উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

আমার কাল আমার চিন্তা

শাহ আব্দুল হান্নান:
স্কুল পরবর্তী সময়
পরবর্তী সময় তখন মেট্রিক বা এসএসসিকে মেট্রিকুলেশন বলা হতো। সেই বছর এপ্রিল-মে’র দিকে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। স্কুল পর্যন্ত পড়াশুনা যশোর থেকে শেষ করে পরবর্তীতে জুন-জুলাই দিকে সেই একই বছরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। আমার মায়ের এক চাচাতো ভাই ছিলেন এ কে এম আমিনুল ইসলাম সাহেব। তিনি তৎকালীন সময়ে ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে তিনি বিকিক (বাংলাদেশ কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) এর চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি আমাকে সরাসরি প্রিন্সিপালের রুমে নিয়ে যান এবং সেখানেই আমার ভর্তি চূড়ান্ত করেন। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে যাই।
আমি স্বাভাবিকভাবেই তখন শহরের কায়দা-কানুন ভালো জানতাম না। আর ঢাকা শহরেও এর আগে থাকিনি। দু’একবার বেড়াতে এসেছি মাত্র। মামার সঙ্গে যখন প্রিন্সিপালের রুমে যাই তখন প্রিন্সিপালের সামনেই আমি আমার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তা দেখে প্রিন্সিপাল আমাকে বললেন, তুমি প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে নাও। আমি সাথে সাথেই হাত বের করে নিলাম। পরে যখন রুম থেকে বের হলাম, রুম থেকে বের হতেই মামা আমাকে বকা দিলেন। বললেন, তুমি এটাও জানো না? কিন্তু সত্যিই আমি এটা জানতাম না যে, কোনটা সঠিক আচরণ আর কোনটা সঠিক নয়। সেই ঘটনাটা আমার এখনো মনে পড়ে কিভাবে ভর্তি হতে যেয়ে প্রথম দিনই এমন ঘটনা ঘটে গেল।
ঢাকা কলেজের তখন অবস্থান ছিল ফুলবাড়িয়াতে। অর্থাৎ পুরানো ঢাকার রেল স্টেশনের অপর পাড়ে। সেখানে পুরানো দু’তিনটি বিল্ডিং এর মধ্যে একটা ছিল কলেজের। তবে সেখানে মাত্র দু’তিনটা ক্লাস আমরা করতে পেরেছিলাম। এরপর আমাদের সময়েই বর্তমান স্থান ধানমন্ডিতে কলেজ স্থানান্তরিত হয়। সেখানে আমরা ১৯৫৫-১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পড়াশুনা করি। তখন ঢাকা কলেজের মাত্র নতুন বিল্ডিং হয়েছে। আমরাই তার প্রথম ছাত্র। ঢাকা কলেজের ডান পাশে নিউমার্কেট। কলেজ এবং নিউমার্কেটের মাঝখানে ছিল ধানক্ষেত। সেই সময় কলেজ থেকে বেরিয়ে আমরা ধানক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে হেঁটে নিউমার্কেটে গিয়ে চা খেতাম। কলেজের চারপাশের পরিবেশ ছিল খুব নীরব। লোকজন ছিল খুব কম। তখনও ধানমন্ডি পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। সেই অংশও অনেকটা ধানক্ষেত ছিল। সবে মাত্র ধানমন্ডি এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে। তবে যতটুকু মনে পড়ে, ঢাকা কলেজের সেটাই ছিল শেষ বিল্ডিং।
সেই দুই বছরের সময়টাও ছিল স্মৃতিময়। সব কথা বলে শেষ করা যাবে না। সব কথা প্রাসঙ্গিকও হবে না। কলেজে আমার রোল নম্বর ছিল একশ। তাই ছাত্ররা কেউ কেউ আমাকে ওয়ান হানড্রেড আর কেউ কেউ সেঞ্চুরি বলে ডাকত। আমি চঞ্চল টাইপের ছিলাম। সবকিছুতেও একটিভ ছিলাম। যার ফলে সবাই আমাকে কম বেশি চিনত। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে ইসলামী শাসনতন্ত্র ঘোষিত হয়। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী সাহেবের সরকার কেন্দ্রে। যুক্তফ্রন্ট, মুসলিম লীগ তাতে আছে। এরা মিলেই কেন্দ্রের সরকার। এ শাসনতন্ত্র সকল ইসলামী দল গ্রহণ করে, সমর্থন করে। সেই সাথে অন্যান্য সকল দলও এটা গ্রহণ করে, একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া। ১৯৫৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে তিনশ দশটি আসনের মধ্যে অমুসলিম আসনগুলো বাদে সবটাই যুক্তফ্রন্ট পায়। মুসলিম লীগ পায় মাত্র দশটি আসন। সে সময় আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় কম্পোনেন্ট (শরিক) পার্টি ছিল। সে দিক থেকে ৫৪তে মুসলিম লীগের পরাজয়ের পর আওয়ামীলীগই ছিল মেজর পার্টি। সেই আওয়ামী সমর্থিত ছাত্ররাও তার ইসলামী শাসনতন্ত্রের বিরোধীতা করে এবং কলেজে ধর্মঘটের আয়োজন করতে চেষ্টা করে। আমিও তাদের ভিতর একজন ছিলাম যারা
একদম না বুঝে বিরোধীতা করে। যদিও শুধুমাত্র যারা বিরোধিতা করেছিল তাদের সঙ্গে থাকা ছাড়া আমার অন্য কিছু করার ছিল না। এর একটা কারণ ছিল, সে সময়ের বয়সটাই এমন যে তখন রাজনীতি কি তা যে কেউ ভালো বোঝে তাও নয়। কিন্তু তারপরেও মানুষ রাজনীতি করে। বিভিন্ন ইস্যুতে জড়িয়ে যায়। আমার পক্ষে একটা যুক্তি ছিল যে আমার বড় মামা নিজে একজন আওয়ামী লীগের খুব সক্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার মায়ের আপন ভাই এ কে এম শামসুল হক। আর প্রথমে যার কথা উলেখ করেছি তিনি ছিলেন এ কে এম আমিনুল ইসলাম, আমার মায়ের সবচেয়ে বড় চাচাতো ভাই। মায়ের একমাত্র চাচার বড় ছেলে।
আমার মামা খুব চরিত্রবান, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক ছিলেন। তার একটা প্রভাব আমার উপর ছিল। সেই কারণে হলেও ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির একটা প্রভাব আমার উপর ক্রিয়াশীল ছিল। যার ফলেই আমি বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু আমার মনে পড়ে একদল ছাত্র এর বিরোধীতা করেনি, করতে রাজি হয়নি। যদিও সেদিন কোনো ক্লাস হয়নি। একদল ছাত্র বেশ সাহসের সঙ্গে এ বিরোধীতাকে গ্রহণও করেনি। মীর্জা আজিজুল ইসলাম সাহেবের কথা মনে আছে। তিনি ম্যাট্রিকুলেশনে ফার্স্ট কি সেকেন্ড হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ফজলুল হক হলের ভিপি হয়েছিলেন। সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। পরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যোগ দিয়ে সিভিল সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে দেন। তিনিও এর বিরোধীতা করেননি এবং করতে রাজিও হননি।
সে সময় কলেজে একটা কালচার চালু ছিল। তখন জাতীয় রাজনীতি তো ছিলই, তবু প্রায় জায়গাতেই রাজনীতিমুক্ত হয়ে লোকাল সংগঠন গড়ে উঠতো। এরকম সংগঠন ঢাকা কলেজেও ছিল। আমাদের সময় ডেমোক্রেটিক পার্টি ও পাইওনিয়ার পার্টি নামে দু’টি দল ছিল। এসব সংগঠনগুলো হতো কলেজ ভিত্তিক। সেখানে দেখা যেত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেও কলেজে ডেমোক্রেটিক হিসেবে সবাই এক। আবার অন্য দিকে পাইওনিয়ার হিসেবে তারাও এক। দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশক্তি যে কোনো একটি পার্টিতে একত্রে আছে। যার ফলে সেখানে ছাত্র রাজনীতি আরেকটা রূপ গ্রহণ করত।
আমি কোনোভাবে তখন ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জড়িয়ে পড়ি। সেখানে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ডেমোক্রেট হিসেবে ছিলেন বর্তমান বিএনপির সাবেক এমপি আমার ক্লাসমেট মুসফেকুর রহমান। বর্তমান বিএনপির শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তখন ছিলেন ডেমোক্রেটিকের অন্যতম প্রধান নেতা। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাহেবও ডেমোক্রেটিকের নেতা ছিলেন। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে তিনি তখন সেকেন্ড ইয়ারে অথবা থার্ড ইয়ারে বিএ পড়তেন। আমাদের ব্যাচের সময়ে আমি এবং মুসফেকুর রহমান ডেমোক্রেট নেতা (আহ্বায়ক) হলাম। সে অর্থে আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও হয়ে গেলাম। দু’টি দলের একটিতে জয়েন্ট কনভেনর ছিলাম আমি এবং আমার সেই বন্ধু। মুসফিকুর রহমান পরবর্তীতে সেক্রেটারি হয়েছিলেন। আবার বর্তমান হাওয়া ভবনে বিগত অক্টোবর ২০০১ এর নির্বাচন পরিচালনার জন্য যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। এরাই সেই সময় নেতা হিসেবে উলেখযোগ্য ছিলেন। সেই সময় ছাত্রলীগ, ছাত্রশক্তির ছেলেরা কলেজ রাজনীতিতে একই দলের সদস্য হয়ে কাজ করতেন।
কলেজে থাকাবস্থায় সেই সময় আমি প্রথমবারের মতো ডেমোক্রেটিকের পক্ষ থেকে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ি। সাংবাদিকতাও ঠিক বলা যায় না। আমরা একটা বুলেটিন বের করতাম। আমি তার অন্যতম সম্পাদক ছিলাম। একটি সংখ্যায় সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে আমরা একটা ভুল করে ফেলি। মানুষের স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে তখনও আমি বুঝতে পারিনি। আমারও সে সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা ছিল না। অধিকাংশ লোকেরই শুরুতে তা থাকে না। আবার অনেকের সারা জীবনেও হয় না। আমরা সেই সম্পাদকীয়তে একটা কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলাম ‘নোয়াখালীর সব লোক যেমন খারাপ না…’। এ কথাটাকে টেনেই বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছিলাম, পয়েন্ট আউট করতে চেয়েছিলাম। এর মূল কথা ছিল কোনো স্থানের বা দলের সবাই খারাপ হয় না এবং কোনো এলাকাকে নির্দিষ্ট করে দায়ী করা ঠিক নয়। কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে বিষয়টি নিয়ে অপনেন্ট পাইওনিয়াররা তখন আমাদের ধরে বসল। আমরা বিপদেই পড়ে গেলাম। তারা আমাদের পেপার ছিড়ে ফেলল। আমাদের উপর হামলা করার চেষ্টা করা হলো। আমি আগে থেকেই খুব দুর্বল স্টাকচারের ছিলাম। আমার বন্ধুবান্ধবরা আমাকে সেই সময় চৎড়ঃবপঃ (প্রোটেক) করার চেষ্টা করে। সেই উত্তেজনা আট দশ দিন পর্যন্ত ছিল। যদিও ঘটনাটা দুর্ভাগ্যের এবং তা আমার জন্য শিক্ষণীয় ছিল। আমি বুঝলাম মানুষের স্পর্শকাতরতাকে বুঝতে হয়। সব সত্য কথাই বলা যায় না। সব সত্য কাজই সবখানে করা যায় না। সব কিছুরই একটা সময় আছে, সুযোগ ও পরিস্থিতি আছে, তা বুঝেই কাজ করতে হয়।
আমাদের সময় শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই খ্যাতনামা শিক্ষক ছিলেন। আমাদের অংক পড়াতেন মঞ্জুরুল হক স্যার। তিনি ছিলেন এই দেশের প্রথম দিকের ইন্টারমিডিয়েট লেবেলের অংক বইয়ের একজন লেখক। ইংরেজিতেই বই লেখা হতো। পরবর্তীতে তিনি আমাদের প্রিন্সিপালও হয়েছিলেন। খুবই লম্বা মানুষ ছিলেন। সুন্দর ছিলেন। খুবই ভদ্র ছিলেন। খুব সহনশীল ছিলেন। তিনি ভালো
মানুষগুলোর অন্যতম একজন ছিলেন। তার এক ছেলে পরবর্তীতে বড় সার্জন হন এবং আমাদের ফ্যামিলির বন্ধু হয়ে যান। ইবনে সিনা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হলে আমি তাকে সেখানে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেই। তখন থেকে তিনি ইবনে সিনার মেডিকেল প্রোগ্রামগুলোতে জড়িত হয়ে যান। পরবর্তী এই ডাক্তার জিয়াউল হক আমাদের পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ট হন। আমাদের অপারেশনও করেন।

মনসুর উদ্দিন সাহেব ছিলেন আমাদের শিক্ষক। বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন দিকপাল। তিনি নিজের ক্ষেত্র অর্থাৎ সাহিত্যের বিরাট ব্যক্তি ছিলেন। তবে ক্লাস পরিচালনায় ছেলেদের মন যোগাতে পারেননি। ক্লাসে তিনি হাসি ঠাট্টা করতেন। ছাত্রদের বাদড় বলে কিংবা অন্য ধরনের বিশেষণ দিতেন। মনে আঘাত পাওয়ার মতো টাইটেল দিতেন। পড়ানোর দুর্বলতার জন্যে তিনি ছেলেদের আকৃষ্ট করতে পারেননি। ফলে এই শিক্ষককে আমরা ছাত্ররা খুব ভালো করে বুঝতে পারতাম না। তখন তাকে পাগল টিচার হিসেবেই ভাবতাম। কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারলাম যে এটা ছিল তার একটি ব্যক্তিগত আচরণ। আমরা যখন ধীরে ধীরে আরো বড় হচ্ছি, প্রত্যেকেই যার যার লেবেলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছি তখন তার সম্পর্কে বুঝতে পারলাম। তিনি বাংলা সাহিত্যে বিরাট অবদান রেখেছেন। তার অর্জন ব্যাপক। তিনি গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিঠিয়ে থাকা লোকগীতি হারামনি ৩ খন্ডে সংগ্রহ করেছেন। এই ক্ষেত্রে তার জ্ঞান, চর্চা, অর্জন অত্যন্ত বড়। এই শিক্ষকের সাথে আমার ব্যক্তিগত ইতিহাস পরবর্তীতে আরো নানাভাবে জড়িয়ে পড়ে।
আমরা একই পাড়ায় থাকতাম। মনসুর উদ্দিন সাহেব আমাকে তার মেয়েদের পড়াতে বললেন। কিন্তু নানা কারণে আমি পড়াতে পারিনি। মাত্র পাঁচ সাত দিন পড়িয়েছিলাম। তার এক মেয়ে প্রফেসর হয়েছে। এক মেয়ের সাথে আমাদের কাস্টমসের এক অফিসারের বিয়ে হয়। তখন থেকে আমরা আরো ঘনিষ্ঠ হই। সবচেয়ে বড় কথা মনসুর উদ্দিন সাহেবের বাসা আমার বাসা থেকে আধা মাইল দূরে ছিল। আমি থাকতাম বিজয়নগরের কোণায় অর্থাৎ কাকরাইল থেকে বিজয়নগর যেতে ডান দিকে আর তিনি থাকতেন শান্তিনগরে। কাজেই জীবনের শেষের দিনগুলোতে তিনি আমার বাসায় প্রায়ই আসতেন। তিনি আমার খুব কাছের হয়ে যান। আমার ছেলেমেয়েকে আদর করতেন। তার জীবনের শেষের দিকে ইসলাম নিয়ে আমার সঙ্গে তার মতবিরোধ হতো। আমি তার পিছনে সিরিয়াসলি চেষ্টা করি তাকে ইসলামের দিকে আনতে। তিনি নাস্তিকও ছিলেন না, ইসলাম বিরোধীও ছিলেন না। কিন্তু জীবনকে তিনি হালকাভাবে নিতেন। অথবা বলা যায়, আমরা যারা ইসলামের সিরিয়াস কর্মী, সব কিছু বাদ দিয়ে যারা ইসলামের জন্য কমিটেড হই, তিনি ঠিক সেরকম হননি বা এটার ঠিক প্রয়োজন আছে বলে বুঝতেও পারেননি।
এর গুরুত্বও তিনি বুঝতে পারেননি। এর একটা কারণ হতে পারে, হয়তো তাদের ছাত্রজীবনে এর তেমন একটা গুরুত্ব উপলব্ধি ছিল না। তবে তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তার মনে ইসলামের প্রতি কোনো প্রকার অনীহা ছিল বলে আমার কখনো মনে হয়নি। তার মৃত্যুর পরে তার সম্বন্ধে ছোট্ট একটি লেখাও আমি লিখেছি। ওনার সাথে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ তাতে আছে। যা হোক এই শিক্ষকের সাথে আমি বিভিন্নভাবে পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়ি এবং আমরা ঘনিষ্ট হই।

(সর্বজনশ্রদ্ধেয় জনাব শাহ আব্দুল হান্নান সাহেবেরে আত্মজীবনীমূলক বই আমার কাল আমার চিন্তার প্রথম অংশের পর স্কুল জীবনের পরবর্তী অংশ আজ দিলাম: মো.তোফাজ্জল বিন আমীন)




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *