উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

ফ্লোরিডার বিউটি কুইন

করিম চৌধুরী: মেক্সিকো উপসাগরে ঘেরা মানোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর কম জনসংখ্যার একটি শহর ফ্লোরিডা ষ্টেটের ফোর্ট মায়ার্স। দ্বীপ আর সমুদ্র সৈকতে ভরপুর ফ্লোরিডা । আবহাওয়া ঠিক বাংলাদেশের মতো। এখানে কখনোই তুষারপাত হয় না। অসংখ্য দ্বীপ আর সমুদ্রে ঘেরা বলে এই শহরের আমেজ একটু আলাদা। সারা বছর ধরে টুরিষ্টদের আসা যাওয়ার শেষ নেই। মাইলের পর মাইল কমলালেবুর বাগান। ইংরেজিতে যাকে বলে অরেঞ্জ গ্রোভ । দোকান থেকে টমাটো কিনলে প্রতি পাউন্ডের [আমেরিকায় কেজি (kg) নয় পাউন্ড ব্যবহৃত হয় এবং কিলোমিটার নয়, মাইল ব্যবহৃত হয়] দাম যদি হয় এক ডলার সেই একই টমাটো ক্রেতা নিজে টমাটো বাগান থেকে হাত দিয়ে ছিড়ে নিলে দাম হবে উনসত্তর সেন্ট।

আমেরিকার প্রধান সিটিগুলো যেমন নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান, ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস, ইলিনয়েসের শিকাগো, টেক্সাসের ডালাস, কলোরাডোর ডেনভার, নেভাডার লাস ভেগাস, ফ্লোরিডার মায়ামি, জর্জিয়ার আটলান্টা, ওয়াশিংটনের (ওয়াশিংটন ডিসি আমেরিকার রাজধানী। ওয়াশিংটন ষ্টেট ওয়েষ্ট কোষ্টে কানাডার ভ্যাংকুভার এর সঙ্গে।) সিয়াটল, ম্যাসাচুসেটস-এর বষ্টন, ইউটা ষ্টেটের সল্ট থেকে সিটি, পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়া, আরিজোনার ফনিক্সসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর ছাড়া বাকিগুলো কম জনবসতির । সংক্ষেপে বলা যায়, পঞ্চাশটি ষ্টেটের মধ্যে প্রতিটি ষ্টেটে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছাড়া বাকিগুলো কম জনবসতির। যেমন ক্যালিফোর্ণিয়ার লসএঞ্জেলেস, সানডিয়েগো, সানফ্রানসিসকো, ফ্লোরিডার মায়ামি, টেমপা, অরল্যান্ডো। এই ধরনের উল্লেখযোগ্য শহর বাদ দিলে অন্য শহরগুলোতে খুবই কম মানুষের বসবাস।
যারা নিয়মিত ড্রাইভ করে এক ষ্টেট থেকে অন্য ষ্টেটে যান তারাও দেখেছেন মাইলের পর মাইল, হাজার হাজার মাইল অনাবাদি খালি জায়গা । জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই । আমার মনে হয় আমেরিকা দেশ নয় । এটি একটি মহাদেশ । ক্যালিফোর্নিয়া ঘেষে প্রশান্ত মহাসাগর আর ফ্লোরিডার একদিকে আটলান্টিক মহাসাগর অন্যদিকে মেক্সিকো উপসাগর । ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে ফ্লোরিডার সময়ের ব্যবধান তিন ঘন্টা । ফ্লোরিডায় যখন রাত নয়টা বাজে ক্যালিফোর্নিয়ায় তখন সন্ধ্যা ছয়টা । একই দেশে দুই শহরের মধ্যে সময়ের ব্যবধান তিন ঘন্টা।
অনেক বছর আগে বছরখানেক টোকিওতে ছিলাম । জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান তিন ঘন্টা । জাপান পূর্বে বলে বাংলাদেশ থেকে ৩ ঘন্টা এগিয়ে থাকে । আমেরিকায় এতোই অনাবাদি জনমানবহীন বিরানভূমি রয়েছে যে, আমার মনে হয়, পৃথিবীর সব মানুষকে এ দেশে নিয়ে এলেও তার জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের চেয়েও কম হবে । এতো বড় দেশ আমেরিকার জনসংখ্যা মাত্র ত্রিশ কোটি।
পড়াশোনা আর জীবিকার জন্য জীবনের বেশির ভাগ সময় শহরে থাকতে হয়েছে । যদি বলা Life is a Struggle….Fight It .তবে আমি নিয়মিত ফাইট করি । কঠিন আর রূঢ় বাস্তবের মধ্যেও আমি সারাক্ষণ হাসিখুশি। যেন Life is a Love…Enjoy it. খুব গান শুনি । যেন Life is Song…Sing it.
ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। শহরে থাকলেও পূর্ণিমার আগে বা পরে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতাম । শহরের বৈদ্যুতিক আলোতে চাঁদের আলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনুভব করা যায় না। জোৎস্না রাতে গ্রামে কতো রকম খেলা হতো । হাডুডু, দাড়িয়াবান্দা, কুস্তি । আমেরিকায় এসব খেলা না দেখলেও জোৎস্না ভরা রাত এমন হৃদয় কাড়া, মনোমুগ্ধকর হবে কখনোই ভাবি নি । আসলে প্রকৃতি প্রতারণা করে না । প্রতারণা করে মানুষ । এ দেশেও থালার মতো চাঁদ ওঠে, জোৎস্না হয়, নদী-সাগরে জোয়ার ভাটা হয়।
রাত জাগা আমার স্বভাব বা অভ্যাস । কাজ শেষে বাসায় ফিরে ড্রেস চেইঞ্জ করে বেরিয়ে পড়ি গাড়ি নিয়ে যেদিকে মন যায় । হাই ভলিউমে গাড়িতে গান বাজাই। কোনো রাত মার্কো আইল্যান্ডে, কোনো রাত সেনিবেল আইল্যান্ডে, কোনো রাত ফোর্ট মায়ার্স বিচ-এ, কোনো রাত বনিটা বিচ-এ, কখনো বা নেপলস-এ, কখনো বা পিস রিভার বা শান্তি নদীর পাড়ে । আশা ভোসলের গানের মতোই-
এ মন আমার হারিয়ে যায় কোন খানে
কেউ জানে না শুধুই আমার মন জানে।
জোৎস্না রাতে এসব জায়গায় কতো কি দেখা যায় । কেউ ফিশিং করছে অর্থাৎ মাছ ধরছে । বাচ্চারা সাগর পাড়ের বালিতে খেলা করছে, প্রেমিক-প্রেমিকারা হাত ধরে হাটাহাটি করছে, সি-গাল পাখিরা উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে । অসংখ্য নাম না জানা গাছ আছে বিচ-এর পাড় ঘেষে । কিছু কিছু গাছের নাম আমি জানি। পপলার, মেপল, উইপিং উইলো । আরেকটি গাছ দেখতে ভারী অদ্ভুত । গাছের কান্ডটার ব্যাসার্ধ অনেক বড় । দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেও হাত দুটো একত্রে মেলানো যাবে না। স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলে হাত দুটো একত্রিত হয় । এমন একটি বিশাল গাছের সাইজ কিন্তু খুব ছোট। পাঁচ ফিট থেকে সাত ফিটের মধ্যে । মাথা ফেটে বেরিয়ে গেছে বড় বড় পাতা । ঠিক বাংলাদেশের কলা গাছের পাতার মতো সেই পাতা । অনেক কৌতুহল নিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই গাছটির নাম কি?
তিনি বললেন, ট্র্যাভেলার্স পাম।
জোৎস্না রাতে অথৈ সাগরে কি চমৎকার ঢেউ । আকাশের চাঁদের আলো সাগরে পড়ে, সেই আলো সাগর তার বুকে করে ঢেউয়ে ঢেউয়ে চিক চিক করে পৌঁছে দেয় তীরের মানুষের কাছে।
তেমনি এক জোৎস্না রাতে লিজার সঙ্গে আমার পরিচয় । সাগর পাড়ে নয়, কর্মক্ষেত্রে । ওর বড় ভাই আমাকে খুবই স্নেহ করেন । তিনি ফ্লোরিডায় বসবাসকারী অনেক ধনী বাংলাদেশি আমেরিকানদের মধ্যে অন্যতম । বিনয়ী, মিশুক আর ফানি চরিত্রের এই মানুষটিকে আমি শ্রদ্ধা করি।
কো-ওয়ার্কারদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে সঙ্গে আসা ছোটবোনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এই বলে-মাই ইয়াংগেষ্ট সিসটার লিজা । আর আমার দিকে তাঁকিয়ে ডান হাতের তর্জনী উচিয়ে ছোটবোনকে বাংলায় বললেন, ওর নাম …। এর পর থেমে গেলেন অর্থাৎ তিনি আমার নামটা বোনকে বলেন নি।
আমি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মেয়েটির দিকে তাঁকিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, এই শহরে আমার একটা ডাকনাম আছে, পাগল । বাঙালি কমিউনিটি এই নামেই আমাকে চেনে। হঠাৎ পরিচয়ে যেন ভুল ধারণা না জন্মায় সে জন্য দেশে বিদেশে যতো পাগলামি করেছি সে বিষয়ে ছোট্ট একটা বক্তৃতাও দিলাম ।
