শাহ্ আব্দুল হান্নান: আল-কুরআনের ১০-১৫টি আয়াতে আত্মীয়স্বজনদের, এতিমদের ও অসুবিধাগ্রস্তদের সাহায্য করার কথা বলা হয়েছে। এখানে আল-কুরআনের সূরা নাহলের একটি আয়াতের উল্লেখ করব। এটি হচ্ছে সূরা নাহলের ৯০ আয়াত। ‘আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন তোমরা ইনসাফ করবে, ভালো ব্যবহার করবে এবং আত্মীয়স্বজনদের/নিকটাত্মীয়দের সাহায্য করবে এবং আল্লাহ নিষেধ করছেন অশ্লীলতা, অন্যায় এবং বাড়াবাড়ি থেকে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের নসিহত করছেন যেন তোমরা স্মরণ রাখতে পারো।’
এই আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা যে প্রধান তিনটি আদেশ দিচ্ছেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মীয়স্বজন/নিকটবর্তীদের দেখভাল করা। আত্মীয়দের সাহায্য করা দেখভাল করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি। আমরা সবাই জানি, ইসলামী অর্থনীতি একটি কল্যাণরাষ্ট্রের কথা বলেছে। কল্যাণরাষ্ট্র হচ্ছে সেই রাষ্ট্র যেখানে আর্থিক ক্ষেত্রে বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে বা শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যবস্থা যারা করতে পারে না, তাদের দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মাল রেখে গেলে সে মাল তার উত্তরাধিকাররা পাবে। আর দায়িত্ব রেখে গেলে (অসহায় সন্তান) তার দেখভাল করার দায়িত্ব আমার ওপর। অর্থাৎ বায়তুল মালের (রাষ্ট্রের কোষাগারের) ওপর।’ কিন্তু ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের কিছু দিক আছে যা অন্যান্য কল্যাণরাষ্ট্র থেকে ভিন্ন। ইসলামী অর্থনীতির ব্যবস্থা হচ্ছে যে, অসহায় লোকদের দায়িত্ব প্রথমত তার আত্মীয়স্বজন নেবে। তারাই অসহায়দের সব ব্যবস্থা করবে। তাদের থাকা-খাওয়াদাওয়ার শিক্ষার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। যদি এ রকম আত্মীয়স্বজন না থাকেন, তবেই রাষ্ট্র বা বায়তুলমাল এসব অসহায় মানুষের ব্যবস্থা করবে। ইসলামের এ ব্যবস্থার সৌন্দর্য হচ্ছে, বেশির ভাগ লোকের ব্যবস্থা ‘ইতায়ি জিল কুরবা’ (নিকটবর্তীদের সাহায্য)-এর আওতায় হয়ে যাবে।
‘কুরআনের বিভিন্ন আয়াতেও আত্মীয়স্বজনের কথা বলা হয়েছে। যেমন : সূরা আন নিসার আট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘(ওয়ারিশি অর্থ-সম্পদ) বণ্টনকালে (ওয়ারিশ নয় এমন) আত্মীয় এবং এতিম ও অভাবী লোক উপস্থিত থাকলে তা থেকে তাদের কিছু দেবে এবং তাদের সাথে উত্তমভাবে কথা বলবে।’ সূরা বনি ইসরাইলের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আত্মীয়স্বজনকে তাদের হক দেবে এবং মিসকিন আর পথিকদেরকেও। কিছুতেই অপব্যয় করবে না।’ সূরা আন নূরের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ধন ও মালে প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন কসম খেয়ে না বলে যে, তারা আত্মীয়স্বজন, মিসকিন (অভাবী) এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের কিছুই দেবে না। তারা যেন তাদের ক্ষমা করে দেয় এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিন? আর আল্লাহ তো পরম ক্ষমাশীল, দয়াবান।’
যাদের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আত্মীয়স্বজন নেই বা আত্মীয়স্বজন সক্ষম নন, কেবল সেসব ক্ষেত্রে দায়িত্ব হবে রাষ্ট্রের। এর ফলে রাষ্ট্রের বায়তুলমাল বা কোষাগারের ওপর চাপ কম পড়বে। এটা একটা বাস্তব প্রোগ্রাম। এ ব্যবস্থা কুরআনে ও সুন্নাহ্তে রয়েছে। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনরা যাতে দায়িত্ব পালন করেন, তার জন্য আইন করা যেতে পারে।
পাশ্চাত্যের কল্যাণরাষ্ট্রে (সুইডেন, নরওয়ে) সমস্যা হচ্ছে এসব অসহায়ের দায়িত্ব সরাসরি রাষ্ট্রের ওপর পড়ে। তার ফলে রাষ্ট্রের এই খাতে ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পায় এবং তাদের অনেক বেশি কর ধার্য করতে হয়। এটা অর্থনীতির উন্নয়নকে সীমিত করে রাখে। এই কারণে এখন পাশ্চাত্যের কল্যাণরাষ্ট্রগুলো তাদের সহায়তা প্রোগ্রাম কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে।
কিন্তু ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রে এই সমস্যা নেই। যেমন আমরা দেখেছি, বেশির ভাগ অসহায় লোকের দায়িত্ব আত্মীয়স্বজন গ্রহণ করবেন, যাদের দায়িত্ব আত্মীয়স্বজন বহন করতে পারবেন না কেবল তাদের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। এ জন্য ইসলামী রাষ্ট্রে অনেক বেশি কর ধার্য করার প্রয়োজন পড়ে না এবং উন্নয়নও প্রভাবিত হয় না। এ দিক দিয়ে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র পাশ্চাত্যের কল্যাণরাষ্ট্র থেকে উন্নত এবং এটা সম্ভব হয়েছে এ জন্য যে, ইসলামই এই বিধান দিয়েছে যে, নিকটাত্মীয়দের দেখাশোনা করা বাধ্যতামূলক।
আশা করি, এই প্রবন্ধ আমাদের দেশের জনগণকে আত্মীয়স্বজনদের দেখভালের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সাহায্য করবে। এটা ফরজ বিধান। যেমন আমরা দেখেছি, আল্লাহ তায়ালা সূরা নাহলে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, ‘আত্মীয়স্বজনদের সাহায্য করতে হবে।’ আর আল্লাহর আদেশ পালন করা ফরজ।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার