১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সময় যেসব ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের ও তাদের বংশধরদের নিজ পিতৃভূমিতে ফেরার অধিকারের বিষয়টি দীর্ঘকাল ধরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের সবচেয়ে দুর্দম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন অবশেষে এটি সমাধান করার জন্য উদ্যোগী হলো ঠিকই, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাদের সব পদ্ধতি ভুল।
ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার এবং তাঁর আইনজীবী ও ইসরায়েলবিষয়ক উপদেষ্টা জেসন গ্রিনব্লাটের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাম্পের টিম ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুরা যে যেখানে আছে, সেখানেই তাদের পুনর্বাসিত করতে চায়। একই সঙ্গে তারা চায় ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থাকে (ইউএনআরডব্লিউএ) বিলুপ্ত করতে। এ লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে এই সংস্থায় সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। সংস্থাটি ১৯৪৯ সাল থেকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তা দিয়ে আসছে। নিঃসন্দেহে এই পরিকল্পনায় ইসরায়েলের সমর্থন রয়েছে। তবে এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের চাহিদা, স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী।
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য হবে একটি বড় আঘাত। ইউএনআরডব্লিউএ গাজা, পশ্চিম তীর, জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় বসবাসরত ৫০ লাখ নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা প্রদান করে আসছে। ইউএনআরডব্লিউএ বিলুপ্ত হলে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া ট্রাম্পের পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে ইসরায়েলের যে দায়িত্ব রয়েছে, তা থেকে তাদের সরে আসার সুযোগ দেবে, যা কি না আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
জাতিসংঘের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের ওই প্রস্তাব ইসরায়েলসহ বিশ্বের সব দেশ মেনে নিয়েছিল। জাতিসংঘের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যেসব ফিলিস্তিনি শরণার্থী নিজ দেশে ফিরতে চায়, তাদের সহায়তা দিতে হবে। এ ছাড়া যারা ফিরতে চায় না, তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আসার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাই ফিলিস্তিনি শরণার্থী সমস্যার যেকোনো সমাধানের জন্য ইসরায়েলকে অবশ্যই তার ‘নৈতিক ও ঐতিহাসিক’ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু সেই দেশে ফিরতে আগ্রহী নয়, যা কার্যত ইসরায়েলের অধীনে একটি রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তি অনুসারে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে, যেটির নাম হবে ‘দ্য নিউ প্যালেস্টাইন’ বা ‘নতুন ফিলিস্তিন’ এবং যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলের হাতে। কিন্তু ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুরা ১৯৬৭ সালের আগের সীমানার ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেম বা আল কুদসকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে।
ট্রাম্প প্রশাসন এর তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনাটি এই মাসে বাহরাইনে অনুষ্ঠিত ‘অর্থনৈতিক কর্মশালায়’ ফিলিস্তিনের ব্যবসায়ী নেতাদের কাছ থেকে সমর্থন লাভ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি সরকার এই পরিকল্পনাকে ইতিমধ্যে বাতিল করেছে। ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ বলেছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে ‘রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল বন্ধ করা এবং আমাদের জনগণের অধিকারকে উপলব্ধি করা।’
ট্রাম্প প্রশাসনের এখনো ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের নতুন কিছু বের করার সময় রয়েছে। কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা বলেছেন, এমন একটি উপায় গ্রহণ করা উচিত, যা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং ফিলিস্তিনিদের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করে।
১৯৪৯ সালের মে মাসে জাতিসংঘ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং সেখানে ইসরায়েলকে সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জাতিসংঘের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাব বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাডহক কমিটিকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করায় ইসরায়েলকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করার পরিবর্তে ইসরায়েল সাত দশক ধরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সমর্থন করা সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের সমাধান চায়, তাহলে তাদের উচিত হবে প্রায় ২০ বছর আগে ফিলিস্তিনি আলোচকেরা যে সমাধান মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন, সেই সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া এবং ইসরায়েলকে একই কাজ করতে তাগিদ দেওয়া। তাদের উচিত ইউএনআরডব্লিউএর কাজকে দুর্বল করার পরিবর্তে সমর্থন করা।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত