হিমালয় রিপোর্টঃ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয় অসংখ্য পর্বতের সমন্বিত রূপ। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও চীন- এ পাঁচটি দেশে এটি বিস্তৃত। হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। উচ্চতা প্রায় ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার। এছাড়াও ৮ হাজার মিটার কিংবা তারও বেশি উচ্চতার বেশকিছু পর্বত রয়েছে হিমালয়ে। এর মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কে-টু, মাকালু, ধবলগিরি, অন্নপূর্ণা পর্বত অন্যতম। এছাড়া ৭ হাজার কিংবা তার বেশি উচ্চতার শতাধিক পর্বত রয়েছে। প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব মতে, ভারতীয় প্লেট ও এশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষে হিমালয় সৃষ্টি হয়েছে। এখনও হিমালয় পর্বতমালা সঞ্চারণশীল। পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অনবরত ধাবিত হচ্ছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিবেশগত ভারসাম্য হিমালয়ের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। এর দক্ষিণ প্রান্ত জীববৈচিত্র্যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলেও উত্তর প্রান্ত ঠিক উল্টো। তবে উঁচু পাহাড়ের চূড়া সারা বছর বরফে ঢাকা থাকে। শীতকালে বরফের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ছোট ছোট ছড়ায় রূপ নেয়। এগুলো মিলিত হয়েই পৃথিবীর প্রধান নদী সিন্ধু, শতদ্রু, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার উৎপত্তি হয়েছে।
হিমালয় এমন এক বিস্ময়ের রাজ্য, যেখানে যেতে চায় পৃথিবীর বহু মানুষ। পৃথিবীর সব মানুষ হিমালয় পর্বতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ। একবার যে জেনেছে বা শুনেছে এর সৌন্দর্য্য আর সৌকর্যের কথা, সে আর তার মায়াজাল থেকে বেরোতে পারেনি। হিমালয় মানে এক বিস্ময়কর রহস্য, এক ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। হাজার হাজার বছর ধরে তাবৎ দুনিয়ার মানুষকে অভিভূত করে রেখেছে এই হিমালয়। হিমালয় হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালা। আর সেটাও কিন্তু যে সে উঁচু নয়! ভাবেন তো, আপনাদের বাড়ির ছাদ থেকে একটা মানুষকে কতোটুকু দেখায়, কিংবা ২০ তলা বা ৫০ তলা উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে? পিঁপড়ার মতো, তাই না? কিংবা ভাবেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিল্ডিংয়ের কথা। কিন্তু সে উচ্চতাও এই পর্বতমালার কাছে নস্যি। অতো উপর থেকে মানুষ তো দূরে থাক, হাতিও দেখা যাবে না। নীল তিমির কথাও যদি ধরেন, সেও পাত্তা পাবে না। কারণ পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার বা ২৯ হাজার ৩৫ ফিট উঁচুতে রয়েছে এর চূড়া “এভারেস্ট”।
এবার চলেন ‘হিমালয়’ শব্দে ফিরে যাই। ‘হিমালয়’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে, অর্থ তুষারের আবাস বা বাসা। কারণ, এর সবচেয়ে উঁচু চূড়াগুলো সবসময় তুষার দিয়ে ঢাকা থাকে। পর্বত আর পর্বতমালার পার্থক্য তো আপনারা বোঝেন, পাহাড়ের চেয়েও উঁচু যেগুলো, সেগুলোকে আমরা বলি পর্বত। আর অনেকগুলো পর্বত একসঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকলে, সেগুলোকে একসঙ্গে আমরা বলি পর্বতমালা। হিমালয় এমনি অনেকগুলো পর্বতমালা; মোটমাট ৬৬টি পর্বত, তিনটি সমান্তরাল রেঞ্জে উঠে গেছে ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সমতল ভূমির বিপরীতে। এই বিশাল পর্বতমালাকে যদি আপনি এক বিশালাকার দানবের আকারে ভাবেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে এর দেহের মাঝে মানে এর রেঞ্জের একদম মাঝে অবস্থিত ভূটান, নেপাল আর ভারতের সিকিম প্রদেশ। আর এর বিস্তৃত অংশ এবং কয়েকটি চূড়া আছে পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, চীন ও তিব্বতের প্রান্ত ঘিরে।
সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো, এই পর্বতগুলোর খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে আছে অমৃতধারা, মানে নদী আরকি। আর এই নদী গুলোই আমাদের প্রাণ। হিমালয় পর্বত থেকে নেমে আসা এই নদীগুলোই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে নয়তো ভারত মহাসাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। আর এই নদীগুলোকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই দেশগুলোর সব প্রাচীন সভ্যতা। হিমালয় পর্বত থেকে সৃষ্ট এই নদীগুলোর কয়েকটি তো শত শত শাখা প্রশাখা মেলে আমাদের দেশকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে, বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে। তাইতো আমাদের দেশকে বলা হয় “নদী মাতৃক” দেশ। আমাদের দেশের বেশিরভাগ নদীর পানিই আসে হিমালয় পর্বতমালার বরফ গলে। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্রের নাম শুনেছেন না? এই দু’টি নদীর উৎপত্তি হয়েছে হিমালয় থেকে। আর গঙ্গা বাংলাদেশে এসে হয়ে গেছে পদ্মা। আমাদের দেশের অধিকাংশ নদীর পানিই আসে এই দু’টি নদীর ধারা থেকে। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদীগুলোর তালিকাতেও কিন্তু দাপট এই নদীগুলোরই। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র তো আছেই, এছাড়াও আছে মেকং, ইয়াংসি ও সিন্ধু।
আচ্ছা, এবার বলেন, এতো যে উঁচু হিমালয়, সেটা তৈরি হলো কি করে? আসলে পৃথিবীর এই উচ্চতম পর্বতমালাও কিন্তু সবসময় এতো উঁচু ছিলো না, আদিম পৃথিবীর উচ্চতম স্থান ছিলো আরেকটি। আজকের এই হিমালয় কি আর একদিনে হয়েছে! তবে হিমালয় এই চেহারায় আসার পর থেকে প্রায় একই রকম আছে। আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি বছর আগে জন্ম হয় এই পর্বতমালার। মূলত ভূমিকম্পের কারণেই জন্ম হয় এই পর্বতমালার।
যাহোক, বলছিলাম চূড়ার কথা। হিমালয় পর্বতমালায় যে সমান্তরাল তিনটি রেঞ্জ বা সারি রয়েছে, তাতে পৃথিবীতে ২৪ হাজার ফিট উঁচু পর্বতচূড়া আছে ১০৯ টি। এই ১০৯টি চূড়ার মধ্যে ৯৬টি আছে হিমালয় পর্বতমালার ওই সমান্তরাল তিনটি রেঞ্জে। সবার দক্ষিণে যে শিখর বা চূড়াটি রয়েছে তা প্রায় ৫০০০ ফিট উঁচু, মধ্যসারির পর্বতমালাগুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা ৭০০০ থেকে ১৫০০০ ফিট। আর এর পরেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতচূড়া সম্বলিত হিমালয় রেঞ্জ। মানে, এই রেঞ্জেই আছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট। তবে মাউন্ট এভারেস্টকে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলে ঘোষণা করার ব্যাপারেও কিছু মজা আছে।
আগে সবাই জানতো, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু চূড়া হল কাঞ্চনজক্সঘা। এই পর্বতশৃঙ্গটিও হিমালয়ে, এভারেস্টের কাছাকাছি। পরে এভারেস্টের খোজ পাওয়া গেলে শুরু হল শৃঙ্গটি মাপার কাজ। এই শৃঙ্গটির উচ্চতা মেপে বের করার কাজটি করেছিলেন এক বাঙালি, রাধানাথ শিকদার, ১৮৫২ সালে। কিন্তু এতো বড়ো সিদ্ধান্ত কি আর মাপজোখ না করে মেনে নেয়া যায়? তৎকালীন বৃটিশ ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়াহ তা মাপজোখ করতে লেগে যান। কয়েক বছর ধরে চলে সেই মাপজোখের পালা। অবশেষে, ১৮৬৬ সালের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, কাঞ্চনজক্সঘা আর পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ নয়, দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আসলে এভারেস্ট।
তবে মজার বিষয় কী জানেন? তখনো কিন্তু পর্বতশৃঙ্গটির নাম এভারেস্ট দেয়াই হয়নি। শৃঙ্গটিকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ঘোষণা করার পরে ওয়াহ পড়লেন আরেকটা ঝামেলায়। শৃঙ্গটির স্থানীয় অনেক নাম আছে, কিন্তু এমন কোনো নাম নেই, যে নামটি সবার কাছে প্রচলিত। মানে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ শৃঙ্গটিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে। এই যেমন ধরো দার্জিলিংয়ে শৃঙ্গটির নাম দেওদুক্সঘা (মানে পবিত্র পর্বতশৃঙ্গ), তারপর তিব্বতে শৃঙ্গটির নাম চমোলুংমা, শৃঙ্গটির এমনি আরো অনেক নাম প্রচলিত ছিলো। তাহলে, ওয়াহ এখন কোন নামটি বেছে নেবেন?
অ্যান্ড্রু ওয়াহ নিরাপদ পথে হাঁটলেন। তিনি স্থানীয় নামগুলোর কোনটিই বেছে নিলেন না। তার আগে বৃটিশ ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল যিনি ছিলেন, ওয়াহ তার নামই বেছে নিলেন, জর্জ এভারেস্টের নামে নামকরণ করা হলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের “মাউন্ট এভারেস্ট” বা “এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গ”। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে। মানবজাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় দিন। এতোদিন পর্যন্ত যে এভারেস্ট মানুষের কাছে ছিলো অজেয়, সেই সুউচ্চ শৃঙ্গটিও মানুষের পদানত হলো। এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগে পা রাখলেন মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়।
ভাবছেন উঁচু হলো তো বয়েই গেল, তাতে উঠতে কি সমস্যা? আছে আছে, সমস্যা আছে বলেই তো বলছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, মাটি থেকে যতো উপরে ওঠা যায়, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ততো কমে আসে। আর অক্সিজেন আমাদের জন্য কতো দরকারি, তা তো জানেনই। আর মাটি থেকে এতো উপরে যে চূড়া, সেখানকার বাতাসে অক্সিজেন এর পরিমান অনেক কম, তা একবার ভাবেন। তাই পর্বত চূড়ায় উঠতে হলে ঘাড়ে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে নিয়ে যেতে হয়, মহাকাশচারীদের মতো। কোনো কারণে যদি ট্যাংক ছিদ্র হয়ে যায়, কিংবা ট্যাংক থেকে মাস্কে অক্সিজেন আসার নল ফুটো হয়ে যায়, তবেই মরণ! তাছাড়া, তুষারাবৃত হিমালয়ের প্রায় সবগুলো পর্বতশৃঙ্গে ওঠার রাস্তা যথেষ্ট খাড়া। শুধু তাই নয়, সে পথে প্রায়ই নানা দুর্যোগ হয়। হঠাৎ করে হয়তো তুষার ঝড় শুরু হলো, কিংবা পাহাড়ে জমা তুষার ধ্বসে পড়লো। তবেই আর আপনাকে বাঁচতে হবে না। আর একবার রাস্তা ভুল করলে হয়েছে, আর রাস্তা খুঁজে পেতে হবে না! ওখানে যে সবই সাদা, শুধু বরফ আর বরফ।
ভাবছেন তাহলে নিশ্চয়ই অনেক মানুষ এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে গিয়ে মারা পড়েছে? তবে আর বলছি কি! হিলারি আর তেনজিং কী আর প্রথম হিমালয়ে চড়তে গিয়েছিলো! এর আগে কতো মানুষ চূড়ায় উঠতে গিয়ে মারা পড়েছে। পরেও মারা গেছে অনেকে। তবে এখন হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে; তবুও কাজটা ভীষণই কঠিন। একই সঙ্গে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। যতো প্রযুক্তিই ব্যবহার করেন, একবার তুষার ঝড়ে নয়তো তুষার ধ্বসের মধ্যে যদি পরেই যান, তবে আর বাঁচার উপায় নেই। তবু মানুষ এভারেস্ট জয় করতে চায়। প্রতি বছরই অসংখ্য মানুষ নেপালে নয়তো চীনে ছুটে যায় এভারেস্ট চূড়ায় পা রাখতে। আর সেই তালিকায় কোনো বাংলাদেশির নাম ছিলো না বহুদিন। অবশেষে সেই আক্ষেপ দূর করেন ‘মুসা ইব্রাহিম’। ২০১০ সালের ২৩ মে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় তিনিই প্রথম বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা ওড়ান। তারপর এভারেস্ট জয় করেছেন আরো কয়েকজন বাংলাদেশি। মুসা ইব্রাহিমের পরপরই এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। তবে তিনি একবার এভারেস্টে চড়েই খুশি থাকেননি, গিয়েছেন দু’বার। বাংলাদেশের মেয়েরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? সেই আক্ষেপও ঘুঁচে গেছে। নিশাত মজুমদার প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন ২০১২ সালের ১৯ মে। পরে ওয়াসফিয়া নাজরীন দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে জয় করেন মাউন্ট এভারেস্ট।