রজত কান্তি রায়: শীতের সকালে নরম রোদে পিঠ পেতে বসে ধনেপাতা দিয়ে রাঁধা আলুর পাতলা ডালে চুবিয়ে পরোটা খাওয়ার স্বাদ বোঝা যায় উত্তরবঙ্গে। চায়ে চুবিয়ে পরোটা খাওয়ার মজা জানে চাটগাঁয়ের লোক। নারকেলের দুধে পোলাও আর চিংড়ির স্বাদ দক্ষিণের কৌলীন্য। বেগুন কিংবা নির্জলা মরিচের ভর্তা মেখে মাষকলাইয়ের রুটির স্বাদ পাবেন রাজশাহী–চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আপনার কাছে সাতকরার গন্ধ বড্ড কড়া হলেও সিলেটের রসনায় তা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। চ্যাপা শুঁটকির কথা উঠলে আপনাকে বলতেই হবে ভাটির দেশের কথা। ময়মনসিংহ থেকে সিলেট এ ক্ষেত্রে অনন্য। চায়ে ডুবিয়ে বাকরখানি খেতে খেতে আগা বাকের আর খানি বিবির প্রমের গল্পে মশগুল হয়ে যেতে পারেন ঢাকার মানুষ। খাদ্যের ছয় রসে জারিত হয়ে এই ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মানুষ ‘আহ্’ থেকে ‘আহা’ পর্যন্ত সব ধরনের অভিব্যক্তি নিয়ে নালে–ঝোলে–অম্বলে দিন গুজরান করছে। কমপক্ষে পাঁচটি শাক একত্র করে হালকা সোডা দিয়ে রান্না করা প্যালকা, সঙ্গে সরিষার তেলে ভাজা খেসারি কলাইয়ের বড়া অথবা ঝাউ আলুর ভাজা দিয়ে আউশ ধানের ভাত খেয়ে নূরলদীন হাঁক দিয়েছিলেন, ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়’—কবি সেসব লিখুন আর না লিখুন, আমরা জানি। কারণ নূরলদীন ‘বাহের দ্যাশে’র মানুষ। আর বাহের দেশ ছাড়া ক্ষার বা সোডায় রান্না করা খাবার এবং কচুপাতা আর দেশি মাছের শুঁটকি দিয়ে তৈরি করা শিদল দেশের অন্য অঞ্চলে পাওয়া যায় না, এ বিষয়ে গ্যারান্টি দিতে পারি। শুধু প্যালকাই নয়, চালের গুঁড়ায় সোডা দিয়ে রান্না করা ফোকতাই কিংবা যেকোনো সবজিতে সোডা দিয়ে রান্না করা ছ্যাকা বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর ছাড়া অন্য অঞ্চলে বিরল। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ সংস্কৃতিগতভাবে মূলত কোচ-রাজবংশী সংস্কৃতি প্রভাবিত। এসব খাবার এই সংস্কৃতিরই অবদান।
উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের খাবারের যেমন পার্থক্য আছে, তেমনি ঢাকাই খাবার বলে পরিচিত মোগলাই খানার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের খাবারেরও পার্থক্য আছে বিস্তর। নিঃসন্দেহে ভাত, ডাল, মাছ বাঙালির প্রধান খাবার। তবে কিছু আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য প্রতিটি অঞ্চলের খাবারকে করেছে বৈচিত্র্যময়।
বুনো রামানাথ নামে ভারতবর্ষীয় এক মহান গণিতবিদ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হতে হতে নাকি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন—না, গাণিতিক কোনো সূত্র নয়—স্বাদে টক কচি তেঁতুলপাতার ঝোলের রেসিপি। বাংলাদেশের ‘ডিপ কালাহারি’ বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ তেঁতুলপাতার ঝোল খাওয়াকে অনভিজাত মনে করে ‘চান্দি ফাটা’ গরমে তেঁতুলের শরবত আর টক খাওয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর খাঁটি সরিষার তেলে বানানো নির্জলা মরিচের ভর্তা দিয়ে মাষকলাইয়ের রুটি খাওয়াকে তারা নিয়ে গেছে শিল্পের ওপারে। কোনো শীতের সন্ধ্যায় যদি রাজশাহী বা চাঁপাইনবাবগঞ্জে বসে হাঁসের ভুনা মাংসসহযোগে এই মাষকলাইয়ের রুটি একবার আপনার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়, সে স্বাদস্মৃতি পরজন্মেও আপনি ভুলতে পারবেন না। বরেন্দ্রভূমির আমের কথা বাদ দিলাম। কারণ, সে তথ্য আপনাদের সবার জানা।
আজ থেকে প্রায় ছয় শ বছর আগে, পনেরো শতকের শেষে পদ্মপুরাণ কাব্যে কবি বিজয় গুপ্ত যেসব খাবারের কথা, রন্ধনপ্রণালির কথা লিখে রেখেছেন, এই একুশ শতকেও সেগুলো দক্ষিণাঞ্চলের খাবারের কৌলীন্য বহন করে চলেছে মহাসমারোহে। চাঁদ সদাগরের স্ত্রী সনেকার রান্নাবান্না বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে মুসুরির সুপ।’ ‘দুগ্ধ লাউ রান্ধে আর নারিকেল কুমারি।’ এবং ‘মাংসেতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল।’ এখনো দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী খাবারে নারকেলের উপস্থিতি জানান দেয় বিজয় গুপ্ত খাঁটি ‘বরিশাইল্যা’—ঘাঘর ও ঘণ্টেশ্বরী নদীর মধ্যবর্তী ফুল্লশ্রী গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল। এই একুশ শতকেও নারকেল কোরা দিয়ে চিংড়ির মালাইকারি তো বটেই, এই অঞ্চলের মানুষ ভাত বা পোলাও রান্না করে নারকেলের দুধ দিয়ে। লবণাক্ত মাটিতে সমুদ্র উপকূলবর্তী চট্টগ্রাম–কক্সবাজার এলাকায় প্রচুর নারকেল উৎপন্ন হলেও সেটি দিয়ে রান্না করা খাবারের অধিকার একচেটিয়া দক্ষিণবঙ্গের।
নারকেল দিয়ে রান্না না হলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের যে খাবারের কথা তপন রায়চৌধুরীর মতো বিদগ্ধ লেখক সসম্ভ্রমে উল্লেখ করেছেন, সেটা শুঁটকি। প্রচণ্ড ঝাল দিয়ে রান্না করা শুঁটকি খাওয়ার জন্য তিনি বারবার জন্মাতে পারেন এই পঙ্কিলতাপূর্ণ পৃথিবীতে, এমন কথা বলতেও পিছপা হননি তপনবাবু। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কাঁচা মরিচের প্রচণ্ড ঝালের সঙ্গে গলে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে থাকা অক্ষত রসুনের কোয়া, গলে যাওয়া পেঁয়াজের প্রায় অদৃশ্য উপস্থিতি আর এক–আধটা লবঙ্গের সংগতে লইট্টা শুঁটকি ভুনার যে স্বর্গীয় স্বাদ, অন্য শুঁটকিতে তা আসে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর মেজবানি? আহা, গোমাংসের এই অপার্থিব স্বাদ চট্টলার পুণ্যভূমি ছাড়া আর কোথাও মিলবে কি? বগুড়া অঞ্চলের গোমাংস রান্নার সুখ্যাতি শোনা যায় বটে, কিন্তু মেজবানির রান্নার সঙ্গে তা কতটা পাল্লা দিতে পারবে, সে বিষয়ে আমার বিস্তর সন্দেহ আছে। তবে যশোর–খুলনার চুই ঝালে রান্না করা গরু কিংবা খাসির মাংস বাংলাদেশের অন্যতম সেরা খাবার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ করা উচিত, সিলেটের সাতকরা দিয়ে রান্না করা মাংসও কিন্তু সে অঞ্চলের খাদ্যসংস্কৃতিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। যেকোনো মাংসকে লবণ-মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাওয়ার ব্যাপারে ময়মনসিংহ অঞ্চলের জুড়ি মেলা ভার, ঠিক যেমন আগুনঝালে চ্যাপা শুঁটকি ভর্তার স্বর্গীয় রোমাঞ্চ আনার ক্ষেত্রেও তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে আট দশকের মাথায় সুবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায় ঢাকা নামের জনপদটি। প্রশাসক হিসেবে মোগলদের স্থায়ী বসবাস শুরু হয় রাজধানীকে কেন্দ্র করে। রাজধানীর বাস্তবতায় মোগলাই খাবার ছড়িয়ে যেতে থাকে বাঙালি হেঁশেলে। মসলার বিশেষ ব্যবহার, মাংসের আধিক্য, জাফরান–গোলাপজলের সুচারু প্রয়োগ অল্প দিনেই শিখে নেয় ঢাকাবাসী। তবে মোগলাই খাবারের এই বোলবোলাই অবশ্য রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে দেশের আনাচকানাচে খুব একটা ছড়িয়ে যেতে পারেনি। বর্তমানের পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করে মোগলাই খাবার এখনো জীবন্ত। দেশভাগের পর ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে যে অবাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস শুরু হয়, যাদের আমরা ‘বিহারি’ নামে চিনি, তাদেরও আছে অত্যাশ্চর্য খাবারের ঝাঁপি। মিরপুর বেনারশিপল্লি বা মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের অলিগলিতে সে সুস্বাদু খাবারের সন্ধান পাওয়া যায় প্রতি সন্ধ্যায়। যদিও এসব খাবারের মূল রয়েছে মোগলাই রান্নার দিল্লি, লক্ষ্ণৌ কিংবা হয়দরাবাদি ঘরানায়।
‘খাদ্যরসিক’, ‘ভোজনরসিক’ ও ‘ভোজনশিল্পী’—এসব বিশেষণ থেকে চেনা যায় বাঙালিকে। ‘জেনো, বাসনার সেরা বাস রসনায়’—রবীন্দ্রবাণী বাঙালি জীবনে বিফল হয়েছে কবে?