শাহ্ আব্দুল হান্নান: পবিত্র কুরআনে দেখা যায় যে, রাসূল সা:-এর দায়িত্বের মধ্যে ছিল মানুষকে মুক্ত করা সেসব গুরুভার ও শৃঙ্খল থেকে, যেগুলো মানুষের ওপর বোঝা হয়ে চেপেছিল। অন্যভাবে বলা যায়, ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের সহজ জীবন নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে সূরা আল আরাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতের অনুবাদ উল্লেখ করছি।
‘যারা অনুসরণ করবে আমার এই রাসূল উম্মি নবীর, যার উল্লেখ তারা লিপিবদ্ধ পায় তাদের কাছে রক্ষিত তাওরাত এবং ইনজিলে, সে তাদের ভালো কাজের আদেশ দেয়, মন্দ কাজ থেকে বারণ করে; তাদের জন্য সব ভালো জিনিস হালাল করে; সব নোংরা অপবিত্র জিনিস হারাম করে এবং তাদেরকে মুক্ত করে সেসব গুরুভার ও শৃঙ্খল থেকে, যেগুলো তাদের ওপর বোঝা হয়ে চেপেছিল। অতএব, যারা তার প্রতি ঈমান আনবে, তাকে সম্মান প্রদর্শন করবে, তাকে সাহায্য করবে এবং সেই নূর (কুরআন)-এর অনুসরণ করবে, যা নাজিল করা হয়েছে তার সাথে, তারাই হবে সফলকাম।’
এ আয়াতে দেখা যায়, রাসূল সা:-এর ছয়টি প্রধান দায়িত্ব ছিল। তার মধ্যে দু’টি ছিল মানুষের ওপর বোঝা দূর করা এবং তাদের শৃঙ্খলমুক্ত করা। আল্লাহ তায়ালা আরো বলছেন যে, যারা এসবের ওপর ঈমান আনবে এবং কুরআনকে অনুসরণ করবে তারাই হবে সফলকাম।
এখন দেখা যাক, জীবনকে ভারমুক্ত করা বলতে কী বুঝব আমরা? ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেছেন, এর অর্থ বিধি-নিষেধ কমিয়ে দেয়া। আজকাল দেখা যায়, প্রত্যেক দেশেই আইন কানুন অনেক বেশি এবং বিধি-নিষেধ আরো বেশি। অথচ এসব আইনের বেশির ভাগেরই প্রয়োগ নেই। এ আয়াতের দাবি হলো, ইসলামী রাষ্ট্রে কেবল প্রয়োজনীয় আইন থাকবে। অতিরিক্ত আইন কানুন, রুলস বা বিধি থাকবে না। তা করা হলে মানুষের জীবন সহজ হয়ে যাবে। দেশে এত আইন আছে যে, তার বেশির ভাগ সম্পর্কেই জানি না। এগুলো সহজেই পরিবর্তন হবে না। কিন্তু ইসলামের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হবে কেবল প্রয়োজনীয় আইন রাখা।
একদল ইসলামী অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘ভার বা বোঝা কমিয়ে দেয়া এবং শৃঙ্খলমুক্ত করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য। মানুষের জীবনকে দারিদ্র্য খুবই ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য হবে, সমাজকে দারিদ্র্যমুক্ত করা। এটাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো ইসলামী দেশে মেগা প্রজেক্ট (বড় পরিকল্পনা) কমও থাকতে পারে। কিন্তু দারিদ্র্য দূর করতে হবে প্রথমেই। অর্থনীতি এমন হতে হবে যেন মানুষ সহজে ব্যবসা করতে পারে, বাণিজ্য করতে পারে, শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিধি-বিধান রাখা ঠিক হবে না। এতে অর্থনীতির কোনো কল্যাণ হয় না, বরং দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়।
বোঝা নামিয়ে দেয়া এবং শৃঙ্খল কমিয়ে দেয়ার আর একটি তাৎপর্য হচ্ছে, কুসংস্কার দূর করা। ‘কুসংস্কার’ কাকে বলে? ইসলামের মতে, কুরআন ও সুন্নাহ্তে যা লিপিবদ্ধ করা হয়নি, এমন সব বিশ্বাস এবং এমন সব কাজকে ইসলামী মনে করা, কল্যাণকর মনে করা এবং অবশ্যই করণীয় মনে করার নাম কুসংস্কার। রাসূলুল্লাহ সা: আরব দেশের সব কুসংস্কার- তা ব্যক্তি জীবনে হোক বা সমাজ জীবনে হোক- বাতিল করে দিয়েছিলেন। যেমন তিনি গণকের কাছে যাওয়া বা হাত দেখিয়ে ভাগ্য নির্ধারণ করাকে নিষিদ্ধ করে দেন। হজের তাওয়াফে নগ্ন হওয়া বা হাততালি দেয়াকে কুরআন শরিফ নিষিদ্ধ করে দেয়। আর একটি কুসংস্কার হচ্ছে, বংশের বা জাতির গৌরব করা। এসব ইসলাম নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এ জন্যই রাসূল সা: বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর ওপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার ওপর কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ আজকের ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদে যেখানে নিজের জাতিকে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়, এটা ইসলামের বিধানে নেই। ইসলাম কেবল নিজ ভৌগোলিক জাতির ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ রক্ষা করাকে জায়েজ বা বৈধ মনে করে।
পরিশেষে বলব, আসলে মানবজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত জীবনকে ভারমুক্ত এবং শৃঙ্খলমুক্ত করা। আশা করি, সবাই বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করবেন এবং ইসলামী বিশেষজ্ঞরা (স্কলার) এ বিষয়ের ওপর লিখবেন।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার