অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বেশি পিছিয়ে থাকা ঐতিহাসিকভাবে পুরোনো। বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি হলো সব পরিস্থিতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনের সব স্তরে নিরবচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জনপ্রশাসনের বহু ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক এবং পরাধীন আমলের ধারাবাহিকতা বয়ে চলেছে বাংলাদেশে, যার ক্ষতিকর প্রভাব সুবিদিত। প্রায় এক যুগ লুপ্ত থাকার পরে সংবিধানের স্থানীয় শাসন পরিচ্ছেদটি ১৯৯১ সালে ফিরে আসে। এরপর থেকে আমরা আশা করেছি, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং তাকে পরিণত করতে হবে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু এখন আমরা প্রায় তিন দশক পরেও নতুন করে জানছি যে অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চেয়ে সব থেকে পিছিয়ে আছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রায় এক লাখ অডিট আপত্তি নিয়ে ধুঁকছে এই মন্ত্রণালয়। এবং এসব আপত্তি নিষ্পত্তির যে হার, তা বিশ্লেষণ করে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এভাবে চললে এর সুরাহায় শতাব্দী পেরিয়ে যাবে।
সব থেকে বড় পরিহাস হলো সরকারগুলোর আচরণ মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা একমত যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই বড় বাধা। তাঁরা অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করতে অনিচ্ছুক। কারণ, তাঁরা হয়তো মনে করেন, টাকাপয়সা বা নিয়মরীতির এদিক–সেদিক হলেই বা কী? তাঁরা তো জনসেবক। তাঁরা নিজেদের জীবন জনস্বার্থে উৎসর্গ করেছেন। সুতরাং অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে তাঁদের উতলা হওয়ার কিছু নেই। এটি আসলে নির্দেশ করছে যে জনপ্রতিনিধিরা ভোটের রাজনীতি বিষয়ে অব্যাহতভাবে উৎসাহী। কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নীতি অনুসরণে অনিচ্ছুক। তাঁদের এই মনোভাব আমলাতন্ত্রের পক্ষে পাল্টানো কঠিন। এটা বদলাতে হলে পদ্ধতিগত রাজনৈতিক চাপ দরকার হবে। আর সেটা নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদ ভূমিকা রাখতে পারে।
সংসদীয় ব্যবস্থার দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো সরকারি হিসাব কমিটি এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক (সিঅ্যান্ডএজি)। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির অস্তিত্ব ও কার্যকরতা হাউস অব কমন্সের মতোই প্রাচীন। বাহাত্তরে বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নকালে এই কমিটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সংবিধানে ঠাঁই দিতে কোনো ভুল ছিল না। কিন্তু রাজনীতিকদের, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের অনেকেরই ভুল হলো, এই কমিটিকে কম গুরুত্ব বা একেবারেই কোনো গুরুত্ব না দেওয়া। বিরোধী দলের প্রভাবশালী নেতাকে এই কমিটির সভাপতি করার কথা তাঁরা আর ভুলেও মুখে আনছেন না। বরং এমন নেতাকে সভাপতি করা হচ্ছে, যাঁর গ্রহণযোগ্যতা অধিকতর দুর্বল। আবার সিঅ্যান্ডএজি দপ্তরের ভঙ্গুর স্বায়ত্তশাসন ও সংস্থাটির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সমাজে কোনো অর্থবহ আলোচনা অনুপস্থিত।
আমরা বেদনার সঙ্গে লক্ষ করি, প্রশাসনে জবাবদিহি ও দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশ সংসদীয় ব্যবস্থার ওপর কম জোর দিচ্ছে। তারা এমন একটি সংস্কৃতি ও পরিবেশ গড়ে তুলেছে, যেখানে সংসদীয় টুলস গুরুত্ব পায় না। নিজেরাই যে ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাকেই তারা নাকচ করে চলছে। অভ্যাসগতভাবে তাদের কাছে যেন বেশি গুরুত্ব পায় থানা-পুলিশ বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সংস্থা। যারা শুধু অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ করতেই অভ্যস্ত। অথচ দুর্নীতি ও সরকারি অর্থের অপচয় বা অপব্যবহার রোধে দরকার শক্তিশালী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ।
সরকার ২০১২-১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছিল। এর আওতায় নিউজিল্যান্ডের সাবেক অর্থমন্ত্রী ম্যাক্স ব্যাডফোর্ডের নেতৃত্বাধীন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল দুটি মুখ্য সুপারিশ রেখেছিল। প্রথমত সিঅ্যান্ডএজি রিপোর্ট নামকাওয়াস্তে সংসদে পেশ হয়। কিন্তু আইন না থাকায় তা সংসদে আলোচনা হয় না। দ্বিতীয়ত, সরকারি হিসাব কমিটির সুপারিশ কতটা বাস্তবায়িত হয়, তার তদারকির জন্য একটি কমিটি করা। আমরা মনে করি, উল্লিখিত চিত্র বদলাতে চাইলে এই সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি।