সরদার জাহিদুল কবীর: নীলসাগর একটি ঐতিহাসিক দিঘী, নীলফামারী জেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট এটি। নীলফামারী থেকে নীল এবং বিশাল সাগর থেকে সাগর, এই দুয়ের সমন্বয়ে ‘নীলসাগর’ নামের উৎপত্তি। এটি একটি বিশাল দিঘী। নীলফামারী জেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা গ্রামে এটি অবস্থিত। মনে করা হয়, বৈদিক রাজা বিরাট এই দিঘী খনন করেন এবং তা বিরাট দিঘী হিসাবে পরিচিত ছিল৷ রাজা বিরাটের শাসনামলে গড়গ্রামে অনেক গরুর খামার ছিল। গরুর পানীয় পানির জন্য রাজা ‘বিরাট অথবা বিরনা এই বিশাল দিঘীটি খনন করেন। পরবর্তীকালে বিন্না দিঘী নামেও পরিচিতি পায়। ১৯৮২ সালে দিঘীটির নাম করা হয় নীলসাগর এবং বর্তমানে এখানে ব্যাপক সংস্কার করে ভ্রমণ পিপাসুদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতি বত্সর শীত মৌসুমে অসংখ্য অতিথি পাখির সমাগম ঘটে এই নীলসাগরে।
দিঘীর মোট আয়তন ৫৪ একর। জল ভাগের আয়তন ৩৪ একর। জলের গভীরতা ৭ থেকে ১২ মিটার। সমগ্র দিঘীটির অভ্যন্তরিণ চারপাশ ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দিঘীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে রয়েছে ইটের তৈরি প্রধান দু’টি ঘাট। ধারণা করা হয় এ ঘাট দু’টিও রাজা বিরাটের তৈরি। দিঘীর পূর্ব পাড়ে রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি শিব মন্দির। পশ্চিম পাড়ে ছিল একজন মুসলিম দরবেশের আস্তানা।
বর্তমানে প্রতিবছর বৈশাখী পূর্ণিমায় দিঘীর পাড়ে হিন্দুদের ‘বরুনী স্নান উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিভিন্ন ধরণের কীর্তন গানও অনুষ্ঠিত হয় এখানে। একই সঙ্গে বসে বৈশাখী মেলা। মাসে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে এখানে। পাকিস্তানী পর্যটক আসিয়া আশফাক দিঘীর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে বলেন, “ফ্যান্টাস্টিক! রিয়েলী চার্মিং এনভায়রনমেন্ট”।
দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে কর্তৃপক্ষের অফিস। অফিসের সঙ্গে আছে পর্যটকদের থাকার রুম। রুম ভাড়া ২শ’ থেকে ৪শ’ টাকা। নীলফামারী জেলা প্রশাসনের পরিচালনায় এ দিঘীতে প্রায় প্রতি বছর কার্প জাতীয় মাছ ছাড়া হয়। ১ হাজার টাকা টিকিটের বিনিময়ে সৌখিন মৎস্য শিকারীরা এ দিঘীতে মাছ শিকার করতে পারেন। প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল থেকে নভেম্বরে অতিথি পাখি আসা পর্যন্তু মৎস্য শিকারের নির্ধারিত সময়। মৎস্য শিকারের সীট রয়েছে ৮০টি। দেশের দূর-দূরন্ত থেকে আসা শিকারীদের কেউ আশানুরূপ মাছ পান, আবার কেউ পান না। এক্ষেত্রে শিকারীদের অভিযোগ রয়েছে বিস্তর।
দিঘীর ৪ পাড় জুড়ে রয়েছে ফল, ফুল ও ঔষধী গাছের সবুজ উদ্যান। পাড়গুলোর উত্তল অবয়বের কারণে কিছুটা পাহাড়ী ধাচ ফুটে উঠেছে আসপাশের সমতল ভূমির মাঝে। পাড়ে মাঝে মাঝে রয়েছে পর্যটকদের বসার স্থান। এ দিঘীর সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য পর্যটকদের ৫ টাকা মূল্যের প্রবেশ টিকিট ক্রয় করতে হলেও আসপাশের স্থানীয় অধিবাসীদের দিঘীর পানিতে গোসল করতে কোন মূল্য দিতে হয় না। রুচিশীল পর্যটকদের দৃষ্টিতে দিঘীর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে আরও পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
নীলসাগরের সৌন্দর্য্য সংরক্ষণ এবং বর্ধিত করতে পারলে এর পর্যটকের সংখ্যা যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে মৎস্য শিকারীর সংখ্যা। তাতে পর্যটনের এই স্পটটি আরও লাভের মুখ দেখতে পারবে।