চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে সেনা অভিযানের পরপরই ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান বলেন, ”কথিত ছিনতাইকারী ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়েছে।”
তবে কিছুক্ষণ পরেই চট্টগ্রাম সেনা দপ্তরের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান জানান, কম্যান্ডোদের আত্মসমর্পণের অনুরোধে সাড়া না দেয়ায় এনকাউন্টারে প্রথমে আহত এবং ওই ব্যক্তি মারা যান।
বিমানটিতে ১৩৪জন যাত্রী আর ১৪ জন ক্রু ছিলেন। অস্ত্রধারী ব্যক্তি ছাড়া সবাই অক্ষত রয়েছেন।
যেভাবে ঘটনা শুরু
বাংলাদেশ বিমানের ময়ুরপঙ্খী নামের এই বোয়িং বিমানটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল।
সেনা কর্মকর্তা ও যাত্রীদের তথ্য মতে, ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার পরেই একজন যাত্রী পিস্তল নিয়ে ককপিটে প্রবেশ করেন। মাঝ আকাশেই তিনি পাইলটকে পিস্তল ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়ার দাবি করেন।
বিমানে থাকা যাত্রী ওসমান গণি সাংবাদিকদের বলেছেন, “ঢাকা থেকে বিমানটি রওনা হওয়ার একটু পরেই একজন যাত্রী ককপিটের দিকে যায়। এরপর আমরা কিছু গুলির শব্দ শুনতে পাই। তখন আমরা শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম।”
বিমানটি চট্টগ্রামে অবতরণের ফাঁকে বিমানের পাইলট ওই ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ অব্যাহত রাখেন যাতে সে কারো ক্ষতি না করে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানটি ছিনতাই করলেও তিনি সেটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। তার দাবি ছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
ওই বিমানটির একজন যাত্রী, বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ”বিমানে একজন যাত্রী অস্ত্র নিয়ে বিমানটি হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছিল। সে বাঙ্গালি। সে গুলি করেছে তবে সব যাত্রীকে নিরাপদে নামিয়ে আনা হয়েছে। পাইলট আমার কাছে এসেছিল, সে বলেছে হাইজ্যাকার একজন, সে গুলি করেছে। পাইলট তাকে পারসুয়েড করার চেষ্টা করেছে। হাইজ্যাকার বলেছে, সে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।”
তবে গুলির শব্দ প্রসঙ্গে সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, এটা যাত্রীদের ভুল হতে পারে। এ ধরণের ঘটনায় অনেক সময় যাত্রীরা সবসময় একটা ট্রমায় থাকে, তারা অনেক কিছু শুনতে পান, সেটা একটা হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান জানান, ”বিমানটি বিকাল ৫টা ৪১ মিনিটে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপরেই জরুরি গেট দিয়ে সকল যাত্রীকে বের করে আনা সম্ভব হয়।” সন্দেহভাজন এই ছিনতাইকারী যাত্রী বা ক্রুদের ক্ষতি করার কোনো চেষ্টা করেনি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিমানবন্দরের রুদ্ধশ্বাস দুই ঘণ্টা
বিমানটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণের পর থেকে ছিনতাইকারী মুক্ত করতে এরপর চলে যায় আরো দুই ঘণ্টা। অবতরণের পরেই সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, কমান্ডো, র্যাব, সোয়াট, দমকল বিভাগ বিমানটি ঘিরে ফেলে।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে থাকা এক যাত্রী শিউলি রানী দে স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলছেন, ”আমার বিমান ছিল ৬টা ২০ মিনিটে। তার আগেই আমি বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট অবতরণ করতে দেখি। তখন আমি দেখতে পাই, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাবের গাড়িগুলো গিয়ে বিমানটি ঘিরে ফেলেছে।”
এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান সাংবাদিকদের বলেন ”এর মধ্যেই পাইলট কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানান যে, কথিত হাইজ্যাকার তার স্ত্রীর কোন বিষয় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চান। এক ফাঁকে একজন ক্রু বাদে সকল ক্রুই বের হয়ে আসতে পারেন। পরে সেই ক্রুও বের হয়ে আসেন। তখন শুধুমাত্র কথিত হাইজ্যাকার বিমানে ছিল।”
”আমরা খবর পাওয়ার পর আমরা বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে কথা বলি। চট্টগ্রাম বিমান বাহিনীর ঘাটি থেকে সদস্যরা সেখানে অবস্থান নেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে আমরা বিষয়টি জানিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী কাজ করা হয়েছে।” বলছেন মি. হাসান।
বিমান বাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেছেন, ”আমাদের লক্ষ্য ছিল কম্যান্ডোরা না আসা পর্যন্ত তাকে ব্যস্ত রাখা। এ পর্যন্ত আমরা নানা ভাবে তার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিলাম।” এর মধ্যে বিভিন্ন বাহিনী, সেনাবাহিনী, এয়ারফোর্স, নেভি, র্যাব, সোয়াট টিম সেখানে অবস্থান নেয়।
কম্যান্ডো অভিযান
সন্ধ্যা ৭টা ১৭ মিনিটে অভিযান শুরু করে সেনা কম্যান্ডোরা। জে. এস এম মতিউর রহমান জানান, হোলি আর্টিজান বেকারিতে কম্যান্ডোদের যে দলটি অভিযান পরিচালনা করেছিল, সেই একই দল এখানে অভিযানটি পরিচালনা করে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল নেতৃত্ব অভিযানে নেতৃত্ব দেন। “মাত্র আট মিনিটের মধ্যে তারা ছিনতাইয়ের অবসান ঘটান।”
জে রহমান বলেন, ”আমাদের কম্যান্ডোরা বিমানের ভেতর অভিযান চালানোর পর তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। কিন্তু তিনি সাড়া না দিয়ে আক্রমণাত্মক হওয়ার চেষ্টা করলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। তার সঙ্গে আমাদের এনকাউন্টার হয়। তিনি প্রথমে আহত হন। পরে তিনি মারা গেছেন বলে আমি জানতে পেরেছি।”
তার কাছে শুধুমাত্র একটি পিস্তল পাওয়া গেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
ছিনতাইকারী সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?
পাইলটের সঙ্গে আলাপের সময় তিনি একবার নিজের নাম মাহাদি বলে উল্লেখ করেছেন। তার পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত আর কিছু জানাতে পারেননি কর্মকর্তারা।
তার চেহারা দেখে পাইলট প্রথমে বিদেশী বলে মনে করলেও, তিনি একজন বাংলাদেশী বলে কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এয়ার মার্শাল নাইম হাসান বলছেন, ”কথিত ছিনতাইকারীকে খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মনে হয়েছে। সাধারণত ছিনতাই ঘটনা যেমনটা দেখা যায়, তেমনভাবে সে যাত্রী বা ক্রুদের জিম্মি করার সেরকম চেষ্টা করেনি।”
কড়া নিরাপত্তা ডিঙ্গিয়ে কিভাবে অস্ত্র নিয়ে ঢুকলেন যাত্রী
মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান বলছেন, এতো কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ডিঙ্গিয়ে কিভাবে তিনি অস্ত্র নিয়ে ভেতরে চলে এলেন, এটা অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে। সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান নাইম হাসান বলছেন, তারা পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখবেন।
সূত্র : বিবিসি