এমএম রহমাতুল্লাহ: এপ্রিল থেকে বিমানের জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করেছে তেল কোম্পানিগুলি। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বিমানের যাত্রীদের ওপর। ঈদ এবং সামার হলিডে মরশুমে চড়া মূল্য দিয়ে টিকিট কাটতে হতে পারে। ঈদ এবং সামার হলিডে মরশুমে প্রতি বছর বিমানের টিকিটের চাহিদা খুব বেশি থাকে।অন্যদিকে বায়রা সম্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বায়রা সভাপতি বেনজীর আহমেদ বলেন, সিন্ডিকেট চক্রের কারণে বিমানের টিকিটের দাম দ্বি-গুণ বাড়ছে। এতে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে। বিমান ভাড়া বৃদ্ধি রোধকল্পে ওপেন স্কাই নীতি দ্রুত ঘোষণা করতে হবে। বিমান ভাড়া বৃদ্ধির কারণে অভিবাসন ব্যয় স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হচ্ছে না।মধ্যপ্রাচ্যসহ ১০টি এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। গামকার মেডিকেল সেন্টারগুলোও কর্মীদের মেডিকেল ফি আরো ৫ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে সর্বমোট সাড়ে ৮ হাজার নির্ধারণ করেছে। তিনি আরো বলেন, বিমানের টিকিট সংকট নিরসন করা সম্ভব না হলে শ্রমবাজারের ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। মাত্রাতিরিক্ত বিমান ভাড়া বৃদ্ধি অভিবাসন ব্যয়কে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনতিবিলম্বে মধ্যপ্রাচ্য মুখী বিমানের আসন সংকট দ্রুত নিরসন ও অতিরিক্ত ভাড়া কমিয়ে আনা সম্ভব না হলে জনশক্তি রফতানি এবং রেমিটেন্স আয়ের ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যসহ ১০টি এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর উড়ানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আর চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ফারাকে টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া। ভবিষ্যতে এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর বিমান গ্রাউন্ড করলে, পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্পট ফেয়ার হিসেবে বেশি ভাড়া দিয়ে টিকিট কাটতে বাধ্য হবেন যাত্রীরা।
এদিকে জ্বালানির খরচ বৃদ্ধির ফলে পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাবে জানিয়ে বাংলাদেশ বিমান বলছে এ অবস্থায় টিকেটের মূল্য বৃদ্ধি করা না হলে রাষ্ট্রীয় এ বিমান সংস্থার লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে মনে করেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শাকির মেরাজ। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের যে বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো রয়েছে, তারা যে মূল্যে তেল কেনে তার চেয়ে আমাদের বেশি খরচে তেল কিনতে হয়। তেলের দাম বাড়লেও আমরা টিকিটের দাম বাড়াতে পারি না।’ বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক রুটে এখনও ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বিদেশি বিভিন্ন বিমান সংস্থা। সেখানে জেট ফুয়েলের আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য না করে উল্টো দাম বাড়ানোর ফলে দেশিয় বিমান সংস্থাগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
এয়ারলাইন্স অপারেটরর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ উপদেষ্টা এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য তেলের দাম, আর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য তেলের যে দাম তার ভেতর অনেক পার্থক্য। অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটের জন্য জ্বালানির দাম বেশি পড়ে। বেসরকারিভাবে যদি তেল আমদানি করা হয়, তাহলে একটা প্রতিযোগিতা আসবে।’
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় বাংলাদেশ থেকে গেল বছর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রুটে আকাশ পথে ভ্রমণ করেছেন প্রায় ১২ লাখ যাত্রী। যা কয়েক বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
দেশীয় রুটেও টিকিটের দাম গগনচুম্বী
শুধু আন্তর্জাতিক রুটে নয়, ডমেস্টিক রুটেও টিকিটের দাম এখন আকাশছোঁয়া। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশের মানুষের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। তাই ঈদকে সামনে রেখে আকাশপথে টিকিটের দাম গগনচুম্বী। সাধারণত বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চের মতো হাঁকডাক করে আকাশপথের টিকিট বিক্রি হয় না। দিনক্ষণ নিয়ে আগে থেকে ঘোষণাও থাকে না। কাউন্টারের সামনে থাকে না টিকিট প্রত্যাশীদের প্রচণ্ড ভিড়। ঈদের সময় আকাশপথে উড়োজাহাজের টিকিট বেশ নীরবেই বিক্রি হয়। তবে নীরবে বিক্রি হলেও আকাশপথে ঈদের টিকিটের জন্য তোড়জোড় বেশ আগেভাগেই শুরু হয়। তাই ঈদুল ফিতরের সময়ের প্রায় ৮০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়ে যায় আগেভাগে। বাকি অবিক্রীত টিকিটের নাগাল পেতে ঈদে মূল্য দিতে হবে তিন গুণ।
ঈদুল ফিতর নয়, তিন মাস পর আগস্ট মাসে কোরবানির ঈদের সময়ের টিকিটের দামও এরই মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সড়কপথে যানজট, রেলপথে বিলম্বিত যাত্রা, নৌপথে ঝুঁকিসহ নানা দুর্ভোগ এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের জন্য আকাশপথকে বেছে নিচ্ছেন ঈদে ঘরমুখী মানুষেরা। তা ছাড়া আকাশপথে সময়ও বাঁচানো যায়। এ সময় প্রবাসীরাও দেশে ফিরে আপনজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। তাই ঈদের টিকিট কেনার কাজটি আগেভাগেই শুরু হয়। অনলাইনে ঝটপট বুকিং, তারপর সুবিধামতো ব্যাংকের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সহজেই আকাশপথের টিকিট মিলে যায়। এবারের ঈদের সময় পড়েছে টানা ছুটি। ৩১ মে ও ১ জুন শুক্র-শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি। ২ জুন রোববার শবে কদরের ছুটি। ৩ জুন সোমবার অনেকেই ঐচ্ছিক ছুটি নিতে পারেন। ৪ জুন মঙ্গলবার (২৯ রমজান) থেকে ৬ জুন বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতরের তিন দিনের ছুটি পড়ছে। এর পর আবারও ৭ ও ৮ জুন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। সে কারণে ৩০ মে ও ৩ জুনের টিকিটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তাই টানা নয় দিনের ছুটি কাজে লাগাতে ঘরমুখী মানুষেরা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলেছেন। দেশের বিমান সংস্থাগুলো ঈদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলোকে সামনে রেখে প্রায় এক বছর আগে থেকে টিকিট বিক্রির কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে। তাদের মতে, ঈদের সময়টা সবারই জানা থাকে। এক দিন এদিক-ওদিক হতে পারে। তাই টিকিট বিক্রিও শুরু হয়ে যায় আগেভাগেই। যাত্রীরা সুবিধাজনক সময়ে বিমান সংস্থাগুলোর বিক্রয়কেন্দ্র ও বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি থেকে টিকিট কিনে থাকেন। অনলাইনে ক্রেডিট কার্ড ছাড়াও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টিকিট কিনে থাকেন অনেক যাত্রী। তাই এবারের ঈদের আগে ৩০ মে থেকে ৪ জুনের নিয়মিত ফ্লাইটগুলোর বেশির ভাগ টিকিট কয়েক মাস আগেই বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথা।
ঢাকা থেকে অভ্যন্তরীণ সাতটি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইউএস বাংলা, নভোএয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। এর মধ্যে রিজেন্টের উড়োজাহাজ কেবল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে চলাচল করে। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে চারটি বিমান সংস্থার ৩০ মে থেকে ৪ জুনের টিকিটের দাম তিন গুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই কেউ সৈয়দপুর বা যশোর রুটের একটি টিকিট কিনতে চাইলে তাঁকে সাত থেকে আট হাজার টাকা গুনতে হবে। যাত্রী চাহিদা থাকায় তাই এখন অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করবে দেশের বিমান সংস্থাগুলো।
বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস ৩০ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ছয় দিনে নিয়মিত ফ্লাইটের পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্ধশত ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছে। ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পিআর) কামরুল ইসলাম বলেন, চাহিদা বেশি থাকায় কম দামে বা লো অফারে কখনোই টিকিট মিলবে না। আসলে ঈদের সময় ঢাকা থেকে যাত্রী পূর্ণ করে ছাড়ছে। কিন্তু ফ্লাইটগুলো ফিরবে একেবারে ফাঁকা। হিসেবের সময় তাই ফিরতি ফ্লাইটের হিসাবটাও থাকে।
নভোএয়ার ঈদের আগে ছয় দিনে অতিরিক্ত ৩০ টি ফ্লাইট পরিচালনা করতে যাচ্ছে। নভো এয়ারের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) এ কে এম মাহফুজুল আলম বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন ঈদের সময় ২১শ যাত্রী বহন করতে পারব। তবে ঈদ শেষে ফিরতি টিকিটের চাহিদাও রয়েছে। ফিরতি টিকিটের চাহিদা একটু বেশি। কারণ ঈদ শেষে সবাই একসঙ্গে ঢাকায় ফিরতে চান।’
রিজেন্ট এয়ারওয়েজ সুপরিসর উড়োজাহাজ দিয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। তাই তারা আপাতত কোনো অতিরিক্ত ফ্লাইট দিচ্ছে না। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আখতার ইউ আহমেদ বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে ৩০ মে থেকে টিকিটের চাহিদা বেশি। এ সময়ের বেশির ভাগ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রুটে অতিরিক্ত ফ্লাইট থাকছে না। তবে এ সময় এই রুটগুলোতে আমাদের বড় এয়ারক্রাফট চলবে।’
ঈদের সময় ঢাকা ও রাজশাহী রুটে অতিরিক্ত ফ্লাইট দিতে যাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এ ছাড়া প্রবাসীরা দেশে ফিরবেন বলে ২ জুন কুয়ালালামপুর, ৩ জুন জেদ্দা ও দাম্মাম এবং ৪ জুন কুয়ালালামপুরে অতিরিক্ত একটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করবে বলে জানান বিমানের মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ রুটে প্রতিদিন ৪টি বিমান সংস্থার প্রায় ১০০টি ফ্লাইটে ছয় হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত ফ্লাইট থাকায় এ সময় যাত্রী চলাচল বেড়ে যাবে। বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রায় ৪০ হাজার যাত্রী আকাশপথে ঢাকা ছাড়বেন।