হিমালয় ডেস্কঃ দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ইসলামিক নানা নিদর্শনে ভরা দেশটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। অর্থনৈতিক প্রগতি এবং আধুনিকতার এক অপূর্ব মিশেলে মরক্কো হয়ে উঠেছে পাশ্ববর্তী দেশগুলোর কাছে এক অনবদ্য মডেল। প্রাচীন ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক নানা নিদর্শনের খোঁজে মরক্কোর বিভিন্ন প্রান্তরে চলুন বেরিয়ে পড়ি।
ক্যাসাব্লাঙ্কা: মরক্কোর সবচেয়ে দর্শনীয় এক শহর ক্যাসাব্লাঙ্কা। শহরের বাড়িগুলোর রঙ প্রায় সাদা। ক্যাসাব্লাঙ্কায় হাসান মসজিদটি পৃথিবীর সবচেয়ে দর্শনীয় মসজিদের একটি। পৃথিবীর সব মসজিদের মধ্যে এর মিনারটি উচ্চতম (৬৮৯ ফুট)। মসজিদটি লাল বেলেপাথরের তৈরি। এর নকশা করেছিলেন ফরাসি স্থপতি মিশেল প্যাঁসো। মসজিদের ভিতরের প্রার্থনা কক্ষের মেঝেটি কাচের। মসজিদের ভেতরে-বাইরে মিলিয়ে একসঙ্গে লক্ষাধিক মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। এখানে অবস্থিত কিংস প্যালেস একটি দর্শনীয় স্থান। প্রাসাদটি ইসলামিক স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন বহন করে চলেছে। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ১৯৩০ সালে নির্মিত প্রাচীন গির্জা, কর্নিক সমুদ্র সৈকত, দর্শনীয় সব স্থাপনা নগরটিকে করে তুলেছে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
রাবাত: সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর রাবাত মরক্কোর রাজধানী। সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় এখানকার আবহাওয়া সবসময়ই ভালো। শহরে প্রধান রাস্তাগুলো একমুখী এবং প্রশস্ত হওয়ায় যানজট নেই বললেই চলে। রাবাতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান কাসবাহ উদাইয়া। ‘কাসবাহ’ শব্দের অর্থ ‘দুর্গ’। আটলান্টিক মহাসাগরের স্বচ্ছ নীল যেন প্রতিফলিত হয়েছে শহরের বাড়িগুলোর দেওয়ালে। আর রয়েছে নীলের সাথে সাদা রঙ। প্রাচীর ঘেরা এই শহরের পুরনো অংশের বিভিন্ন গলি-শাখা গলি নিয়ে গড়ে ওঠা রাস্তাগুলো যেন এক ভুলভুলাইয়া।
এই রাস্তাগুলোর পরিকল্পনায় ছিল পর্তুগিজরা। মূলত গরমে বাড়িগুলোকে ঠান্ডা রাখার জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আফ্রিকার একটি দেশ হয়েও এখানে প্রচুর গাছ দেখতে পাওয়া যায়, যা সত্যিই অকল্পনীয়। জুলাই-আগস্টে এখানকার তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে। আর সে কারণে অনেক গলিতে ইচ্ছে করেই সূর্যকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই শহরের অধিকাংশ বাড়িই ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি। বাড়িগুলোর নির্মাণশৈলী প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরে।
ভলুবিলিস: তৃতীয় শতাব্দীতে তৈরি হওয়া শহরটি একসময় রোমান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। আর এজন্য শহরজুড়ে প্রাচীনকালের নানা রোমান স্থাপত্য চোখে পড়বে। মুসলমানদের আগমনের আগে এসব অঞ্চলে যখন শুধুই বার্বারদের দাপট, সে সময় রোমান সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রমাণ এই ধ্বংসাবশেষ। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা পাওয়া সত্ত্বেও শহরে অযত্নের ছাপ পরিলক্ষিত। এখানকার উর্বর ভূমিতে বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদিত হয়। এখানকার উৎপাদিত অলিভ অয়েলের কাঁচামাল রোমে রপ্তানি করা হয়, যা দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
