উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের গল্প

সালাহউদ্দীন আহমাদ: চাহিদার তুলনায় ২৫ লাখ টন ঘাটতি নিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ১ কোটি টনের মতো চাল উৎপন্ন হতো। সরকারী হিসেবে গত ৪৫ বছরে খাদ্যশস্য বা ধান উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৭-১৮ সময়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৩ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানের কারণে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশকে হঠাৎ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবী তোলে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর খাদ্যশস্য উৎপাদনের তথ্যেও অনেক অস্বাভাবিকতার উল্লেখ রয়েছে, যা ব্যাখ্যা করা কঠিন। বিবিএসের হিসেবে গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে দেড় কোটি টন, যা গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হারে ৩ দশমিক ১২ শতাংশ। এ ২০ বছরের মধ্যে মাত্র ৪টি অর্থবছর ১৯৯৯-২০০০, ২০০০-০১, ২০০৯-১০ ও ২০১৩-১৪ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ে ১ কোটি ৪২ লাখ টন। বাকী ১৬ বছরে মোট নীট বৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৭ লাখ টন। যার হিসেব মেলানো কঠিন। ২০০৯-১০ সালে ৫৬ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিরাট উল্লম্ফনেরও বিশ্বাসযোগ্যতা কম। অন্য তিন বছরের অলৌকিকতার ব্যাখ্যা আরো দুর্বল। ১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০০০-০১ সময়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫৫ লাখ টন (২২.৭%) যার মধ্যে চাল উৎপাদন বেড়েছে ৫২ লাখ টন (২৬%)। ২০১৩-১৪ সালের একটি অর্থবছরেই খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে ৩৫ লাখ টন (১০.৮%) এবং চাল উৎপাদন বেড়েছে ৩৪ লাখ টন (১১.১%)। এ তিন বছরের বার্ষিক উৎপাদনের মোট বৃদ্ধি ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত ২০ বছর সময়ের মোট বার্ষিক বর্ধিত উৎপাদনের ৫৮ শতাংশ। আর এ বছরগুলোয় খাদ্যশস্য উৎপাদনের এই বিরাট উল্ল¬ম্ফন হয়েছে ফসলি এলাকা বা অন্য কৃষি উপাদান জোগানের উল্লেখযোগ্য কোনো বাড়-বৃদ্ধি ছাড়াই। উভয় সময়ে এ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে সাধারণ নির্বাচনের আগে, যখন সরকার পরিচালনায় ছিল আওয়ামী লীগ। যদি খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে, তাহলে খাদ্য আমদানী কমে আসার কথা। বাস্তবে এদেশে ঘটেছে উল্টোটা। অবিশ্বাস্যভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সর্বোচ্চ বৃদ্ধির পরও কোন কোন বছরে বাংলাদেশে অত্যধিক খাদ্য আমদানী ঘটেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে আমদানী করা হয় ৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য, যখন উৎপাদন হয়েছিল ২ কোটি ৭৩ লাখ টন। পরের বছর উৎপাদন ৫৬ লাখ টন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ২৯ লাখ টনে। কিন্তু আমদানীও বেড়ে হয় ৩৫ লাখ টন। চার বছর পরও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ২০১২-১৩ সময়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন ৩ কোটি ২২ লাখ টন এবং খাদ্য আমদানী ১৯ লাখ টন। পরের বছর খাদ্য উৎপাদন ৩৫ লাখ টন বেড়ে হয় ৩ কোটি ৫৭ লাখ টন। পাশাপাশি আমদানীও ৬৩ শতাংশ বেড়ে হয় ৩১ লাখ টন। ২০১৩-১৪ থেকে বাংলাদেশের কৃষিতে উন্নয়ন অনেকটাই থমকে আছে এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন স্থবির হয়ে রয়েছে। আর আমদানীর প্রয়োজন উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ২০১৬-১৭ সময়ে খাদ্যশস্য আমদানী ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা বন্যাকালীন ১৯৯৮-৯৯ সময়ের উচ্চ আমদানীকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালের পূর্ণ আমদানীর চিত্র পাওয়ার পর এটিও ক্ষুদ্র হয়ে যায়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর চাল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া সত্তে¡ও খাদ্যশস্য (গমসহ) আমদানী বেড়েছে বিশাল আকারে, ৯৮ লাখ টন। এই বছরের শুধু আমদানীই এককভাবে স্বাধীনতা-পরবর্তী এক বছরের পুরো খাদ্য উৎপাদনকেও ছাড়িয়ে গেছে।২০১৬-১৭ পর্যন্ত ঘাটতির রেকর্ড হলো ১৯৯৮-৯৯ সালে খাদ্য উৎপাদনের ২৫ শতাংশ পরিমাণ আমদানী। গত ২০ বছরে আমদানীর হার যেভাবে বেড়েছে, তাতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবী যথেষ্ট সন্দেহ তৈরী করেছে। সবচেয়ে বেশী চাল আমদানীকারক দেশের তালিকায় ২০১৭-১৮ বছরে প্রথমদিকে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে বৈশ্বিক খাদ্যশস্যের বাজার বর্তমানে সংকটময় নয়।তাই চাল ও গম সাশ্রয়ী মূল্যে কেনা যাচ্ছে, যা পেমেন্ট ব্যালান্সের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলেনি। তবে সবসময় এমন ভাগ্যের ওপর দেশ নির্ভর করতে নাও পারে।

‘উদ্বৃত্ত’ ধান-চালেও বেশুমার আমদানী

বাংলাদেশে সরকারী হিসেবে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন চাল উৎপন্ন হয়। এই হিসেবে দেশে এখন চাহিদার তুলনায় বেশী ধান-চাল রয়েছে। যা প্রায় ৪০ লাখ টন। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, সরকারীভাবেই গত এক বছরে ২ লাখ টন চাল আমদানী হয়েছে এবং এলসি খুলে বেসরকারীভাবে আমদানীর পাইপলাইনে রাখা রয়েছে আরও প্রায় ৪ লাখ টন চাল। ২০১৭ সালের মে মাসে হাওরে আগাম বন্যায় ফসলহানীর পর সরকার চালের আমদানী শুল্ক উঠিয়ে দেয়। সরকার থেকে তখন বলা হয়েছিল, এই ক্ষতির ফলে ঘাটতি হবে ১০ লাখ টন চালের। কিন্তু গত দু’ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানী হয়েছে। গত নভেম্বরে সরকার ২৮ শতাংশ আমদানী শুল্ক পুনর্বহাল করে। এতে চাল আমদানী কমলেও বন্ধ হয়নি। উৎপাদনের সরকারী হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৩০/৪০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত। কৃষি মন্ত্রণালয় এই বাড়তি চাল রপ্তানীর বিষয়টি বিবেচনা করছে। তারপরেও এমন পরিস্থিতিতে কেন দেশে চাল আমদানী হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।ডলারের সাথে টাকার নি¤œ বিনিময় হারও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে মন্তব্য করে তারা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু ভারত থেকে বৈধ পথেই ২৫ লাখ টন চাল এসেছে বাংলাদেশে। এর প্রায় সবই নন-বাসমতী। এই চাল আমদানীতে বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। এর পাশাপাশি চাল আসছে অবৈধ পথেও। এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ভারতীয় অর্থবছরের সরকারী হিসেবে ২০১৭-১৮ সময়কালে দেশটি থেকে বাংলাদেশে চাল (বাসমতী ও নন-বাসমতী) রফতানী হয়েছে ২১ লাখ টন।অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানী হয়েছে ৪ লাখ টন। সব মিলিয়ে দুই অর্থবছরের ২১ মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশে চাল আসে ২৫ লাখ টন। চালের এই আমদানী প্রসঙ্গে সাবেক কৃষি সচিব ড. আনোয়ার ফারুক বলেন, চাল আমদানি উন্মুক্ত রেখে কৃষকের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ সাংঘর্ষিক। গত আমন মৌসুমে যখন বাম্পার ফলন হলো, তখনই উচিত ছিল চাল আমদানি বন্ধ কিংবা আরো উচ্চ শুল্কারোপ করা, কিন্তু সেটি করা হয়নি। কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দেশে উৎপাদন কমে গেলে আমদানী শুল্ক শিথিল করা যেতে পারে। আমনের পর বোরোতে পরপর দুই মৌসুম ভালো ফলনের কারণে চাল আমদানীর ব্যাপারে এখনই কঠোর হতে হবে। তা না হলে কৃষক যে বোরো ধানের দাম পাচ্ছেন না, তা আরো জটিল আকার ধারণ করবে। ভবিষ্যতে কৃষক চাল উৎপাদন থেকে সরে গেলে হুমকিতে পড়তে পারে খাদ্যনিরাপত্তা।

ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও চালের আমদানী নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের শেষদিকে আমদানী শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এর সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) যোগ হয় ৩ শতাংশ। ফলে চাল আমদানিতে সব মিলিয়ে ২৮ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর প্রভাবে পরের দেড় বছর চাল আমদানী কমে যায়। কিন্তু ২০১৭ সালের মে মাসে পাহাড়ি ঢলের কারণে হাওড় অঞ্চলে সৃষ্ট আগাম বন্যায় ফসলহানীর পর সরকার চালের আমদানী শুল্ক উঠিয়ে দেয়। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বাকীতেও (ডেফার্ড পেমেন্ট) চাল আমদানীর সুযোগ করে দেয়। এর ফলে ব্যাপকভাবে চাল আমদানী শুরু হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেই সরকারী-বেসরকারীভাবে ৪০ লাখ টনের বেশী চাল আমদানি করা হয়। তার আগের বছর ২০১৬-১৭ সালে আমদানী করা হয়েছিল সাড়ে ১৩ লাখ টন। অবস্থানগত কারণেই আমদানীর প্রায় পুরোটা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। গত বছরের শেষদিকে সরকার চাল আমদানীতে আবার ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহাল করলে চাল আমদানী কিছুটা কমলেও বন্ধ হয়নি। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৬ লাখ টন চাল আমদানীর এলসি খোলার বিপরীতে এরই মধ্যে দুই লাখ টন দেশে এসে গেছে এবং আরও ৪ লাখ টন পাইপলাইনে রয়েছে। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও চাল আমদানীকে অস্বাভাবিক মন্তব্য করে বলেছেন, বাড়তি আমদানীসহ কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছে ধান-চালের উচ্চ মজুদ বর্তমানে ধানের দাম নিয়ে সংকটকে জটিল করে তুলেছে।তাই কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সরকার চাল রফতানীর বিষয়ে ভাবছে বলে জানান তিনি। দেশের খাদ্য চাহিদায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাড়তি চাল রফতানীর উদ্যোগ নিলে কৃষক ন্যায্য দাম পাবে উল্লেখ করে তিনি জানান, চলতি বোরো মৌসুম শেষ হলেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, এ মুহূর্তে চাল রফতানী করা সম্ভব নয়। তবে দেশে চাল আমদানীতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যেতে পারে। চাল রফতানী করতে হলে ভর্তুকি দিতে হবে মন্তব্য করে মুস্তফা কামাল বলেন, এ বছর আনইউজুয়ালি আমরা অনেক বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পেরেছি। আমাদের যেমন বেশী উৎপাদন হয়েছে, আশপাশের দেশেও তেমনি খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে। বাইরে যদি চাহিদা থাকতো, আমরা রফতানী করতাম। বাইরেও চাহিদা নেই। তারপরও দেশের কৃষকদের বাঁচাতে চাল আমদানী হয়তো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, কিন্তু একেবারে বন্ধ করা যাবে না। ভর্তুকি দিয়ে সবজি রফতানি করায় সবজির বাড়তি উৎপাদনের সমস্যা কমেছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার সবজি রফতানীতে ২০% ভর্তুকি সহায়তা বা প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। এর কারণে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চার নম্বরে।রফতানী করার কারণে এর বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। সবজিতে অন্তত দামটা পাচ্ছে কৃষকরা। একইভাবে চালও ভর্তুকি দিয়ে রফতানি করতে হবে। যা বাংলাদেশের জন্য কঠিন।

আর করবো না ধানচাষ, দেখবো তোরা কি খাস

বাংলাদেশের কৃষক এবার শ্লোগান দিতে শুরু করেছে “আর করবো না ধানচাষ, দেখবো তোরা কি খাস”। ধারণা করা যায়, এর পরিণতিতে শিগগিরই এদেশের কৃষিতে কর্পোরেট ঢুকে যাবে। তখন সস্তা চালের মজা জনগণ টের পাবে। কারণ বর্তমানে প্রতিবিঘা জমিতে চাষ দিতে কৃষকের ২ হাজার টাকা, চারা বাবদ ৫শ’, সেচ বাবদ ২ হাজার, রোপণের জন্য শ্রমিক মজুরি ২ হাজার, নিড়ানি বাবদ ১ হাজার, সার বাবদ দেড় হাজার,কীটনাশক বাবদ ৫শ’ এবং কাটা-মাড়াইয়ে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া এক মৌসুমের জন্য জমির লীজমূল্য ৪ হাজার টাকা এবং বীমা খরচ আরো ২ হাজার টাকা। আছে ঋণের সুদ। জমির অবচয় ২ হাজার টাকাসহ ৪ মাসে নিজের মেধা ও শ্রম কমপক্ষে আরো ৪ হাজার টাকা যোগ করলে সবমিলিয়ে এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে কৃষকের ২৭ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। কমপক্ষে ৫০% লাভ ধরলে তার এই বিনিয়োগ থেকে ৪০ হাজার টাকা তুলে আনা দরকার। এক বিঘা বোরো জমিতে গড়ে ধানের ফলন হয় ১৬ থেকে ১৮ মণ। বর্তমানে বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৪৫০ টাকায়। এ হিসেবে এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিঘাপ্রতি কৃষককে প্রায় ৩২ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে। জমি বর্গা নেয়া কৃষকদের উৎপাদিত ধানের অর্ধেক মালিককে দিয়ে দিতে হয়। এ কারণে তাদের লোকসান আরো বেশী। এ ব্যাপারে কৃষি কর্মকর্তারা জানান, প্রতি বছরই বোরোর ভরা মৌসুমে বাজারে ধানের দাম কম থাকে। তবে মৌসুমের শেষের দিক থেকে দাম বাড়তে শুরু করে। কৃষকরা কষ্ট করে ধান কিছুদিন ধরে রাখতে পারলে তখন কিছুটা বেশী দাম পাবেন। কিন্তু মাড়াইয়ের সাথে সাথে ধান বেচতে না পারলে কৃষকের যে ভাত জোটে না, তা তারা জানেন না। ধারদেনা করে তাঁরা যে জমি বর্গা বা লীজ রাখেন, বীজ,সার ও কীটনাশক কেনেন, কলের লাঙল, পানি, নিড়ানির দাম মেটান; তা সুদে-আসলে শোধ করতে হয় ফসল ওঠার সাথে সাথে। এই সহজ হিসেবটা ধানের মূল ক্রেতা আড়তদার-পাইকার-মিলাররা জানেন বলেই ধান উঠলে তারা হাত গুটিয়ে নেন। কৃষক বাধ্য হন কম দামে ধান ছেড়ে দিতে। লোকসানি দামে না বেচে হাট থেকে ধান বাড়ীতে ফিরিয়ে নেয়ার মতো গাড়িভাড়াও তার থাকে না। তাই বাধ্য পাইকার-আড়তদারের হাওলায় রেখে যেতে হয় রক্ত-ঘামে ভেজা ধান। আবার লোকসানী দামে ধান বেচে বেশী দামে চাল কিনে খেতে হয় কৃষককে। “ধানের বাজার মন্দা কেন?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাংবাদিকরা দেশের অন্যতম ধান উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ এলাকা নওগাঁর ধান-চাল পাইকার সমিতির সভাপতি নীরদবরণ সাহার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, ধানের অতিরিক্ত ফলন হওয়ায় আড়তে-গোলায় ধান রাখার জায়গা নেই। তার ওপর বাজার-ভরা আমদানীকৃত ভারতীয় চাল। তাই পাইকাররা আর ধান কেনার সাহস পাচ্ছেন না। মিলারদের কাছেও এখন ধানের চাহিদা কম।কারণ গত দু’বছর ধরে বৈধ-অবৈধ পথে ভারত থেকে রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানি করে সব গুদাম-আড়ত ভরে রাখা হয়েছে। এখন বাজারে ক্রেতা নেই, তাই দামও নেই। এতে পাইকারদের কি করার আছে? তারা বাজারের দাস মাত্র। নীরদবরণ সাহা তার ভাষায় সরাসরি এই জবাবই তুলে ধরেন। বাংলাদেশের ধান-চালের পুঁজির মালিক আড়তদার, পাইকার, চাতাল-মিলার আর তাঁদের রাজনৈতিক দোসররা।ফলে তাদের হাতেই এখন বাজার। এই বাজার অর্থনীতির ধকল সামলানোর কোমরের জোর কৃষকদের নেই।

এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বোরো ধানের অস্বাভাবিক দর পতনের (সাড়ে ৪শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা মণ) খবর এরই মধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। দেশে চালের কথিত উচ্চ মূল্যের হারে এই দর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর প্রতিবাদে টাঙ্গাইলে ধান না কেটে এরই মধ্যে জমিতেই পুড়িয়ে ফেলার খবরও পাওয়া গেছে। লোকসান দিতে দিতে নিঃস্ব কৃষক এ বছরের মতো এতো কঠিন বিপদে আর কখনো পড়েনি বলে জানিয়েছে। তারা এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার একজন চালকল ব্যবসায়ী।যেখানে ৩০ হাজার ছোট-বড় চাতাল ও চালকল ব্যবসায়ী সিÐিকেটের হাতে কৃষক জিম্মি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বাজারে এক কেজি মোটা চালের দাম যেখানে সর্বনি¤œ ৪০/৪২ টাকা, তখন এক কেজি ধান বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ ১৫ টাকারও নীচে। এই হিসেবে বাজারে এক কেজি চালের দাম হওয়া উচিৎ বড়জোর ২০/২২ টাকা। মণের (৪০ কেজি) হিসেবে এক মণ ধানের দাম সর্বোচ্চ পাঁচশ’সাড়ে পাঁচশ’ টাকার বেশী বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না। যখন জমি ও উৎপাদকের শ্রমের হিসেব ছাড়াই সরকারীভাবে ২০১৮ সালে এক মণ ধানের উৎপাদন খরচই ধরা হয়েছে সর্বনি¤œ সাড়ে ৯শ’ থেকে ১২শ’ টাকা (উৎপাদনের হার ভেদে)। গতবছর বোরো মৌসুমের শুরুতে কৃষক এই ধানের দাম পেয়েছিল গড়ে সাড়ে ৭শ’ থেকে সাড়ে ৮শ’ টাকা মণ। পরে সরকার চালের দাম নির্ধারণ করে ৩৮ টাকা কেজি এবং ধানের দাম সর্বনি¤œ ২৬ টাকা কেজি বা ১ হাজার ৪০ টাকা মণ। তবে এটি শুধু সরকারীভাবে ধান কেনার ক্ষেত্রে। যার পরিমাণ সারাদেশে দেড় লাখ টনের মতো। অর্থাৎ এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের (প্রায় পৌণে ৫ কোটি টন) শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ। যদিও ভারতে এটি ১৫ শতাংশের মতো এবং কৃষকের স্বার্থে বর্তমানে তা ২০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা ভারত সরকার নিয়েছে। আর জাপান-কোরিয়াতে কৃষকের শতভাগ ধানই সরকার উচ্চমূল্যে কিনে নিয়ে পরে মিলিং করে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে ছাড়ে।

সরকারী ধান-চাল সংগ্রহে কৃষকের লাভ নেই

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক স্বীকার করেছেন সরকারি ধান-চাল সংগ্রহে এদেশে কৃষকের কোনো লাভ হচ্ছে না। এখানে রাজনৈতিক চাপ আছে।এখন কৃষককে লাভবান করতে তিনি ধান-চাল রপ্তানির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। তবে যেভাবে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য আমদানী হচ্ছে, তাতে তার এই পরিকল্পনা ধোপে টেকে না। বাংলাদেশের পক্ষে চাল রপ্তানী করা আদৌ সম্ভব নয়। দেশকে খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেখানোর জন্য বছর পাঁচেক আগে আওয়ামী লীগ সরকার শ্রীলংকায় মাত্র ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানী করেছিল। সেটাই শুরু এবং শেষ। তারপরে আর সম্ভব হয়নি।  কৃষিমন্ত্রী বলেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ ছিল। প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশকে খাদ্য আমদানি করতে হতো এবং বিদেশী খাদ্য সাহায্যের উপরও নির্ভরশীল থাকতে হতো। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাবিøউএফপি) থেকে বাংলাদেশ নব্বুইয়ের দশক পর্যন্ত বছরে গড়ে ২০ লাখ টন করে বিনামূল্যের খাদ্য সহায়তা পেয়েছে। বর্তমান সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ঘোষণা করে এই বিদেশনির্ভরতা বন্ধ করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে সেটি আর ধরে রাখতে পারেনি কোনো সরকার। ২০০৮ সাল পর্যন্ত উৎপাদন তেমন বাড়েনি। প্রতিবছরই খাদ্য ঘাটতি ছিল। মঙ্গাপীড়িত এলাকা, উপকূলীয় জেলা এমনকি হাওড় এলাকায় খাদ্য ঘাটতি বেশী হয়।গতবছর কিছুটা চাল আমদানি করতে হলেও, ২০১১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে সরকারীভাবে চাল আমদানি করছে না। সরকার মানুষকে এখন পুষ্টিজাতীয় ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে চায়। জনগণের জন্য পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ ও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করা হবে। রফতানি না হওয়ার কারণে কৃষিপণ্যের বাজার ও মূল্য স¤প্রসারণ হচ্ছে না দাবী করে মন্ত্রী বলেন, এর ফলে কৃষক তার ধানের ন্যায্যমূল্য পেতে পারে। তিনি আরো বলেন, ধান উৎপাদন এ মুহূর্তে তেমন লাভজনক নয়। সংকটটা হলো যদি ধান ও চালের দাম বাড়ে তাহলে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট হয়। আবার ধানের দাম কমে গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। কাজেই সরকার চায়,এর মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকুক। এজন্য বাজার থেকে ২০-২৫ লাখ টন চাল সংগ্রহ করা হয়। পরোক্ষভাবে কিছুটা প্রভাব পড়লেও প্রত্যক্ষভাবে এতে লাভবান হয় চালকল মালিক ও প্রভাবশালী মহল। আবার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল কেনায়ও নানা সমস্যা রয়েছে। একজন কৃষক ভ্যান ভাড়া করে সরকারী গুদামে ধান বা চাল নিয়ে আসার পর দেখা গেল, তাতে আর্দ্রতা সঠিক মাত্রায় নেই। তখন তাকে ফেরত পাঠাতে হয়। এতে কৃষক আরো নিরুৎসাহিত হন এবং লোকসানে পড়েন। কিন্তু উন্নত বিশ্বের কিছু দেশ যেমন জাপান, কোরিয়া কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সবটাই কিনে নেয়। পরে সরকার সেটা কম দামে বাজারে বিক্রি করে। জাপানের জিডিপিতে কৃষির অবদান দুই ভাগ হলেও ভর্তুকি অনেক বেশী। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কৃষি উপকরণে সহায়তা আরো বাড়ানোর পক্ষে। এটা করা গেলে সব ধরনের কৃষকের কাছে সরকারের সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো যাবে। ফলে কম মূল্যে বিক্রির পরও কৃষকের মুনাফা কমবে না বলে মনে করেন তিনি।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *