পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলার ছোট্ট ইউনিয়ন ফাইতং। কক্সবাজারের চকরিয়ার বানিয়ারচরা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওই এলাকায় ঢোকার সময় চারদিক ছিল ধুলায় ধূসর। ভাঙা রাস্তা ধরে ইট কিংবা কাঠবোঝাই বড় ট্রাক হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে। ধুলা উড়ছে। কাছাকাছি হতেই দেখা যায় ধোঁয়া। এই ধোঁয়ার উৎস এলাকার ৩০টি ইটভাটা। সরকারি হিসাবে ৩০টি হলেও সাধারণের হিসাবে তা আরও বেশি।
ছোট্ট একটি ইউনিয়নের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ৩০টি ইটভাটা দেশের আর কোথাও আছে কি না জানাতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে এসব ভাটা বনাঞ্চল, পাহাড়, আবাসিক এলাকা—সব দিক দিয়ে অবৈধ। ইটভাটার কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ।
ফাইতং স্টেশন থেকে দুটি সড়ক দুদিকে পাহাড়ি পথে চলে গেছে। দুদিকেই দেখা যাবে ইটের চুল্লি। উত্তর দিকের পাহাড়ি পথ পেরিয়ে শিবাতলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯৭। প্রধান শিক্ষক মো. নেজাম উদ্দিন বসার চেয়ার মুছতে মুছতে বললেন, ‘প্রতি মিনিটে মিনিটে ধুলাবালি এসে পড়ে। পাশে ইটভাটা তো।’
পাশে ইটভাটা একটি নয়, পাঁচটি। খুব কাছেই এবিসি ব্রিকস। ভাটাটিতে সিমেন্টের লম্বা চুল্লি। পাশাপাশি দুটি ইটভাটা ব্যবসায়ী মো. বেলালের। এই দুটির মাঝখানে টিলার ওপর মো. হুমায়ুন নামে আরেকজনের ড্রাম চিমনির ইটভাটা রয়েছে একটি। এইচবিএম নামে এই ভাটা টিনের চিমনি দিয়ে তৈরি। পাশে পড়ে আছে বন থেকে কেটে আনা কাঠের স্তূপ। একই স্থানে আরও তিনটি ভাটার চিমনি প্রতিনিয়ত ইট পুড়িয়ে যাচ্ছে।
এবিসি ব্রিকসের শ্রমিক আবু জাফর বলেন, এখানে প্রায় ১০ বছর ধরে এসব ভাটা চলছে। কোনো সমস্যা হয় না।
শিবাতলীপাড়া থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিম দিকে রোয়াজাপাড়া। ওখানে গিয়ে দেখা যায়, শুধু চুল্লি আর চুল্লি। রয়েছে ড্রাম চিমনিও। এখানে প্রায় ১০টি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার কাছে ঘেঁষেই আছে বসতি ও বনাঞ্চল। বনের কাঠ নিয়ে ভাটায় ঢুকছে ট্রাক। আর ইটভাটার মাটির জোগান দিতে গিয়ে পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা হচ্ছে। রোয়াজাপাড়া মৈত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেও রয়েছে ইটভাটা। এ ছাড়া হেডম্যান পাড়ায় তিনটি ও রম্যখালীতে দুটি ইটভাটা দেখা গেছে। স্থানীয় দুই বাসিন্দা বললেন, ইটভাটার ধুলাবালি রাস্তা থেকে শুরু করে ঘর, স্কুল—সব জায়গায়।
লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে ইটভাটাগুলোর কোনো ধরনের সরকারি ছাড়পত্র নেই
তারপরও দিব্যি বনের কাঠ পুড়িয়ে পাহাড় ধ্বংস করে চলছে
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. মোয়াজ্জম হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ফাইতংয়ে ৩০টির মতো ইটভাটা রয়েছে। সব কটিই অবৈধ। কিছুদিন আগে এগুলোকে জরিমানা করা হয়েছিল। তারপরও বন্ধ হয়নি।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী কোনো পাহাড় বা টিলার উপরিভাগে, ঢালে বা তৎসংলগ্ন আধা কিলোমিটারের মধ্যে সমতলে ইটভাটা স্থাপন অবৈধ। এ ছাড়া আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে এবং বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।
পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক এ কে এম সামিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ের আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষেধ। কিন্তু ফাইতংয়ের ইটভাটাগুলোর বেশির ভাগ পাহাড়ের ওপর করা হয়েছে। কাঠ পোড়ানো নিষেধ। কিন্তু এগুলোতে বনের কাঠ পোড়ানো হয়। সব কটিকে সম্প্রতি জরিমানা করা হয়। আবার অভিযান চালানো হবে। তারা উচ্চ আদালতে রিট করে এসব ভাটা চালু রেখেছে। এসব ভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র বা জেলা প্রশাসনের ছাড়পত্র—কোনোটি নেই।
ইটভাটাগুলোর মালিকেরা বেশির ভাগ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক পরিচয় তেমন নেই। তাঁরা পাশের উপজেলা চকরিয়া ও অন্যান্য এলাকার বাসিন্দা। ফাইতং ব্রিকফিল্ড মালিক সমিতি নামে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছেন তাঁরা। সমিতির সভাপতি মোকতার আহমদ সাবেক ইউপি সদস্য। সমিতির অধীনে ৩০টি ইটভাটার মধ্যে ২৯টি চালু রয়েছে।
জানতে চাইলে মোকতার আহমদের সোজাসাপ্টা জবাব, ‘ইটভাটা আইনসম্মত না হলেও অবৈধ তো নয়। জেলা প্রশাসনে আবেদন করা হলেও ছাড়পত্র পাইনি।’
ফাইতংয়ের ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন অবশ্য আওয়ামী লীগের। তাঁর ভাই ফরিদুল আলমেরও ইটভাটা রয়েছে। জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার ইটভাটা নেই, তবে আমার ভাইয়ের আছে। ইটভাটাগুলো সব অবৈধ। তারপরও এলাকায় কিছু কাজকর্ম হচ্ছে। আর ইটভাটার গাড়ি চললে তো রাস্তা ভাঙবে। তাদের জন্য নতুন একটি রাস্তা করা হচ্ছে।’