শাহরোজা নাহরিনের ঘরে ঢুকতেই ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলাম। ঘর না বলে বরং লাইব্রেরি বলা ভালো, যে লাইব্রেরিতে এক কোণে শোয়ার ব্যবস্থাও আছে! শাহরোজা জানালেন, তাঁদের পুরো পরিবার লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র তিন গোয়েন্দার লেখক ও অনুবাদক রকিব হাসান সম্পর্কে তাঁর ফুফা হন। বাবা রহস্য পত্রিকার নিয়মিত লেখক। শাহরোজা নিজেও লেখালেখি করেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক করেছেন তিনি। পেয়েছেন সিজিপিএ–৪। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে একসময় সংশয় ছিল তাঁর মনে। সেই তিনি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগে সবচেয়ে ভালো ফল করে স্বর্ণপদকের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। কীভাবে?
বুয়েটে স্থাপত্য নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল শাহরোজার। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন, চান্সও পেলেন। কিন্তু বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে এত খরচ বহন করা সম্ভব নয়। অগত্যা নিজের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছিলেন শাহরোজা নাহরিন। ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হওয়ার আগেই চাকরি নেন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সে। পারিশ্রমিক মোটামুটি মন্দ ছিল না। প্রথম দিন থেকেই কি প্রথম হওয়ার ইচ্ছা ছিল? এক মুহূর্তও না ভেবে বলেন, ‘হ্যাঁ, একেবারে প্রথম দিন থেকে আমি চেয়েছি ভ্যালেডিক্টোরিয়ান (কোনো বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষার্থী) হতে। প্রতিটি দিন ভ্যালেডিক্টোরিয়ানের সমাবর্তন ভাষণ নিয়ে আমি ভেবেছি। মনে মনে বলেছি, ওই মুহূর্তটা আমার চাই। তা ছাড়া আমার যেহেতু অর্থনৈতিক সংকট ছিল, তাই স্কলারশিপ পাওয়ার জন্যও আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।’ তাঁর এই চেষ্টা সফল হয়েছিল। সপ্তম সেমিস্টার থেকে শুরু করে শাহরোজাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির জন্য আর একটি টাকাও দিতে হয়নি।
একে তো চাকরি, তার ওপর ইংরেজি সাহিত্যের মতো কঠিন একটি বিষয়ে এত ভালো রেজাল্ট, কী করে সামলেছেন? জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বহুবার তিনি অসুস্থ হয়েছেন, নাটক করতে গিয়ে পা মচকেছে, তবু কোনো দিন ক্লাস মিস করেননি। ‘মন দিয়ে ক্লাস করলে ক্লাসেই ৭০ শতাংশ পড়া হয়ে যায়,’ বলছিলেন শাহরোজা। সবার যেখানে স্নাতক করতে চার বছর সময় লাগে, শাহরোজার লেগেছে সাড়ে তিন বছর। তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য কয়েকটি সেমিস্টারে পাঁচটি করে কোর্স নিয়েছিলেন তিনি।
কাজের চাপের মধ্যে পড়তেন কখন? প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শাহরোজা ধন্যবাদ দিলেন ঢাকার যানজটকে। তাঁর ভাষায়, ‘দিনের অনেকটা সময় চলে যেত তুরাগ বাসে। এই বাসই আমার তখনকার সময়ের সবচেয়ে ভালো পড়ার জায়গা। বাসে বসে আমি যে কত বই পড়ে শেষ করেছি!’
শাহরোজা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগে কাজ করেছেন, কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের (চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষাকেন্দ্র) দুজন চীনা শিক্ষককে ইংরেজি শিখিয়েছেন এবং কয়েকটি বইয়ের অলংকরণের কাজও করেছেন। সঙ্গে পাঞ্জেরীর চাকরিটা তো ছিলই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান তিনি। সেই সঙ্গে লেখক হওয়ার স্বপ্নটা তো আছেই। ‘দানব প্রহরী’ নামে পাঞ্জেরী থেকে এডাম ব্লেডের জনপ্রিয় সিরিজ ‘বিস্ট কোয়েস্ট’–এর অনুবাদ করছেন, ইতিমধ্যে এই সিরিজের প্রথম দুটি বই প্রকাশিতও হয়েছে। এ ছাড়া মার্চেই তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বের হবে। ৬ মার্চ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন। ভ্যালিডেক্টোরিয়ান হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও, মায়ের কাছে তিনি পৃথিবীর সেরা সন্তান। এই অর্জনই বা কম কিসে!
শাহরোজা নাহরিন: শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি