তীব্র বিরোধিতার মুখে বিল পাস, বিএনপির ওয়াকআউট ৬১টি সংস্থার তহবিলের উদ্বৃত্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা নেওয়ার জন্য বিল পাস করাতে গিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের তীব্র বিরোধিতা ও সমালোচনার মুখে পড়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির একাধিক সাংসদ এই আইনকে ‘কালো আইন’ আখ্যা দিয়ে এটি প্রত্যাহারের দাবি জানান। তাঁরা বলেন, শেয়ারবাজার, ব্যাংক খাত ধ্বংস হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী এখন বিভিন্ন স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দিয়েছেন। অবশ্য আজ বুধবার শেষ পর্যন্ত কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়েছে। বিল পাসের বিরোধিতা করে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে বিএনপি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সদস্যরা নিজেদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাবগুলো প্রত্যাহার করে নেন। সাম্প্রতিক সময়ে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনকারী সদস্যদের সবাইকে নিজেদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে দেখা যায়নি। আজ ‘স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান বিল-২০২০’ সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিরোধী সাংসদেরা বিলের আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থমন্ত্রীরও সমালোচনা করেন। তাঁকে ‘ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী’ বলে আখ্যা দেন। জবাবে অর্থমন্ত্রী দাবি করেন, তিনি বিশ্বের এক নম্বর অর্থমন্ত্রী। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। বিলের ওপর আলোচনায় বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, এভাবে টাকা নিলে ব্যাংকে টাকা থাকবে না। শেয়ারবাজার, ব্যাংক খাতে লুট হয়েছে। এখন চোখ গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সাধারণ অবস্থা থেকে ব্যবসায়ী হয়েছেন। তিনি অর্থনীতি বোঝেন না, এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। রুমিন বলেন, সমস্যা হলো অর্থমন্ত্রীর সদিচ্ছার অভাব। তিনি এত মেধাবী, কিন্তু শেয়ারবাজার, খেলাপি ঋণ নিয়ে কিছু করেননি। অর্থমন্ত্রী শুধু ধনী সমাজের মন্ত্রী নন। খেটে খাওয়া মানুষের দিকে তাঁর নজর নেই। জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ সাংসদ ফখরুল ইমাম বলেন, ব্যাংকে মানুষের যে টাকা, সেটাও সরকারের অর্থ। কয়েক দিন পর হয়তো সেটাও নিয়ে নেওয়া হবে। তিনি চিন্তা করছেন, তাঁর ব্যাংকের টাকা বাসায় নিয়ে যাবেন কি না। ফখরুল ইমাম বলেন, অর্থমন্ত্রী শিক্ষিত মানুষ। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তিনি সরকারি দলের উদ্দেশে বলেন, ‘নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতা দেখাবেন না। পৃথিবীর অনেক ধ্বংস হয়ে গেছে।’ বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, এটা একটা কালো আইন। আইন করে সমস্ত টাকা তুলে নেওয়া হবে। এতে ব্যাংকগুলো মারাত্মক বিশৃঙ্খলায় পড়বে। প্রতিষ্ঠানগুলোরও স্পৃহা ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বিলটি প্রত্যাহারের দাবি জানান। জাপার কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিলটি পাস হলে অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে যাবে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নাজুক। জনগণের স্বার্থে উন্নয়ন করতে চাইলে ভ্যাটে অটোমেশন করা হলো না কেন। রাজস্ব বোর্ড অটোমেশন করতে দিচ্ছে না। তারা কর নিচ্ছে না, ঘুষ নিচ্ছে। কাজী ফিরোজ বলেন, টাকার মালিক জনগণ। পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার, টাকা পাচার বন্ধ করা এবং ব্যাংকিং খাতের দিকে নজর দেওয়ার জন্য তিনি অর্থমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন। বিল পাসের বিরোধিতা করে বিরোধী দলের এই সাংসদ বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই বিল পাস করলে তা ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে না। বিলটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেন, অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ী হলে যা হয়, তা-ই হয়েছে। বাজেট করার সময় চিন্তা করেননি, রাজস্ব ঘাটতি সম্পর্কে চিন্তা করেনি যে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি। আগের বছরের চেয়ে ৪৫ ভাগ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন। কিন্তু হয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। জাপার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এই আইনকে ‘জনবিরোধী, ডিসগাস্টিং আইন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি পাস হলে সংসদের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটবে। তিনি বলেন, শিপিং করপোরেশনের টাকা নিতে হলে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমতি নিতে হবে। এটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরা পর্যন্ত আইনটি পাস না করার দাবি জানিয়ে শামীম হায়দার বলেন, স্বাধীন দেশে এ ধরনের আইন হতে পারে না। এটি এতই ন্যক্কারজনক আইন যে সংশোধনযোগ্য নয়। জাপার এই সাংসদ বলেন, ‘একটা আইন অর্থনীতিতে কি লোটাস বা পদ্মফুল এনে দেবে? একটা আইন সিস্টেমকে কলাপস করে দেবে।’ আমিও অনেক কিছু বলতে পারি বিরোধী দলের সাংসদদের দুই দফা বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, ‘পৃথিবীতে কোথায় কী হচ্ছে জানা দরকার। বাংলাদেশ অন্য দেশের কাছে দৃষ্টান্ত। আপনারা বলছেন, ব্যাংক, শেয়ারবাজার সব খালি করে ফেলেছি। আপনাদের সময় পুঁজিবাজার কী ছিল? আপনাদের সময় ইনডেক্স কী ছিল? এবার সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। অর্থনীতিতে ওঠানামা থাকে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের টাকায় হয়েছে। লাভের সময় ইচ্ছেমতো বোনাস নেবে, বিদেশে ঘুরবে, তা হয় না। মুজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্যের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সাইফুর রহমান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। আমিও তা–ই। আমি সারা বিশ্বের এক নম্বর অর্থমন্ত্রী। পারসোনাল লেবেলে কথা বলবেন, এটা ঠিক নয়। আমিও অনেক কিছু বলতে পারি। সবারই বিষয়েই আমি জানি।’ অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, একমাত্র রপ্তানি–বাণিজ্য নেতিবাচক। এটা ছাড়া একটি খাতেও দেশ পিছিয়ে নেই। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জেপি মর্গান সবাই মনে করে জিডিপি আট ভাগের কম হবে না। অর্থমন্ত্রী বলেন, ভ্যাট আইন নিয়ে তিনি আশাবাদী ছিলেন। তবে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিছুসংখ্যক ভ্যাট মেশিন আনা হয়েছে। রাজস্ব আহরণ শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক থাকবে না। মুস্তফা কামাল বলেন, পিছিয়ে থাকা মানুষকে মূল স্রোতে নিয়ে আসাই উদ্দেশ্য। এ ধরনের আইন দেশে নতুন নয়। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন দশম সংসদে পাস হয়েছে। সেখানে এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। একাদশ সংসদে উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ আইনে একই ধরনের কথা বলা হয়েছে। সরকারে
Previous Postচীনের বাধা, রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ নিরাপত্তা পরিষদ
Next Postরাষ্ট্রপতির কাছে আলজেরিয়ার দূতের পরিচয়পত্র পেশ
Related articles
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।
HimalaySep 20, 2023