মোরশেদ মুকুল: রমজানের প্রথম দিনেই বাহারি সব ইফতারে সেজেছে প্রাচীন ঢাকার ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র চকবাজারসহ পুরো রাজধানী। ইফতারের আয়োজনে থাকছে লোভনীয় রসনা বিলাসের সব খাবার। কদরও বেশ। প্রকার আর কোয়ালিটি ভেদে দামেরও রয়েছে ভিন্নতা। হাক-ডাক আর কোলাহলে চলছে বেচা-বিক্রি। মানুষের ভীড়ে বিক্রেতারা গলা ছেড়ে হাক ছাড়ছে মন ভুলানো নানা কথায় ও বাক্যে। ‘বড় বাপের পোলা খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়’। রাজধানীর চকবাজার, বেইলি রোড, আজিমপুর, সেন্ট্রাল রোড, ঝিগাতলা, কলাবাগান, গুলশান-১, বনানী সহ প্রতিটি স্থানে বাহারি ইফতারি নিয়ে বসেছে দোকানিরা। দেশীয়ও পাশ্চাত্য ধাচের খাবারও মিলছে এসব দোকানে।
দেখা যায়, মঙ্গলবার বিকেলে সামিয়ানা এবং প্যান্ডেল সাজিয়ে ইফতারি বিক্রি করেছেন চকের ব্যবসায়ীরা। বাহারি ইফতারের পসরায় সাজানো হয়েছে ঢাকার প্রাচীন এ স্থানটিতে।দুপুর থেকেই চকবাজার ছাপিয়ে পুরান ঢাকার অলিগলির বাতাসে ভাসছে নানা স্বাদের মুখরোচক খাবারের মনকাড়া সুবাস। বিক্রেতারা জানায়, বংশগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে এই জায়গায় ইফতারির ব্যবসা করছেন তারা। তাদের বাবা, দাদা, তার বাবারাও এখানে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করতেন। ঐতিহ্য ধরে রাখতেই তাদের এই ব্যবসা। তবে, এখন অনেকেই নতুন নতুন এখানে এসেছেন বলেও জানান তারা। এখানকার খাবারের মধ্যে একটি নবাবী স্বাদ ও আমেজ থাকে।
এদিকে মোহাম্মদপুর থেকে চকবাজারে ইফতারি কিনতে এসেছেন শিশির কাউসার। তিনি জানান, প্রতিবছর তিনি চকবাজার থেকে প্রথম দিন ইফতার কিনেন। এখানকার ইফতারি অন্যান্য স্থান থেকে আলাদা। তাই তিনি এখানে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চকবাজারের ইফতারি কিনতে এসেছেন জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিবছর ইফতার কিনতে চকবাজারে আসা হয়। পরিবারের সদস্যরাও চকবাজারের ইফতার পছন্দ করেন। তাই প্রথম দিনই ইফতারি কিনতে এসেছি। একই সময় গতবারের তুলনায় ইফতারির দাম কিছুটা বেড়েছে বলে অভিযোগ করেন। দাম বেশি নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিক্রেতা ইমরান খান বলেন, এবছর গরু ও খাসির মাংসের দাম বাড়তি। এ ছাড়া চিনিসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বেশি। তাতে ইফতার বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
বিক্রেতারা জানান, পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের বাড়ির তৈরি ইফতারির চেয়ে দোকানে তৈরি ইফতারি দিয়েই ইফতার করতে অভ্যস্ত। যে কারণে পুরো রমজান জুড়েই চকের ইফতিারির বাজার থাকে সরগরম। তবে শুধু পুরান ঢাকার বাসিন্দাই নন। রাজধানীর অন্যান্য এলাকার বাসিন্দারা ও রমজানে চক বজার থেকে ইফতার সামাগ্রী নিতে আসেন। এবার নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ইফতার সমাগ্রীর দাম বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।
