সুরাইয়া হেনা: জাপানে প্রথমবারের মতো ভ্রমণকালে পর্যটকরা ভীষণ অবাক হয় যখন লক্ষ্য করে জাপান বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত শিল্পজাত দেশগুলোর মধ্যে একটি। এই অপেক্ষাকৃত ছোট এশিয়ান দেশটি তুলে ধরছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় সব ইতিহাস। ইউরোপের অধিকাংশ দর্শনীয় ক্যাথেড্রাল নির্মাণের অনেক আগেই জাপানের শিন্তো (জাপানের ধর্ম) এবং বৌদ্ধ মন্দির সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একই সাথে, দেশটি ইতিমধ্যে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অনেক দক্ষতা দেখিয়েছে। সিরামিক থেকে শুরু করে সিল্কের মতো জনপ্রিয় অনেক কিছু নিয়েই কাজ করছে জাপান। যদি আপনার পরবর্তী ভ্রমণ গন্তব্য হয়ে থাকে জাপান, তবে এই ভ্রমণটি নিঃসন্দেহে অনেক সুন্দর ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জেনে নিন জাপানের কয়েকটি বিশেষ স্থান সম্পর্কে যা পর্যটকদের মূল আকর্ষণে থাকে।
ফুজি পর্বত:জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট ফুজি, যার উচ্চতা ৩,৭৭৬ (১২,৩৮৯ ফিট)। জাপানের সবচেয়ে পরিচিত স্থান এটি। এটি জাপানের তিনটি পবিত্র পর্বতের একটি। অপর দুইটির একটি হলো মাউন্ট তাতে এবং অপরটি মাউন্ট হাকু। অপূর্ব সৌন্দর্য আর অনন্য গঠনের মাউন্ট ফুজি প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটককে আকৃষ্ট করে। রাজধানী টোকিও থেকে ১০০ কিলোমিটার (৬০ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে শিজুকা আর ইয়ামানশি প্রদেশের সীমান্তে হনশু দ্বীপে মাউন্ট ফুজি অবস্থিত। পর্যটক ও পর্বতারোহীদের কাছে মাউন্ট ফুজি একটি জনপ্রিয় স্থান। কারো কারো কাছে, হিমালয়ের পরে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পর্বত এই মাউন্ট ফুজি।
ইম্পেরিয়াল টোকিও: টোকিওর সবচেয়ে বিখ্যাত স্থান ‘ইম্পেরিয়াল প্যালেস’। এটি জাপানের সম্রাটের বাসভূমি। বর্তমানে এটি প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং মিউজিয়াম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যেখানে জাপানের শিল্প ও ইতিহাসের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। প্রাসাদটি ঐতিহ্যবাহী জাপানী বাগান দিয়ে ঘেরা। অতিথি ও দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাতে বিভিন্ন অভ্যর্থনা কক্ষ রয়েছে প্রাসাদটিতে। পার্শ্ববর্তী পার্কল্যান্ডের অনেকগুলো পয়েন্টে প্রাসাদের অনেক সুন্দর দৃশ্যের পাশাপাশি বিখ্যাত নিজুবাশি সেতু বা ‘ডাবল সেতু’র দেখা পাবেন। টোকিওতে আসা পর্যটকদের জন্য আরো একটি ‘অবশ্যই’ দেখা উচিত ধরনের স্থানের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত ‘গিঞ্জ শপিং জেলা’।
হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল: ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমাতে আণবিক বোমায় নিহতদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে এই স্মৃতিসৌধ। গম্বুজাকৃতির এই স্মৃতি সৌধটি একটি পার্কে অবস্থিত। বোমা বিস্ফোরণের পর এই অঞ্চলে শুধুমাত্র একটি ভবন দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধের বিধ্বংসিতা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এবং নিহতদের প্রতি সম্মান জানাতেই এই সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। মানুষের জীবনের মূল্য উপলব্ধি করতে পারেন এই স্থানটির দর্শনার্থীরা।
ঐতিহাসিক কিয়োটো: সুন্দর কিয়োটা জাপানের সর্বাধিক পরিদর্শন করা শহরগুলোর মধ্যে একটি। বছরে ১০ মিলিয়নেরও অধিক পর্যটক আসেন এখানকার পুরনো রাস্তা, অসাধারণ স্থাপত্য, দারুণ সব নির্মাণ এবং এখানকার অপরিবর্তিত সৌন্দর্য দেখতে যা ইম্পেরিয়াল পরিবার রেখে গেছেন আরো ১০০ বছর আগে। এমনকি জায়গাটি সে সময়েও ছিলো জাপানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অংশের একটি। এবং পূর্বের ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনো জায়গাটি সাংস্কৃতিক ও শিল্পের দিক থেকে বিস্তার ঘটিয়ে আসছে তার অসংখ্য জাদুঘর, আর্ট গ্যালারী, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, চিত্রকর্ম ও শিল্পের আরো অনেক ধারা নিয়ে।
কিয়োটোয় বৌদ্ধ-প্রভাবিত নির্মাণশৈলীর মধ্যে অসংখ্য সুন্দর নির্মাণ রয়েছে যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে স্থানটির প্রতি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সুন্দর সংরক্ষিত মন্দির রয়েছে, যার মধ্যে ৩০টি নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে প্রার্থনায় ও ভ্রমণের স্থান হিসেবে। চতুর্দশ শতাব্দীর গোল্ডেন প্যাভিলিয়নের (কিংকাকু-জি) মতো গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো রয়েছে এই স্থানটিতে, যা পর্যটকদের আগ্রহের তালিকায় রয়েছে। অবশেষে বলা যায়, কিয়োটো ভ্রমণ পরিপূর্ণ হবে না যদি না ‘অ্যারিয়াশিয়াম বাঁশ গ্রুভ’ ভ্রমণ করেন। শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র কয়েক মিনিট হাঁটার পর পেয়ে যাবেন লম্বা বাঁশের তৈরি সুন্দর এই স্থানটি।
মন্দিরের শহর, ঐতিহাসিক নারা: শতাব্দী ধরে জাপানী সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু এই নারা শহরটি। শহরটিতে রয়েছে বিশাল সংখ্যক ঐতিহাসিক ভবন, গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ এবং চমৎকার কিছু শিল্পকর্ম। শহরটির অনেক ঐতিহাসিক রাস্তার পাশাপাশি পুরো নগরটিতে রয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরাতন মন্দির। নারার বিখ্যাত ৭টি মন্দিরের মধ্যে অন্যতম সপ্তম শতাব্দীর বিখ্যাত কোফুকু-জী মন্দির।
আরো অসংখ্য মন্দির রয়েছে এ শহরটিতে। শহরটি পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের আনাগোনায় অন্যান্য শহর থেকে একেবারেই আলাদা চিত্র ধারণ করে থাকে সারা বছর। শহরটি অধিকাংশ মানুষের কাছেই পবিত্র একটি স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া শহরটির আলাদা সৌন্দর্য তো থাকছেই পর্যটকদের মুগ্ধ করতে।
ওসাকা ক্যাসল: ১৫৮৬ সালে বিখ্যাত জাপানী যোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদ টোয়োটোমি হেময়োশি ওসাকা ক্যাসল (ওসাকা-যো) নির্মাণ করেন। মূলত এটি ছিল দেশের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ। নানা কারণে অসংখ্যবার ধ্বংস ও পুনরায় তৈরির পর দূর্গের বর্তমান কাঠামোটি নির্মিত হয় ১৯৩১ সালে এবং তা দেখতে আসল দূর্গের মতোই। আপনার এক পরিদর্শনে যুক্ত হবে ৫ টি বিশাল ঐতিহাসিক গল্প।
৪২ মিটার লম্বা মূল টাওয়ারটির ভেতরে ১৪ মিটার লম্বা পাথরের ঘরে কিছু বিস্তারিত প্রদর্শনী হচ্ছে যা ক্যাসলটির ইতিহাস ও এই শহরের কিছু ইতিহাস তুলে ধরে। ক্যাসলের উপর থেকে এর আশেপাশের চমৎকার দৃশ্য দেখতে অবশ্যই ক্যাসলের ছাদে যাবেন। এছাড়াও এখানকার ওসাকা ক্যাসল পার্ক ও বিখ্যাত কিছু মন্দির রয়েছে যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে সারা বছর।