং দেওয়া হলো। ব্রিফিং শেষেই শুরু হলো আমাদের ট্রেকিং।
প্রথম দুই কিলোমিটার খাড়া পাহাড় উঠতে হলো। এরপর পাঁচ মিনিটের বিরতির পর আবার শুরু হলো পাহাড়ে চড়া। মাঝেমধ্যে খাড়া অংশ পার হতে হচ্ছিল, যেটা দেখে নিজেই তাজ্জব হয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা সবাই চলছি, কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পরপর পাঁচ–দশ মিনিটের বিরতি। সে সময় একটু পানি খেয়ে, হালকা নাশতা করে ঝটপট আবার যাত্রা শুরু করি।
এমনভাবেই কেটে গেল সাতটি ঘণ্টা! এর মধ্যে অনেক খাড়া পাহাড়ে চড়েছি, অনেক জায়গাতেই হয়তো পাহাড় ভেবে পা ফেলেছি কিন্তু সেই জায়গাটি শুধু বরফ হওয়ায় বরফ ভেঙে কিছুটা নিচে পড়ে গিয়েছি, আবার খানিকটা পথ ঘুরে ওপরে উঠেছি। কোনো কোনো সময় প্রবল হাওয়া আমাদের কাঁপিয়ে রেখে গেছে আর কখনো–বা পাহাড়ের ওপর থেকে ‘রিঙ্গেডালসভেটনেট’ হ্রদের পাগল করা সৌন্দর্য দেখে ট্রেকিংয়ের কষ্ট ভুলে গেছি। দিকনির্দেশনার জন্য সব সময় আমাদের সঙ্গে গাইড ছিল। এ ছাড়া চলতি পথে পাথরের গায়ে ‘টি’ লেখা থাকে বা খুঁটি গাঁথা থাকে—সেই অনুযায়ী চললেই দেখা মিলবে অতি আকাঙ্ক্ষিত ট্রলটাঙ্গা। সেখানে পৌঁছাতে যখন আরও চার কিলোমিটারের মতো বাকি তখন আমরা সবাই কাঠের তৈরি একটি কক্ষে কিছুক্ষণ অবস্থান করি, যা সারভাইভালের জন্য নির্মিত। ট্রেকিংয়ের মধ্যে সেখানেই সর্বোচ্চ সময়ের জন্য বিরতি পাওয়া যায়। এদিকে সূর্যের আলোর চরম তীক্ষ্ণতা অন্যদিকে বাতাসের প্রবল বেগ—এসব ছেড়ে যখন সেই রুমে আমরা প্রবেশ করলাম, মনে হলো ঠান্ডার মধ্যে এমন পরিতৃপ্তি আগে কখনো মেলেনি আর সেখানে থার্মোস থেকে পানি নিয়ে বানানো রেডিমিক্স হট চকলেটটি আমার জীবনের খাওয়া শ্রেষ্ঠ হট চকলেট।
সেদিন ট্রলটাঙ্গার তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। প্রবল বেগে হাওয়ার কারণে মনে হচ্ছিল যেন মাইনাস ৩০ ডিগ্রি! সেই রুম থেকে কিছুটা ঝরঝরে হয়ে নতুন উদ্যমে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আর একটু এগোলোই ট্রলটাঙ্গা—আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য।
অবশেষে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম। সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য! ওখানে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে দেখেছি সৃষ্টিকর্তার সুনিপুণ শৈল্পিক সৃষ্টি, যার বৈচিত্র্যের কোনো শেষ নেই। তার সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে ‘রিঙ্গেডালসভেটনেট’ হ্রদ এবং তার দুই ধারের শ্বেতশুভ্র পাহাড়। আসলেই যেন প্রকাণ্ড পাহাড়ের দেহ থেকে এক জিহ্বা বের হয়ে আছে। ক্রিস্টালের ওপর থেকে আলোকচ্ছটা দেখতে যেমন, জমে থাকা লেকের পানির ওপর সূর্যের আলো পড়ায় মনে হচ্ছিল যেন ক্রিস্টালের ওপর থেকেই বিচ্ছুরিত হচ্ছে সেই আলো। যেই ট্রলটাঙ্গার ছবি দেখে এখানে এসেছি; সেখানে দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম এ যে আরও সুন্দর। সেই সৌন্দর্য এবং ট্রলটাঙ্গা জয়ের আনন্দ, নামার সময় আমাদের কষ্টটা যেন অর্ধেক করে দিয়েছিল। নামতে সময় কম লাগে, আমাদের নামতে লেগেছিল প্রায় ছয় ঘণ্টা। নামতে নামতে আমাদের রাত হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু ট্রেকিংয়ে আমরা দুজন তেমন পারদর্শী ছিলাম না, অন্য ইউরোপিয়ানদের থেকে আমাদের সময় লেগেছিল কিছুটা বেশি। কিন্তু সেটাও ছিল আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, রাত হওয়ায় আমরা দেখতে পেয়েছিলাম বরফে মোড়ানো সাদা পাহাড়ের ওপরে ছড়িয়ে পড়া চাঁদের আলো। শ্বেতশুভ্র বরফের ওপর জ্যোৎস্নার আলো সৃষ্টি করেছিল এক মোহময়ী রূপ, উপভোগ করেছিলাম নৈসর্গিক সৌন্দর্য, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ শুধু নিজের অনুভবের।
ওপরে ওঠার সময় প্রথম দুই কিলোমিটার ছিল সবচেয়ে কঠিন কিন্তু নামার সময় যখন সেখান থেকে আলো ঝলমলে রাতের শহরটাকে দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল যে পৃথিবীটা অতি সুন্দর, বিস্ময়কর, অতি রহস্যময়।
কীভাবে যাবেন: আমরা যেহেতু স্নো মাউন্টেন ট্রেকিং করেছিলাম, গাইডেড ট্যুরে আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। নরওয়ের ট্রমসো থেকে দুপুরের ফ্লাইটে স্টাভেঙ্গারে যাই। সেখান থেকে রাত আড়াইটার দিকে গাড়িতে করে রওনা দিলাম অড্ডার উদ্দেশে। সাড়ে ছয়টার দিকে আমরা পৌঁছে যাই ট্রলটাঙ্গা অ্যাকটিভের স্টার্টিং পয়েন্টে। স্নো মাউন্টেন ট্রেকিংয়ের পরিকল্পনা থাকলে তার আগের রাতে যেন পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ঘুম হয় সেদিকে যত্নশীল হতে হবে। সে জন্য স্টাভেঙ্গার বা বার্গেন বিমানবন্দর থেকে সরাসরি অড্ডায় গিয়ে কোনো হোটেলে রাত যাপন করতে পারেন। ট্রেকিংয়ের দিন ভোরে ‘অড্ডা’ থেকে ট্রলটাঙ্গায় (ট্রেকিং শুরুর স্থানে) পৌঁছে যাবেন দেড় ঘণ্টার বাসভ্রমণে।
শীতকালে গাইডেড ট্যুর নিতে জনপ্রতি বাংলাদেশি টাকায় ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে লাগবে। এই এজেন্টেদের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করলেও থাকা–খাওয়ার হিসাব ট্রেকিংয়ের হিসাবের বাইরে ধরতে হবে আপনাকে। সানগ্লাস, ওয়াটারপ্রুফ ব্যাকপ্যাক, জ্যাকেট, সোয়েটার, প্যান্ট, উলেন ক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস, থার্মোস, পানির বোতল, স্ন্যাকস, চকলেট।