দেখা যায়, সুতি কাবাব, জালি কাবাব, টিকা কাবাব, ডিম চপ, কবুতর-কোয়েলের রোস্ট, ঐতিহ্যবাহী বড় বাপের পোলায় খায়, খাসির রান, গোটা মুরগি ফ্রাই, মুরগি ভাজা, ডিম ভাজা, পরোটা, শাহী কাবাব, সুতি কাবাব, সাসলিক, ভেজিটেবল রোল, চিকেন রোল, খাসির রানের রোস্ট, দইবড়া, হালিম, লাচ্ছি, পনির, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, মাঠা পাওয়া যাচ্ছে দোকানগুলোতে।
আর পরিচিত খাবারের মধ্যে বেশি পাওয়া যাচ্ছে কিমা পরোটা, ছোলা, মুড়ি, ঘুগনি, সমুচা, বেগুনি, আলুর চপ, পিয়াজু, জিলাপিসহ নানা পদের খাবার। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বড় বাপের পোলায় খায় বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে। ব্যবসায়ি সালেহ আহমেদ জানায়, এই ইফতার আইটেমটি তেরি করা হয়েছে ২৭টি পদ দিয়ে। এছাড়া খাসির রোস্ট পিস আকার ভেদে ৪৪০ থেকে ৬৫০ টাকায়, মুরগির রোস্ট পিস ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, গরুর সুতি কাবাব ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি, দইবড়া কেজি ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা, কবুতরের রোস্ট ১৫০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। কোয়েল প্রতি পিস ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এ ছাড়া চিকন জিলাপি কেজি ১৫০ টাকা, বড় শাহী জিলাপি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
মন্ত্রিপাড়ার ইফতার বেইলি রোড
রাজধানীর অভিজাত শ্রেণীর মানুষের ইফতারির বাজার হিসেবে খ্যাত বেইলি রোড। মন্ত্রিপাড়ার বাসিন্দা, ব্যাংকার, বিভিন্ন সরকারি আমলা ও কর্মকর্তা, বড় ব্যবসায়ি এবং শিল্পপতিরাই মূলত এখানকার ক্রেতা। তবে সাধারণ মানুষেরও ভীড় জমে এখানে। এখানে ফখরুদ্দিনের ইফতার, কাচ্চি বিরিয়ানি ও খাসির হালিমের ক্রেতাই বেশি। এছাড়াও রয়েছে স্কাইলার্ক, গোল্ডেন ফুড, আমেরিকান বার্গার, ক্যাপিটাল কনফেকশনারি, রেডকোর্ট, বুমার্স, মিস্টার বেকারস, কেএফসি, পিৎজা হাটসহ সব লোভনীয় সব ফাস্টফুডের দোকান। দোকানভেদে বেইলি রোডে রয়েছে দামেরও তারতম্য। চিংড়ি মাছের বল ৪০-৫০ টাকা, দইবড়া ১০০ থেকে ২০০ টাকা, সমুচা ১০-১৫, জিলাপি ১৬০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি, হালিম ৫০ থেকে ৫০০, টানা পরোটা ৩০, কিমা পরোটা ৪৫, চিকেন ললি ৪৫-৬০, বিফমিনি কাবাব ৪০-৫০, চিকেন সিংগার স্টিক ৩০, আলু চপ প্রতিপিস ৫-২০, বেগুনি ও পেঁয়াজু ৫-১০, ছোলা প্রতি কেজি ২০০-২২০, প্রতিপিস শিক কাবাব ৬০, ঝালফ্রাই প্রতি কেজি ৪০০, বিফঝোল চাপ ৫৫০-৬০০ এবং ফালুদা ১৬০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি গরুর কিমা ৬০০ টাকা, গরুর মগজ ৭০০-৮০০, জাম্প রোস্ট ৪০০-৪৫০, দেশী মুরগি প্রতিপিস ২৫০, গরুর শিক কাবাব পিস ৬০ এবং খাসি কাবাব ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়।