দুপুরের রোদে সবুজ পাতার মধ্যে লাল করমচাগুলো চকচক করছে। যেন সবুজের মাঝে সিঁদুর লাল বিন্দু! গাছে গাছে ধরে আছে আম, জাম, আলুবোখারা, লাল শরিফা, জামরুল, লটকন। আছে আনারসও। আগারগাঁওয়ে বৃক্ষমেলায় গেলে দেখা মিলবে এমন দৃশ্যের। মেলার এমন সবুজ পরিবেশ টানছেও দর্শনার্থীদের। বিক্রেতারা বললেন, ইট-পাথরের বহুতল জঙ্গলের মধ্যে একটু প্রশান্তি পেতে অনেকে যেখানে পারছে, সেখানে গাছ লাগাচ্ছে। এ কারণে গাছ কিনতে প্রচুর মানুষ আসছে মেলায়। দেখতেও আসছে অনেকে।
আগারগাঁওয়ে বাণিজ্য মেলার মাঠে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা শুরু হয়। আগামী ১৯ জুলাই পর্যন্ত এ মেলা চলবে। মেলায় ১০৪টি স্টলে নানা প্রজাতির ফুল, ফল, ওষধি, শোভাবর্ধনকারী গাছ বিক্রি হচ্ছে। আরও আছে গাছ লাগানোর ও পরিচর্যার সরঞ্জাম, বই, ফুলের টব, বীজ, সার। কেউ কেউ গাছ লাগানোর মাটিও বিক্রি করছেন।
মেলায় গ্রিন ওয়ার্ল্ড নার্সারির মো. তোরাব হোসেন বলেন, ঘরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য অনেকে এখন ইনডোর প্ল্যান্ট কেনেন। এসব গাছ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখা যায়। পানি দিতে হয় কম। দাম এক শ থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে।
বৃক্ষমেলার পরিবেশ অন্য মেলার চেয়ে আলাদা বলে বন্ধুদের নিয়ে দল বেঁধে এসেছেন কলেজছাত্রী যারিন তাসনিম। তিনি বললেন, বৃক্ষমেলার পরিবেশই অন্য রকম। বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে ও গাছ কিনতে এসেছেন তাঁরা।
মেলা ঘুরে দেখা যায় প্রচুর বিদেশি গাছ। থাই শোভাবর্ধনকারী এলেরিয়াগাছ দেখতে দেশি আলুপাতার মতো। বৃক্ষমেলায় আছে থাইল্যান্ডের গ্রাফটিং করা থাই আম ‘ই টু আর টু’। আছে চার কেজি ওজনের আম ‘ফোর কেজি’। বিদেশি ‘গোল্ডেন বল’ ক্যাকটাসের দাম লাখ টাকার মতো। আরও আছে থাইল্যান্ড থেকে আনা ক্যাকটাস। বিক্রেতারা জানান, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং যত্নে খরচ বেশি, তাই দামও বেশি।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, মা-বাবার সঙ্গে শিশুরাও এসেছে। তারা বেশ আগ্রহ নিয়েই বিভিন্ন ধরনের গাছ দেখছে। গাছের ঝুলে থাকা ফল তাদের আনন্দ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মেলায় দেখা গেছে, মালয়েশিয়ার মিল্ক কোকোনাট, গন্ধযুক্ত সাদা রঙের অ্যারোমেটিক জুঁই, মিসরীয় ডুমুর, থাই সফেদা, থাই পদ্ম, আমাজন লিলি, প্যারাডাইস, পয়েন, সৌদি খেজুরগাছ, গোল্ডেন বোতলব্রাশ আরও অসংখ্য রকমের গাছ। আছে পিচ, ডেউয়া, হানি ডিউ, চায়নিজ মাল্টা, থাই শসা। আরও আছে হরেক রকমের লতা ও গুল্মজাতীয় গাছ। হরেক রঙের এবং দামের ক্যাকটাস, অর্কিড, ঔষধি গাছ মিলবে মেলায়। আছে ঝুমকোলতা (থাই ফ্যাশন ফ্লাওয়ার), জুঁই, কামিনী, ক্যামেলিয়া ফুলের গাছ। ফলের মধ্যে আছে আমলকী, পেয়ারা, লেবু, জাম্বুরা, আমড়া, কামরাঙাসহ হরেক রকমের দেশি-বিদেশি ফল। এগুলোর দাম শুরু হয়েছে ১০০ টাকা থেকে। তবে যেসব গাছে ফল ধরেনি, সেগুলোর দাম আরেকটু কম।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) স্টলে আছে বিলুপ্তপ্রায় নাগলিঙ্গম, মহুয়া, পলাশের চারাগাছ। মেলায় পাওয়া যাচ্ছে সাওয়ারসপ (টক আতা), গাইনুরা, মিসরীয় ডুমুর, ভ্যানিলা অর্কিড, নীল গাছ, চুইঝালগাছ, জয়তুনগাছ (জলপাই)। এগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশি জাতের আমগাছের চারা পাওয়া যাচ্ছে। ঘাসও কেনা যাবে মেলা থেকে।
নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দায় ছোট মসলার বাগান করবেন আশা বারী। নিজের ছোট্ট সন্তানকেও এই কাজে যুক্ত করবেন। তার জন্য বিভিন্ন ধরনের মসলার গাছের চারা কিনছেন। একটি মসলার গাছ কিনবেন বলে দরদাম করছেন। লিভিং আর্ট নামের একটি স্টলে সালমা শিরিন সেই গাছের দাম হাঁকছেন। সালমা শিরিন জানালেন, এই গাছের পাতা যেকোনো মাংস রান্নার সময় ছিঁড়ে দিলে তা মসলার কাজ করবে।
মেলায় আছে মডেল সুন্দরবন। ‘সুন্দরবন কর্নার’ নামের ওই মডেল বন তৈরি করেছে বন বিভাগ। সেখানে বটগাছে ঝুলছে মাটির বানর। আরও আছে মাটির তৈরি বাঘ, চিত্রাহরিণ, কুমির ও বক। আছে কৃত্রিম নদীও। নদীর পাড়ে নৌকায় রাখা শুকনো গোলপাতার ডাল।
গত শনিবার মেলায় গাছ কিনতে আসা মানুষের বেশ ভিড় দেখা গেছে। দর্শনার্থীদের প্রায় সবাইকে এক বা একাধিক গাছের চারা নিয়ে মেলা থেকে বের হতে দেখা যায়। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ জানান, মেলার প্রথম দিনে ১৪ হাজার ২২৮টি চারা বিক্রি হয়েছে ২২ লাখ ২৮ হাজার ৫০২ টাকায়।