‘হিজাব আমার স্বাধীনতা, হিজাব আমার নিরাপত্তা, হিজাব আমার পছন্দ, হিজাব আমার আচ্ছাদন’-এ স্লোগানে বিশ্বের কমপক্ষে ১৪০টি দেশের মুসলিম-অমুসলিম নারীদের অংশগ্রহণে পালিত হয়েছে এবারের ‘ওয়াল্ড হিজাব ডে’। দিবসটি সব নারীকে এ কথাই মনে করিয়ে দেয় যে, হিজাব শুধু মুসলিমরাই পরবে এমনটি নয়, বরং মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্যই হিজাব নিরাপত্তা ও সম্মানের প্রতীক, যা ব্যবহারে নারী থাকে নিরাপদ। ফেইসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক সোশ্যাল নেটোয়ার্কের মাধমেই এ দিবসটির চেতনা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানির মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথম ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ বিশ্বের ৪৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত, খ্যাতনামা রাজনীতিক, স্কলার, বিশ্ববিখ্যাত গণমাধ্যম সিএনএন ও টাইম ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন দেশের নারীরা হিজাব দিবস পালন করেছিল।
আয়ারল্যান্ডের মুসলিম নারীরা ব্যতিক্রমী আয়োজনে শুক্রবার সপ্তম বিশ্ব হিজাব দিবস পালন করেন। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলো- ‘প্রথাগত ধ্যানধারণার সীমান্ত ভেঙে দাও।’ ডাবলিন শহরের পোর্টবেলো অঞ্চলের একটি হোটেলে হিজাব দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান আগত নারীদের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। তাদের বেশিরভাগই রঙবেরঙের জিলবাব এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ হিজাব পরিধান করে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তবে তাদের কেউই নেকাব বা এমন পর্দা যা পুরো মুখমণ্ডল ঢেকে রাখে এমন হিজাব পরিধান করেননি আর এ ধরনের হিজাব আয়ারল্যান্ডে প্রচলিতও নয়। বিশ্ব হিজাব দিবসের অনুষ্ঠানে আগত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের গোলাপি হিজাব ও ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হয়।
হিজাব দিবস পালিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়ও। বহু সংস্কৃতির দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকরা কোনো বৈষম্য ছাড়াই ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে মুসলমান নারীরা প্রায়ই মাথায় স্কার্ফ পরিধানের কারণে বৈষম্যের শিকার হয়। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকায় চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে জানান এ সম্প্রদায়ের সদস্যরা।
রাজধানী প্রিটোরিয়াতে বিশ্ব হিজাব দিবস উদযাপনের সময় মুসলিম এনজিও বায়তুস সালামন এর জুওয়াইরিয়া আবু বকর রোববার আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, ‘আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বাধীনভাবে হিজাব দিবস উদযাপন করতে পেরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমাদের দেশ আমাদেরকে বাধাহীনভাবে আমাদের ধর্মের অনুশীলন করতে দেয় এবং আমাদেরকে ধর্মীয় পোশাক পরিধান করতে সক্ষম করে’।
জুওয়াইরিয়া বলেন, হিজাব দিবস উদযাপনের লক্ষ্য ছিল মুসলমান নারীদেরকে মাথা ঢাকার স্কার্ফ পরিধানে গর্ব বোধ করার বার্তা দেয়া, কারণ এটি তাদের ধর্মেরই অংশ। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকা একটি সহনশীল সমাজ, তবুও এমন কয়েকজন লোক আছেন যারা মাঝে মাঝে মুসলমান পর্দানশীল নারীদেরকে কটাক্ষ করে।
জেন্ডার কর্মী বলেন, তার সংগঠন পর্দানশীল নারীদেরকে নিগ্রহকারীদের নারীকে সম্মান জানানোর শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করবে এবং নিজেদেরকে তারা কেন ঢেকে রাখে তা বোঝাবে। পর্দানশীল মুসলিম নারীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সহনশীল হতে এবং পর্দার ব্যাপারে ঘৃণা বন্ধ করতে তিনি অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরকেও আহ্বান জানিয়েছেন। প্রিটোরিয়ার উপকণ্ঠে হাম্মাস্ক্রাআলের একটি মসজিদে বিশ্ব হিজাব দিবস উদযাপন উপলক্ষে দেয়া বিভিন্ন বক্তৃতা শোনার জন্য রোববার ৭০ জন নারী একত্রিত হয়েছিল। অনেক বক্তারা মুসলিম নারীদের মাথা ঢেকে রাখার ধর্মীয় বিধান নিয়ে পৌরাণিক কাহিনী দূর করার কথা বলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, ইসলাম ধর্মে মাথা ঢেকে রাখার ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আছে। কিছু সমালোচক যেভাবে নারীদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের রূপ হিসাবে এটিকে উপস্থাপন করে আসলে এভাবে দেখা উচিত নয়। এই বছর আয়োজকরা দেশের সংখ্যালঘিষ্ট কালো মুসলিম নারীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন, যাদের প্রায় সবাই ইসলামে নতুন তথা নওমুসলিম। আবুবকর বলেন, ‘বেশিরভাগ নারীরাই প্রথমবারের মতো উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তারা জানতে আগ্রহী ছিলেন স্বাধীনভাবে হিজাব পরিধানে অনুমতি না থাকা দেশের নারীরা কিভাবে হিজাব পরিধান করে।’
যার আহ্বানে ‘বিশ্ব হিজাব দিবস’
পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি নারী নাজমা খান। ১১ বছর বয়সে পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কয়েক বছর আগে জ্যামাইকায় এ অভিবাসী নারী হিজাব পরিধানের কারণে ২০১৩ সালে আক্রমণের শিকার হন, বিভিন্ন সময় অপমানিত ও লাঞ্ছিত হন। হিজাব পরিধানের কারণে ১/১১ এর সময় তাকে শুনতে হয়েছে টেরোরিস্ট, ওসামা বিন লাদেন, ব্যাটম্যান ও নিনজাসহ নানান কটূ কথা। তার আহ্বানেই ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের প্রায় দেড়শ‘ দেশ বিশ্ব হিজাব দিবস পালন করছে। অমুসলিমরাও এ দিবসে হিজাব পরিধান করে অংশগ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, স্কুলে কেবল আমিই হিজাব পরতাম। এ জন্য নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। তাই ভাবলাম, অমুসলিম নারীরা যদি মাত্র এক দিনের জন্য হলেও হিজাব পরেন, তাহলে মুসলিম নারীদের আর এ ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। হিজাব পরিধান করার জন্য মুসলিম হওয়া কোন শর্ত নয়। হিজাব যে কোন ধর্মের নারীরা পরিধান করতে পারেন। হিজাব শালীনতার জন্য পরিধান করা হয়, তাই তিনি হিজাব পরিধানে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। পোষাক-আষাক দেখে মানুষকে বিচার-বিবেচনা করা ঠিক নয় এটি প্রমাণের জন্য এই দিবসটি মোক্ষম সুযোগ। অমুসলিম নারীরা যদি শুধু এই একটি দিবসের জন্য হিজাব পরিধান করেন তাহলে আর কখনো মুসলিম নারীদের বৈষাম্যের শিকার হতে হবে না।