উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

হযরত মুহাম্মদের (স) সর্বজনীনতাঃ প্রামাণিকতায় অকাট্য

ডক্টর শাহ মুহাম্মাদ আবদুর রাহীম
আল কুরআন উদাত্ত কণ্ঠে ও স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিচ্ছে, ইসলাম মৌলিকভাবে একটি বিশ্বাস একটি সর্বজনীন আদর্শ। সে বিশ্বাস বিশেষ কোনো সময়, সমাজ বা জনসমষ্টির জন্যে নির্দিষ্ট নয়। বিশেষ কোনো শহর, নগর বা দেশের জন্যে একান্তভাবে নির্দেশিত নয়। দ্বীন-ইসলাম পূর্ণাঙ্গ বিধান হিসেবে সকল ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্যে। জাতি, দেশ, কাল, বর্ণ ও ভাষার দিক দিয়ে তাদের মধ্যে যতই পার্থক্য থাক না কেন; মানব বংশের সকল পর্যায়ে তা বাস্তবায়িত হওয়ার যোগ্য, কোনো প্রতিবন্ধকতাই এ পথ আগলে দাঁড়াতে পারে না। জাতীয়তা ও আঞ্চলিকভাবে প্রতিবন্ধকতাও তথায় স্বীকৃত হতে পারে না। তাঁর দাওয়াত ও আন্দোলনের ইতিহাস এবং তার বিস্তৃতি ও সম্প্রসারণের ইতিবৃত্তই এর অকাট্য প্রমাণ।
ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম:
ইসলাম ধর্মবিশ্বাসও সর্বজনীন এর ইবাদত অনুষ্ঠানও সর্বজনীন। অতএব, ইসলামি ধর্ম বিশ্বাসের ধারক ও বাহক হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর রিসালাতও সর্বজনীন। আমরা যখনই মহানবী (স) এর উপস্থাপিত দ্বীনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের দিকে তাকাই, তখন আমাদের সামনে থেকে অন্ধকারের কুহেলিকা বিলীন হয়ে যায়। কোনরূপ চেষ্টা চরিত্র ও কষ্ট ছাড়া আমরা মহানবী (স)-এর রিসালাতের সর্বজনীনতা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই।
মহানবী (স)-এর দ্বীনি দাওয়াতের প্রথম সূচনা পর্ব তাঁর বংশ ও পরিবার পরিমন্ডলের মধ্যে আবর্তিত ছিল। যেমন, তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল- “আর তোমার বংশীয় নিকটবর্তী লোকদের সতর্ক করো।” (সূরা শুআরা-২৬:২১৪)
রাসূলে পাক (স) তাঁর নিজের ঘরের চাচা-মামা পর্যায়ের ও রক্ত সম্পর্কীয় ব্যক্তিদের একত্রিত করে সর্বপ্রথম যে দাওয়াত পেশ করেন, প্রামাণ্য ইতিহাসে তা নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত রয়েছে- “যে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ উপাস্য ও মাবুদ নেই, তাঁর নামে শপথ করে বলছি, আমি আল্লাহর রাসূল রূপে মনোনীত ও নিয়োজিত হয়েছি। বিশেষভাবে তোমাদের জন্যে এবং সাধারণভাবে সমস্ত মানুষের জন্যে। আল্লাহর নামে শপথ! তোমরা অবশ্যই মরবে যেমন করে তোমরা নিদ্রায় অচেতন হয়ে পড় এবং তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে, যেমন করে তোমরা নিদ্রা থেকে জেগে উঠ। তখন তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্মের হিসাব-নিকাশ নেওয়া হবে। সেই সাথে এও জানবে যে, জান্নাত চিরন্তন, জাহান্নামও স্থায়ী।” (হাদীস ও সিরাতগ্রন্থসমূহ)
