যুবাইর এহসানুল হক: অস্থির সময় পার করছে পুরো দুনিয়া। অদ্ভুত ও অপরিচিত। দুনিয়া চালানোর ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা বড় একগুঁয়ে, বেমানান আচরণ করছেন। এই অস্থির সময়ে সবচেয়ে বেশি আক্রম্য জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে মুসলমানরা। অবস্থাটা এমন আপনি এড়িয়ে যেতে চাইলেও যেন গায়েপড়ে আপনার সাথে ঝগড়া লাগাবে।
সম্প্রতি ট্রাম্পের গোলান স্বীকৃতির বিষয়টিও তেমনি। জেরুসালেমকে ইসরাইলি রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির দেয়ার পাপিষ্ট সিদ্ধান্তের পর প্রসঙ্গহীনভাবে গোলান মালভূমিকে ইসরাইলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আরব বিশ্ব তাদের ইতিহাসের সর্বাধিক বিভক্তির সময় অতিবাহিত করছে। প্রায় প্রতিটি আরবদেশে নিকৃষ্ট রাজারা ক্ষমতায়। নিজেদের কুর্সি রক্ষা ব্যতীত তাদের আর কোন লক্ষ্য নেই। জনগণবিচ্ছিন্ন এসব রাজাদের গদি রক্ষার একমাত্র ভরসা হল আমেরিকা। আর ওই যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের মত ঠাণ্ডা মাথার অকপট অমানুষ ক্ষমতায়। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের এজেন্সি ইসরাইলের হাতে তুলে দিয়েছেন। অতএব যে আরবরা ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইলের সাথে তিনবার যুদ্ধ করেছে তারা আজ ইহুদিতোষণে ব্যস্ত। ইসরাইলের এটাইতো সুযোগ। একে একে সব স্বার্থ বাগিয়ে নিচ্ছে। পত্রিকান্তরে জানা গেল, সৌদি আরব ও আরব লিগ ট্রাম্পের গোলান ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একটা শিশুর বুঝতে বাকি নেই, এটি আমরা-আমরা কেইস, চুক্তিভিত্তিক প্রতিবাদ। জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত, ঘুমন্ত, রাজারা পদলেহনে ব্যস্ত; এই জাতির মুক্তির উপায় কি?
অযৌক্তিক আচরণের আরেক দৃষ্টান্ত দেখুন পাশের দেশে। ওখানকার প্রধানমন্ত্রী মোদি হলেন আরেক ট্রাম্পবাজ। হঠাৎ করে তার দল লোকপঞ্জি তৈরির নামে মুসলিম বিতাড়নের কর্মসূচি শুরু করে। ১৯৪৭ সালে ভারত হতে অনেক মুসলমান পাকিস্তানে চলে আসে। আবার পাকিস্তান হতে বহু হিন্দু ভারতে চলে যায়। ১৯৪৭ এর পর পাকিস্তান বা বাংলাদেশ হতে কোন মুসলমানের ভারতে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আসাম হতে মুসলিম বিতাড়নের জন্য লোকপঞ্জি তৈরিরে কাজ চলছে। আসামে অনেক বাঙালি মুসলিম আছে। এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, এদের কেউ ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর ওই দেশে যায়নি। ১৯৪৭ এর পূর্বে তো পুরো বৃটিশ ভারত এক দেশ ছিল। দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে জনস্থানান্তর তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাছাড়া পূর্ব বাংলা হতে মুসলমানরা স্বেচ্ছায় আসামে যায়নি। আসামের চা বাগানে কাজ করার জন্য বৃটিশরাই তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল। এখন প্রায় এক দেড়শো বছর তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া কোন বিচারেই বৈধ কাজ হতে পারে না। এ সাধারণ কথাটি উপলব্ধির জন্য পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। অথচ উদ্ভট ঘটনা ঘটছে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য হিংসাচর্চা চলছে। জনউত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের কাজ, অথচ তারাই আজ হীন স্বার্থে জনগণকে উত্তেজিত করছে। কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই, উচ্চকণ্ঠ নেই, সবই গা-সওয়া, সবই যেন স্বাভাবিক।
এখন আমরা কী করতে পারি? আমরা দুর্বল ও আক্রম্য, আমাদের নেতারা উদাসীন ও কুর্সিরক্ষায় ব্যস্ত। নিরাপদ জায়গাও নেই যে, পালিয়ে যাবেন, কোথাও আশ্রয় নেই। প্রতিবাদে লাভ নেই, লড়াইয়ের ক্ষমতা নেই। সশস্ত্র লড়াই অনেক হয়েছে, ভারসাম্যহীন ওই লড়াইয়ে বিপর্যয়ের প্রলম্বন ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এখন একটাই পথ হতে পারে, যে কোনভাবে নিজের পরিচয় রক্ষা করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। আপনি যদি পরিচয় লুকিয়ে রাখেন, লাভ হবে না। ওরা আপনাকে বিশ্বাস করবে না। দু’কূল হারাবেন। যে কেন উপায়ে স্বতন্ত্র আইডেন্টিটি বহাল রাখতে হবে, নিজেকে, পরিবারকে বাঁচাতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাস ও চেতনাকে ধারণ করতে হবে। যে কোন উপায়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। আত্মঘাতী ও হটকারী কাজ করা যাবে না। মনে রাখা দরকার, আমাদের জীবন খুব দীর্ঘ নয়। এরচেয়ে বড় বিপর্যয় হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষগণ অতিক্রম করেছেন। ১২৫৮ সালের খেলাফত পতন তখনকার মুসলিমদের কি নিদারুণ হতাশাই না সৃষ্টি করেছিল। ১৮৫৮ সালের অসফল বিপ্লব ও পরবর্তী সীমাহীন বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করুন। কুকুর যেন গোল হয়ে শুয়ে থাকে তেমনিভাবে মাটি কামড়ে পরিচয় ধারণ করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। সময় আসবে, দৈত্যরা ধ্বংস হবে, আবার আমরাই পৃথিবী আবাদ করব।
লেখক: সযযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়