মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, মৌলভীবাজার

আবদুল্লাহ: প্রকৃতির অপরূপ লীলা নিকেতন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। এটি দেখতে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন অনেক লোকের সমাগম ঘটে এখানে। প্রায় ২০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে জলরাশি এর গা বেয়ে অবিরাম ধারায় সাঁ সাঁ শব্দে নিচে পড়ছে। অবিরাম পতনের ফলে নিচে সৃষ্টি হয়েছে কুণ্ডের। আর কুণ্ডের প্রবাহমান স্রোতধারা শান্তির বারিধারার মতো মাধবছড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলার ঐতিহ্য: মৌলভীবাজার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে একটি ঐতিহ্য মন্ডিত জেলা। দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতিতে এ জেলার গুরুত্ব অপরিসীম।আকর্ষণীয় অনন্য বৈশিষ্টের কারণে মৌলভীবাজার জেলা পর্যটন শিল্পের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে বৈচিত্র্যময় পরিবেশ, চা বাগান সমূহের দৃষ্টি নন্দন দৃশ্য এবং মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, অভ্যন্তরীণ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত সুবিধা, প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য সমাহারে এ জেলাটি অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন। এ ভিন্নতা ছাড়াও মৌলভীবাজার জেলার অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে হযরত শাহ মোস্তফা (র:) এর মাজার শরীফ, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, পৃথিমপাশা নবাববাড়ী, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট, মনু ব্যারেজ, মাধবপুর চা-বাগান লেক, মনিপুরী পল্লী, প্রাকৃতিক গ্যাস ট্রান্সমিশন প্লান্ট, কমলা/লেবু/আনারস বাগান ইত্যাদি।

পাহাড়, টিলা, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, হাওড়/বাওড়/বিল, ঝর্ণা, নদ-নদী পরিবেষ্টিত এবং জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ জেলা ইকো ট্যুরিজমের (Eco-Tourism)জন্য খুবই উপযোগী। এ কারণে এখানে প্রতি বছর বহু সংখ্যক দেশী-বিদেশী পর্যটক ভ্রমণ করেন। কিন্ত পর্যটকদের চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, আবাসন, বিনোদন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কারণে পর্যটকগণ অনেকক্ষেত্রে নিরাশ হন। এক্ষেত্রে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সহজেই এ জেলাকে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য আরো উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়। এ লক্ষ্যে বিনোদনের ব্যবস্থা অন্তর্ভূক্ত করে শ্রীমঙ্গল উপজেলা, কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মনিপুরী পল্লী, খাসিয়া পল্লী, বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওড় এবং চা বাগানসহ অন্যান্য দর্শনীয় স্থানকে সম্পৃক্ত করে একটি প্যাকেজ তৈরী করা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ জেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

মাধবকুণ্ডের নামকরণ সম্পর্কে কথিত আছে যে, শ্রীহট্টের রাজা গঙ্গাধ্বজ ওরফে গোবর্ধন পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ শুরু করলে সেখানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মাটির নিচে একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। তখন তিনি ওই সন্ন্যাসীর পদবন্দনা ও স্তূতি করলে সন্ন্যাসী তাকে নানা উপদেশসহ মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশ তিথিতে তাকে এ কুণ্ডে বিসর্জন দিতে নির্দেশ দেন। সন্ন্যাসী বিসর্জিত হওয়া মাত্র তিনবার মাধব, মাধব মাধব নামে দৈববাণী হয়। সম্ভবত এ থেকেই মাধবকুণ্ড নামের উৎপত্তি। আবার কারও কারও মতে, মহাদেব বা শিবের পূর্বনাম মাধব এবং এর নামানুসারে তার আবির্ভাব স্থানের নাম মাধবকুণ্ড। এ কুণ্ডের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে শিবমন্দির। যে পাহাড়টির গা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে এ পাহাড়টি সম্পূর্ণ পাথরের। এর বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে ছড়া। ছড়ার উপরের অংশের নাম গঙ্গামারা ছড়া আর নিচের অংশের নাম মাধবছড়া। পাহাড়ের উপর থেকে পাথরের ওপর দিয়ে ছুটে আসা পানির স্রোত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে হঠাৎ খাড়াভাবে উঁচু পাহাড় থেকে একেবারে নিচে পড়ে যায়। এতে দুটি ধারা সৃষ্টি হয়। একটি বড়, একটি ছোট। বর্ষাকালে ধারা দুটি মিশে যায়। জলরাশি যেখানে পড়ছে তার চতুর্দিকে পাহাড়, নিচে কুণ্ড। কুণ্ডের মধ্যভাগে অনবরত পানি পড়ছে। এই স্থান অনেক গভীর। কুণ্ডের ডান পাশে একটি পাথরের গহ্বর বা গুহার সৃষ্টি হয়েছে। ১৩৪২ সালে বিষ্ণুদাস সন্ন্যাসী মাধবকুণ্ডের পশ্চিমাংশে কমলা বাগান তৈরি করেন, সেই কমলা বাগান আজও আছে। মূল জলপ্রপাতের বাম পাশে প্রায় ২০০ গজ দূরে আরও একটি পরিকুণ্ড নামের জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকেও অনবরত পানি পড়ছে। কিন্তু সেখানে খুব কষ্ট করে যেতে হয়। যাতায়াতের সুবিধা করে দিলে সেটি দেখতেও অনেকেই ভিড় করবে।

ভূগোল এবং দূরত্বএটির অবস্হান ২৪° ৩৮’২১”N ৯২° ১৩’১৬E এবং প্রায় ২০০ ফুট (৬১ মিটার) উঁচু।  টা দাকশিনবাঘ রেল স্টেশন থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে, মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে কুলাউড়া, জুরী, কাঁঠালতলী হয়ে ৭০ কিলোমিটার দূরে এবং ঢাকা শহর থেকে ৩৫০কিমি দূরে।

কিভাবে যাবেন: সিলেট বা মৌলভীবাজার থেকে গাড়িতে যেতে পারেন অথবা কুলাউরা সংযোগস্থল থেকে ট্রেনে যেতে পারেন। যাত্রা পথে দেখতে পাবেন চা বাগানের অপুরুপ সৌন্দর্য।

কোথায় থাকবেন: এখানে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার্থে একটি রেস্টুরেন্ট, রেস্টহাউস ও বসার জন্য কিছু শেড নির্মাণ করে। শীতকালে এখানে শত শত পর্যটকের আগমন ঘটে। আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এখানে পর্যটকের আগমন আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তথ্যসূত্র: পর্যটন সেল, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মৌলভীবাজার।




One thought on “মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, মৌলভীবাজার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *