মেশিনে নতুন একটি প্রডাক্ট এর টেস্ট চলছিল, আমি মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সহকর্মীদের নিয়ে প্রতিটি প্রোডাক্ট পরীক্ষা করছিলাম। হঠাৎ বসের ফোন আসলো “ তুমি তুরস্ক যাবা না আমি যাব”।
তুরস্ক থেকে একটা মেশিন কেনা হচ্ছে আমাদের লাইনের জন্য। আমি সেই কাজ সব শেষ করে দিয়েছি, আর একটা মেশিনের জন্য এত খরচের ট্যুর হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে স্বিধান্ত হল এই মেশিন সহ আর কিছু প্রজেক্ট দেখতে যেতে হবে ইউরোশিয়া দেশ তুরস্কে।
বিশ্ব ভ্রমণের ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে ছোট বয়েসে ভবেশ রায় এর লেখা বিশ্ব জয়ের কথা বইটি পড়ে। পরে আন্দালুস থেকে মাগরেব হয়ে মধ্য এশিয়ার ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমি মাঝে মাঝেই স্বপ্নে প্রাচীন সিল্ক রোড ধরে হাটি । যেখানে আমার এক কাফেলা শুরু হয় লিবসন থেকে শুর করে কর্ডোভা, টলেডো, গ্রানাডা, ফেজ, কায়রো, জেরুজালেম, দামেস্ক, হালব, কোনিয়া, আনাতোলিয়া হয়ে ইস্তানবুল পর্যন্ত আরেক কাফেলা বাগদাদ,বসরা, ইস্পাহান,সিরাজ, সমরখন্দ, বুখরা, নিশাপুর, কাশঘর, দিল্লি হয়ে প্রিয় মাতৃভূমির প্রাচীন গৌড়ে চলে আসে। আমি মাঝে মাঝেই এই নাম গুলোতে হারিয়ে যাই। মক্কা আর মদিনা জিয়ারতের পরে আমার স্বপ্ন ইসলামের সোনালী সময়ের কেন্দ্র গুলো ঘুরে আসা। কিন্তু গরিবের স্বপ্ন বলে কথা।
“ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্ সে সামাল-সামাল তাই !
. কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই !
হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!”
আব্বার কাছে প্রথম খিলাফতের ইতিহাস আর তুরস্কের সম্পর্কে ইতিহাসের হাতে খড়ি। সাথে ছিল কবি নজরুলের কামাল পাশা কবিতা। কামাল পাশা খিলাফত ধ্বংস করেছে শুনেছি কিন্তু নজরুল কেন কামাল পাশা নিয়ে কবিতা লেখলো বুঝি নাই তখন।
২০০২ সালে বিবিসি তে শুনলাম তুরস্কে ইসলামপন্থী একটা দল ক্ষমতায় আসছে প্রধানমন্ত্রী হলেন আবদুল্লাহ গুল। আগ্রহ নিয়ে তখন খবর গুলো শুনতাম। আসবে কি কামাল পাশার দেশে পরিবর্তন? আব্বা বলেন এরা মুসলিম হলেও ইউরোপিয়ান হয়ে গেছে, মনে হয়না কিছু হবে। মাঝে মাঝে খবর পেতাম আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ হচ্ছে দল বা আবদুল্লাহ গুল। এর পর ওআইসি এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ এর সাকা চৌধুরী আর রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ানের মধ্যে দ্বন্দ্বের করা শুনি। সাকা বলেছিল এখন থেকে তুরস্কে এক সাথে ইসলাম আর ইহুদীবাদের পতাকা উড়বে। আমিও মনে করতাম রিসেপ তাইয়েব এ কেমন নাম, এরা না হয়ে বাংলাদেশ ওআইসি এর চেয়ারম্যান হলে ভাল হত মনে হয় ।
এরপর মাধ্যমিক শেষ করে (২০০৪) ফতেহ মুহাম্মদ নামে একটি বাংলা ডাবিং করা কার্টুন দেখলাম যেখান থেকে উসমানীদের কস্তান্তুনিয়া জয়ের ইতিহাস জানলাম। এরপর যেন নেশা ধরে গেল উসমানীদের ইতিহাস পড়তে। ইসলামের ইতিহাসের বই পরে উসমানীদের ইতিহাস জানতে লাগলাম আর ভালবাসতে শুরু করলাম রিসেপ নামের লোকটাকে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনে হামাসের জয়ের পর থেকে।
আসতে আসতে উসমানীদের ইতিহাস জানতে জানতে তুরস্কের বিভিন্ন স্থান গুলো নিয়ে জানা ও আগ্রহ জন্ম নিলো।
চানাক্কালে আর বসফরাস প্রণালীর জন্য তুরস্ক বরাবরই পৃথিবীর আগ্রহের এর কেন্দ্রে। অনেক সভ্যতার জন্ম মৃত্যু হয়েছে এই অঞ্চলে। এশিয়া মাইনর বা বাইজেন্টাইন অঞ্চল হিসাবে এটা ইতিহাসের একটা বড় অংশ এর স্থান। প্রাচীন গ্রিসের ট্রয় নগরী হোমার রচিত অমর মহাকাব্য ইলিয়াড এর মাধ্যমে আমাদের কাছে পরিচিত। সেই ট্রয় এর অবস্থা তুরস্কের আনাতোলিয়া অঞ্চলে ছিল। বর্তমান তুর্কি মূলত প্রাচীন গ্রিসের অংশ। রোমানদের পূর্বাংশের সম্রাজ্য এবং রোমের রোমান সম্রাজ্য পতনের পর কস্তান্তুনিয়া কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা বাইজেন্টাইন সভ্যতা একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘ মেয়াদী সম্রাজ্য হিসাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠে। পারস্যের সাথে রোমের যুদ্ধের সে ইতিহাস আমরা নবী মুহাম্মদ সা. এফেন্দির সিরাত এ পড়ি তা হচ্ছে বাইজেন্টাইন আর পারস্যের দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বের ইতিহাস।
সূরা রোম আর নবী মুহাম্মদ সা. এফেন্দির কস্তান্তুনিয়া দখলের অমিয় ভবিষ্যতবানী মুসলিম মাত্রই কনস্টান্টিনোপল বা ইস্তানবুল নিয়ে আগ্রহী করে তুলে। সাথে উসামানীদের ইউরোপ জয়ের সেই সোনালী দিন গুলো, সুলতান মুরদ ,ফতেহ মুহাম্মদ, সুলায়মান আল কানুনি, সুলতান আবদুল হামিদ হানের ইতিহাস আমাকে তুরস্ক তথা ইস্তানবুল এর গভীরে নিয়ে যায়।
ইসলামের তমদ্দুন আর সামরিক ইতিহাসে উসমানীদের প্রতি অনীহা প্রকাশের সুযোগ নেই। ইতিহাস পড়তে পড়তে তাই আমার মনে হয় আমি যেন ইস্তানবুলের রাস্তা আর আনাতোলিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রমণ করেছি।
বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে তুরস্ক আবার সবার আগ্রহের বিষয় হয়েছে। এই দেশটি দেখার ইচ্ছে ছিল তাই বরাবরের মতই প্রবল।
২০১৯ সালেই আমি প্রথমবারের মত বিদেশ ভ্রমনে দক্ষিণ কোরিয়া সফরে যাই । এরপর আসে তুরস্ক সফরের সুযোগ। অফিসের কাজে যেহেতু ভ্রমণ তাই স্যামনই ইতিহাস ভ্রমণের সুযোগ হবে বলেই জানতাম। দক্ষিণ কোরিয়া সফরেও তাই হয়েছে। যদিও আমি প্রথম দিনই আমার কোরিয়ান ব্যসায়িক বন্ধূকে বলে রেখেছিলাম একদিন আমাকে ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরতে নিয়ে যেতে। লিস্টও দিয়ে রেখেছিলাম। শেষ দিন সেই সুযোগ হয়েছিল।
কিন্তু তুরস্কের মত বড় নতুন পরিচিত ব্যবসায়িক বন্ধুদের সেই আবদার রাখার সুযোগ নেই। তাই নিজেই বানিয়ে রেখেছিলাম কাজে ফাকে ফাকে ঐতিহাসিক স্থান সমূহ ঘুরার প্ল্যান।
প্রথমে একটা প্রজেক্ট যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা অনেকগুলো প্রজেক্ট ও চারটি শহর ইস্তানবুল, সাকারিয়া, কোনিয়া ও ইজমির যাওয়ার প্ল্যান করি। মোট ১২ দিনের প্ল্যান নিয়ে আমি আর আমার অফিসের বড় ভাই যাত্রা শুরু করলাম ইস্তানবুলের পথে। ভাইয়ের সাথে আগের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকায় সফর ভাল হবে সেই আশাতেই এক নির্ঘুম রাত পার করে তার্কিস পতাকাবাহী হাওয়াই জাহাজে চেপে বসলাম।
নির্ঘুম রাত এর কারণে সবাই জানালা নামিয়ে ঘুমাচ্ছিল আমিও তিন ঘণ্টা টানা ঘুমিয়েছি। হাওয়াই জাহাজের ভ্রমণ সবচেয়ে কম আরামদায়ক ভ্রমণ। কাছাকাছি থাকা চাপা সিট আর ইঞ্জিনের শব্দ খুবই বিরক্তিকর।
জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি নিচে পাতলা মেঘের ফাকে ফাকে ন্যাড়া পাহাড়গুলো উকি দিচ্ছে। আমি মনিটরে দেখে নিলাম সেটা আফগানিস্তানের কারাকোরাম পর্বতমালা। এরপর মাঝে মাঝেই পর্দা উঠিয়ে দেখতে থাকি আফগানিস্তান ও ইরান এর বিভিন্ন ভূমি সৌন্দর্য। সমতলের মানুষ আমরা পাহাড় দেখলেই ভাল লাগে।
তার্কিস এয়ারলাইনের খাওয়া দাওয়া খুব পাওয়া যাবে না জেনেই রাতে উদরপূর্তি করে এসেছিলাম।জাহাজে বেগুন ভাজি, বন রুটি, মিষ্টি, পায়েস দিয়েই দুই বারের খাওয়ার পর্ব সারলাম।
জানাল দিয়ে কৃষ্ণসাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের ইস্তানবুলে। নিজের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল আমি আসলেই কি আমি ইস্তানবুলে পৌঁছে গেছি…।
আমারা সহি সালামতে অবতরণ করলাম ইস্তানবুলের ইয়ানি হাওয়ালিমান্দারে ( নতুন বিমানবন্দর)। পৃথিবীর বৃহৎ বিমানবন্দরের একটি এটি। এয়ারপোর্টে কাজ শেষ করে আমরা রওনা দেই ইস্তানবুলের এশিয়ার অংশে আমাদের আপাত ঘাটিতে। পাহাড়ের সুরঙ্গ আর বসফরাসের উপর ইয়াভুজ সুলতান সেলিম ব্রিজ দিয়ে শুরু হয় আমাদের ইস্তানবুল যাত্রা ।