মুলে ইদ্রিস: ভলুবিলিসের পরের গন্তব্য মুলে ইদ্রিস। পাহাড়ের ওপর থেকে শহরটির দৃশ্য এককথায় অনবদ্য। মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সা) পৌত্র মুলে ইদ্রিস ৭৮৯ সালে অ্যাটলাস মাউন্টেনের কোলে যে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন, তা বিশ্বে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মসজিদের মধ্যে অন্যতম। স্থানটি মুসলমানদের জন্য বড় পবিত্র স্থান হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। প্রতি বছর আগস্ট মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলিম তীর্থযাত্রীরা ভিড় করেন মুলে ইদ্রিসে।
শহরের বাসিন্দাদের বাড়িতে তখন পর্যটকদের অবারিত দ্বার। ধর্ম আকড়ে বেঁচে আছেন এই শহরের লোক। শহরটির বৈভব নেই, কিন্তু ঐতিহ্যে তাকে হারায় কে? একেকটা বাড়ির দরজা যেন একেকটা নিদর্শন। দেওয়ালে অসাধারণ মোজাইকের কাজ। মুলে ইদ্রিসের পাহাড়ি গলিপথে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম গাধা। এখানকার বিভিন্ন দোকানে বার্বার উপজাতি সদস্যদের তৈরি উটের চামড়া আর সুতোর অপূর্ব কাজ করা জিনিসপত্রের ব্যাপক সমাহার দেখতে পাওয়া যায়।
হ্যান্ডিক্র্যাফট ক্যাপিটাল: ফেজ মরক্কোর তৃতীয় বৃহত্তম শহর, মরক্কোর পুরনো রাজধানী। হ্যান্ডিক্র্যাফট ক্যাপিটাল হিসেবে শহরের বেশ সুনাম রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আল-কারাওউইন এখানেই অবস্থিত।
ফেজের প্রধান আকর্ষণ চতুর্দিকে দেওয়াল ঘেরা মেদিনা (বাজার)। ফেযের মেদিনা হলো মরক্কোর সবথেকে বড় ও প্রাচীন এবং পৃথিবীর সবথেকে বড় নাগরিক অঞ্চল। সরু রাস্তা, প্রাচীন ঘিঞ্জি বাড়ি, সেখানে গাড়ি চলে না। তাই মেদিনার ভেতরে যাতায়াতের জন্য পায়ে হাঁটা বা গাধাই সম্বল।
মেদিনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান ট্যানারি। ট্যানারিটা প্রবলভাবেই পর্যটকদের গন্তব্যের মধ্যে পড়ে, কারণ ৯০০ বছরের পুরনো এই ট্যানারি পৃথিবীর প্রাচীনতম। উট আর ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতো, ব্যাগ, পার্স কিনতে পর্যটকদের আগ্রহের কমতি নেই।
মারাকেশ: ফেজ থেকে পরের গন্তব্য মরক্কোর দক্ষিণে মারাকেশ। ফেজ থেকে ৭ ঘন্টার ট্রেন যাত্রা। এটলাস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঘেরা রাজকীয় এক নগর মারাকেশ। কুতুবিয়া মসজিদ এখানকার প্রধান আকর্ষণ। ১১৮৪ থেকে ১১৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে মসজিদটি তৈরি হয়। মসজিদের আড়াইশ ফুট উচু মিনার দেখা যায় শহরের যেকোনো স্থান থেকে। নগরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে এল বাদি প্যালেস, বাহিয়া প্যালেস, সেন্ট্রাল স্কয়ার প্রভৃতি।
ফেজের মতো এখানেও পুরনো মেদিনা আছে, তার গলিঘুঁজি আছে। হাতের কাজের নানা আকর্ষণীয় জিনিস পাওয়া যায় এখানে। মেদিনার মাঝখানে বিশাল এক চত্বরে প্রায় শ’খানেক খাবারের দোকান। মেদিনার গলিঘুঁজি হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাতই পেয়ে যেতে পারেন অলৌকিক বাতিদানের দোকান। কপার, ব্রোঞ্জের হাতে তৈরি জিনিসগুলোর সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখলে সম্ভ্রমে মাথা নুয়ে পড়বে সেই অজানা শিল্পীদের জন্য।
এইত বেনহাদু: মারাকেশ থেকে একদিনের রাউন্ড ট্রিপে ঘুরে আসা যায় দর্শনীয় স্থান এইত বেনহাদু। মাটির বাড়ি, মাটির দুর্গ মিলিয়ে পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা আস্ত এক শহর এইত বেনহাদু। এখানেই রয়েছে একাদশ শতাব্দীতে তৈরি হওয়া বার্বারদের গ্রাম।। সবুজ উপত্যকা আর মাইলের পর মাইল লাল রুক্ষ মাটি আর গিরিখাত, দেখতে অনেকটাই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মতো।
অঞ্চলটির নিকটবর্তী শহর কিংবা দুর্গম অ্যাটলাস পর্বত ঘেরা গ্রাম- সব জায়গায় প্রাচীন ঐতিহ্য যেন হাত ধরে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে আরব্য রজনী থেকে তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। লরেন্স অব অ্যারাবিয়া থেকে শুরু করে গ্ল্যাডিয়েটর এবং প্রিন্স অফ পার্সিয়ার মতো বহু হলিউডি ছবির শ্যুটিং হয়েছে এখানে। পুরো শহরটাই ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বন্দর শহর এসাউইরা: মরক্কোর পশ্চিমে আটলান্টিকের দিকে বন্দর শহর এসাউইরা বাকি শহরগুলো থেকে একটু অন্যরকম। মাছ ধরা এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা। সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে সারি সারি নীল রঙের বোট আর মাঝারি সাইজের লঞ্চ। ভোর হেলেই জেলেরা মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়েন আর দিনের শেষে এসে জমা করেন সার্ডিন, বোনিটো, টুনা ফিস ইত্যাদি নানা প্রজাতির মাছ।
টেটোয়ান: মরক্কোর একেবারে উত্তরে ভূমধ্যসাগরের তীরে রিফ পর্বতমালার ওপর গড়ে ওঠেছে এই পুরনো বন্দরনগরী। ইতিহাস সমৃদ্ধ শহরটি চোখজুড়ানো, মনমাতানো ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যমন্ডিত আরব জনপদের সাক্ষী বহন করে চলেছে। স্পেনে মুসলমানদের শাসনামলে অষ্টম শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়গুলোতে শহরটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
মরক্কো এবং আন্দালুসিয়ার একমাত্র যোগসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো শহরটি। আর ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে টেটোয়ানের ভাষা ও সংস্কৃতিতে ফরাসির চেয়ে স্প্যানিশ প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। শহরের বাড়িঘরগুলো সব সাদা রঙের। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন সাদা কংক্রিটের চাদরে ঢাকা পাহাড়ে এক বিশাল তাবু। এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে কাবো নেগ্রো বিচ, রিফ পর্বতমালা, প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, মার্টিল মেদিনা বাজার উল্লেখযোগ্য। মরক্কোর অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে আলজেরিয়ান সীমান্ত ঘেঁষে মারজুওগা মরুভূমি আরেক অনন্য মরুভূমি। ৩৫০ মিটার উঁচু ও ৫০ কিলোমিটার প্রশস্ত বালিয়াড়িতে উটে করে ভ্রমণ, সূর্যাস্ত দেখা, ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীতে পর্যটকেরা নিজেদের হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া শহর মাকেন, সিদি ইফনি, এসিলাহ সমুদ্র সৈকত, অ্যাটলাস পর্বতশ্রেণীর পশ্চিমে তদ্রা জর্জ, দ্রাহ উপত্যকা প্রভৃতি স্থানগুলো এককথায় অনবদ্য।