এভাবেই ইসলামী দাওয়াতের সূচনা হয়েছিল। বলা যায়, হাঁটি হাঁটি পা পা করেই তা অগ্রসর হচ্ছিল, চতুর্দিকে সমাচ্ছন্ন শিরক ও নাস্তিকতার আবরণ ছিন্ন করেই অতি ধীরে ধীরে তাঁকে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। এ সময়ই মক্কা নগরীর কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন। বহু সংখ্যক যুবকও তাঁর দাওয়াতের প্রতি আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ হয়। সেই সাথে কুরাইশ সর্দাররা উদ্বীগ্ন হয়ে উঠে। অবস্থা দেখে তারা অনেকটা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কেমন করে এই আন্দোলনকে নিস্তব্ধ করা যায়, সে চিন্তায় তারা খুবই মরিয়া হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তারা এই আওয়াজকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে মুহাম্মাদ (স)- কেই সম্পূর্ণরূপে খতম করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করতে আদেশ দেন।
মহানবী (স) হিজরত করেও কুরাইশ বাহিনীর জিঘাংসা, শত্রুতা এবং ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন নি। বরং তাঁর সাথে যুক্ত হয় মদীনার স্বার্থবাদী ইয়াহুদী মহলের পরশ্রীকাতরতা। এক পর্যায়ে স্বার্থবাদী মুনাফিক ও পরশ্রীকাতর ইয়াহুদীসহ মিত্রবাহিনীর কুরাইশদের বিরুদ্ধে মহানবী (স) কে অনেক সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে হয়। অবশেষে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মহানবী (স)-এর সামনে থেকে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হয়ে যায়। তিনি মদীনা ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের বাহিরে দূর বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে সচেষ্ট হন।
এই সময় তিনি চতুর্দিকে দূত পাঠিয়ে বড় বড় রাজা বাদশাহ ও শাসকদের নিকট দ্বীন ইসলাম কবুল করার দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। রোমের সম্রাট কাইসার, পারস্য সম্রাট কিসরা, মিশরের কিব্তী শাসক ‘আজীম’, হাবশার বাদশাহ গাসানী প্রধান হারিস, সিরিয় রাজা এহুম, ইয়ামামা শাসক হাওদা এবং আরবের বিভিন্ন গোত্রপতি, এমনকি সরকারি কর্মচারী, ধর্মযাজক ইত্যাদির নিকট দ্বীন ইসলাম কবুলের আহ্বান সম্বলিত পত্র পাঠিয়ে দেন। তাকে তিনি শান্তির একমাত্র বিধান দ্বীন ইসলাম কবুল করার ও তাঁকে আল্লাহর রাসূলরূপে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
এসব পত্র আহ্বান অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, বিশ্বনবী (স)-এর দাওয়াত ও দ্বীন ছিল বিশ্বজনীন, সমগ্র পৃথিবীর জন্যেই তা ছিল আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ দ্বীন এবং তিনি ছিলেন সব মানুষের জন্যে আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ রাসূল ও বিশ্বনবী।
আল কুরআনের দৃষ্টিতে মুহাম্মদ (স) এর রিসালাতের সর্বজনীনতা:
গবেষণার দৃষ্টিতে আল কুরআনের দিকে তাকালে এরূপ অসংখ্য আয়াত দেখতে পাওয়া যায়, যা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলে কারীম (স)-এর রিসালাত ছিল বিশ্বজনীন, ছিল সমগ্র বিশ্বের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্যে। তা যেমন কোনো দেশ বা অঞ্চল কিংবা ভাষা, বর্ণ বা দেশের লোকদের জন্যে ছিল না। তেমনি কেবল এক কালের লোকদের জন্যেও ছিলনা। তা ছিল পৃথিবীর সর্বকালের সকল মানুষের জন্যে সমানভাবে গ্রহণীয়, অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। তিনি সর্ব মানুষের সার্বিক কল্যাণ বিধানের জন্যেই প্রেরিত হয়েছিলেন। এ পর্যায়ে কুরআনের ‘সর্বজনীনতা বিষয়ক’, আয়াতগুলোকে কয়েকটি ভাগে উদ্ধৃত করা হলো।
প্রথমত: আল কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতের সুস্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে- মহানবী (স)-এর রিসালাত সারা বিশ্বব্যাপী। তিনি সর্বকালের সর্ব মানুষের প্রতিই প্রেরিত। আল্লাহ তাঁকে গোটা বিশ্বের রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। “বলুন হে মানব মন্ডলী! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর রাসূল।” (সূরা আ’রাফ- ৮:১৫৮) “আমরা তোমাকে সমগ্র মানবতার জন্যে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই পাঠিয়েছি। (সূরা সাবা-৩৪:২৮) “আমরা তোমাকে সমগ্র মানুষ মন্ডলীর জন্যে রাসূল রূপে পাঠিয়েছি। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।” (সূরা নিসা- ৪:৬৯) “আমরা তোমাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্যে রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি” (সূরা আম্বিয়া-২১:১০৭) “মহান পবিত্র বরকত ওয়ালা সেই আল্লাহ, যিনি পার্থক্যকারী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তাঁর বান্দাহর উপর যেন তিনি সমগ্র বিশ্বলোকের জন্যে সতর্ককারী হতে পারে।” (সূরা ফুরকান-২৫:১) “আমার নিকট ওহী করে এই কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যেন আমি এর দ্বারা তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট তা পৌঁছবে তাদেরকেও সতর্ক করতে পারি।” (সূরা আনআম-৭:১৯) “তিনিই মহান আল্লাহ, যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াতের বিধান ও সত্য অনুসরণ এবং অধীনতার ব্যবস্থাসহ পাঠিয়েছেন, যেন তিনি তা সমস্ত আনুগত্য ব্যবস্থার উপর জয়ী করতে পারেন।” (সূরা সাফ- ৬১:৯) “হে মানব জাতি! এ রাসূল তোমাদের নিকট তোমাদের রব এর পক্ষ থেকে সত্য নিয়ে এসেছেন। অতএব, তোমরা ঈমান আন। তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর হবে”। (সূরা নিসা- ৪:১২০)
দ্বিতীয়ত: কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে নিঃশর্ত ও কোনরূপ বিশ্লেষণ ব্যতীত সমগ্র মানুষকে সম্মোধন করা হয়েছে। সম্মোধনের এই রূপ ও প্রকৃতি প্রমাণ করে যে, এই কুরআন যেমন সর্ব মানুষের জন্যে, হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নবুয়্যত ও রিসালাত তেমনি সর্ব মানুষের জন্যে। এ পর্যায়ের কিছু আয়াত এখানে তুলে ধরছি:
“হে মানুষ! তোমরা সকলে তোমাদের সেই রব এর দাসত্ব কবুল করো- দাস হয়ে থাক, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকেও এ আশায় যে, তোমরা আল্লাহ ভীরু হবে।” (সূরা বাকারা- ২:৬১)
“হে মানুষ! তোমরা আহার করো পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা থেকে হালাল, উত্তম উৎকৃষ্টরূপে। আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু” (সূরা বাকারা- ২:১৬১)
