ব্যাংকের ভল্টে হীরক ‘দরিয়া-এ নূর’
লায়েকুজ্জামান: ব্রিটিশ যুগে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। ব্রিটিশ যুগ গেছে, পাকিস্তানি আমল পেরিয়ে বাংলাদেশেরও প্রায় অর্ধশতাব্দী ছুঁই ছুঁই। ঋণ শোধ হয়নি। দেনার দায়ে সরকারের হেফাজতে এসেছিল হীরক খণ্ড ‘দরিয়া-এ নূর’ ও আরো ১০৯ প্রকার স্বর্ণালংকারসহ নবাবদের ভূসম্পদ। হীরা ও স্বর্ণালংকারগুলো এখন ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন রক্ষিত আছে সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ভল্টে। ঢাকা গড়ায় অবদান রাখা নবাব সলিমুল্লাহ ১১০ বছরেও ঋণমুক্ত হতে পারেননি।
নবাব সলিমুল্লাহ পানীয় জল, ইলেকট্রিসিটি এবং টেলিফোন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে আধুনিক ঢাকার জন্ম দেন। ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জন ঢাকা সফরে এলে তাঁর কাছে পূর্ব বাংলার সমস্যাগুলো তিনি তুলে ধরেছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ঢাকার রমনা এলাকায় নিজ জমি দান করেন এবং বাবার নামে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমানে বুয়েট) প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দোসরদের ক্রমাগত আক্রমণ থেকে নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য এবং ধর্ম রক্ষায় প্রায় ছয় মাসের চেষ্টায় পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠনে তিনি অসামান্য ভূমিকা রাখেন।
সরকারের নথি থেকে জানা যায়, ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ আর্থিক সংকটে পড়লে ১৯০৮ সালে ‘রেহেন দলিল ৪১৪২’ মূলে নবাব পরিবার ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ৩০ বছরে পরিশোধযোগ্য বার্ষিক ৩% সুদে ১৪ লাখ রুপি ঋণ গ্রহণ করে। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়, “ঢাকা নবার স্টেটের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি যা ১৯০৮ সালের ৬ আগস্ট পূর্ববঙ্গ আসাম সরকারের পক্ষে কমিশনার ঢাকা বিভাগ এবং নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুর সিএসআইয়ের মধ্যে সম্পাদিত বন্ধকী চুক্তি অনুসারে অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে পাঁচ লাখ রুপি মূল্যের ‘দরিয়া-এ নূর’ ও ১০৯ প্রকার হীরক খণ্ড পাওয়া যায়।”
ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথিপত্র থেকে জানা যায়, ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় সম্পদগুলো ব্রিটিশ সরকার সেফ ডিপোজিট হিসেবে তৎকালীন স্টেট ব্যাংকে জমা রাখে, সেই ধারাবাহিকতায় এ সম্পদ বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে জমা আছে। দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি সংস্কার বোর্ড। বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় নবাব পরিবারের সম্পদ বন্ধকী হিসেবে আছে।’
এদিকে কারো কারো সন্দেহ, হীরক খণ্ডটি যথাস্থানে নেই। ভূমি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে হীরক খণ্ডটি যাচাইয়ের সুপারিশ করে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত কমিটির ২৩তম বৈঠকে। ভূমিমন্ত্রীর নেতৃত্বে ‘দরিয়া-এ নূর’ পরিদর্শনের সুপারিশ করা হয়। ভূমি সংস্কার বোর্ডের ২০১৬ সালের ৬ অক্টোররের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।
জানা যায়, ২০০৩ সালের ৩ মে নবাব স্টেটের অস্থাবর সম্পত্তি পরিদর্শনে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি কোনো বৈঠকে মিলিত হয়েছে এমন কোনো তথ্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে নেই। তবে ভূমি সংস্কার বোর্ডের নথিতে দেখা যায়, ২০১১ সালের ২১ জুন লোহার বাক্স কাপড়ে মোড়ানো সিলগালাকৃত অবস্থায় সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষে এনে পরিদর্শন করা হয়। এ সময় ভূমিমন্ত্রীসহ কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সেদিন হীরক খণ্ডটি উন্মুক্ত করে দেখা হয়নি।
