অবশেষে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হোসনে আরা বিনার ওএসডি আদেশ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সোমবার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শাহীন ইমরান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্বে করা ওএসডি আদেশ বাতিল করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শাহীন ইমরান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, হোসনে আরা বিনার ওএসডি আদেশ বাতিল করা হয়েছে। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অতিদ্রুত কার্যকর করা হবে।
এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি হোসনে আরা বিনাকে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে ওএসডি করা হয়। এ ঘটনায় ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে এ বিষয়টি নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেন। এরপর ইউএনও’র ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি নয়াদিগন্ত অনলাইনে সংবাদ প্রকাশের পর প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। মন্ত্রী পরিষদে এনিয়ে আলোচনা উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে।
এদিকে ইউএনও’কে ওএসডি করার বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে বক্তব্য রাখেন নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও মেহের আফরোজ চুমকি। বক্তব্যে শামীম ওসমান জানতে চেয়েছিলেন কার নির্দেশে হোসনে আরা বিনাকে ওএসডি করা হয়েছে। স্পিকার নিজেও বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মূলত প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পরই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিনার ওএসডি আদেশ বাতিল করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
নয়াদিগন্ত অনলাইনের পাঠকদের জন্য ইউএনও সেই স্ট্যাটাস হুবহু তুলে ধরা হলো :
‘আমি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সাধারণত ফেসবুকে খুব একটা শেয়ার করি না। তবে আজ মনে হল এখন চুপ করে থাকাটাও অন্যায়। তাই আজ আর না, আজ আমি বলবো- আমি হোসনে আরা বেগম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নারায়ণগঞ্জ সদর, মাত্র ৯ মাস পূর্বে আমি এ পদে যোগদান করি।
আমার দীর্ঘ ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে বহু চেষ্টা চিকিৎসার পরও আমরা কোনো সন্তান লাভ করতে পারিনি। কিন্তু পাঁচ মাস পূর্বে আমি জানতে পারি আমি দুমাসের সন্তানসম্ভবা। এ ঘটনা আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত ছাড়া আর কিছুই নয় এ বিশ্বাস আমি প্রতিনিয়ত বুকে ধারণ করেছি। এ বিশ্বাস ও স্বপ্ন বুকে নিয়ে অনাগত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম।
উল্লেখ্য, আমি আমার বাবুকে পেটে নিয়েই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সহকারি রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বপালন করি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আমি নারায়ণগঞ্জ-৪ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের আংশিক নির্বাচন অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করি। একজন নারী কর্মকর্তা হিসেবে অজুহাত ফাঁকিবাজী এই বিষয়গুলোকে কখনই পুজি করিনি। যখন যে পদে কাজ করেছি চেষ্টা করেছি শতভাগ নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে।
সন্তানসম্ভবা হয়েও এর কোনো ব্যতিক্রম আমি করিনি। অথচ আমি সন্তানসম্ভবা হয়েছি শোনার পর থেকেই একজন বিশেষ কর্মকর্তা, যার নাম বলতেও আমার রুচি হচ্ছে না, বিভিন্ন মহলে আমাকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে আমাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বদলির পায়তারা করেই চলছিল। আমার সন্তানসম্ভবা হওয়াটাকেই সে বিভিন্ন মহলে আমার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
অথচ এই সন্তান পেটে নিয়েই আমি অত্যন্ত সফলভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারি রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বপালন করেছি, ও আমার উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ কতৃক এপ্রিসিয়েশনও পেয়েছি। আমার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল এপ্রিলের ২০ তারিখ, তেমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি ছিলাম। গত ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখ বিকেলে রেগুলার চেকাপ করতে আমি হাজব্যন্ডসহ স্কয়ার হাসপাতালে আসি, চেকআপ শেষে সন্ধ্যায় আমার হাসপাতালে অপেক্ষা করছি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য। এমন সময় আমার একজন ব্যাচমেট ফোন করে জানায় আমার সদাশয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ওএসডি করেছে অর্থাৎ আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছে।
আমার অপরাধ হলো আমি সন্তানসম্ভবা, আর তার চেয়েও বড় কারণ হল সেই তথাকথিত ক্ষমতাধর কর্মকর্তার উপরের মহল কর্তৃক তদবির। খবরটা শোনার পর আমি প্রচন্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে পারিনি। উল্লেখ্য, আমি এজমার রোগী।
প্রচন্ড মানসিকচাপে আমার ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে আমার পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই আমার পেটের বাবু নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। তাৎক্ষণিক হসপিটালে ভর্তি করা হলে ডক্টর সেদিন রাতেই সিজার করে বাবু বের করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে আমার পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে পরদিন সকালে আমার মাত্র ৩১ সপ্তাহ বয়সি প্রিমেচিউর বেবিকে সিজার করে বের করে ফেলা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিইউতে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে!!!
আমার এই নিষ্পাপ সন্তানটার কি অপরাধ ছিল??? নাকি মা হতে চাওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল আমি জানিনা!!! তবে জানি একজন সব দেখেন তিনি আমার নিষ্পাপ মাসুম সন্তানের উপর এই জুলুমের বিচার করবেন। এই নিষ্ঠুর অমানবিকতার পৃথিবীতে কোন কর্তাব্যক্তিদের কাছে আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই না, শুধু আমার সৃষ্টিকর্তাকে বলবো তুমি এর বিচার করো!!! আর যারা আমাকে একটুও ভালোবাসেন আমার নিষ্পাপ সন্তানটার জন্য দোয়া করবেন ও সুস্থ্য হয়ে গেলে কোনো কষ্টের কথাই আমার মনে থাকবে না।’