উদ্ধৃত আয়াতদ্বয়ে স্পষ্ট ভাষায়, “হে মানুষ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ফলে এ সম্বোধন, আহ্বান মানুষ পদবাচ্য সকলেরই জন্যে সকলেরই প্রতি। বিশেষ কোনো অংশের মানুষের জন্যে নয়। এতে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, কুরআন এবং হযরত মুহাম্মাদ (স) যে দ্বীন পেশ করেছেন- দ্বীন ইসলাম তা সকল মানুষের জন্যে যেমন, তেমনি তার নবুওয়্যাত ও রিসালাত সর্বকালের, সর্ব মানুষের জন্যে। ইসলাম বিশ্বজনীন দ্বীন। যদি তা না হতো, তাহলে কুরআনে এরূপ সম্বোধন উদ্ধৃত্ত হবার কোনো তাৎপর্যই থাকতো না। অথচ আল-কুরআনে ষোলটি আয়াতে হে মানুষ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
তৃতীয়ত : আল কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে সাধারণ বিষয়ের অবতারণা করে বহু সংখ্যক বিধান পেশ করা হয়েছে। যে বিধান বিশেষ কোনো ধর্ম, বর্ণ, বংশ বা দেশের ও যুগের লোকদের জন্যে নয়। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, রাসূল কারীম (স) পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বসবাসকারী সকল মানব সমাজের সংশোধন ও পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। আর তাঁর রিসালাত কোনো বিশেষ সীমার মধ্যেই সীমিত বা সংকুচিত ছিল না। এ পর্যায়ের কতিপয় আয়াত-
‘আল্লাহর জন্যে আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা সাধারণভাবে সব মানুষেরই কর্তব্য, তবে যারা সেই পর্যন্ত যাতায়াতের সামর্থ্যবান। (সূরা আলে ইমরান- ৩:৯৭)
এ আয়াতের বক্তব্য হলো, যে কোনো মানুষ আল্লাহর ঘর পর্যন্ত যাতায়াতের জন্যে প্রয়োজনীয় শারীরিক ও অর্থনৈতিক সামর্থের অধিকারী হবে, তাকেই এই ঘরের হজ্জ করতে হবে। মানুষের জন্যে তা একান্তই কর্তব্য এবং এ কর্তব্য উক্ত গুণের অধিকারী সকল মানুষেরই। সে মানুষ যে দেশের, যে বংশের ও যে কালেরই হোক না কেন। কুরআনের আয়াত এই কর্তব্য কেবল আরববাসী বা মহানবী (স) এর সমসাময়িক লোকদের জন্যেই নির্দিষ্ট করা হয়নি।
“মসজিদে হারাম যা আমি সকল মানুষের জন্যে বানিয়েছি, তথায় স্থানীয় বাসিন্দা ও বহিরাগতদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে সমান।” (সূরা হজ্জ- ২২:১৫)
“লোকদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা মন ভুলানো কথা খরিদ করে আনে, যেন সঠিক জ্ঞান ব্যতিরেকেই আল্লাহর পথ থেকে লোকদের ভ্রষ্ট করা যায়।” (সূরা লুকমান- ৩১:৬)
চতুর্থত: আল কুরআন স্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে, তাঁর হিদায়াত বিশেষভাবে কোনো সমাজ বা জনসমষ্টির জন্যে নয়, বিশেষ কোনো কাল বা সময়ের লোকদের জন্যেও নয়, বরং আকাশের নিচে, পৃথিবীর উপরে অবস্থানকারী সমস্ত মানুষের জন্যে সমভাবে প্রযোজ্য। এ পর্যায়ে কতিপয় আয়াত-“হে মানুষ! তোমাদের নিকট তোমাদেরই রব এর নিকট থেকে অকাট্য দলীল এসে গেছে এবং আমি তোমাদের প্রতি সুস্পষ্ট আলো অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা নিসা- ৪:১৭৪) “রমযান মাস! তাতেই নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্যে হিদায়াতের বিধান হিসেবে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।” (সূরা বাকারা- ২:১৮৫) “আমি এই কুরআনে জনগণের সম্মুখে নানা প্রকারের উপমা পেশ করেছি, যাতে তারা তা থেকে বিশেষভাবে উপদেশ নেয়।” (সূরা যুমার- ৩৯:২৭) “এই গ্রন্থ তা তোমার প্রতি আমি এজন্যে নাযিল করেছি, যেন তুমি লোকদেরকে পুঞ্জীভ‚ত অন্ধকারের মধ্য থেকে আলোকের দিকে বের করে নিয়ে আসতে পার।” (সূরা ইব্রাহীম- ১৪:১)
এ ক’টি আয়াতই উদাত্ত কণ্ঠে জানাচ্ছে যে, কুরআন সকল মানুষের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছে। সকলেরই জন্যে আলো; অজ্ঞানতা ও পাপ-বুদ্ধির সুচিভেদ্য অন্ধকার থেকে মুক্তি লাভের এক মাত্র উপায় হচ্ছে এই কুরআন এবং তা বিশেষভাবে কারো জন্যেই নয়। নির্বিশেষে সকল মানুষেরই জন্যে। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াতাংশটিও স্মরণীয়- “আর এই রাসূলের আগমন অন্যান্য সেই অনাগত লোকদের জন্যেও যারা এখনও তাদের সাথে বসে মিলিত হয়নি।” (সূরা জুম’আ- ৬২: ৩)
এই ‘অন্যান্য লোক বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? নিশ্চয়ই সেই সব লোক যারা উত্তরকালে কিয়ামত পর্যন্ত আরব-অনারব নির্বিশেষে এসে এই মুসলিমদের সাথে ঈমানের ভিত্তিতে মিলিত হবে। ফলে এই আয়াতাংশও রাসূলে পাক (স)-এর বিশ্বজনীন ও চিরন্তন নবুয়্যত এবং রিসালাতের কথাই প্রকাশ করছে। সেই সাথে একান্ত প্রকারান্তরে প্রকাশিত ও প্রমাণিত হয় যে, তাঁর এ নবুয়্যত ও রিসালাত পৃথিবীর শেষদিন পযন্ত দীর্ঘায়িত-সম্প্রসারিত। অতঃপর অপর কোনো নবী বা রাসূলের আগমনের কোনো সম্ভাবনার প্রশ্নই উঠতে পারে না। তার কোনো অবকাশও নেই।
এ সব আলোচনার সার কথা এই দাঁড়ায় যে, রাসূলে কারীম (স)-এর রিসালাত ও নবুয়্যতের বিশ্বজনীনতা ও সর্বজনীতা অবশ্য স্বীকৃতব্য। তা না কোনো জাতীয়তা আঞ্চলিকতার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ, না কাল ও যুগের সীমায় পরিবেষ্টিত।
প্রকৃতিগত দিক থেকে রাসূলের সর্বজনীনতা :
রাসূলে করীম (স)-এর রিসালাত সর্বজনীনতা ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রমাণিত। এই দৃষ্টিকোণটিও ইসলামের প্রকৃতির সাথে পুরোপুরি সামাঞ্জশ্যশীল। বিশ্বলোক, জীবন ও মানুষ এবং আইন প্রণয়ন ও শরীয়তের বিধান রচনার দিক থেকেও ইসলামের দৃষ্টিকোণের ব্যাপক বিশালতা লক্ষ্যণীয়।
বস্তুত ইসলাম তার আইন-বিধান নির্ধারণে এবং মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ চিন্তার মানবতার সেই সাধারণ প্রকৃতির ওপর অধিক নির্ভরতা গ্রহণ করেছে। যার উপর সব মানব বংশের সৃষ্টি ও সংগঠন বাস্তবায়িত হয়েছে। যা মানুষের সমস্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেবারে অতি সাধারণ ও সকলেই পরিব্যাপ্ত। কেউই তার বাইরে নয়। এদিক দিয়ে দুনিয়ার কোনো অঞ্চলের মানুষের সাথে অপর অঞ্চলের বা কোনো সময়কালের মানুষের সাথে অপর সময়কালের মনুষের বিন্দুমাত্র পার্থক্যও নেই। আর ইসলাম যখন সকল মানুষের এই অভিন্ন প্রকৃতি ও জন্মগত স্বভাবের প্রতি লক্ষ্য রেখেই বিধান পেশ করেছে, তখন সে বিধান গ্রহণ ও পালনের দায়িত্বের দিক দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের বা বিভিন্ন সময়কালের মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা হবে কেন? কেন বলা হবে, ইসলাম কেবল অমুক এলাকার বা অমুক সময়ের লোকদের জন্যে আর অমুক অমুক এলাকার বা অমুক অমুক সময়ের লোকদের জন্যে নয়? ইসলামের ব্যাপারে এ ধরনের ধারণা নবী করীম (স) এর ওপর স্থাপিত জীবন বিধান-দ্বীন ইসলাম এর ব্যাপক ভিত্তিকতা ও দিক বিপুলতার প্রতি লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যায় যে, মানুষের যত দিক, যত বিভাগ ও যত সমস্যাই থাকতে পারে, রাসূলে করীম (স) তাঁর কোনো একটি দিক, বিভাগ বা সমস্যাকে বাদ দিয়ে-উপেক্ষা করে কথা বলেননি। বরং সকল দিক বিভাগ ও সমস্যা সম্পর্কেই কথা বলেছেন। এ দিকটাও অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, রাসূলে করীম (স) সর্বজনীন সকল মানুষের জন্যেই নবী ও রাসূল ছিলেন। কোনো বিশেষ বা বিশেষ সমস্যায় জর্জরিত জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্যে তাঁর আগমন হয়নি।
ইসলামের নৈতিক আদর্শ ও তৎসংক্রান্ত বিধি-বিধান দ্বীন ইসলামের গৌরবের বিষয়। ইসলাম বিশ্ব মানবতার জন্যে কল্যাণের দিকগুলো যেমন স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে, তেমনি অকল্যাণের দিকগুলো তুলে ধরে সেগুলো থেকে মানুষকে নিরুৎসাহিত ও নিষেধ করেছে। কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ সকল মানুষের জন্য একটিই হতে পারে। আর অকল্যাণের দিকও একটিই হতে পারে। ইসলাম সত্য ভাষণ ও সততার নীতি, আমানত রক্ষা নীতি, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা প্রদর্শন, পারস্পরিক ভালো ধারণা পোষণ, ক্ষমাশীলতা, ত্যাগ তিতীক্ষা, মেহমানদারী, ঔদার্য, বিনয়, শোকর, তাওয়াক্কুল, কর্মে নিষ্ঠাসহ সকল নৈতিক ভাবধারা সম্পন্ন আদর্শ উপস্থাপন করেছে। পক্ষান্তরে মিথ্যা কথন, কার্পণ্য, বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মসাৎকরণ, শঠতা-কপটতা, মিথ্যাদোষারূপ, ক্রোধ, আক্রোশ, হিংসা-দ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, ধোকা-প্রতারণা-অহংকার প্রভৃতি হীন ও জঘন্য
কার্যকলাপ পরিহার করার উপদেশ দিয়েছে। আর ইসলামের এসব নৈতিক ও অনৈতিক কার্যকলাপের ফিরিস্তি ও আদেশ নিষেধ কোনো বিশেষ কাল ও সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য সীমাবদ্ধ করা হয়নি। ফলে ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম এবং ইসলামের নবী ও সর্বজনীন।
এ পর্যায়ে কুরআনুল কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত প্রণিধানযোগ্য-
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা সুবিচার, ইনসাফ, অনুগ্রহ, সদাচরণ এবং আত্মীয় স্বজনকে দান করার আদেশ দেন। আর তিনি অশ্লীলতা, অসংগত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ করতে পার।” (সূরা আন নাহল- ১৬:৯০)
“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি। নির্দেশ দিবে ভালো কাজের আর বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই হলো সফলকাম।” (সূরা আলে ইমরান- ৩:১০৪)
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামের নীতিমালা যেরূপ সর্বজনীনতার আলোকে প্রদীপ্ত সেরূপ ইসলামের নবীও সর্বজনীন, বিশ্বজনীন তাঁর ভাস্বর।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *