যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রতিপক্ষের আকাশসীমায় ঢুকে হামলা চালাতে হয় পাইলটদের। কাজটি প্রচণ্ড ঝুঁকির, কারণ প্রতিপক্ষও সব সময় প্রস্তুত থাকে বিমান তাদের আকাশে প্রবেশের সাথে সাথে সেটি ধ্বংস করতে। সেক্ষেত্রে কখনো ভূমি থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের গোলা, কখনো বা অন্য বিমান থেকে গোলা ছোড়া হয় ওই বিমানের উদ্দেশ্যে। আর গোলার আঘাত লাগলে আর রক্ষা পাওয়ার উপায় থাকে বিমানটির।
বিমান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারলে মাঝ আকাশেই বিমান ছেড়ে বের হয়ে যেতে হয় পাইলটকে। ইংরেজিতে যেটিকে বলে ইজেক্ট(বের হয়ে যাওয়া)। প্রাণ বাঁচানোর তাগিতে তাকে ঝাঁপ দিতে হয় প্যারাস্যুট নিয়ে। সেটি করতে হয় অন্তত ১০ থেকে ৩০ হাজার ফুট উচ্চতায়। বিমান ধ্বংস হলে প্রাণ বাঁচানোর এটিই একমাত্র পদ্ধতি।
পাইলটদের বিষয়টি নিয়ে কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই প্রক্রিয়াটি অবশ্য অতটা সহজও নয়। যুদ্ধবিমান চলে প্রচণ্ড গতিতে, আবার সেটি ধ্বংস হলেও নিচে পড়তে থাকে অনেক গতিতে। তাই এমন অবস্থায় বিমান থেকে বের হওয়া সহজ নয়। অবশ্য বিমানের নকশা করার সময় বিষয়টি খেয়াল রেখেই করা হয়। এখনকার অত্যাধুনিক যুগের যুদ্ধবিমানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি থাকে পাইলটের ইজেক্ট করার জন্য।
প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ইজেক্ট করতে হয় পাইলটদের। সিটের নীচে থাকে রকেটের মতো একটি বস্তু। যেটিতে আগুল লাগলে ওই রকেট সিটসহ পাইলটকে বিমান থেকে বাইরে শূন্যে ছুড়ে দেয়। রকেটের একটি অংশে আগুন ধরলে সেটি চালু হয়। এজন্য শুধুমাত্র একটি সুইচ চাপতে হয় পাইলটকে। এরপরই পাইলট ককপিটের বাইরে বেরিয়ে যান, যাকে বলা হয় ব্লো আপ। যদিও প্রচণ্ড গতিতে কাজটি হয় বলে এর ফলে কাঁধ ও কলারবোনে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা মারাত্মক।
বিমানে আরোহনের পর পাইলটের পিঠে প্যারাশুট তো থাকেই, সিটের সাইডে থাকে লিভার। পাইলট বিমান থেকে ইজেক্ট করতে চাইলে সেই লিভারটিতে টান দেন। ফলে সেটি রকেটে ফায়ার চার্জ করে। রকেটটি অত্যন্ত শক্তিশালী। আগুন ধরলেই রকেট বুস্টার সিট-সহ যুদ্ধবিবমানের বাইরে বেরিয়ে আসে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিমান থেকে শূন্যে ভাসতে শুরু করেন বিমানচালক।
শূন্যে ভাসার পর প্রথমে সিট খুলে পড়ে যায় নিজে থেকেই। পাইলট মুক্ত হয়ে যান শূন্যে। ওই অবস্থায় ভাসতে ভাসতেই আরও একটু নীচে নামেন নামেন, কারণ ১৪ হাজার ফুটের উপরে প্যারাস্যুটের কাজ করতে সমস্যা হয়। উচ্চতা আন্দাজ করে একটা দড়ির মতো অংশ টেনে ক্যানোপিটা বের করতে হয়। খুলে যায় প্যারাস্যুট। তবে এতে শিরদাঁড়ায় চোট লাগার আশঙ্কা থাকে।
সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিমানচালক ও অস্ট্রেলীয় বাহিনীর চিকিৎসক নিউম্যান বলেন, এটি ‘এসকেপ মেকানিজম অব লাস্ট রিসর্ট’। অত্যাধুনিক ইজেকশন সিটে একটি ইজেকশন গান থাকে। শুধু সিটের হ্যান্ডেল তুলেই এটি চালু হয়ে যায়। সিট-সহ পাইলট বিমানের বাইরে বেরিয়ে আসেন।
সিটের নীচে যে রকেটের মতো একটা যন্ত্র থাকে তাতে সলিড রকেটের জ্বালানি থাকে। মাত্র ০.২ সেকেন্ড জ্বলে এটি। এই রকেটের শক্তির তোড়ে বাতাসে প্রায় ১০০ ফুটের মতো উড়ে যায় সিটটি। মোটামুটি ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় কাজ শুরু করে প্যারাস্যুট। চেয়ারের হাতল টানা থেকে প্যারাস্যুট খোলা পর্যন্ত সময় লাগে মাত্র তিন সেকেন্ড। উচ্চতা যদি ২০-৩০ হাজার ফুট হয়, তা হলে প্যারাস্যুট তখনই নাও খুলতে পারেন চালক।
ওই উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাব যেন না হয়, সে জন্য সিটের নীচে থাকে ছোট অক্সিজেন বোতলও। প্যারাস্যুট খুলে গেলেই সিটটি নিজ থেকে পড়ে যায়, তার আগে নয়। আরও শক্তপোক্তভাবে মাটিতে পা রাখতে পারেন পাইলটন। অবশ্য ল্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও আছে অনেক ঝুঁকি।
সিট ইজেক্ট করার সময় অভিকর্ষীয় বল সাধারণের তুলনায় প্রায় ১৪ থেকে ১৬ গুণ বেশি হয়। গতি থাকে মারাত্মক। প্যারাস্যুট বিস্ফোরণের সম্ভাবনাও থাকে। শরীরে বড় চোটের সম্ভাবনাও থাকে। কাঁধে চোট পাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। কারণ ইজেক্টের সময় মাথা ঠেকে যেতে পারে বুকের মধ্যে। তাছাড়া পাইলটের মুখে মাস্ক ও মাথায় হেলমেটও থাকে, যার ওজন প্রায় ৭ কেজি। মহাকর্ষীয় বল মারাত্মক হওয়ায় গতি আরও বেড়ে যায়। ফলে মাথা উপর-নীচ হতে থাকে বারবার। এর ফলে পা ভাঙার সম্ভাবনাও থাকে।
তবু প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে তো বড় কিছু নেই, তাই এই কাজগুলো করতে হয় পাইলটদের। এ বিষয়টি তাদের প্রশিক্ষণেরই অংশ। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা