ড. আবদুল লতিফ মাসুম: পৃথিবীর সবচেয়ে সংবেদনশীল বা স্পর্শকাতর বিষয় হলো, ধর্ম। বাংলা ভাষায়- ‘মানুষ যা ধারণ করে তাই হচ্ছে ধর্ম’। এই ধারণ কোনো শারীরিক বিষয় নয়, বরং এর অবস্থান অন্তরের অন্তস্তলে। সমাজের গভীরে এর শিকড় এতটাই বিস্তৃত, যারা ধর্মকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছে, তারাই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। সভ্যতার সুপ্রভাতে ধর্মই ছিল সব নগর ও জনপদের সামাজিক আকর। ধর্মই নির্ধারণ করত নেতৃত্ব, শাসনকাঠামো, এমনকি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও। সভ্যতার আধুনিকায়ন, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং উৎপাদনের উপায়গুলোর রাষ্ট্রীয়করণ সত্ত্বেও সভ্যতার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ধর্মের আবেদন কখনো ম্লান হয়েছে বটে, তবে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
পৃথিবীর ইতিহাস মানেই, ধর্মের ইতিহাস। ধর্ম নিয়ে মানুষ পেয়েছে আত্মার পরিশুদ্ধি, জীবনযাত্রার আলোকিত সোপান এবং সামাজিক প্রশান্তি। আবার এটাও অপ্রিয় সত্য যে, ধর্ম নিয়ে অধর্মও কম হয়নি। ধর্মের আবেদন নষ্ট হয় তখন, যখন ব্যক্তিগত স্বার্থ, গোষ্ঠীগত ক্ষমতা ও রাষ্ট্রিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাওয়া হয়েছে। তখন অশান্তি, অরাজকতা অথবা যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। গোটা ইউরোপের ইতিহাস, ধর্ম নিয়ে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। জাগতিক বিষয়কে ধর্ম থেকে পৃথক করার কারণে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-লড়াই দীর্ঘায়িত হয়েছিল। অবশেষে ‘বিধাতার যা প্রাপ্য বিধাতাকে দাও এবং পোপের যা প্রাপ্য পোপকে দাও’- এভাবে সমীকরণ নির্ণীত হয়ে, আধুনিক সভ্যতা নির্মিত হয়েছে।
খ্রিষ্টধর্মের প্রথম ৫০০ বছর পৃথিবী শাসিত হয়েছে বাইবেলের বাণী দ্বারা। পরবর্তী এক হাজার বছর ইসলামের উত্থানকাল। স্বাভাবিকভাবেই উত্থানের মাত্রায় খ্রিষ্ট ধর্মের সাথে ইসলামের বিবাদ-বিসংবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল। বিশ্বব্যাপী প্রসারিত খ্রিষ্টধর্ম ইউরোপে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অপর দিকে ইসলামের অবধারিত বিজয় এশিয়া ও আফ্রিকায় বিস্তৃত হয়। একাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ইতিহাসবিশ্লেষণে দেখা যাবে, এই যুদ্ধগুলো যতটা না ধর্মনির্ভর, তার চেয়ে বেশি, ক্ষমতার লড়াই। আর এসব লড়াই সংঘটিত হয়েছে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে।
একসময় এই ধর্মীয় অনুভূতি সাধারণ মানুষের অনুভূতি-কেন্দ্রিক না হয়ে স্বার্থসুবিধা-কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এই সময়ে ধর্মে অসারতা প্রমাণ করার পক্ষে একদল বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটেছে। জর্জ টমসন ধর্মকে ‘আফিম’-এর সাথে তুলনা করেন। কার্লমার্কস ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মার্কসীয় ধারণা একটি দার্শনিক ভিত্তি অর্জন করে। এই তত্ত্বে সব কর্মকাণ্ডে ধর্মের ভূমিকা অস্বীকার করা হয়। ধর্মের বিপরীতে বিজ্ঞানমনস্কতা, আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা অর্জন করে প্রাতিষ্ঠানিকতা। বিশেষ করে ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর ধর্মের আবেদন হ্রাস পায়। দৃশ্যত মনে করা হচ্ছিল, ধর্মের আবেদন শেষ হয়ে গেছে। মার্কসবাদে বিশ্বাসীরা ধর্মের বিরোধী ভাবধারাকে রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে পুষ্ট করে তোলেন। তারা বিশ^ব্যাপী এই আদর্শের লালন পালন ও সংরক্ষণ করেছেন। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সর্বত্র ধর্মীয় পুনর্জাগরণ পরিলক্ষিত হয়। ১৯৯০ সালে খ্রিষ্টান জগতের ধর্মগুরু পোপ জন পল যখন পোল্যান্ড সফর করেন, তখন লাখ লাখ মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। পৃথিবীর সর্বত্র একই আবেদন দৃশ্যমান হয়েছে।
৭০ বছর আনুষ্ঠানিক ধর্মের অনুপস্থিতির পর সমাজতাত্ত্বিকরা ভেবেছিলেন, ধর্মীয় অনুভূতির বিলোপ ঘটেছে। ধর্মের দৃশ্যমান প্রত্যাবর্তন সবাইকে অবাক করে দেয়। এখানেই শেষ নয়, পৃথিবীর সর্বত্র ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটেছে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটে যায়। ইউরোপ আমেরিকাসহ খ্রিষ্ট ধর্ম শাসিত জনপদে ‘ব্যাক টু দ্য বাইবেল’ আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ‘ভানজেলিক’ বা খ্রিষ্টধর্মে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জোরদার হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের শেষের দিকে খ্রিষ্টবাদ প্রভাবিত কথিত ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’ নির্ভর করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে। একই ভাবে গোটা ইউরোপে লোকরঞ্জনবাদের প্রকোপ দেখা দেয়।
জার্মানিতে উদার মনোভাবাপন্ন ‘খ্রিষ্ট গণতান্ত্রিক দলের’ অ্যাঞ্জেলা মার্কেল কোণঠাসা হয়ে পড়েন। জোড়াতালি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় টিকে আছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, মুসলিমবিদ্বেষ নির্ভর চরপন্থী খ্রিষ্টবাদ ইউরোপকে মধ্য যুগের দিকে নিয়ে যাবে। পশ্চিমের এই চরম মতবাদ প্রসারিত হচ্ছে প্রাচ্যে। তার সর্বশেষ উদাহরণ হলো, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার ভারত। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর ধর্মনিরপেক্ষতার খোলস ধারণ করে ভারত গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালের নির্বাচনে সেই খোলসটুকু পর্যন্ত ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। সাপ যেমন বারবার খোলস পাল্টালেও তার দংশন স্বভাব পরিবর্তন করতে পারে না; তদ্রƒপ সবটুকু বিষ ঢেলে দিয়ে মোদির দল, বিজেপি ভারতকে চরমভাবে বিষায়িত করে তুলেছে। সেখানে মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ- কেউই আর নিরাপদ নয়।
এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও ধর্মীয় উন্মাদনা লক্ষ করা যায়। অহিংস বৌদ্ধধর্মের কথিত অনুসারী মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রতি কী আচরণ করছে, বাংলাদেশের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে। রোহিঙ্গাদের একমাত্র ‘অপরাধ’ তারা মুসলমান। একই ‘অপরাধে’ থাইল্যান্ডের দক্ষিণাংশে পাত্তানি অঞ্চলে মুসলমানদের ওপর চলছে নির্যাতন। ফিলিপাইনে মিন্দানাও অঞ্চলে মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের ইতিহাস অনেক পুরনো। সাম্প্রতিককালে তুলনামূলকভাবে শান্ত শ্রীলঙ্কায় পর্যন্ত মুসলিমবিদ্বেষ উসকে দেয়া হয়েছে। এসব উদাহরণের মাধ্যমে প্রমাণ হচ্ছে, সভ্যতার যত উৎকর্ষের কথাই আমরা বলি না কেন, ধর্ম সর্বত্রই রাজনীতির অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধর্ম, ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমাজকে কী ভয়ঙ্করভাবে প্রভাবিত করে তার সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ভারতীয় সমাজে গরু দেবতা হিসেবে পূজনীয়। সেখানে গরুর গোশত খাওয়া ও রাখার অভিযোগে অনেক মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে সম্প্রতি। বিজেপির নির্বাচনী ধ্বনি ‘শ্রী রাম’ উচ্চারণ না করায় বিজেপির লোকেরা মুসলমানদের হত্যা করার উদাহরণ রয়েছে। নিকট অতীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন ধর্মীয় অনুভূতির কারণে। বিশ্বস্ত শিখ দেহরক্ষী তাকে হত্যা করেছিল। কারণ, শিখদের পবিত্র তীর্থকেন্দ্র অমৃতসরের ‘স্বর্ণমন্দিরে’ তিনি সশস্ত্র অভিযানের আদেশ দিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে হজের সময় পবিত্র কাবা শরীফে সশস্ত্র প্রবেশের ঘটনা ঘটে। গুজব রটে যায়, মার্কিনিরা কাবা শরীফ আক্রমণ করেছে এবং দখলের চেষ্ট করছে। এতে গোটা মুসলিম বিশ্বে বিস্ফোরণ ঘটে। ইসলামাবাদ ও জাকার্তায় মার্কিন দূতাবাস ভস্মীভূত হয়েছিল। সর্বত্র মার্কিন স্থাপনা আক্রান্ত হয়।
১৯৬৯ সালে মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান, ফিলিস্তিনের ‘আল-আকসা’ মসজিদে ইহুদিরা অগ্নিসংযোগ করে। প্রতিবাদে মুসলিম বিশ্বে সর্বত্র প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। যতবারই ফিলিস্তিনে বর্বরতা ঘটেছে, পৃথিবীর সব মুসলমান ততবারই বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। প্রতিবারই ইসরাইলের দোসর হিসেবে ব্রিটিশ ও মার্কিন স্থাপনাগুলো আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ২০০১ সালে নিউ ইয়র্কের ‘টুইন টাওয়ার’ বিমান হামলায় ধ্বংস হয়। ৯/১১ নামে খ্যাত এই মর্মান্তিক হামলার জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়। ওই দিন ও পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে। মসজিদে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং অনেক মুসলমান নিহত হন। এমনকি মুসলমানদের মতো শ্মশ্রুধারী শিখরাও আক্রান্ত হন শুধু ধর্মীয় কারণে। এসব ঘটনা ধর্মীয় ভাবানুভূতির চরম প্রকাশ।
ইসলাম এখনো জীবন্ত ধর্ম এবং এর অনুসারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি ধার্মিক। তাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। ’৮০-এর দশকে যখন নাস্তিক সালমান রুশদি পবিত্র কুরআনকে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বা শয়তানের পদাবলি বলে অভিহিত করে, তখনো মুসলিম বিশ^ ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে। খ্রিষ্ট পৃথিবী বা পাশ্চাত্য রুশদিকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়। ইউরোপ ও আমেরিকার রাষ্ট্র ও সমাজ যদিও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, কার্যত তারা মুসমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে দারুণ মজা অনুভব করে।
ফ্রান্সসহ ইউরোপের সর্বত্র মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরা যেন বড় একটি সমস্যার কারণ। মুসলমানদের কুরআন, নবী মুহাম্মাদ সা: এবং ইসলামী প্রতীকগুলো এদের ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার্টুন, লেখনী এমনকি বিলবোর্ডের মাধ্যমে এসবের প্রকাশ ঘটছে। সেই সাথে মুসলমানদের পক্ষ থেকে হামলা তথা প্রতিশোধপরায়ণতার প্রকাশ ঘটছে। এ যেন এক অব্যাহত প্রতিযোগিতা, যার কোনো শেষ নেই। পৃথিবীতে সব ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে শান্তি ও সুন্দরের জন্য। অথচ চরমপন্থীদের দ্বারা তা আজ হানাহানি ও রক্তারক্তির মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশও এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যতিক্রম নয়। আবেগময় জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে দুর্নাম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুনাম থাকলেও ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অসম্প্রীতির বিভাজন ঘটেছে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ’১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ, ’৪৬-এর সাম্প্রতিক দাঙ্গা এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ- এক একটি কালো অধ্যায়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও পরবর্তীকালে সীমান্তের উভয় পারে দুঃখজনক ঘটনার কমতি নেই। এসব ঘটনার পেছনে কখনো কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও উসকানি কাজ করেছে; যেমন নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক নির্বাচন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামুলি গুজব হয়েছে কারণ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিশেষ সম্প্রদায়ের কোনো কোনো ব্যক্তি, কখনো কখনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণ ঘটিয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা ’৪৭-এর আগে তাদের প্রাধান্যের সময়কালে বেশি ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে সে সম্প্রদায়ের কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে সরকার অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অপব্যবহার করছে। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রায়ই বলতেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধার্মিক মানুষ বলেই জানে সবাই। ভোলার এই সে দিনের আলোচিত ঘটনায় তিনি দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো ধর্মের লোকজনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা গ্রহণযোগ্য নয়।’ অথচ গত ১২ বছরে এ রকম অনেক ঘটনাই ঘটেছে দেশে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আওয়ামী লীগ শাসনামলে এ প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করে থাকে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃনীতির ভুল ব্যাখ্যা এর কারণ হয়ে থাকবে।
এতে দুই ধরনের লোকদের অংশগ্রহণ লক্ষ করা গেছে। প্রধান অংশ হলো, নাস্তিক ব্লগার ও হঠাৎ করে বিখ্যাত হওয়ার খায়েশি লোকজন। নাস্তিক কবি লেখে কবিতা, নাস্তিক লেখক সাহিত্যকর্ম করে এবং নাস্তিক ব্লগার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিখ্যাত হতে চায়। ১৯৭৩ সালে দাউদ হায়দার নবী মুহাম্মদ সা:-কে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন, ‘মোহাম্মদ তুখোড় বদমাশ চোখে মুখে রাজনীতি’। তসলিমা নাসরিন ইসলামের বিধিবিধানকে গালি দিয়ে পরিচিতি অর্জন করেছেন।
উভয়ই পশ্চিমাদের সহায়তা লাভ করেছেন। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ব্যাপক আন্দোলনের কারণ ছিল ইসলাম ও নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর সম্পর্কে অশালীন উক্তি ও অশ্লীল বক্তব্য। এর পরও কক্সাবাজারের রামুর বৌদ্ধমন্দিরে হামলা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া, দু-একজন পণ্ডিতের অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য এবং জনরোষ লক্ষ করা গেছে। ঘটনার উৎস সর্বত্রই প্রায় এক ও অভিন্ন- ব্লগ, ফেসবুক ইত্যাদি।
এবার ভোলায় যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল, তা-ও একই রকম। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ভোলা সরকারি কলেজের ছাত্র শুভ তার ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম ও মহানবী সা: সম্পর্কে কটূক্তি করেছিল। একপর্যায়ে সেটি ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিবাদে জনগণ ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। শুভ অবশ্য দাবি করে যে, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে অন্য কেউ এটা করেছে।
অনুমান করা হয়, ঘটনার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে সে তা অস্বীকার করার কৌশল নিয়েছে। এলাকায় তার শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হলেও পুলিশ দু’জন ইমামসহ নেতৃস্থানীয়দের ‘আটক’ করে। এটা জেনে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশের ভাষ্যে বলা হয়, তারা কাউকে গ্রেফতার করেনি। সংবাদপত্রে বলা হয়, ‘একপর্যায়ে জনতার একটি দল ইমামের সাথে থাকা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ দৌড়ে মসজিদের দোতলায় একটি কক্ষে আশ্রয় নেয়। বিক্ষোভকারীরা সেখানে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে একপর্যায়ে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এ সময় আহত হন বোরহানউদ্দিন আলিয়া মাদরাসার আরবির প্রভাষক, বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের খতিব হাবিবুর রহমান জাজেরি। এতে জনতা তখন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। পুলিশও গুলি ছোড়ে।’
পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হলেন। অনেকেই আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুলিশ ও প্রশাসন যদি আরো ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতির মোকাবেলা করত, তাহলে এই মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো যেত। সংবাদভাষ্যে দেখা যায়, পুলিশ প্রথমেই গুলি ছুড়েছে। প্রথাগতভাবে সতর্কীকরণ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ না করেই বেধড়ক গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ। এটি আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশের খেলাফ। গত প্রায় ১২ বছরে এই প্রবণতাই দেখা গেছে। ক্ষমতাবানরা যেন গুলি ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। হেফাজতে ইসলাম মন্তব্য করেছে, ‘শান্তিপূর্ণ মিছিলে এভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নবীপ্রেমীদের শহীদ করে লাখো তৌহিদি জনতার কলিজায় আঘাত করা হয়েছে।’
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানলে তার পরিণতি যে কী হতে পারে, ভোলার ঘটনা এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। মানুষ ধার্মিক না হতে পারে, কিন্তু নিজের ধর্ম সম্পর্কে গভীর আবেগ পোষণ করেন, তিনি যে ধর্মেরই মানুষ হোন না কেন। একজন মুসলমান ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতে না-ও পারেন, কিন্তু তিনি ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। ভোলার মানুষের ধার্মিকতার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। ভোলার মানুষ বিশ্বাস করেন, ইসলাম ও মহানবী সা:-এর ইজ্জত ও মর্যাদা রক্ষার জন্য যা করা হয়েছে তা যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত।
সব সরকারের মতো এই সরকারও ঘটনার পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করেছে। সরকারবিরোধীদের দায়ী করার চেষ্টাও হস্যকর। সরকারি ভাষ্যে অভিযোগ লাঘব করার প্রবণতা প্রকট। গণমানুষের অনুভূতিকে আরো ক্ষুব্ধ ও তিক্ত না করে সরকারের উচিত, বিক্ষোভকারীদের সব দাবি মেনে নেয়া। পুলিশ চার-পাঁচ হাজার মানুষকে আসামি করে যে মামলা ঠুকেছে, তা অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য ও উদ্দেশ্যমূলক। বিক্ষোভকারীদের ছয় দফা দাবি মেনে নেয়ার মধ্যেই শান্তি ও স্বাভাবিকতা নিহিত। সরকার যত দ্রুত এই বাস্তবতা মেনে নেবে, ততই মঙ্গল।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]