দামি থ্রী পিস এর সঙ্গে ম্যাচ করা ওড়না আর পায়ে দামি হিল পরা, মুখে কোনো রকম মেকআপ ছাড়া লিজা আমার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁকিয়েছিল । পাশে বড় ভাইয়া। লিজার ঠোঁটগুলো যেন সদ্য জলে ভেজা। পিঠে ছড়িয়ে দেয়া এমন চুল শুধু শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনেই দেখা যায়। দাঁতগুলো এতোই সুন্দর যে মনে হয় যেন টুথ পেষ্টের বিজ্ঞাপন। টানা টানা ভুরু । মায়াবি মুখ। গায়ের রঙ ধবধবে শাদা। গোসলের পর কানের লতিতে এক ফোঁটা পানি জমলে নিশ্চয়ই তা মুক্তার মতো দেখাবে।
কিছু কিছু রূপের বর্ণনা করা যায় না। এমন রূপ ধরতে হয় চেতনার উপলব্ধিতে। আমার কাছে প্রায়ই একটা দামি ক্যামেরা থাকে। হাজার চেষ্টাতেও সেই ক্যামেরায় এই সৌন্দর্যের রূপ ধরতে পারবো না । আমার কাছে যেসব কলম আছে তা দিয়েও লিজার সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে পারবো না।
লিজার থাকে ফোর্ট লডারডেল। এখান থেকে দেড়শ মাইল দূরে । নিজেদের বাড়িতে । শুনেছি সুমি আটলান্টিক ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েট কোর্সে পড়ে। ছয় ভাই, তিন বোনের মধ্যে সে ছোট। বাবা-মা সহ সবাই এ দেশে থাকেন ।
এখনো মনে আছে সেদিনের কথা। রিফ্লেকশন লেকের এক অভিজাত বাসায় জমজমাট এক পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়ে লিজার সঙ্গে আবারো দেখা । অনেকের মাঝে আমি যখন লিভিং রুমে লিজার ইমিডিয়েট বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম দাঁড়িয়ে তখন অপ্রয়োজনে লিজা আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম । পার্টি শেষে বিদায়ের সময় লিজার ভাই যখন খালাম্মার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো তখন মায়ের পাশে বসা লিজা সোফা থেকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে মিষ্টি করে রহস্যজনকভাবে হাসলো । মনে হলো যেন নি:শব্দ হাসিতে লিজা আমাকে ধমক দিয়ে বলছে, এ্যাই, মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় পাগলামি করবে না। খবরদার বলে দিচ্ছি । আমি এখানে আছি ।
আরেক দিন এক পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে দেখি, লিজাদের ফ্যামিলির সবাই এসেছেন । কথায় কথায় দেশের প্রসঙ্গ আসায় লিজার বাবা আমাকে ডেকে পাশে বসিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। সামনের সোফায় বসে লিজা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাঁকিয়ে ছিল । চোখে চোখ পড়তেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম ।
মনে আছে কতো কি ? একদিন ব্যস্ত সময়ে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কাজ করছিলাম । কম্পিউটারের কীবোর্ড আমার আঙুলের মুখস্ত । অনেক আমেরিকান আমাকে বলে, তুমি দেখছি কমপিউটারের চেয়েও ফাষ্ট । আমি মধুর হেসে বলি, ইটস মাই প্লেজার । এমনি এক ব্যস্ত দিনে হঠাৎ দেখি চশমা পরা একজন পর্দানশীন সম্মানিতা বাঙালি মহিলা ষ্টোরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছেন । পরে জেনেছি তিনি লিজার মা ।
আদরে বাদর হয়। আমি মানুষের আদর পেয়ে পেয়ে বাদর হয়ে গেছি । লিজার বড় ভাই আমাকে প্রায়ই বলতেন, নিউ ইয়র্ক থাকতে তোমার অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবী ছিলো। এখানে এসে তো একাকী হয়ে গেছো । বিয়ে করে ফেলো । সময়টা ভালো কাটবে । তোমার বাবা-মা নেই জানি । আমি অভিভাবক হয়ে তোমাকে বিয়ে করিয়ে দেবো । কোন মেয়ে তোমার পছন্দ তা আমাকে বলো।
আমি হাসতে হাসতে বলতাম, আমি উদাসীন প্রকৃতির, অনুভূতিপ্রবণ, স্পর্শকাতর মনের খেয়ালি চরিত্রের মানুষ। বিয়ের পর যদি স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হয় তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবে। বন্ধনহীন একাকী জীবনে বেশ ভালো আছি । কোনো পিছুটান নেই।
ভাইয়া তখন ফান করে বলতেন, আল্লাহকে তোমার মনের মতো একটা মেয়ে বানানোর জন্য অনুরোধ করা উচিত।
পরিচিত জনেরা দেখা হলেই বিয়ের কথা বলবে । বিয়ে করছেন কবে ? মেয়ে দেখবো নাকি ? এসব কথা শুনে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে । মনের অজান্তেই একদিন আল্লাহকে ডেকে বললাম, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে বিয়ের হাত থেকে রক্ষা করো । আপাতত তোমার কাছে আমি কিছুই চাই না।
একদিন জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজ শেষে সমবয়সী বন্ধুরা বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই মুরুব্বি শ্রেণীর এক ভদ্রলোক বললেন, বাবারে, বিয়ে শাদি আল্লাহর হুকুম । ওনার হুকুম ছাড়া কিছু হবে না ।
আমি বললাম, আংকল সবাই যা শুরু করেছে, মনে হয় আল্লাহপাক খুব শিগরিই হুকুম দেবে।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে জোরে গাড়ি চালিয়ে কাজে যাচ্ছিলাম । যখন সামারলিন রোডে লেফট টার্ণ নিতে যাবো তখনি সিগনালের লালবাতি জ্বলে উঠলো । ঘ্যাচ করে ব্রেক করলাম । এমন সময় বাম দিকের ট্র্যাকে একটি টয়োটা ফোর রানার জিপ এসে থামলো। আস্তে হর্ণ বাজিয়ে আমাকে ডাকলেন । তাঁকিয়ে দেখি ড্রাইভিং সিটে লিজার বড় ভাইয়া, পাশে বাবা। দুজনেই গাড়ির গ্লাস নামালাম। গরম বলে গাড়িতে এসি চলছিল।
ভাইয়া তখন ফান করে আমাকে দেখিয়ে তার বাবাকে বললেন, ওকে বলেছিলাম, মেয়ে পছন্দ করতে আমি বিয়ে করিয়ে দেবো।
মনে বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম । বাবার সামনে এ ধরনের ফানে আমি কিছুটা অপমানিত বোধ করলাম । নিজের ঘরে বিয়েযোগ্য মেয়ে রেখে একজন অবিবাহিত পুরুষকে বারবার খোঁচা দেয়া আর যাই হোক অন্তত ফান নয়।
নিজেকে সামলে নিয়ে আমিও কাষ্ঠ হাসি হেসে ফান করে বললাম, ইশ! মেয়েই যদি আমি সিলেকশন করবো তাহলে বিয়েটা আপনাকে করাতে হবে কেন ? এতোই যখন আমাকে বিয়ে করানোর ইচ্ছা তখন একটা মেয়ে যোগাড় করে দিন না।
আমাদের দুজনের কথায় বাবা মজা পেয়ে হাসছিলেন । হঠাৎ লালবাতি নিভে সবুজবাতি জ্বলে উঠলো । আমরা ব্রেক থেকে পা সরিয়ে একসিলারেটরে পা চাপলাম। দুই গাড়ি দুই দিকে চলে গেল দ্রুতগতিতে।
আজ অনেক দিন হয় লিজাদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই । আমি জানি, হঠাৎ কোনো একদিন কোনো শপিং সেন্টারে বা পার্টিতে অথবা জোৎস্না রাতে সাগর পাড়ে লিজার সঙ্গে আবারো আমার দেখা হবে।
আমাকে দেখেই এগিয়ে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করবে, করিম, তুমি কেমন আছো ? এখনো পাগলামি করো ? প্যান্টের পকেটে দুই হাত ভরে ঠোঁটে কামড় দিয়ে নিচের দিকে তাঁকিয়ে দুই দিকে মাথা নেড়ে শান্তভাবে আমি বলবো । না, আর পাগলামি করি না ।
লিজা অভিমানী গলায় বলবে, ভাইয়াদের সঙ্গে তুমি রাগ করেছো। কিন্তু আমি কি দোষ করেছি ? ছলছল চোখে লিজা আরো বলবে, তুমি তো আমাকে অনেকগুলো সিডি দিয়েছিলে । আশা ভোঁসলের ওই গানটা শোনো নি-
মনটা যদি না থাকতো
আমার কিছুই মনে পড়তো না।
গানের কথা শুনতেই আমি চোখ তুলে লিজার চোখে তাঁকাবো । তখনি দেখবো ওর দুই চোখের মণিতে আমার ছবি । আয়নার মতো একজনের চোখে আরেকজনের ছবি দেখা যায় । ইচ্ছা করলেই যে কেউ সেই ছবি প্রিয়জনের চোখে দেখে নিতে পারেন।
লিজা আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকবে বিউটি কুইনের মতো । তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে সোনালি দ্যুতি।

০৭. ০২. ২০০১ (ফ্লোরিডা)
ইমেল:[email protected]




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *