জাফর আহমাদ: আল্লাহকে বাদ দিয়ে গায়রুল্লাহর নামে কসম করা অবৈধ এবং মারাত্মক অপরাধ। আমাদের সমাজের অজ্ঞ লোকেরা বিভিন্ন সৃষ্টির নামে শপথ করে থাকে। যেমন: নবীর কসম, ফেরেস্তাদের কসম, আকাশের কসম, পানির কসম, রিজিকের কসম, মা-বাবার কসম, ছেলেমেয়ের কসম, জীবন, প্রাণ, মাথাসহ পীর ও মাজারের নামেও কসম করা হয়। এ ছাড়া অঞ্চল ভেদে শপথের কিছু পরিভাষা এমনটি শোনা যায় যেমন: ‘আমি যদি এমনটি করে থাকি তবে আমি আমার কোলের শিশু বাচ্চাটির মাথা খাই’ ‘আমার বুকে আল্লাহ যেন বজ্র ফেলে’ ‘রিজিকগুলো সামনে নিয়ে বা রিজিকে হাত রেখে বলছি আমি যদি এমনটি করে থাকি তবে রিজিকগুলো যেন হারাম হয়ে যায়’ ‘আমার মরা বাপের কসম’ ‘আমার মরা মায়ের কসম’ ‘মরা কাঠটায় বসে বলছি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার রা: থেকে বর্ণিত। তিনি উমার রা:-কে বলতে শুনেছেন। রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে কেউ কসম করতে চায় সে যেন আল্লাহর নাম ছাড়া কসম না করে। কুরাইশরা তাদের বাপ-দাদার নামে কসম করত। অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন, তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার নামে হলফ করো না।’(মুসলিম)
শপথের তাৎপর্য হলো: যার নামে শপথ করা হয়, সেটিকে অধিক প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর, অপ্রাকৃতিক ও বিশাল ক্ষমতার অধিকারী মনে করেই শপথ করা হয়। এবং যে বক্তব্য বা বিষয়কে সামনে রেখে কসম করা হয় তা থেকে অধিক গুরুত্বের দাবিদার হিসেবে সেসব সৃষ্টির নামে কসম খেয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহাবিশ্বের শ্রষ্টা ও মালিক। আসমান-জমিন ও সব সৃষ্টিলোকে তাঁর রাজত্ব ও প্রভাব বিস্তৃৃত। তিনি প্রত্যেক জিনিসের ওপর শক্তিশালী। তাঁর প্রভাব বলয়ের বাইরে কোনো সৃষ্টিই নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন ‘হে জিন ও মানবজাতি আসমান ও জমিনের বাইরে কোথাও চলে যাওয়ার যদি কোনো ক্ষমতা তোমাদের থাকে, তাহলে বেরিয়ে যাও। আল্লাহর ক্ষমতা ছাড়া কখনো বেরুতে পারবে না।; (সূরা আর রাহমান) তিনি সব কিছু জানেন ও দেখেন। ভয় একমাত্র তাঁকেই করা যায়। সুতরাং কসম হতে হবে একমাত্র তাঁর নামেই। আল্লাহকে বাদ দিয়ে শপথ করার অর্থ হলো, সে বস্তুটিকে আল্লাহর ওপর প্রাধান্য দেয়া এবং আল্লাহ থেকে অধিক ভয় করা। এ জন্য আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘কেউ অভ্যাসবশত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে ভুলক্রমে শপথ করলে তৎক্ষণাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।’(বুখারি ও মুসলিম) এ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যারা বিভিন্ন নামে কসম করে তারা ঈমান ও ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায়, যার ফলে রাসূল সা: সাথে সাথে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে আবার ইসলামের সীমানায় প্রবেশ করতে বলেছেন। আল্লাহর রাসূল সা: আরো বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের পিতৃ-পুরুষদের নামে শপথ করতে নিষেধ করেছেন। শপথ যদি করতেই হয় তবে আল্লাহর নামেই করবে, নচেত চুপ থাকবে।’(বুখারি ও মুসলিম) সহিহ মুসলিমে বর্ণিত রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমাদের দেব-দেবীর নামে বা বাপ-দাদার নামে শপথ করো না।’ ‘আমার কথা সত্য না হলে আমি অমুকের সন্তান নই’এরূপ বলা বাপ-দাদার নামে শপথের পর্যায়ভুক্ত।’ (সহিহ মুসলিম)
আল্লাহর নামে কসম করার চেতনা এই হওয়া উচিত যে, আমি এমন এক সত্তার নামে কসম করছি, পৃথিবীর কেউ না দেখলেও তিনি দেখেন। আমি মিথ্যা বলছি নাকি সত্য বলছি তা তিনি প্রত্যক্ষ করছেন। আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে মিথ্যা কসম করা এক দুঃসাহসিক আচরণ। অর্থাৎ আল্লাহকে সামনে রেখে মিথ্যা বলা হলো। রাসূল সা: বলেছেনÑ যে ব্যক্তি নিজের শপথ দ্বারা কোনো মুসলমানের সম্পদ কুক্ষিগত করে, সে নিজের জন্য জাহান্নাম অবধারিত ও জান্নাত হারাম করে ফেলে। এক ব্যক্তি বললÑ হে আল্লাহর রাসূল! যদি তা নগণ্য জিনিস হয় তবুও? তিনি বললেন, যদি একটা গাছের ডালও হয় তবুও।’(মুসলিম)
আবু যর রা: কর্তৃক বর্ণিত রাসূল সা: বলেছেন ‘তিন ব্যক্তির সাথে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা কথা বলবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের একজন হলো মিথ্যা শপথ করে যে ব্যক্তি পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে।’(মুসলিম, তিরমিজি) রাসূল সা: বলেছেন, ‘কবিরা গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে শরিক করা, মা-বাবাকে অসন্তুষ্ট করা,আত্মহত্যা করা ও মিথ্যা শপথ করা। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা শপথ করে, তাকে ‘ইয়ামানে গামুস’ অর্থাৎ নিমজ্জিতকারী শপথ বলা হয়। কারণ এ ধরনের শপথ মানুষকে পাপে নিমজ্জিত করে।
কসম করার পর যদি দেখা যায় যে, সেটির বিপরীত করাটা উত্তম, তখন কসম ভেঙে উত্তম কাজটি করে নেবেন। তবে কর্তব্য হবে কসমের কাফ্ফারা আদায় করা। হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন ‘যে কেউ কসম করার পর সেটার চেয়ে উত্তম দেখে, তার উচিত সে যেন তার কসমের কাফ্ফারা আদায় করে এবং উত্তম কাজটি করে নেয়।’(মুসলিম)
অতএব, মুসলমান ভাই ও বোনদের কাছে আবেদন গায়রুল্লাহর নামে কসম করা, মিথ্যা কসম করা এবং তুচ্ছ ব্যাপারে ঘন ঘন কসম খাওয়া পরিত্যাগ করুন। মনে রাখবেন, যারা এমনটি করবে কুরআন ও হাদিসের পরিভাষায় আল্লাহ তাদেরকে পবিত্র করবেন না। আর অপর দিকে কাফেরদেরকে আল-কুরআনে অপবিত্র বা নাপাক বলা হয়েছে। সুতরাং আমরা নাপাক এবং কাফের হতে চাই না।
লেখক: ব্যাংকার