ঢাকা গড়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রাখা নবাব সলিমুল্লাহর কোনো উত্তরাধিকারীও এ ঋণ শোধ করেনি। জানা যায়, সলিমুল্লাহর বোনের ছেলে পাকিস্তানের একসময়ের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঋণ পরিশোধ করে সম্পত্তি অবমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়ে পারেননি পারিবারিক বিরোধের কারণে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯০৮ সালের ১৪ লাখ রুপি এখন কয়েক শ কোটি টাকা হতে পারে। কেউ ঋণ নিলে তিনি জীবিত না থাকলে তাঁর উত্তরাধিকারীদের কারো পক্ষ থেকে তো ঋণের দায়মুক্তির আবেদন আসতে হবে। এলেই সরকার বিবেচনা করতে পারে। এ ছাড়া এই ঋণের কথা এই প্রথম শুনলাম।’
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, ‘নবাব সলিমুল্লাহ ঋণ নিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে। ব্রিটিশ সরকার এ খেলাপি ঋণের কোনো সুরাহা করেনি। তারপর পাকিস্তান গেছে। বাংলাদেশও অনেক বছর পার করল। এখন রাষ্ট্র কিভাবে তাঁকে ঋণমুক্ত করবে?’
সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন এমন কোনো নথি সোনালী ব্যাংকে আমার সময় দেখিনি। তবে নবাব পরিবারের অজনা কিছু অস্থাবর সম্পদ বাক্সবন্দি অবস্থায় সোনালী ব্যাংকে আছে সেফ ডিপোজিট হিসেবে; এটা ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পদ হিসেবে নয়। এর মধ্যে হীরক খণ্ড বা অন্য কী আছে সেটা ব্যাংকের জানার কথা নয়। কারণ সেফ ডিপোজিট আননোন কনন্টেট হিসেবে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘ঋণের বিষয়টি লিপিবদ্ধ থাকলে হয়তো ঋণমুক্তির প্রশ্ন আসত।’
ভূমি সংস্কার বোর্ডের ডিএলআরসি রইসউদ্দিন এ নবাব স্টেট ও হীরক খণ্ড নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, নবাব সলিমুল্লাহর উত্তরাধিকারী খাজা নাজিমউদ্দিনও ঋণ পরিশোধ করেননি। এখন সমাধান হতে পারে যদি সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়।
অন্যদিকে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, ‘এই হীরক খণ্ড সোনালী ব্যাংকের ভল্টে বন্দি করে রাখার কোনো যুক্তি দেখছি না। এ ছাড়া এটা ১০০ বছর ধরে ব্যাংকে আছে এখন এমনিতেই জাদুঘর পেতে পারে। আমরা এটা নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আবারও নতুন করে ২০১৫ সাল থেকে চেষ্টা করছি। বিভিন্ন দপ্তরে লেখালেখি করছি। সোনালী ব্যাংকের এমডিকে জাদুঘরে নিয়ে এসেছিলাম। তাঁকে বলেছিলাম হীরক খণ্ড বন্দি না রেখে জাদুঘরে দিতে। তবে কোনো পক্ষেরই সাড়া পাচ্ছি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘অনেকে জাদুঘরে হীরক খণ্ড রাখার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি বলি, হীরক খণ্ডের চেয়েও দামি জিনিসপত্র জাদুঘরে আছে।’
নবাব স্যার সলিমুল্লাহর বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকার বলে ঢাকায় বসবাসকারী বেশ কিছু লোক দাবি করেন। তবে তাঁরা কেউ নবাব সলিমুল্লাহর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হননি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বিভূতিভূষণ বলেন, ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যদি ঋণের দাবি প্রত্যাহার না করে অব্যাহত রাখে তাহলে ঋণ গ্রহীতার বংশধরদের সে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এখানে বংশধরদের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই।