আরাফাত শাহীন: ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের ক্ষুদ্র একটি দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আকার-আকৃতিতে ক্ষুদ্র হলে কী হবে, বাংলাদেশের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য। আর আছে এদেশের অপার সৌন্দর্য। এদেশের সৌন্দর্যে যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা মুগ্ধ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, কালে কালে এদেশের সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি ভীনদেশি পরাশক্তিরা। তাইতো বারবার বৈদেশিক আক্রমণের শিকার হয়েছে এই সোনার বাংলা। চতুর্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর জগদ্বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা নৌকাযোগে সোনারগাঁও থেকে সিলেট যাবার পথে নদীর দু’কূলের অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছিলেন। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে আকর্ষণসমৃদ্ধ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও বিদ্যমান পর্যটন খাতে যে বিচিত্রতা রয়েছে, তাতে সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে।
সৌন্দর্যের দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে রূপের রাণী। এর চারপাশে যেন রূপের আধার! কী নেই এখানে! এদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা, দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রঙের নয়নাভিরাম চারণভূমি সিলেট, আদীবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-আচার সমৃদ্ধ উচ্চ সবুজ বনভূমি ঘেরা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইত্যাদি। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে উন্নয়নের সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান।
বর্তমান পৃথিবীতে পর্যটন একটি সমৃদ্ধ এবং সফল শিল্প। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যাদের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত এই পর্যটন শিল্প। শুধু তাই নয়, এই শিল্প এবং শিল্প সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ জড়িত থাকে। ফলে একটি দেশের বেকার যুবকদের একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ১১ জনের মধ্যে গড়ে ১ জন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই তথ্য থেকেই পর্যটন শিল্পের সমপ্রসারণশীলতা অনুমান করা যায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা খুব একটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারিনি। এই খাতটি থেকে সরকারের বিপুল অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা থাকলেও বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। পর্যটন শিল্প বিকাশের পথে আমাদের পর্বত প্রমাণ সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন খুব একটা সুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি, তেমনি যাতায়াত খরচও তুলনামূলক বেশি হওয়ায় আমরা পর্যটক আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছি।
দেশের পর্যটক আকর্ষণকারী স্থানগুলোতে নিরাপত্তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গিয়েছে। দিনদুপুরে চুরি, ছিনতাইয়ের মত ঘটনা ঘটে থাকে। ফলে বিদেশি পর্যটকেরা নিরাপত্তার অভাবে ক্রমে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। স্রষ্টা অপার কৃপায় আমাদের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দান করলেও আমরা তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। আমরা সুন্দরবনের গাছ কেটে উজাড় করে দিয়েছি। নিজেদের সামান্য স্বার্থের আশায় ধ্বংস করে দিয়েছি এর অপরূপ জীববৈচিত্র্যকে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কক্সবাজারের পৌর এলাকায় প্রতিদিন শহরে ৩০ টন বর্জ্য উত্পাদিত হয়। এসব বর্জ্য নালা কিংবা সমুদ্রে ফেলা হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে গন্ধে থাকা দায় হয়ে দাঁড়াবে। এদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে।
এত সমস্যা থাকার পরও আমাদের পর্যটন শিল্প ধীরে ধীরে হলেও সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যান মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সরকারের বৈদেশিক আয় হয়েছে ৪ হাজার ১৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য অবশ্যই মনে আশার সঞ্চার করে; পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে পারার স্বপ্ন দেখায়।
আমাদের ছোট্ট এ দেশে হয়ত কোনো সোনা, রূপা কিংবা হীরার খনি নেই; কিন্তু আমাদের আছে প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিপুল ভাণ্ডার। এদেশের পর্যটনে প্রচলিত চিন্তাচেতনার বাইরে একটু দেশীয় ছোঁয়া দিতে পারলে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশে এমন একটু চেষ্টা করলে সারা দেশেই পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা যদি একটু আন্তরিকতার সাথে পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য কাজ করতে পারি ও নিজেদের সম্পদের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি, তাহলে এদেশের পর্যটনশিল্প যে বিশ্বমানে উপনীত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
Related articles
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।
HimalaySep 20, 2023