উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

মুসলিম নারী স্কলারদের বিস্মৃত ইতিহাস

মেসবাহ উদ্দিন: আপনি যদি কাউকে দীর্ঘদিন ধরে চোর হিসেবে অভিযুক্ত করতে থাকেন, তাহলে এক পর্যায়ে সে সত্যিই নিজেকে চোর ভাবতে থাকবে। একইভাবে, কোনো বাচ্চাকে যদি সবসময় স্টুপিড বলে ধমক দেন, তাহলে সেও নিজেকে স্টুপিড মনে করেই বড় হবে। মুসলিম নারীদের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে এ ধরনের হীনমন্যতাই শেকড় গেঁড়ে বসেছে। মিডিয়া ও একাডেমিক জগতে ইসলামকে এমন এক সেক্সিস্ট ও পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা হয় যেন নারীদের এই হীনমন্যতার উৎস ইসলাম। মনে করা হয়, নারীরা সহজাতভাবে ত্রুটিযুক্ত। ফলে পুরুষের অধীনস্ত হয়ে থাকাই উচিত। ইসলামের এহেন চিত্রায়নের পেছনে রক্ষণশীল ও প্রগতিবাদী – উভয় পক্ষই সমভাবে দায়ী।
মুসলিম নারীবাদীরা মনে করে, তারা একটি লিঙ্গবৈষম্যহীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি লাভ করেছে। পুরুষতান্ত্রিক পাণ্ডিত্যের আধিপত্য থেকে মুক্ত করে মসজিদের ইমাম ও রাষ্ট্রনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে নারীদের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। পাশাপাশি খোঁজ নিলে এটাও জানা যাবে, উপমহাদেশের অপরিচিত কোনো ইমাম নারী অধিকারকে পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা ক্ষতিকর ব্যাপার হিসেবে ঘোষণা করছে এবং শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে রেখে নারীদেরকে ঘরের কোনে বসিয়ে রাখাকেই সর্বোত্তম বলে দাবি করছে। এভাবেই প্রগতিশীল নারীবাদীদের সাথে নারীবিদ্বেষী মোল্লাদের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। উভয় পক্ষের কাজকর্মই তাদের আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে উদ্ভূত প্রতিক্রিয়া ছাড়া কিছুই নয়। গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক আমূল পরিবর্তন মুসলিম উম্মাহকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় আলেমগণ নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ব্যাপারকে উপেক্ষা করেছেন।
ইসলামের উপর আরোপিত নারীবিদ্বেষের নিন্দা ও সমর্থনের বাইরে গিয়ে শায়খ মোহাম্মদ আকরাম নদভীর এই গবেষণা খুবই সময়োপযোগী হয়েছে। এটি আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছে, ইসলামে জেন্ডার ইস্যু কোনো সমস্যা নয়। ইসলাম কর্তৃক নারীকে পুরুষের অধীনস্ত হিসেবে দেখাতে বরাবরই মিডিয়াগুলো উৎসাহী। এই অভিযোগ খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে শায়খ নদভী দীর্ঘ এক দশক ধরে গবেষণা পরিচালনা করেছেন। অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের বর্তমান রিসার্চ ফেলো শায়খ নদভী ইতিহাসের ভিন্ন বয়ান নিয়ে মুসলমানদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। এ ব্যাপারে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে তার একটা বাস্তবভিত্তিক ঐতিহাসিক দলীল অন্বেষণের প্রয়োজন ছিল।
ইসলামী জ্ঞানের জগতে পুরুষদের প্রতি পক্ষপাতমূলক রেফারেন্সের বহুল প্রচলন কোরআন-হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ আমাদেরকে দেখিয়ে দেয়, পুরুষ বিচারকদের দ্বারা ইস্যুকৃত ফতোয়া আদতে পুরুষদের প্রতিকূলে ও নারীদের অনুকূলে ছিল।
বলাবাহুল্য, অধিকাংশ প্রতিভাবান নারী আলেমদের পাণ্ডিত্যের বিবরণ তাদের পুরুষ ছাত্ররাই দিয়েছেন। ইমাম যাহাবী উল্লেখ করেছেন – নারীদের মধ্যে যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের কারো বর্ণনাই বানোয়াট সাব্যস্ত হয়নি। জ্ঞান-গবেষণায় নারীদের সততা ও স্বাধীনতা ছিল প্রশ্নাতীত ব্যাপার। স্বভাবতই, যে কোনো সেক্সিস্ট পুরুষের পক্ষে এই সত্যকে স্বীকার করে নেয়া কষ্টকর।
নারীরা বর্তমানে হাদীস শিক্ষা দেওয়া ও ফতোয়া প্রদানের কাজে খুব কম অংশগ্রহণ করায় ব্যাপকভাবে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ঐতিহাসিকভাবে তারা কখনোই এ ধরনের ভূমিকা পালন করেনি। শায়খ আকরাম নদভীর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে আমি ভেবেছিলাম বড়জোর ত্রিশ-চল্লিশ জন নারী আলেম হয়ত ছিলেন।’ কিন্তু গবেষণা যতই এগুতে থাকলো, নারী আলেমদের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকলো। কমপক্ষে ৮,০০০ নারী আলেমের খোঁজ পাওয়া গেলো। এই বিশাল সংখ্যাই সাক্ষ্য দেয়, মহানবীর (সা) যুগ থেকে শুরু করে দীর্ঘসময় পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে নারীদের ব্যাপক অবদান ছিল। শায়খ আকরাম ভেবেছিলেন, নারীদের অবস্থা পুরুষদের তুলনায় মাঝারি মানের হবে হয়তো। কিন্তু তিনি যখন এই অপ্রত্যাশিত সংখ্যক নারী আলেমদের সন্ধান পেলেন, তখন দেখা গেলো কোনো কোনো নারী আলেম পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি প্রজ্ঞাসম্পন্ন। এইসব ব্যতিক্রমী নারীগণ শুধু সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণই করেননি, সমাজ সংস্কারের কাজও করেছেন। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, জ্ঞানের দিক থেকে অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়ায় সমাজে তাঁরা খুবই সম্মানিত ছিলেন।
হজরত আবু বকরের (রা) কন্যা আয়েশার (রা) মতো যারা অতি পরিচিত ছাড়াও অন্যান্য বিস্মৃত নারী স্কলারদের মহিমা তাঁদের কর্মের মাধ্যমে পুনরায় প্রজ্বলিত হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর আলেম ফাতিমা আল বাতায়াহিয়্যাহ দামেস্কে সহীহ বুখারীর দরস দিতেন। তৎকালীন সময়ে তিনি সবচেয়ে বড় মাপের স্কলারদের একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিশেষত হজের মওসুমে নেতৃস্থানীয় পুরুষ আলেমগণ তাঁর কথা শুনতে দলে দলে আসতেন। একজন প্রতিথযশা বৃদ্ধা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বয়ং মসজিদে নববীতে তাঁর ছাত্রদেরকে পড়াচ্ছেন – ইসলামী জ্ঞানের জগতের এই চমৎকার দৃশ্যটা দীর্ঘদিন আগেই বিস্মৃত হয়ে গেছে। ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি মহানবীর (সা) মাজারে মাথাটা হেলান দিয়ে রাখতেন। এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ছাত্রদের ক্লাস নিতেন। অথচ এখন কোনো নারী মসজিদে নববীতে গেলে খুব হতাশার সাথে জানতে পারবে, মহানবীর (সা) কবর দেখার অনুমতিই তার নেই; কবরের দেয়ালে মাথা রেখে বিশ্রাম নেয়া তো দূরের কথা!
দ্বাদশ শতকে আরেকজন স্কলার ছিলেন জয়নব বিনতে কামাল। তিনি চার শতাধিক হাদীসের কিতাব পড়াতেন। তাঁর গ্রন্থ বোঝাই উট দেখে ছাত্ররা দলে দলে তাঁর নিকট পড়তে আসতো। তিনি ছিলেন স্বভাবগত শিক্ষক। অসীম ধৈর্যের কারণে তিনি যাদেরকেই পড়াতেন তাদেরই হৃদয় জয় করে নিতেন। উঁচুমানের জ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি থাকায় দামেস্কের মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাঁর নারী পরিচয় কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
এরপর ফাতিমা বিনতে মোহাম্মদ আল সমরকন্দীর কথা বলা যায়। তিনি ছিলেন একজন ফিকাহবিদ। কীভাবে ফতোয়া ইস্যু করতে হয়, সে বিষয়ে তিনি তাঁর অধিকতর বিখ্যাত স্বামীকে পরামর্শ দিতেন।
উম্মে দারদা নামে এক তরুণী স্কলার ছিলেন। তিনি সাধারণত মসজিদে পুরুষ আলেমদের পাশেই বসতেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি সর্বোতভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে চেষ্টা করি। তবে অন্যান্য আলেমদের সাথে বসে কোনো বিষয়ে আলোচনা করার চেয়ে ভালো কোনো নফল ইবাদত আছে বলে আমার জানা নেই।’ তিনি হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষক ছিলেন। পুরুষদের সেকশনেই তিনি লেকচার দিতেন। তাঁর ছাত্রদের একজন ছিলেন দামেস্কের তৎকালীন খলিফা।
ইসলামের জন্য এই মহিয়সী নারীদের কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ এখনকার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অনেক বেশি ছিল। অবশ্য পুরুষদের বিপরীতে তাঁরা কিছু স্বাস্থ্যগত সুবিধাও পেয়েছিলেন। দীর্ঘজীবন লাভ করার কারণে হাদীস শেখার জন্য ছাত্ররা নারী মুহাদ্দিসগণকেই বেশি খুঁজতেন। কারণ, তাঁদেরকে পাওয়া মানে হলো হাদীস বর্ণনাকারীদের পরম্পরা ছোট হয়ে আসা। শায়খ আকরাম নদভী হাদীস বিশারদদের উপর গুরুত্ব দেয়া সত্বেও ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, ক্যালিগ্রাফিসহ কলাবিদ্যার বিভিন্ন শাখায় শিক্ষাদানে নারীদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান খুঁজে পেয়েছেন।
ইসলামের ইতিহাসে নারীদের গুরুত্ব শুধু শিক্ষকতা পেশায় নারীদের উপস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পশুর চামড়া ও হাড়ের ওপর লিখিত কোরআনের প্রথম পাণ্ডুলিপি হজরত ওমরের (রা) কন্যা হাফসার (রা) নিকট আমানত হিসেবে সংরক্ষিত ছিল। ইসলামী খেলাফতের অধীন বিভিন্ন প্রদেশে কোরআনের ছয়টি অপ্রামান্য সংকলন প্রচলিত ছিল। হজরত হাফসার (রা) নিকট কোরআনের প্রামান্য পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত থাকায় খলিফা উসমানের (রা) পক্ষে অপ্রামান্য সংস্করণগুলো ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে হাফসার (রা) যোগ্যতা ও নৈতিক চরিত্র কী পরিমাণ নির্ভরযোগ্য ছিল তা অনুমান করা যায়। সাহাবীগণ এবং পরবর্তী কোনো স্বনামধন্য স্কলারই নারী পরিচয়ের কারণে কারো শিক্ষকতা করার অধিকারকে অস্বীকার করেননি।
নারী-পুরুষের মৌলিক সমতার বিষয়ে ইসলামের শিক্ষাকে বিবেচনা করলে শায়খ নদভীর এই গবেষণায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। মহানবীর (সা) শিক্ষা অনুযায়ী জেন্ডারের কারণে বিশ্বাসীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কোরআন-হাদীসের মর্মবাণী আয়ত্ত করা, প্রচার করা, ব্যাখ্যা করা এবং সে অনুযায়ী মুসলমানদেরকে ফতোয়া তথা বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদানের মাধ্যমে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েরই সমানাধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে। সৎ কাজে উৎসাহ প্রদান ও মন্দ কাজে নিরুৎসাহিত করার ক্ষেত্রে পুরুষের মতো নারীরও সমান দায়িত্ব রয়েছে।
আলেম না হলে ইসলামের শিক্ষা গভীরভাবে অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ফলে মুসলিম হিসেবে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করাও সম্ভব হবে না। এটা খুবই যৌক্তিক কথা। নারীকে দমন করে রাখা ইসলামী শিক্ষা নয়। তা সত্বেও মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে ভীষণভাবে নারী অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। কেন এমনটা ঘটছে? এই আধুনিক যুগে এসেও কোথাও কোথাও মুসলিম নারীকে সব জায়গা থেকে অপসারিত করে শুধু একজন মা ও গৃহবধূর ভূমিকায় আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ আয়েশা (রা) কি একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেননি? হুদায়বিয়ার সংকট মোকাবেলায় উম্মে সালমা (রা) ভূমিকা পালন করেননি? বহুমাত্রিক এই জটিল সমস্যার কার্যকর সমাধান নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে – এটা সত্য। তবে এই বিতর্ক নিরসনের জন্য কিছু ফলপ্রসু সমাধান আমরা খুঁজে পেতে পারি।
আভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে মুসলিম বিশ্বের পতন ঘটায় আধুনিক দুনিয়ায় পাশ্চাত্য সভ্যতার কর্তৃত্ব অনিবার্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইহুদী-খ্রিস্টান ঐতিহ্যে নারীদের অবস্থান ছিল সবসময়ই অবদমিত। এর সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বেহেশতের বাগান থেকে আদম-ইভের পতিত হওয়ার ঘটনা। মানবজাতির আদি পাপের জন্য প্রত্যক্ষভাবে ইভকে দায়ী করা হয়। এই গল্পে তিনি অবলা নারী জাতির প্রতীক। খ্রিস্টান ধর্মমতে, নারীদের প্রসব বেদনাকে আদি পাপের প্রায়শ্চিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ধর্মীয় কাহিনীগুলো বাইরেও আমরা দেখি, পাশ্চাত্য ইউরোপে নারী-পুরুষের সমতা অনেক পরে এসেছে। নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হবে কিনা, তা নিয়ে ষোল শতকেও বিতর্ক হয়েছে। মাত্র ঊনিশ-বিশ শতকের দিকে এসে নারীকে পুরুষের সমান আইনগত অধিকার দেয়া হয়েছে। বিশিষ্ট লেখিকা ও কোরআনের অনুবাদক আয়েশা বিউলে বর্ণনা করেছেন, পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক প্রভুদের মাধ্যমেই নারীবিদ্বেষের আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে। তারা নারীকে মসজিদে পড়াশোনা করা থেকে বঞ্চিত করেছে এবং মুসলিম সমাজে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিয়ে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। ‘পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে মুসলিম নারীরা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ধারণাকে পুরো মুসলিম জাতির উপর আরোপ করার পর ধীরে ধীরে সেটাকেই প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে।’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের প্রলুব্ধ করে। যার ফলে এইসব আগ্রাসী সংস্কৃতির দ্বারা লালিত মূল্যবোধকে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা ক্রমান্বয়ে গ্রহণ করে নেয়।
এর নিহিতার্থ হলো, পাশ্চাত্যই হচ্ছে সবার জন্য উপযুক্ত সমাধান। কিন্তু এটা বুঝতে পারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, মুসলিম নারীর পরিণতি মুসলিম কমিউনিটির সামগ্রিক পরিণতি থেকে আলাদা কোনো বিষয় নয়। এক ধরনের ভীতির কারণে জনপরিমণ্ডল থেকে নারীকে গুটিয়ে রাখা হয়। আকরাম নদভী বলেছেন, ‘ইসলামের বর্তমান সাংস্কৃতিক অধঃপতন মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তি ও মুসলিম নারী উভয়ের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছি। লোকজন যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন শংকাবোধ তাদেরকে পেয়ে বসে। যখনই তারা শংকিত হয়ে ওঠে, তখনই তারা তাদের নারীদের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে।’ পুরুষরা নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে তাদের আরো ক্ষতি করে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে এটা মুসলমানদের সামাজিক সক্ষমতাকে আরো দুর্বল করে দিয়েছে। নারীমুক্তির লক্ষ্যে কিছু নারী, উগ্র নারীবাদের প্রচার শুরু করে। যার ফলে সমাজে সন্দেহ, ভয় ও নিপীড়নের একটা দুষ্টচক্রের উদ্ভব ঘটেছে।
সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আট হাজার মুসলিম নারী স্কলারের ইতিহাস খুঁজে বের করার এই গবেষণার বিষয়ে নানা রকমের প্রতিক্রিয়া আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। নারীবিদ্বেষীরা এই ইতিহাসকে অস্বীকার করতে চাইবে এবং এর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করবে। অন্যদিকে নারীবাদীরা হয়তো খুশি হবে এই ভেবে, কেউ একজন তাদের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তবু ভালো যে, এ ধরনের গবেষণার পেছনে অনুপ্রেরণা পাওয়া যাবে। ইসলাম যে নারীবিদ্বেষী নয় কিংবা প্রাথমিক যুগের পুরুষ আলেমগণও যে নারীর প্রতি বিরূপ মনোভাবসম্পন্ন ছিলেন না – এটা দেখানোর উদ্দেশ্যে আকরাম নদভী লোকজনকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসের দিকে ফেরাতে চেয়েছেন।
এই গবেষণা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও শালীনতার সীমাতিক্রমকে উৎসাহিত করবে বলে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বইয়ের ভূমিকা থেকেই এটা পরিষ্কার, নারীদের হিজাব আল্লাহর রাসূলেরই (সা) সুন্নাহ। যা নারীদেরকে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে জনপরিমণ্ডলে হাজির ও দৃশ্যমান হতে সহায়তা করেছে। শায়খ আকরাম নদভী ভারতের লখনৌয়ে অবস্থিত ‘নদওয়াতুল উলামা’র মতো মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করা বিশিষ্ট আলেম। প্রথাগত পদ্ধতিতে ইসলামকে অধ্যয়ন করাটা তাঁর এই কাজের জন্য সহায়ক হয়েছে। শায়খ ইউসুফ আল কারযাভীসহ আলেমরা তাঁর গবেষণাকে যথেষ্ট ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
ঐতিহাসিক সত্যতা অনুসন্ধানের জন্য যারা নিজেদের গোটা জীবন ব্যয় করেছেন, তাঁরাই মুসলমানদের নিকট দীর্ঘদিন ধরে বিস্মৃত হয়ে আছেন! এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ইতিহাসকে খতিয়ে দেখা ইসলামের একটা অন্যতম মূলনীতি। কোরআন নির্দেশ দিয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি খবর নিয়ে আসে, তাহলে তোমার তা যাচাই করে দেখো, (এমন না হয়) যেন তোমরা অজ্ঞতাবশত লোকদের ক্ষতি করে ফেলো…।’ (সূরা হুজুরাত: ৬) ইসলামের বিরুদ্ধে মিডিয়ার চরম পক্ষপাতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে খুব ভালো কিছু আশা করা যায় না। অথচ মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হলো সত্যের সন্ধান করা।
ঐতিহাসিকভাবে সঠিক তথ্য-উপাত্তকে স্বীকার করে নিলে আমাদেরকে এটাও মানতে হবে, ইসলাম নারীকে দমিয়ে রাখে না, বরং ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অবশ্যই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। নারী অধিকার, মানবাধিকার কিংবা প্রাণী অধিকারের কিছু বর্ণনা সংবলিত একগুচ্ছ আইন আকারে ইসলাম আবির্ভূত হয়নি। আমরা যখন আন্তরিকভাবে আল্লাহর হক আদায় করতে রাজি থাকি তখনই ইসলামের দিক থেকে এসব অধিকার ও দায়িত্ব আমাদের উপর ফরজ হয়। নিরস বুদ্ধিবাদের পরিবর্তে ঈমানী চেতনা আমাদেরকে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে বলে, যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যে কেউ নিজেদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হতে পারে।
শতাব্দীকাল ধরে নারীবিদ্বেষের অভিযোগ বহন করতে করতে এক পর্যায়ে তা বাস্তবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ইসলামের ত্রুটি রয়েছে বলে মুসলমানরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। পৃথিবীর কোথাও কোথাও নারীরা ঘরে আবদ্ধ, আবার অন্য কোথাও নারীরা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শায়খ নদভীর এই গবেষণার ফলে হয়ত ইসলামের ন্যায়বিচারের ধারণার ব্যাপারে আমাদের মাঝে কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। ইসলামের ইতিহাসে অনেক নারী স্কলার ছিল – এমনটা ভাবার চেয়ে অনেক বড় স্কলার হিসেবে যাদেরকে আমরা জানি, তাদের অনেকেই নারী ছিলেন।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *