সুলেইমানির মৃত্যুর পর থেকেই তার মৃত্যুর উপজাত হিশেবে শিয়া সুন্নি ঐক্যের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে। ধর্মীয় ঐক্য সম্ভব কি অসম্ভব, সম্ভব হলে কোন মাত্রায়, সেটা স্কলাররা বলবে। আমি এখানে রাজনৈতিক ঐক্যের বিষয়ে কিছু কথা বলছি।
একাধিক দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের একটা উপায় হল জিটুজি, অর্থাৎ গভার্নমেন্ট টু গভার্নমেন্ট রিলেশন। আরেকটা হচ্ছে জিটুপি, অর্থাৎ গভর্নমেন্ট টু পিপল। যেমন একাধিক দেশের মাঝে যেসব সামরিক চুক্তি হয় ওগুলো হচ্ছে জিটুজি। আবার বিভিন্ন দেশের সরকার অন্য দেশের কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সহায়তা নিয়ে যায়, জনগনের মাঝে বিলি করে সেটা হচ্ছে জিটুপি।
………
ইরানের সাথে অন্য সুন্নি দেশগুলোর জিটুজি সম্পর্ক সম্ভব, এবং সেটা প্রয়োজনীয়ও বটে। যেমনটা তুরস্ক, কাতারের সাথে দেখি। হামাসের সাথেও রয়েছে। এসব দেশগুলো পুরোমাত্রায় সুন্নি হওয়া সত্ত্বেও ইরানের সাথে এদের সম্পর্ক সুন্নি সৌদির চেয়েও ভাল। এবং এই সম্পর্ক এখনো পর্যন্ত তুরস্ক-কাতারের অভ্যন্তরে কোন সংঘাত তৈরি করেনি।
এখানে একটি মজার তথ্য শেয়ার করা যেতে পারে। কাতারের উপর ছয় রাষ্ট্রের অবরোধের বাহ্যিক কারণগুলোর অন্যতম একটি হল ইরানের সাথে কাতারের দহরম মহরম। আপাতত অফিসিয়ালি তারা এমনটিই বলেছে।
এই ছয় রাষ্ট্রের মধ্যে আরব আমিরাতও রয়েছে। অথচ কাতার ইরানের নন অয়েল প্রোডাক্টের ১৯ তম বাণিজ্যিক পার্টনার, আর আরব আমিরাত হচ্ছে ৩য়! ভাবা যায়? তৃতীয় বৃহত্তম সহযোগী, উনিশতম সহযোগীকে বয়কট করছে ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে। এ যেন ভূতের মুখে রাম নাম।
এখানে এই তিন দেশের পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যেত, কিন্তু সেটা খুব একটা প্রাসঙ্গিক না। এই তথ্যটা এজন্য দিলাম, যারা মধ্যপ্রাচ্যের সব সমস্যার শিয়া সুন্নি সহজ সমাধান দিয়ে ফেলেন, আদতে বিষয়টা অত সোজা না।
………..
এখন কথা হল জিটুপি রিলেশন সম্ভব কিনা? সম্ভব, কিন্তু সেটা হবে রক্তক্ষয়ী। রিসেন্ট উদাহরণ-পাকিস্তান। দুবছর আগেও প্রতি জুমাবারেই সংবাদ আসত কোন না কোন মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলার, যেগুলোতে দুশো-আড়াইশ করে নিহত হত। এসব হামলার প্রায় শতভাগ ছিল শিয়া মসজিদে সুন্নি বম্বিং আর সুন্নি মসজিদে শিয়া আক্রমণ।
এসব বড়মাপের আত্মঘাতী হামলা ছাড়াও প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষের প্রাণহানি হত শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের গুলাগুলি আর খুনাখুনিতে।
তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে, তৃণমূল পর্যায়ে, শিয়া সুন্নি মতবাদের আবির্ভাব হওয়ার সাথে সাথেই সেখানে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের কুদৃষ্টি পড়বে। সেই অঞ্চলকে অস্থির করতে চাইলে খুব সহজেই এই দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে গোটা অঞ্চল অস্থিতিশীল করা যাবে। চলতি উদাহরণ হচ্ছে বেলুচিস্তান।
…….
মুসলিম ঐক্যের মূল উদ্দেশ্য প্রয়োজনের সময় সবার সম্মিলিত রাষ্ট্রশক্তি উম্মাহর কল্যাণে ব্যয় করা। আর সেটা করার জন্য জিটুজি ই যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হয় যেটা, কোন রাষ্ট্রের সাথে ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক উর্ধ্মূখী হলেই সেদেশের ইরানি কনস্যুলেট, শিয়া, সেমি শিয়া, ইরানি বিপ্লবে প্রভাবিত জনগোষ্ঠি এই সম্পর্ককে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে তৎপর হয়ে উঠে। তারা একে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বাইরে নিয়ে শিয়া মতবাদ প্রচারের সুযোগ ও উপলক্ষ্য হিশেবে ব্যবহার করে থাকে।
বাংলাদেশেও ৮০-৯০ র দশকে ইরান বিপ্লবের অব্যবহিত পর এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে। ইরান যদি তার এসব সেলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, এবং তার মতবাদ কেন্দ্রিক স্ট্রাটেজি পরিবর্তন না করে তবে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও রক্ষা করা কঠিন।
……
রাকিবুল হাসান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি