উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

হৃদয়ে কা’বার বাসনাঃ এক প্রতিবন্ধীর আর্তি

                                                                                   এ এস এম জাফর উল্লাহ
ভূমিকাঃ ”কাফনের কাপড় পরিধাণের পূর্বে ইহরামের কাপড় পরিধানের ব্যবস্থা করে দিও”- হে আমার প্রভূ। সহস্র কোটি শোকর কা’বার মালিকের সেই মহান দরবারে। আল্লাহ সে দো’য়া বাস্তবায়ন করেছেন। দীর্ঘদিনের অপার্থিব লালিত বাসনা/স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে- এ খুশী নিজের বুকের মধ্যেই ধরে রেখে ছিলাম সযত্নে। বাস্তবায়নের পূর্বে এ ধরণের প্রোগ্রাম প্রকাশ করা সঙ্গত নয় বলে কেন জানি মনে হয়েছে। প্রকাশ করা হলে আমার ক্ষেত্রে কোন কোন সময় প্রোগ্রামের বাস্তবায়নটি অধিকাংশ সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে থাকে। আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। স্বল্প সময়ের  সফর। একান্ত আমার উপলব্ধি, আমার জ্ঞান, বাস্তব পরিদর্শন আর ইতিহাস থেকে নিয়েই লেখনিটি। পাঠককুলের সামান্যতম উপকারে আসলেও আমার এলেখা সার্থক হবে।

সৌদি আরব এশিয়া মহাদেশের একটি পাহাড়ী মরুময় এলাকা। অধিকাংশ এলাকায় গাছ-পালার সমাহার বাংলাদেশের মত নাই বললেই চলে। এমন পাহাড়ী স্থানে দিনে প্রচন্ড গরম আর রাতে ঠান্ডা অনুভব হয়েছে। এ রুহানী যাত্রায় আমরা সৌদির মক্কা আর মদিনায় এই প্রথম। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ থেকে মার্চ মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত ওমরায় ছিলাম সৌদিতে।
হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে আল্লাহকে জানাই- ইয়া আল্লাহ, আপনার কোন নিয়ামতকে আমরা অস্বীকার করতে পা্রি? প্রিয়তমা স্ত্রী আর এক মোহসিন শিশু বাচ্চাকে নিয়ে আপনার কৃপায় এই গোনাহগার বান্দা (Wheel-Chair-user) একটু পরেই উড়াল দিবে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত আর সাইয়্যেদুল মুরসালিন-খাতামুন নাবিয়্যিন- এর জন্মভূমি মক্কার বাক্কা উপত্যাকায়।

ওমরা হজ্জ যাত্রীদের অভিন্ন পোশাক, দু’খানী সিলাই বিহীন সাদা কাপড়। নেই কোন বাদশা-ফকিরের পার্থক্য, সাদা-কালোর নেই কোন তারতম্য, নেই দেশ-বিদেশের পার্থক্য, নারী -পুরূষ সবাই একমুখী এক অভিন্ন উদ্দেশ্যে ছোটা। মনে হয় যেন কাফনের কাপড় পরা মানুষের এক মিছিল। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর আহ্বানের পর থেকে এ রুহানী মিছিলের যাত্রা শুরু। এর যেন বিরাম নেই। সেই কা’বার মহা স্রোতে আমরা তিন মাজুর ব্যক্তি। ওহে খোদা, আমাদেরকে তুমি তোমার রহমত থেকে বঞ্চিত করো না। যা তুমি দিচ্ছ প্রতিদিন।

কা’বা ঘরের ইতিহাসঃ এ ঘরের ইতিহাস না জানলে যেন হৃদয়ে এক অতৃপ্ত তৃষ্ণা রয়ে যায়। হয়তবা ইহরামাবস্থায় ফরজ-ওয়াজিব ও অন্যান্য কাজগুলো সমাধা হয়ে যাবে। হয়ে যাবে ওমরাহ হজ্জও সমাপন। কিন্তু কোন কোন প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে কী কী কর্তব্য পালন করতে হচ্ছে পূর্বেই জানা থাকলে এক অনুপম আনন্দের মাঝে তা সহজ হয়ে যায়। তৃষ্ণিত আত্মা যেন ভরে যায় তৃপ্ততায়। ফেরেশতারা বানালেন পৃথিবীর আদিতম ঘর। হযরত আদম আ. এ’টাকে বানালেন প্রথম ইবাদতখানা। নবী নূহ আ. এর প্লাবনে এ’ঘর লুপ্ত হয়। এরপর অনেক ঘটনা ঘটে যায় কালানান্তরের মাঝে। এখানেই গাছের নিচে আল্লাহর হুকুমে ইব্রাহীম আ. তাঁর ছোট শিশু ইসমাইল ও বিবি হাজেরাকে রেখে গেলেন। আস্তে আস্তে বাক্কা উপত্যকায় জনবসতি গড়ে উঠে। মক্কার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার ও সৌন্দর্যের মধ্যমণি হয়ে উঠে “কা’বা শরীফ”। যাকে বাদ দিলে মক্কার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। মূলতঃ মক্কা নগরের উৎপত্তি খানায়ে কা’বাকে কেন্দ্র করে। কা’বা ঘর দুনিয়ার বুকে প্রথম ঘর। এ ঘর নির্মাণের পূর্বে বিশ্বে আর কোন ঘর ছিল না। সুরা আলে ইরমান-এর ৯৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে “নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্টিত হয়েছিল তাহাতো বাক্কায়, উহা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী।” এখানে বাক্কা বলতে মক্কাকে বুঝানো হয়েছে। সুরা আলে ইরমান এর ৯৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে – ”উহাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইব্রাহীম। আর যে কেহ সেখানে প্রবেশ করে সে নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যাহার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহে হজ্জ করা তাহার অবশ্য কর্তব্য। এবং কেহ প্রত্যাখান করিলে জানিয়া রাখুক, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।” সুরা হজ্জ এর ২৬নং আয়াতের মাধ্যমে জানা যায় – আল্লাহ ইব্রাহীম (আঃ)কে কা’বা ঘরের স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, আমার সাথে কোন জিনিসকে শরীক করবে না। আর আমার ঘর (কা’বা) তাওয়াফকারী ও রুকুকারী এবং সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখবে। আল্লাহর আদেশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তার ছেলে ইসমাঈল (আঃ)কে সাথে নিয়ে কা’বা ঘরের ভিত্তি স্থাপন করলেন। চারদিকে পাথর দিয়ে উঁচু দেয়াল গাঁথলেন। উচুঁতে দেয়াল গাঁথার সময় এক পাথরের সাহায্য নিলেন, যা মাকামে ইব্রাহীম নামে সর্বজন খ্যাত। এ’পাথরটি এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের। কা’বার দেয়াল গাঁথার সময় উচুঁতে এবং দেয়ালের চারপার্শ্বে যেখানে যেমনভাবে যাওয়া প্রয়োজন পড়ত সেভাবে ইব্রাহীম (আঃ)কে নিয়ে যেত এ পাথরটি। এ কা’বার সাথেই রয়েছে যমযম, হাযারে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহীম। এ’তিনটি স্থায়ীভাবে কা’বা ঘরের সাথে জড়িত এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রাচীন তত্ত্ব অনুযায়ী জানা যায়, ইবাদতের জন্য এ’টি পৃথিবীর প্রাচীনতম ইবাদত ঘর। মূলতঃ কা’বা ঘরের নির্মানকাল প্রায় চার হাজার বছর আগে। অন্যদিকে বায়তুল মোকাদ্দাস নির্মিত হয় প্রায় তিন হাজার বছরের কাছাকাছি। কা’বা ঘর নির্মাণ শেষ হলে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তার ছেলেকে নিয়ে আল্লাহর কাছে দো’য়া করলেন, যা সুরা বাকারার ১২৬ থেকে ১২৮নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

পরবর্তিতে আল্লাহর হুকুমে হযরত জিবরাইল (আঃ) হজ্জ্বের যাবতীয় নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিলে পিতা-পুত্র উভয়ে একত্রিত হয়ে সর্বপ্রথম কা’বা ঘরে তাওয়াফ করলেন। সুুরা হজ্জ্বের ২৭ নং আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ দুনিয়ার সকল মানব-আত্মাকে পবিত্র কা’বা ঘরে এসে হজ্জ্ব করার জন্য ইব্রাহীম (আঃ) কে আহবান করতে বললেন। কোন কোন তাফসীর থেকে জানা যায় এ’ হুকুমের পর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর কাছে আরয করলেন, “হে আমার রব, হে আমার আল্লাহ, এ মরুময় প্রান্তরে আমি লোকদেরকে ডাকলে, সে ডাক কত দূরইবা পৌছিবে? আর কত জনইবা শুনতে পারবে? তখন আল্লাহ বলেন “হে ইব্রাহীম, তোমার কাজ আহবান করা। আমার কাজ লোকদের কর্ণকুহরে পৌছে দেয়া। আর মানব-আত্মার কাজ এর জবাব দেয়া। তাই তুমি ডাক, আমি সকল মানব-আত্মার কানে তোমার এ আহবান পৌছে দিব”। এর পর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মসজিদে হারামের দক্ষিনে মিসফালার মুখের অংশে অবস্থিত অনুচ্চ পাহাড় জাবালে “আবু কোবায়েস” এর উপর উঠেন। বিশ্বের সকল মানব-আত্মাকে আল্লাহর ঘরের দিকে ডাকেন। আর আল্লাহ তাঁর কুদরতী শক্তি দিয়ে বিশ্বের সকল মানব-আত্মার কর্ণকূহরে পৌছে দেন। কিয়ামত পর্যন্ত সৌভাগ্যবানরাই কা’বা অর্থাৎ আল্লাহর ঘর (বায়তুল্লায়) এসে হজ্জ্ব করবে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সে ডাকের ফলেই। বিভিন্ন সময়ের সম্প্রসারণের ফলে বর্তমান মসজিদুল হারামে প্রায় ৪০ লক্ষাধিক মুসল্লি একসাথে সালাত আদায় করতে পারেন।

কা’বা-শরীফ-কে হারাম শরীফ বলা হয় কেনঃ হারাম অর্থ সম্মানিত। কা’বাকে হারাম শরীফ করার কারণ হলো এখানে নিরাপত্তা থাকবে। করা যাবে না কোন ধরণের হত্যাযজ্ঞ কর্মকান্ড পরিচালনা। এটি হবে সম্মানীত ঘর। সুরা বাকারার ১২৫নং আয়াত থেকে জানা যায় – ”এবং সেই সময় স্মরণ কর, যখন আমি কা’বা গৃহ-কে মানব জাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করিয়াছিলাম এবং বলিয়াছিলাম তোমরা মকামে ইব্রাহীম-কে সালাতের স্থানরূপে গ্রহন কর। এবং ইব্রাহীম ও ইসমাঈল-কে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখিতে আদেশ দিয়াছিলাম”। তাই যুগে যুগে ইসলাম প্রিয়রা ও বিশ্বস্থতরা কা’বা শরীফকে সম্মান প্রদর্শন করে আসছে। একটি হাদীস থেকে জানা যায়- ”হুজুর (সা.) ফরমান, ইব্রাহীম(আ.) মক্কাকে হারাম বানিয়েছিলেন, আর আমি মদীনাকে হারাম বানালাম।”

হজ্জের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ বিশ্ব মুসলিম মিল্লাতের জন্য যেমন রমজান মাস তাকওয়া ও পরহেজগারীর মৌসূম। তেমনি হজ্জের মাসও বিশ্ব মুসলিমের পূনর্জাগরণের মৌসূম। আল্লাহ সুবহানুতা’য়ালা মানব দেহের মধ্যস্থলে হৃদপিন্ড যেমন সংস্থাপন করেছেন। বিশ্বের কেন্দ্রভূমি হিসেবে পবিত্র কা’বা-কে তেমনি ভাবে সংস্থাপন করেছেন। সূরা হাজ্জ এর ৪৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- ”তাহারা কি পৃথিবী ভ্রমণ করে নাই? তাহা হইলে তাহারা জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হইতে পারিত। বস্তুতঃ চক্ষু তো অন্ধ নয় বরং অন্ধ হইতেছে বক্ষস্থিত হৃদয়।”

আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছরেরও আগে মহান আল্লাহ মুসলিম জাতির পিতা নবী ইব্রাহীম(আ.) মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা করার নির্দেশ দেন। পরে সুরা আলে ইমরানের ৯৭ নং আয়াতের মাধ্যমে সাইয়্যেদুল মুরসালিন, খাতামুন ন্যাবিয়িন হযরত মুহাম্মদ(সা.) এর মাধ্যমে হজ্জে গমনের নির্দেশ দেন। এ’নির্দেশের মাধ্যমে আল্লাহ তার সেরা জীবকে বলতে চাচ্ছেন ”হজ্জের সময় আগমন করে কা’বা শরীফে একত্রিত হয়ে আল্লার অনুগত বান্দারা নিজের চোঁখে প্রত্যক্ষ করবে এটা তাদের জন্য সত্যিকার এক কল্যানজনক ব্যবস্থা”।
হজ্জ মানুষকে তার নফস অশ্লীল, বেহায়াপনা, নিলর্জ্জতা, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা, ঝগড়া-ফ্যাসাদ ইত্যোকার কাজ থেকে বিরত রাখে। ফলে একজন হাজী যেন আল্লার সৈনিকে পরিণত হয়। ৫-৬ দিনের ক্যাম্পে অবস্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিটি মুসলিমের জীবনকে সৈনিকের ট্রেনিং দিয়ে গঠন করা হয়ে থাকে। হে কা’বার মালিক আল্লাহ, এ’ধরণের সুযোগ আমায় আবারো করে দিয়েন। আমিও এসেছি ওমরায়। সম্প্রতি যে ট্রেনিং (ওমরাহ হজ্জ-১৮) নিয়ে এলাম তা ছিল খানায়ে কা’বা তাওয়াফ, সাফা-মারওয়া পাহাড় সাই করা ছাড়া আর কিছুই নয়। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও আমি যা সম্পন্ন করতে পেরেছি, তাতো তাঁর কৃপা ছাড়া আর কিছুই নয়। হজ্জ উপলক্ষে যে সফর করা হয় তা যেন অন্যান্য সফর থেকে আলাদা। এক ভিন্ন স্বাদ ও তৃপ্তির অন্বেষনে উন্মুখ মন প্রাণ আর আত্মা। পার্থিব দাবী পূরণের জন্য তা করা হয় না। করা হয় শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লার আদেশ পালনের বাস্তবায়ন। অপার্থিব এক সুখময় কল্যানের অনুসন্ধানে।

কেন গেলাম খানায়ে কা’বায়ঃ আব্বা ও মা, আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই ডাঃ মোঃ শফি উল্লাহ এর সাথে হ্জ্জ করেছেন ১৯৯৮ ইং সালে, যা আকবরী হজ্জ হিসেবে আখ্যায়িত। ডাঃ মোঃ শফি তখন সৌদি আরবে চাকরি করত। মায়ের মুখে শুনেছি একবার হজ্জে গেলে নাকি বার বার যেতে ইচ্ছে করে। আমার নানা-নানী, খালা-খালু, ছোট ভাই তার মিসেস ও ছোট বোন মিস্টি হজ্জে গেছেন। এছাড়াও হজ্জ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি, অনেক বই পড়েছি ইতোমধ্যে। নাজমা ফেরদৌসীর হজ্জ এর উপর লিখিত বই ”আল্লার অতিথি” পড়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। বাস্তব দর্শন আর শুনার মধ্যে অনেক তফাৎ। মনের গহীনে কখন যে কা’বাকে ভালো বেসে ফেলেছি, তার দিন ক্ষণ এখন আর মনে নেই। কা’বা গৃহ প্রদক্ষিণ করতে যাওয়ার এরাদা করার সাথে সাথে মনে হবে সোনার মদিনায় মসজিদে নববীতে শায়িত আছেন যুগশ্রেষ্ঠ মহা মানব হযরত মুহাম্মদ(স.) এর রওজা মোবারক জিয়ারত। এ আকাঙ্ক্ষাও উক্ত প্রোগ্রামের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

হজ্জে যাব যাব করছি। সময় গড়িয়ে অনেকগুলো বছর পেরুল। চিন্তার মধ্যেই যেন আছি। কিন্তু তার বাস্তবায়ন করে উঠতে পারছি না। ২০১৭ এর শেষ দিক থেকে ২০১৮ সালের প্রথম দিক। কেন জানি মনটি অশান্তির দাবানলে জ্বলছিল। শেষে পূর্ণ প্রস্তুতি না নিয়ে মন স্থির করে ফেললাম। ওমরা হজ্জটি করে আসি। ভাল কাজ করতে যাওয়াতেও শয়তান আষ্টে পৃষ্টে বাঁধা দিতে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। হাতে সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। তবুও যেতেই হবে। মন কোনভাবেই যেন বাঁধ মানছে না। শেষে স্থীর করলাম স্টক শেয়ার বিক্রি। উক্ত অর্থ দিয়েই ওমরাহ। চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও দেরি হচ্ছে। কারণ বিক্রির জন্যতো শেয়ার মার্কেটে যেতে হবে। এমনিতে অফিসে কাজের চাপ। দশ মিনিটের পথ। মার্কেটেও যেতে পারছি না। শেষে ১৩/০২/২০১৮ইং তারিখ বিকাল ২.৩০টার দিকে আইসিবি, কাকরাইলে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী নাসমিন আনোয়ার ছবির মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করি। তাড়াহুড়া করছিলাম দ্রুত অর্থ ছাড়করণের। কিন্তু সেখানেও বাঁধ সাধলো। যাক, শেষে নাসমিন আনোয়ার (ছবি) বলল, টাকা পেতে দেরী হলে আমি দিব। টেনশন থেকে সাময়িক অবসান ঘটল। সবশেষে ২২/০২/২০১৮ তারিখে টাকা একাউন্টে জমা হওয়ার ম্যসেজ এলো। তৎক্ষনাত ক্যাশ করি। শুকরিয়া আল্লাহর। কোন প্রোগ্রাম সফল করতে হলে, সে প্রোগ্রাম নিয়ে চিন্তা ভাবনা আগে ভাগেই করে প্রগ্রাম সিডিউল করা প্রয়োজন। ওমরাহ হজ্জ প্রোগ্রামের সিডিউল করা উচিৎ ছিল এজেন্সির এবং তা যাত্রীদের জানায়ে দেয়া উচিৎ ছিল। আমার এজেন্সি তা করে নাই। আমিও এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলাম।

টীম সদস্যবৃন্দঃ আমাকে জানানো হয়নি ওমরাহ এ’টীমে কারা কারা যাচ্ছে আমার সাথে। এমনকি আমি জেনেও নেয়নি। তবে আমার ভুবনে তিন জনা। আমি, প্রিয়তমা সহধর্মীনি প্রভাষিকা শাহানারা পারভীন ও ক্লাস ফোরের পড়–য়া ছোট ছেলে যুবাইর। হাতে টাকা না থাকলেও সহধর্মীনিকে বাদ দিতে পারিনি। কেননা আমার এন্তেকাল হলে, তাকে এ’ক্ষেত্রে ছেলেদের উপর নির্ভর করতে হবে। এ’এক মর্মদন্তু পিড়াদায়ক নির্ভরতা। সে সংসারটিকে ২৮ বছর অবধি আগলিয়ে রেখেছে। তার আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক শ্রমের অবদান অস্বীকার করি কি করে? সেই ধর্মভীরু সরলা রমনীকে কিভাবে পরনির্ভরতায় রাখি? তাও ওমরার ব্যাপারে। এটা মন মেনে নিতে পারিনি। তাই শেষে আমরা তিন জনাই ওমরায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

মি. রাসেলের মাধ্যমে যাওয়াঃ আমরা যাচ্ছি ওমরা হজ্জে। M. Taiyeba Tours & Travels (Shiddeswari High School Jame masjid, Licence # 911) এর স্বত্বাধিকার জনাব কাজী রাসেল আহমেদ এর মাধ্যমে। তিনি জানেন আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী (Person with disabilities)। যে নাকি হুইল-চেয়ার ছাড়া কোনভাবেই চলতে ফিরতে পারে না। কেন অন্যান্য টীম সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন নাই, তা আমি জানি না। জনাব কাজী রাসেল বললেন, ”আপনার সাথে এমন লোক দিব কোন সমস্যা হবে না”। ওমরাহ শেষে বুঝতে পারলাম তিনি অন্য একজনের ওমরাহ লাইসেন্সে আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। ওমরাহ সমাপন শেষে ওমরা লাইসেন্সধারী অগউঅ ঞড়ঁৎং ্ ঞৎধাবষং (খরপবহংব # ০৫৯৪) এর এর স্বত্বাধিকারী জনাব মোঃ সাব্বির হোসেন-কে ২৬/০৩/২০১৮ তারিখে জিজ্ঞাসা করলাম আমাদেরতো খোঁজ খবর নিলেন নাত? গম্ভীর কন্ঠে জবাব এলো-এটা আমার কাজ নয়। পাঠক বুঝতেই পারছেন, আমাদের এ্যাজেন্সিদের জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু- কোন্ পর্য়ায়ে। একটি অপার্থিব ধার্মিক বিষয়াবলী নিয়ে কত তালবাহানা। অর্থ তাদের কাছে মুখ্য তবে তার ভাই জনাব মোঃ তানভীর হোসেন এর প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি মক্কা-তে হোটেল ও খাওয়-দাওয়া কেন্দ্রিক অমার খোঁজ খবর রেখে ছিলেন।

জনাব কাজী রাসেল আহমেদ এক বিশিষ্ট মরহুম সমাজ সেবক ব্যক্তির আত্মীয় পরিচয় দিলেন। আমি তার (মি. রাসেল) প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম। তিনি আমাদের ০৩ জনের MOBA, Tickets ও অন্যান্য ওমরাহ হজ্জের প্রসেসিং করে দিলেন। কোন অগ্রিম অর্থ ছাড়াই। আমি এতটাই তাকে বিশ্বাস করেছিলাম যার ফলে অন্য কোন এ্যজেন্সির সাথে আলাপ করি নাই। শেয়ারের টাকা হাতে আসবে এমন গ্রীন সিঙ্গাল পেলাম। বাসায় রাতে খাওয়ার টেবিলে মি. রাসেলকে জানাই ওমরায় যেতে চাই। তার কথায় জানা যায় আমাদেরকে বিশাল এক গ্রুপের সাথে পাঠাবেন। তড়িঘড়ি করে রাজি হলাম। এটা ভেবে বড় গ্রুপের সাথে গেলে এই প্রতিবন্ধী পরিবারটি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। ওমরা হজ্জ কেন্দ্রিক দিক নির্দেশনা পাবে। মি. রাসেল একজন হাজীর(জনাব মোকাররম) মোবাইল নাম্বার দিলেন। যিনি আমাকে ইহরাম বাঁধা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগীতা করবেন। টীমের অন্যকোন সদস্যের নাম ঠিকানা দিলেন না। আমিও চাইনি। বিধি বাম সাঁধলো।
পালতোলা নাবিকহীন জাহাজে আমারা তিন জনা। মনে হয়েছিল মি. রাসেল আমাদেরকে সৌদি আরব ভ্রমণে পাঠিয়ে দিল। আমরাতো ভ্রমণে নয়, ওমরাহ-হজ্জের এরাদা করেছি। তবে কেমন এ’আচরণ? এক আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাক্কা উপত্যাকায় যাওয়া। মি. রাসেল জানার পরও এ’তিন সরল ধর্ম-প্রাণ মানব মনের সাথে এমনটি আচরণ করল। তা আমার এখনও অজানা রয়ে গেল। আমি কিভাবে রাহবার ছাড়া মক্কাতে পৌছালাম? একটি বারও মি. রাসেল আমার সাথে সরাসরি যোগাযোগও করে নাই। ক্ষোভে আমিও করি নাই। আমার বড় ছেলে বলেছিল সব টাকা আগেই পরিশোধ করো না। হজ্জ থেকে ফিরে এসে বুঝে শুনে বাকীটা পরিশোধ করো। আমি তার কথায় কান দেইনি। কারণ একটি মহৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাচ্ছি। এটাই হয়তঃবা আমার জীবনের অন্তিম যাত্রা। এখানে নয়-ছয় করার মানে নেই। সেহেতু যাওয়ার আগেই গোটা টাকাটাই (২.৯ লক্ষ) পরিশোধ করি। এ লেনদেনটি হয় সিদ্ধেশ্বরিস্থ মসজিদে অর্থাৎ আল্লাহর ঘরেই বসে। হজ্জে গিয়ে জানতে পারি আমার কাছ থেকে তুলনামূলক বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শর্ত মোতাবেক সার্ভিস দেয় নাই। অন্যদিকে আমি সৌদিতে পালিয়ে থেকে গেছি বলেও এ্যজেন্সির অন্যন্যরা অভিমত প্রকাশ করেছে। কেন তাও জানি না।

আল্লাহর কাছে শতসহস্র কোটি শোকর। কিছু জ্ঞান বুদ্ধি তিনি দেয়ার কারণে পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌছে ছিলাম। নির্ধারিত কাজগুলো সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম কোন ধরণের মোয়াল্লিম এর গাইড ব্যতিত। তবে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ একজন মোয়াল্লেম এর প্রয়োজনীয়তার তীব্রতা অনুভব করেছিলাম পরতে পরতে। প্রথম হজ্জ যাত্রীর জন্য এর প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই এই পদের Provision রাখা হয়েছে। মোয়াল্লেম আপনাকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে স্বল্প সময়ে অনেক ফায়দা হাসিলের করে দেয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভুমিকায় থাকে। যা কা’বা গৃহে ও মসজিদে নববীতে অন্যান্য টীমে টীম-লিডারদের দিক নির্দেশনায় ফুটে উঠেছিল।
হজ্জ যেহেতু একটি মহৎ ইবাদত, এটাকে যেনতেনভাবে নেয়াটা যুক্তি সংগত নয়। শ্রষ্টার কাছে তাঁর সেরা জীবের হৃদয়ের করুণ আকুতি-মিনতি-আর্তি জানানোর অভিপ্রায়ে পৃথিবীর প্রাচীনতম গৃহ ”বায়তুল্লাহ”-এ গমন। এখানে জীবনের সমস্ত সঞ্চয়ীর সাথে কায়িক শ্রম আর সময় ব্যয় জড়িত। এমনকি এটি অন্তিম ইচ্ছা/যাত্রাও হতে পারে। তাই আমার দৃষ্টিতে হজ্জে যাওয়ার আগে প্রত্যেক নবাগতের এ্যজেন্সির মূল মালিকের মুখমুখী হয়ে যা যা জানা একান্ত প্রয়োজন, তাত্মিক রূপ বলে আমার ধারণা হয়েছেঃ
০১। যিনি পাঠাচ্ছেন-তিনি কি সরাসরি না অন্যের লাইসেন্সে পাঠাচ্ছেন? Responsibility কে নেবেন?
০২। মক্কা/মদিনার দায়িত্বশীলের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার সঙ্গে রাখা।
০৩। সাথে মুয়াল্লিম দিচ্ছে কি না ? তার নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার নিয়ে নেয়া এবং তার সাথে পূর্বেই পরিচিত হওয়া
০৪। কোন কারণে মুয়াল্লিম যেতে না পারলে- কি হবে? তা বুঝে নেয়া
০৫। টীমের অন্যান্য সদস্যদের কয়েক জনের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার রাখা
০৬। কোন এয়ারলাইন্সে, কবে, কোন সময় যাচ্ছেন এবং কবে, কোন সময় দেশে ফিরছেন- সব মিলে কত দিনের প্যাকেজ দিচ্ছে ?
০৭। দিনের খাবার কখন কখন দিবে, নাকি নিজের কিনে খেতে হবে ?
০৮। হোটেল কোথায় দিবে (কা’বা শরীফ ও মসজিদে নববী থেকে কত দূরে)? হোটেল রিজার্ভেশনের ডকুমেন্ট নিয়ে রাখবেন।
০৯। মক্কা ও মদিনায় কোথায় কত দিন করে অবস্থান করাবেন?
১০। মক্কা ও মদিনার জিয়ারায় কোন কোন স্পটে যাবেন তার তালিকা নেয়া এবং বহন খরচ কার?
১১। ঢাকা ও সৌদি এয়ারপোর্টে হজ্জ কাফেলার প্রতিনিধির উপস্থিতি থাকবে কি না? অর্থাৎ আপনাকে রিসিভ/বিদায়ে থাকবে কিনা?
১২। কে.এস.এ পৌছে সিম কার্ড (এক ব্যক্তির জন্য একটি করে ফ্রি) কে দিবে ? তার নাম কি?
১৩। ১ম দিনে (মক্কায় ও মদিনায়) সব কিছু হাতে কলমে বুঝিয়ে দিবেন কিনা?
১৪। আপনি যে প্যাকেজের টাকা নির্ধারণ করলেন, কিন্তু শর্ত সব পূরণ না হলে কি হবে- লিখিতভাবে জেনে নিতে হবে আগে ভাগে।
১৫। কোন কোন খাতে কত টাকা নিচ্ছে তার টোটাল ব্রেক-আপ স্বাক্ষরসহ লিখে রাখবেন
১৬। মোহরেম নিয়ে কোন কারসাজি করেছে কিনা? ডকুমেন্টটি চেক করে দেখবেন এবং সংগে রাখবেন।
১৭। সম্ভব হলে প্যাকেজের ৮০% পরিশোধ এবং হজ্জ শেষে প্রতিশ্রুতির ১০০% বাস্তবায়ন হলে বাকী ২০% প্রদান

এবার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আপনার সার্ভের মধ্য থেকে কোন এ্যজেন্সির মাধ্যমে গেলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। হাজীদের মেন্টাল এন্ড ইস্পিরিচুয়াল স্পীরিটকে নিয়ে বাংলাদেশী হজ্জ এ্যজেন্সিরা ফটকাবাজারী করে থাকে। কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে নয়। শুধুমাত্র এ’বিষয়ে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে পাঠকবৃন্দের একান্ত সুবিধার্থে অবতারণা করেছি মাত্র।

পরিধেয় বস্ত্রের ধরণ ও রংঃ মক্কা ও মদিনাতে গিয়ে রোজা রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করি। খুলনা থেকে বদলী হয়ে আসা হিসাব কর্মকর্তা জনাব কাজী মোঃ নুরুননবী আমাকে টিপস দেন। ২৫/০২/২০১৮)-তে অফিস থেকে বেরিয়ে যাব এমন মুহুর্তে বললেন- কা’বা শরীফ ছাড়া পৃথিবীর কোন মসজিদে তাওয়াফের বিধান নেই। তাই বেশি বেশি করে তাওয়াফ করবেন। কা’বার দিকে চেয়ে থাকবেন। তাকিয়ে তাকিয়ে দো’য়া দরুদ পড়তে থাকবেন। এ’ভাবে সময় কাটিয়ে দেবেন। ইহরামের পর হালাল হলে শার্ট-প্যান্ট পরিধান না করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরিধান করবেন। দেখবেন মনে প্রফুল্লতা এনে দিবে। তার কথামত বাসায় যাওয়ার পথে সাইন্সল্যাব থেকে আমার ও যুবাইর এর জন্য এক সেট করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী কিনি। পূর্বেরটা মিলে দুইটি করে সেট হলো। জনাব মোঃ নুরুননবীর পরামর্শ আমায় কাজে দিয়ে ছিল বহুলাংশে। দো’য়ার দরখাস্তের সময় তার নামটি বাদ পড়েনি আমার হৃদয় থেকে। মনে হয়েছিল সুব্রতার প্রতীক সাদা রঙ্গের আরো এক সেট থাকলে কতই না ভালো হতো। পবিত্রতার শীর্ষে উঠে আরাধনায় লিপ্ত হতে হয়। সেখানে পরিষ্কার পরিচ্ছনতার পিছনে সময় ব্যয় না করে ২/১ সেট কাপড় বেশী নেয়াই শ্রেয়। যতটুকু সময় বেশি পাওয়া যায়, তা যেন সেই দরবারে-ইলাহীর জন্য ব্যয় করা যায়। এমন মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। প্রথম যাত্রার এ’ত্রুটি বিচ্যুতি পরবর্তি যাত্রায় আরো উৎকর্ষিত সাধিত হবে-এ’আকাঙ্খা মহান আল্লার দরবারে। (চলবে)

 

 

 

কিভাবে মক্কাতে পৌাছালামঃ ২৫/০২/২০১৮ইং তারিখে সন্ধ্যা ৭.০০টা। গোসল, নামাজ ও অন্যান্য বিষয় গুছিয়ে অপেক্ষায়। মাইক্রোবাস এলো। জিগাতলার নিঝুঁম আবাসিক এর বাসা থেকে সবাইকে(৬জন) নিয়ে এয়ারপোর্টে রওনা হলাম। অন্যদেরকে টারমিন্যালের বাইরে রাখি। আফিফকে নিয়ে আমরা তিনজন Saudia Airlines এর অভ্যান্তরে ঢুকলাম। ঝধঁফরধ অরৎষরহবং -এর কাউন্টারে ল্যাগেজ-পত্র ও নিজস্ব ব্যববহৃত হুইল-চেয়ারটি দিয়ে ট্যাগ বুঝে নিলাম। বোর্ডিং কার্ড  তিনটি সযত্নে রাখলাম। ডিউটিরত অফিসারকে আমার অসুবিধার কথা জানালে সিটত্রয় বাথরুমের অদুরে চমৎকার অবস্থানে পেয়ে গেলাম। সেই ২৩.১০.২০০১ইং তারিখ জাপানে যাওয়া ছাড়া এর মধ্যে আর বর্হিঃবিশ্বে যাওয়া হয় নাই। তাই অনেক নিয়ম কানুন ত্বরিৎ সেরে না নিতে পারলেও অসুবিধা হয়নি। এ’বারের এ’যাওয়া ভ্রমণে যাওয়া নয়। এ’যেন এক ও অদ্বিতীয় বিশ্ব জাহানের অধিপতি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে যাওয়া। তিন বান্দার পিছনের সব ভুলত্রুটি ক্ষমা চাওয়ার এক চরম ও পরমতম সুযোগ এলো। এক অনুপম আতিœক ও অপ্রার্থিব সম্পর্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য পাগলপারা তিনটি মন। অপেক্ষার পালা যেন শেষ হয় না।

হাতে সময় খুবই সংর্কীন। কই সে মুয়াল্লেম? যে আমাকে ইহরাম বেঁধে দিবে। আমাদের রাহবার হবে। ওমরার দিক নির্দেশনা দিবে। কই, না তিনি আর এয়ারপোর্টে এলেন না। এমনকি এ’বিষয়টি তিনি জানালেনও না। ইতোমধ্যে আমি তাকে অনেকবার ফোন করলে তিনি বললেন এইতো আসছি। সময় কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। আমি হিসেবের পাতা খুলি। সময় মিলিয়ে দেখি। পরের উপর ভরসা ! সর্বনাশ ! আর অপেক্ষা নয়। বাপ-বেটায় সুন্দর করে ওজু করি। ইহরাম বাঁধি। দু’রাকাত নামাজে আমরা তিন জনে জানু পাতি।

সৌদিয়া এয়ার লাইন্স। হজ্জ যাত্রীদেরকে প্লেনে ঢুকতে অগ্রাধিকার দেয়। আমরা সযত্নে প্রবেশ করলাম। ঢাকা থেকে মক্কার এয়ার ফ্লাইং দূরত্ব ৫,১৭৫ কিলোমিটার। এক টানা ছয় ঘন্টায় পাড়ি দিল উড়োজাহাজটি। ভোরে জেদ্দা এয়ারপোর্টে  পৌছালাম। মালামাল বুঝে পেলাম। ফ্রেস হলাম। ফজরের নামাজ সমাপ্ত করি। এখন আমার কাজ কি? আল্লাহ আমায় পরীক্ষা কর, কিন্তু পাস করে দিও, বোঝা চাপিও কিন্তু ভারবহন করার শক্তি দিও। আমিত তোমার এক পাপি-তাপি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। যে নাকি একেশ্বরবাদীতে বিশ্বাসী। একান্ত মনে বলতে থাকলাম। আমায় ক্ষমা কর, সহজ কর আমাদের ওমরাহ। এখন আমায় পথ দেখিয়ে দেয়ার কেউ নেই। তুমিই ভরসা।
জেদ্দা এয়ারপোর্টের টারমিনালটি এক বিশাল আয়তনের। টারমিনালে বেরিয়ে আসার আগে ঐখানকার এক চাকুরীজীবী বললেন টারমিনালে গাড়ী হাজ্জীদের জন্য অপেক্ষা করছে। কত ভাড়া লাগবে? কিছুই লাগবে না বলে তার আধো কথা আর ইঙ্গিতে বুঝলাম। এক বড় তাবুর নিচে দাড়িয়ে থেকে সাহায্যকারী খুঁজছি। আল্লাহ আমাদের রহম করলেন। সৌদি দুই তরুণ আমাকে কোলে করে বিশাল উচু গাড়ীতে উঠিয়ে দিল মাঝ বরাবর ছিটে। যুবাইর ও তার আম্মা সামনের দিকের ছিটে বসল। কোচ তার আপন গতিতে ছুটে চলল। জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে বড় কোচে পবিত্র মক্কাতে পৌছাতে সময় নিল ১.৩০ মিনিট। ইহরাম বাঁধা অবস্থাতে আছি। সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত কিন্তু এক অদৃশ্য ভালোবাসা মনের গভীরটি আচ্ছন্ন্।
সম্ভবতঃ কোচটি মিসফালার কাছাকাছি থামল। এখন কোথায় যাব? পথ দেখাবার কেউ আসেনি? মহাবিপদ? ওদিকে কোচওয়ালা যাত্রীদের সকলের পাসপোর্ট নিয়ে নিল কোচ চাড়ার ৫/৬ মিনিটের মধ্যে। এ’এক মহাচিন্তা? সব মিলিয়ে আমি ঢ়ুুঁষব হয়ে গেছি। আল্লাহকে বললাম, আমায় পরীক্ষা কর, কিন্তু পাস করিয়ে দিও। বহিবার আর সহিবার শক্তি দিও। আমাদের রহম কর। কর হজ্জকে সহজ এবং মাবরুর। হঠাৎ মনে হলো গলায় ঝুলিয়ে রাখা আইডি-কার্ডে মক্কার কোন টেলি. নং আছে কিনা? পেয়ে গেলাম। সিলেটের এক বাংলা ভাষাভাষি ভাই আমদের সাহায্যে এগিয়ে এলো। ফোনে কনটাক্ট করে অখ-ইঅঘঙঘঅ ঐঙঞঊখ(হবধৎ গবৎরফরধহ ঐড়ঃবষ, তধশধশ ইধংঁহবষ) ঐড়ষু গধশশধয, অলরুধফ -এ পৌছাই সিলেটি ভাইকে নিয়েই। তাঁকে ৩০ রিয়াল দিলে তিনি খুশী হয়ে বিদায় নেন। সেখানে তিনি অবৈধ ভাবে বসবাস করছেন এবং সর্বক্ষন আতংকে দিন অতিবাহিত করছেন বলে জানান। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ৩০৬ নং রুমে গিয়ে উ্ঠলাম। ফ্রেশ হলাম। দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম মূল কাজে। জানিয়ে বা বুঝিয়ে দেয়ার কেউ ছিল না। যেন অভিভাবকহীন এক এতিম পরিবার।
ইহরামের কাপড় পড়ার অর্থই হলো কাফনের কাপড় পরিধান। দু’টুকরো সাদা সেলাইহীন ইহরামের কাপড় গায়ে দুই বাপ-বেটায়, সংগে সংগিনী, মুখে লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক …… বলতে বলতে কা’বার পানে এগিয়ে চলি। শ্রষ্টার সাথে তাাঁর সৃষ্টির সেরা জীবের সাক্ষাতের এক অনুপম পবিত্র পরিবেশ উপলব্ধি করি।
আমি ডযববষ-ঈযধরৎ-ঁংবৎ হওয়ার কারণে আমাকে ”আরাবিয়া” বলেন কা’বায় নিয়োজিত সৌদি এরাবিয়ানরা। মূল কা’বার চত্তরে ”আরাবিয়া”দের ঢুকতে দেয়া হয় না। এযে আমার জন্য কত বড় কষ্ট, তা কাকে বোঝাই। অন্তর আমার ঢুকরে কাঁদে। তাই বাধ্য হয়ে কিং আ. আজিজ গেইট দিয়ে ২৬/০৩/২০১৮ইং তারিখে যুবাইর ও তার আম্মাসহ মাতাফে প্রবেশ করি। কালো গেলাফে মোড়া কা’বা চোঁখে প্রথমে আবিষ্ট হয়। যা কোরানের বিভিন্ন সুরায় খোদ আল্লাহ বলেছেন। আমি বলি – হে দো-জাহানের এক ও একমাত্র অধিপতী আমার আল্লাহ, আমাদের জন্য দোযোখ হারাম করে বেহেস্ত ওয়াজিব করে দাও। দাও আমাদের পূর্বের গোনাসমূহ মাফ করে। কর আমাদের ক্ষমা, কর আমাদের তোমার মনোনিত সৎ বান্দাদের তালিকাভুক্তিতে। আমি যে তোমার এক প্রতিবন্ধী গোনাগার বান্দা। শত বাঁধা অতিক্রম করে এ’ রুহানি মনজিলে আসার তৌফিক তুমিই আমায় দিয়েছ। সহশ্রকোটি শোকর তোমার দরবারে। তুমিই পার সব কিছু করতে। আমাদের হজ্জ সহজ ও মাবরুর করে দিও।
আস্তে আস্তে এগুতে থাকি সবুজ চিহ্নিত বাতির কাছে। হাজরে আসওয়াদ বরাবর। দোয়া পড়ি। যত ঘুরি, বিছিন্ন হতে পারি না। হাজরে আসওয়াদ থেকে মুলতাজাম হয়ে হাতিম, হাতিমের আগে রুকনে ইরাকি, এর পর রুকনে শামি হয়ে রুকনে ইয়ামেনী, রুকনে ইয়ামেনী হয়ে হাজরে আসওয়াদ আসলে পূর্ণ হয় এক চক্কর। এ’যেন ঘড়ির কাটার বিপরীতে শ্রান্তিহীন আবর্তন। আড়াই চক্করের মাঝে যুবাইরকে হারাই। তার মায়ের সেকি কান্না। কেন যেন আমার কোন ভাবান্তর ঘটল না। সাত চক্কর করি শেষ। দু’রাকাত নামাজে রত হই। যমযমের পানি পান করি। সাফা-মারওয়ার দিকে রওনার পালা। পথে দেখি আল্লার মোহসিন যুবাইর দাড়ায়ে আছে। মায়ের সেকি প্রশান্তি-দিপ্ত চোঁখ।
উঠে যাই সাফা পাহাড়ে। সাফা থেকে মারওয়া। মারওয়া থেকে সাফা – এ’ভাবে সাত বার সাঈ। বিরামহীন আবর্তনে হাজীদের সাথে লীন হয়ে যাই আমি, আমরা সবাই। এ’আমাদের প্রথম ওমরা। অভিজ্ঞতার বালাই নেই। হুইল-চেয়ার ইউজার হওয়াই সাহায্যের হাত বাড়ায় এক নওজোয়ান। চক্করের মধ্যখানে ডযববষ-ঈযধরৎ এর সামনের ছোট চাকাটির নাট বল্টু খুলে যায়। অমি পাহাড়ে ওপর পড়ে যাই। অল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছে। বিমর্ষ হই। তবে থমকে যাইনি। ভিন দেশী ভিন ভাষী হেল্পকারী লজ্জাবোধ করলেন। বললাম ফড়হ’ঃ ভববষ ংযু. চষবধংব ুড়ঁ সধু মড়, অষষধয মরাব ুড়ঁ তধুধ-ব-কযধরৎ. আমি আল্লাহকে বললাম, হে আমার আল্লাহ আমায় রক্ষা কর, যেমন করেছ বিবি হাজেরাকে। আমি তাদের মত নই, গোনাগার বান্দা আমি। হুইলের নাটটি ঢুকায়ে বলি আর খুলো না আল্লাহ। এ’বিদেশ ভুইঁয়ে আমরা কিছুই চিনি না। আজই প্রথম পর্দাপন এ’পবিত্র মাটিতে। আমাদের জন্য সব কিছু সহজ করে দাও। খুব সর্তকতার সাথে সাঈ-য়ের কাজ সমাপ্ত করি। আল্লার ইচ্ছায় হুইলচেয়ারের নাটটি আর খুলে নাই। শেষে মাথা মুন্ডন করে হালাল হই। সমাপ্ত করতে পারি প্রথম যাত্রার পদক্ষেপ। আল-হামদুলিল্লাহ।
শৈশবে মা-বাবার ¯েœহের ছায়াতলে। কৈশরে ভাই-বোন-খেলার সাথীদের আবিষ্টে। তারুন্যে ব›ধু-বান্ধব-সহকর্মী-সহযাত্রীদের সান্নিদ্ধে। বার্ধ্যকে কে কোথায় হারিয়ে যায়। জীবদ্দশার শেষ প্রান্তে স্ত্রী হয় শেষ সম্বল। সেই স্ত্রী ও তার আদরী ছোট মোহসীন বান্দা যুবাইরকে নিয়ে ওমরায় হাজির হই।
কা’বা চত্তর ঘড়ির কাটার সেকেন্ড, মিনিটি, ঘন্টা, রাত, দিন সবার সাথে পাল্লা দিয়ে যেন আনন্দে মুখরিত। ঘুমহীন দিবা নিশি। কি এক লোভে সকল মেহমানকে সমাদর করে চলেছে নিরন্তর। আমরাও তার মেহমানদারীতে ক্ষনিকের তরে হলেও অংশ নেই। গ্রহন করি তার স্বাদ-গন্ধ-ভালবাসা আর ভালোলাগার সুঘ্রাণ। ওদিকে সুরা বাকার ১৫৮ নং আয়াতের কথা মনে পড়ে। সাফা-মারওয়া জেগে আছে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায়। আমরা মা-হাজেরা মত এ’পাহাড় থেকে ও’পাহাড়ে কিসের নেশায় ছুটাছুটি করছি। হে আল্লাহ, আমদের পরীক্ষা কর তবে পাশ না করিয়ে বিদায় দিও না। যেমন দিয়েছিলে মা-হাজেরাকে। তিনি দৌড়ায়ে ছিলেন পাহাড় গলা রৌদের খরতাপে। মা- হাজেরার পদাংক আমরাও অনুস্মরণ করেছি। আমাদেরকে নাজাত দিয়ে সেই মনজিলে পৌছে দিও – যেখানটার আশায় পূন্যবান আতœারা যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।
আল্লাহর ঘরের দিকে তাকাই। তৃষ্ণা আর আতœার ক্ষুধা যেন মেটে না। বেজমেন্টে নেমে কা’বার চত্তরে যাই। স্বর্ণখচিত কালো গেলাফে মোড়া কা’বাকে সামনে রেখে হুইল-চেয়ারে বেসে আছি, চেয়ে আছি তার পানে। কাছে যুবাইর নেই, তাই হয়তঃবা পিছু টান নেই। প্রাণ জুড়িয়ে কি মধুর স্বরে আছরের আজান ধ্বনিত হচ্ছে। কান পেতে শুনি। বিভিন্ন পোশাকে ভিন দেশ থেকে আসা মুসলিম উম্মাহের সাথে অভিন্ন ভাষায় রুকু সেজদায় শামিল হই। কা’বা শরীফে ১২০টি রহমত নাযিল হয়ে থাকে। এ’প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) – এর বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “ এই কা’বা ঘরের উপর প্রত্যেক দিন ও রাতে ১২০টি রহমত নাযিল হয়। এর মধ্যে কা’বা ঘর তওয়াফকারীদের জন্যে ৬০টি, মসজিদে হারামে এতেকাফকারীদের জন্যে ৪০টি এবং কাবার প্রতি দৃষ্টিকারীদের জন্যে ২০টি রহমত নাযিল হয়।”

অবিরাম চলছে তাওয়াফ। যেন শ্রান্তি নেই। নেই কোন ক্লান্তি। নেই কোন অবকাশ। এইতো তাঁর মহিমা। চিন্তার সাগরে ডুব দেই। কত নবী-রাসুল-সাহাবী-তাবেঈণ-তাবে তাবেঈন – আইম্মায়ে মুছতাহেদীনদের কদমমোবারকের ছোঁয়া এ’মনজিলের যমিন। সেখানে আমি আজ একাকী এক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিশেষ। চাতক পাখীর ন্যায় চেয়ে আছি কালো গেলাফে মোড়া কা’বা-র পানে। হে দয়াময়, গাফুরুর রহিম আমার এ’জীবন খাতার শূন্যপাতা তুমি পূর্নতায় ভরে দিও। আমার এ’শূন্য জীবনকে তুমি করেছ মহিয়ান। আমি গুছিয়ে বলতে পারি না, কিন্তু তুমিত অন্তরযামী। আমার অন্তরের নেক মাকসুদগুলো পূরণ করে দিও ঐযে কালো গেলাফে মোড়া কা’বার অছিলায়। বিগত ৪০০০ বছর থেকে যাকে ঘিরে অনন্তর তোমার আশেকানরা তাওয়াফ করে চলেছে। আমি ধন্য তুমি আমায় এখানে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিয়ে এসেছ পূন্যময় মনজিলে। আমাকে তুমি নতুন বৈভবে সাজিয়ে গুছিয়ে দাও।
৫) মক্কাতে জিয়ারা –
পবিত্র মক্কা ২১.৫ অক্ষাংশ, ৪০ দ্রাঘিমাংশ এবং সমুদ্রের স্তর থেকে ২৮০ মিটার উপরে অবস্থান করছে। মক্কার আবহাওয়া উষ্ণ। বছরের অধিকাংশ সময় গরম থাকে এবং কমসংখ্যক মাস শীত থাকে। পবিত্র মক্কা পৃথিবীর মাঝামাঝিতে রয়েছে বলে মিশরের ভূগোল বিজ্ঞানীরদের গবেষনায় প্রমানিত হয়। সম্ভবতঃ পৃথিবীর সকল অঞ্চলের মানুষের কাছে এর দূরত্ব সমান হয়। পবিত্র মক্কা নগরী কঠিন পাথরের পাহাড় -পর্বতে ঘেরা। মাঝে মাঝে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ঘাস ও গাছ পরিলক্ষিত হয়েছে। মক্কা জিয়ারার সময় যা দেখলাম তার কিছু বর্ণনা নিন্মে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
্র মসজিদে নামেরা ঃ
মসজিদে নামেরাটি আরাফার একপাশে অবস্থিত। এটি আরাফাহ ও উরানাহ উপত্যকার মাঝে অবস্থিত। এ’মসজিদে হজ্জের দিনে হজ্জের খুতবা পর এক আজানে দুই একামতে জোহরের কসর হিসেবে জোহর ও আসর এর নামাজ পর পর একত্রে জামায়াতে পড়া হয়ে থাকে। হজ্জের পর মসজিদটি বন্ধ করে রাখা হয়।
্র জাবালে রহমত ঃ
এ’পাহাড়টি আরাফাত ময়দানের মাঝে অবস্থিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জের দিন এ’পাহাড়ের দক্ষিণ পার্শ্বের বড় পাথরগুলোর কাছে দাড়িয়ে দোয়া করেছেন, পাহাড়ের উপর উঠেননি। তাই হজ্জের দিন রাসুলের অনুকরণে জাবালে রহমতের পার্শ্বে দাড়ানো সুন্নত। এটি সেই ঐতিহাসিক পাহাড়, যেখানো কোন এক জায়গায় বাবা আদম (আঃ) ও মা হাওয়া (আঃ) এর দুনিয়ার জীবনে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। পৃথিবীতে খলিফা হিসাবে সৃষ্টি করে বাবা আদম (আঃ) ও মা হাওয়া (আঃ)-কে আল্লাহ পাক প্রথমে জান্নাতে রাখলেন এবং একটি বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। কিন্তু তাদেঁর দু’জনকে পৃথিবীর দু’ জায়গায় নামিয়ে দিলেন। একজনকে শ্রীলংকায় এবং অন্যজনকে জেদ্দায়। প্রতিদিনই স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় কত অপরাধ করছি, তার জন্য কি আমরা তাদের মত ঐভাবে ক্রন্দন করতে পারছি ? আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) জাবালে রহমতের কোন এক স্থানে দাঁড়িয়ে প্রায় সোয়া লক্ষ সাহাবীকে সামনে রেখে বিদায় হজ্জের শ্রেষ্ঠ ভাষণ পেশ করেন। এ’ভাষণ মানব ইতিহাসে এক “ম্যাগনা কা’র্টা”।
্র নহরে যুবাইদা ঃ
স¤্রাজ্ঞী যুবাইদা। এক প্রেয়সী নারী ব্যক্তিত্ব, উচ্চ গুণসম্পন্না। আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশীদের স্ত্রী। মন ও মননশীলতার দিক দিয়ে অনন্য, শ্রষ্ট্রার এক সৃষ্টি। একদা হ্জ্জব্রত পালনে এসে মরূাঞ্চলে পানির কষ্ট তাঁকে ব্যাথাতুর করে এক ভাবনার জগতে নিয়ে যায়। দরদী মন। তৈরী করেন একটি নহর। নহর অর্থ খাল/নালা/ঈধহধষ/উৎধরহ ইত্যাদি বোঝায়। যেখানে পানির প্রবাহ বয়ে চলে, তৃষ্ণা মেটায় পাড়ের সৃষ্টিজীবকে। হজ্জে আগত হাজ্জীদের পানির কষ্ট লাঘব হয়। তায়েফ আল হুদার পাশ দিয়ে এটি বয়ে চলেছিল। আরাফাত, মুজদালিফা ও মিনার পাশ দিয়ে প্রবাহিত নহরটি আজ প্রাণহীন। পড়ে আছে তার চিহ্ন। এতকাল পরেও বিশ্বের মুসলমানরা শ্রদ্ধাভরে সেই স্মৃতি স্মরণ করে আসছে। এ’দেখে আমার ম্যাডাম স্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। কারণ এতদিন এ’ইতিহাস সে তার ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াত, আজ তা তার দিব্য চোখের সামনে।

্র জাবালে নুর ঃ
জাবালে নুর বলা সেই পাহাড়কে, সেখানে রাসুলে পাক (সাঃ)-এর ওপর প্রথম কুরআন নাযিল হয়। ফেরেশতা জিবরাঈল আ. তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, পড়–ন। হুজুর (সাঃ) বললেন, আমি তো পড়তে জানিনা। তখন জিবরাঈল আ. নবীকে এমনভাবে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন, ইকরা বিসমি —– মা লাম ইয়ালাম পর্যন্ত পড়ে শুনালেন।

্র জান্নাতুল মোয়াল্লা- কবরস্থান ঃ
মক্কার একটি উল্লেখযোগ্য কবরস্থান হ’ল জান্নাতুল মোয়াল্লা। এখানে চির শান্তির শয্যায় শায়িত আছেন জগৎজননী, মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারীনী মা খাদীজা (রাঃ)। মোয়াল্লাহ কবর স্থানে অসংখ্য কবর রয়েছে। মা খাদীজা (রাঃ) এর নজীরবিহীন আত্মত্যাগ ও কীর্তি গাঁথা স্মরন করে আমি আবেগে আপ্লুত হয়েছি। একমাত্র হযরত খাদিজা (রাঃ) ই তাকে অভয় দান করতেন। তার সকল বেদনা মুছে ফেলবার চেষ্টা করতেন। এবং রিসালতের মহান কর্তব্যে অটল থাকার জন্যে সর্বদা তাকে প্রেরণা দান করতেন। ইসলামের প্রতি তার অবদানের কারণে, জিবরাঈল (আঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিকট নাযিল হয়ে বললেন, “খাদিজাকে আল্লাহর তরফে সালাম পৌছে দিন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, খাদিজা (রাঃ) ইনি জিবরাঈল, আল্লাহ, তোমাকে সালাম জ্ঞাপন করেছেন। খাদিজা (রাঃ) বললেন, আল্লাহ স্বয়ং সালাম তার নিকট হতে সালাম এবং জিবরাঈলের উপর সালাম।”

্র মসজিদে জ্বিন ঃ
মসজিদে জ্বিন মোয়াল্লাহ কবর স্থানের পার্শ্বে অবস্থিত। এ মসজিদটি বলতে গেলে একেবারেই রাস্তার সাথে লাগানো। জ্বিনদের কুরআন শুনার জন্য রাসলুল্লাহ (সাঃ) যে জায়গায় দাগ একে ছিলেন, বর্তমান মসজিদটি সেখানে অবস্থিত। এতে সুন্দর একটি মিনার আছে। কথিত আছে, রাসুল পাক (সাঃ)-ও উপর এখানে নাযিল হয়েছে পবিত্র কালামে পাকের সুরা জ্বিন। তার স্মরনেই এ মসজিদ। মসজিদটিতে দু’রাকাত নামাজ পড়ার ইচ্ছা থাকলেও দরোজা বন্ধ থাকার কারণে পারি নাই।

্র নবী (সা.) এর জন্মস্থান ঃ
মসজিদে হারামের বাবুস-সালাম বরাবর উত্তরপূর্ব দিকে খালি চত্তর পার হলেই একটি অনুচ্চ টিলার উপর নবী পাকের (সাঃ) জন্মস্থান। এখানে বর্তমানে একটি পাকা ভবন রয়েছে। যা লাইব্রেরী হিসাবে পরিগণিত। বাদশা আবদুল আযীযের আমলে, এ’ঘরের পুরাতন কাঠামো ভেঙ্গে তা নতুন করে নির্মাণ করা হয়। এতে বহু ইসলামী বই-পুস্তকের সমাহার ঘটানো হয়েছে। নবীর জন্মস্থান বিজড়িত সেই লাইব্রেরীতে আমরা তিন জনা গেলাম। লাইব্রেরী থেকে কয়েকটি বই সংগ্রহ করলাম। সৌদি সরকার কর্তৃক নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন, যাতে কোন শেরেকী কাজ না হয়। “আমুল ফীল” অর্থাৎ হস্তী বাহিনী নিয়ে আবরাহার কা’বা অভিযানের ঘটনা যে বছর ঘটে, ঠিক সেই বছরের আউয়াল মাসের দ্বাদশ রজনী অতিক্রান্ত হবার শুভ মুহূর্তে সোমবার রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন এ’বাড়ীতে।

্র মসজিদে আয়শা ঃ
তানঈম হচ্ছে হারাম এলাকার সীমানা এবং এর চাইতে নিকটবর্তী সীমানা অন্য কোনটি নেই। কথিত আছে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জের সময় আবদুর রহমান বিন আবু বকরকে এখান থেকেই হযরত আয়িশা (রাঃ)-কে উমরাহ করানোর নির্দেশ দেন। এখানে একটি মসজিদ আছে। একে মসজিদে আয়িশা বলে। বহুবার এ’মসজিদটির সংষ্কার করা হয়েছে। বর্তমানে এটি একটি সর্বাধুনিক সুন্দর ডিজাইনের মসজিদ। উমরাহর এহরাম বাধার, অজু, গোসল-এস্তঞ্জা করার জন্য পানি এবং টয়লেটের সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। বার দুয়েক ইহরাম বাঁধার জন্য আমরা এখানে এসেছিলাম।

্র মীনা ঃ
গাড়ির মধ্যে বসেই আমরা মীনা এলাকা দেখছিলাম। চারদিকে শুধু তাবু আর তাবুই চোখে পড়ছিল। হজ্জের সময় আরাফায়, মীনায় ও মুজদালিফায় কি কি কাজ করতে হবে তা আমাদের সম্পূর্ণ জানা নেই তবে হজ্জে এলে এখানে অবস্থান করতে হবে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কোরবানীকে কেয়ামত পর্যন্ত হাজীদের জন্যে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এ’মীনাতে হাজীগণকে ১০ই জিলহজ্জ তারিখে কোরবানী দিতে হয়।

্র মুজদালিফা ঃ
মুজদালিফা হচ্ছে মীনা এবং আরাফাতের মধ্যে অবস্থিত একটি জায়গার নাম। হাজীরা আরাফাহ থেকে ৯ই জিল হজ্জ সূর্যাস্থের পর মাগরীবের নামাজ না পড়ে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এবং এখানেই এক আজানে দুই ইকামতে মাগরিব ও এশার নামাজ জামায়াতে পড়তে হয় এবং রাত্রি যাপন করতে হয়।

্র জাবালে সাওরে ঃ
জাবালে সাওরে এলে নবী পাক (সাঃ) এর হিজরত কালের কিছু খন্ড চিত্র মনের পর্দায় ভেসে উঠে। এ’পাহাড়ের একটি গুহাতেই আত্মগোপন করেছিলেন নবী। তিন দিন তিন রাত রাসুল (সাঃ) এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) সেই সংকীর্ণ গুহায় অবস্থান করেন। সিদ্দীকে আবুকবর (রাঃ) এর অল্প বয়স্ক ¯েœহের তনয় হযরত আবদুল্লাহ তাদের নিকট রাত্রি যাপন করতেন এবং প্রভাতের পূর্বেই মক্কায় ফিরে আসতেন। দিনের বেলায় রাসুল্লাহ (সাঃ) সম্বন্ধে কুরাইশদের আলাপ-আলোচনা শ্রবণ করে রাতে তাদের নিকট গিয়ে ব্যক্ত করতেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) এর গোলাম আমের বিন ফুহাইয়া (রাঃ) রাতে পর্যন্ত বকরী চরাতেন এবং অন্ধকার হলে বকরী দোহন করে তাদেরকে খাদ্য পৌছে দিতেন। রাসুল (সাঃ) কোথায় রয়েছেন, তা শত্রুরা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারল না। তিন দিনের মধ্যে তাদের ক্ষিপ্রতা কিছুটা হ্রাস পেল। বিরোধীদের সকলেরই মুখমন্ডলে নিরাশার ছায়া।

্র সামিয়া হারাতুল বাবে ঃ
“সামিয়া হারাতুল বাবে” – হেরেম শরীফের মালেক ফাহাদ গেটের বিপরীতে যেখানে ইবরাহীম খলীল সড়ক এসে শেষ হয়েছে ও তার পাশ দিয়ে উপরের দিকে একটি রাস্তা। কিছু দুর গেলেই সেই সামিয়া হারাতুল বাব। পাহাড়ের পাদদেশে বিরাট এলাকা জুড়ে গর্তের মত বিরান এলাকা। জাহেলীয়াতের যুগে এখানে পাহাড়ের উপর থেকে কন্যা সন্তানদের নিচে ফেলে দিয়ে জীবন্ত হত্যা করা হত। উল্লেখ্যে যে, সময়ের অভাব এবং এ’স্থানটি সম্পর্কে পূর্ব থেকে কোন ধারণা না থাকায় এ’অভিশপ্ত জায়গাটি আমাদের দেখা সম্ভব হয়নি।

্র আরাফার ময়দান ঃ
এ’এক বিস্তৃণ বিশাল মরু এলাকা। এখানে চোখে পড়বে নিম গাছ, প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। কথিত আছে এ’নিমগাছগুলো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে রোপন করা হয়েছে। হজ্জের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়ে থাকে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত তাৎপর্যপূর্ণ ময়দানে, যার নাম আরাফা। আরাফা অর্থ পরিচয়, যেখানে হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়ার পৃথিবীতে পরিচয় ঘটে। আল্লার কাছে তারা তাদের কৃতকর্মের ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ মাফ করে দেন। এ’টা আল্লার কাছে অধিক পছন্দনীয় ছিল বলে আল্লাহ তা’য়ালা বিশ্ব মুসলিমের জন্য আরাফার ময়দানে উপস্থিত হওয়াকে হজ্জের মূল রুকন হিসেবে কবুল করেন। পবিত্র মক্কা নগরী থেকে ১৩/১৪ কিমি দুরে জাবালে রহমতের পাদদেশে এ’ময়দানের অবস্থান। ময়দানটি ৩দিক দিয়ে পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। হযরত মা আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন”আরাফাতের দিনের চেয়ে বেশি আর অন্য কোন দিনে আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন না। এ’দিন তিনি (বান্দার) নিকটবর্তী হন এবং তাঁর ফেরেস্তাদের জিজ্ঞেস করতে থাকেন, এই মানুষগুলো কি চায়? ”(মুসলিম শরীফ)। ইহরামের শুভ্র বসনে হাজীগন গুনাহ মাফ ও সঠিক পথের দিশা লাভে আল্লার ধ্যানে আতœ নিয়োগ করে থাকেন।

্র বিদায়ী তাওয়াফ ঃ
বিদায়ী তাওয়াফে মনে হয়ে ছিল অন্তহীন মানব-মহা¯্রােতে ভাসমান একবিন্দু প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আমি। এসেছি ভাটি বাংলার, বিশ্বের এক ব-দ্বীপের এক বনি আদম। বুকফাঁটা আর্তনাদ- হে কা’বার মালিক আবার কবে হবে দেখা এ কা’বা। তাওয়াফ শেষে দু’রাকাত নামাজে রত হই। কিয়াম করি। রুকু সেজদায়ে নত হই। আল্লার শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর মহিমার গান গাহি। চোঁখদ্বয় ঝাপসা হয়ে উঠে। হয়তঃবা জীবনে এ’পবিত্র চত্বরে আর পদাচারণা হবে না। কেন এত পরে আমার বোধশক্তি উন্মোচিত হলো। কেন শক্তি-সামার্থ-আর্থিকাব্যস্থা ভাল থাকার পরও আগে আসি নাই। আল্লাহ আমায় ক্ষমা কর, তুমি গফ্ফার আর আমি গোনাহগার।

বিদায়ী তাওয়াফ শেষে চোখ নামিয়ে আসতে পারছিলাম না। আর হয়তঃ এমন দিনটি আসবে না। এটাই হয়তঃবা আমার জীবনের শেষ তাওয়াফ, শেষ দেখা আর শেষ সফর। গত ক’দিন এ’ঘরের সাথে যেন এক মিতালি হয়ে গেছে। যেন এক আতিœক সম্পর্ক। দেহ-মন-তনু-প্রাণ সব কিছুই যেন কেড়ে নিয়েছে। সামান্য একটু বিশ্রাম নিয়ে যেন তার সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকতাম সদা। এ’যেন নাড়ীর টান। যেন কি একটা পাবার তীব্র বাসনায় হৃদয়-মন উন্মুখ। ছুটতে ছিল না মানা, সকাল-দুপুর-সাঝের বেলা। গিয়ে হাজির হতাম মাতাফে। হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতাম ঐ যে সামনে আমার কা’বা, স্বর্ণ খচিত কালো গেলাফে মোড়া। কি এক দুর্নিবার আকর্ষণ। তাকে ছেড়ে কি করে আসি। হে দয়ময়, আমি গোনাহগার আপনি গাফুরুর রাহীম। আমাকে এই চৌহদ্দির মধ্যে আপনি প্রতিদিন যে পরিমান খায়ের ও বরকত নাজিল করেন তা থেকে বঞ্চিত করবেন না। আমি আপনার একান্ত এক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিশেষ। ইচ্ছা করলেই তো আমি একাকী আসতে পারি না। আল্লাহ আমায় বঞ্চিত করবেন না।

্র মদিনাতে ঃ
০৭-০৩-২০১৮ তারিখ সকাল ৮.৩০টা। এবার পালা মদিনা মনোয়ারায় যাওয়া। বাস চলছে মদিনার পথে। মনোরম পরিবেশ কোচের মধ্যে। মার্সিডিস বেঞ্চ হওযায় যাত্রীদের কোন কষ্ট হয় নাই। আমাদের সাথে পাকিস্থানী হাজ্জীরা ছিলেন। যেকের আজগার করতে ছিলাম, কোচ ছুটে চলল আপন গতিতে। বেলা ১১.০০টার সময় কোচ গিয়ে থামল ওয়া দিস সেতারা-এ নাফি হোটেলে। ৩০ মিনিট বিরতীতে নাস্তায় মনোনিবেশ করলাম। চারি দিকে ধুধু বালু চর আর পাহাড়ের সমাহর। আমাদের সবার মন পড়ে আছে কা’বার আঙ্গিনায়। গত ক’দিনে কা’বার সাথে শখ্যতা কেমন যেন জমে উঠেছিল। মনে পড়ছে হযরে আসওয়াদ। ছোট্ট বেলায় পড়েছিলাম যে পাথরকে সরান নিয়ে তুমুল বিবাদের সম্ভাবনাকে মিটিয়ে ফেলেছিল আমাদের নবী সাইয়্যেদুল মুরছালিন খাতামুন নাবীয়িন হযরত মুহাম্মদ। মুলতাজাম, মাকামে ইব্রাহীম, হাতিম, বীরে যমযম। ওদিকে পাশে সাফা-মারওয়া। মা হাজেরা কদম ছোঁয়া যমিনে এ’কদিনের দৌড়াদৌড়ি।

কা’বার সংলগ্ন কবুতর চত্তর ও অন্যান্য চত্তরে মাগরিবের পর যেন মিলন মেলা বসে। ঝির ঝিরে হিমেল হাওয়ায় মন ভরে দেয়। ছোট ছোট কোমল মতিদের ছুটা ছুটি আরো আনন্দে মাতিয়ে দেয় মনকে। মনে হয় ৪০০০ বছর আগে শিশু ইসমাইল আ. যুরহুম গোত্রে ছেলেদের সাথে এখানে কোন এক স্থানে খেলা করত। আমার ছোট যুবাইরও খেলা করেছে একাকী দৌড়ে দৌড়ে। আমার তৃতীয় প্রজন্মের এই যুবাইর-ই ১ম, যে নাকি এত অল্প বয়সে কা’বা শরীফের দেয়াল ধরেছে। একাকী মূল চত্তরে তাওয়াফ করেছে। চুমু খেয়েছে ঐ সর্বাঙ্খীত হাযরে আসওয়াদে। আয় আল্লাহ তুমি তাকে তোমার মনোনিত বান্দাদের মধ্যে শামীল করে নিও। যৎসামান্য হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে বাকী সময় কেটেছে হারাম শরীফে। হে কা’বার মালিক আমাদেরকে আবার কা’বায় নিয়ে এসো। বার বার কা’বার মাধ্যমে তোমায় পেতে চাই এ’কজনা। কথাগুলো হৃদয়পটে ভেসে উঠছিল। জোহরের শেষ প্রান্তে গোল্ডেন ওয়াসেল হোটেলে গিয়ে উঠলাম। যেমনটি পাওয়ার কথা ছিল তেমনটি ছিল না।

 রওজাপাকের কাছে কিছুক্ষণ ঃ
নবী পাকের (সাঃ) রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রাত ২.০০টায় মসজিদে নববী পানে যাই। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি সরদারে আলম হুজুরে মকবুলের (সঃ) এর রওজা পাকের কাছাকাছি এসে গেলাম। কম্পিত পদে, ধীরে, অতি ধীরে অগ্রসর হতে থাকলাম। হাজার হাজার লোক কাতারবন্দী হয়ে চলছে নবীকে (সঃ) সালাম জানাতে। প্রিয় নবীর (সঃ) প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করতে করতে এগিয়ে চলছি অতি ধীর কদমে। অন্য দিনের মত কেউ আমাকে আজ বাঁধা দেয়নি। যাকে কাছ থেকে সালাম পেশ করার জন্যে সর্বদা আল্লাহপাকের নিকট ধর্ণা দিয়েছি, যাঁর সুপারিশ ও যাঁর হাতে হাউজের পানি পানের জন্যে সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদী উম্মুখ। আল্লাহ পাকের সেই হাবীব, সাইয়্যেদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামীনের শয্যাপাশে নিজেকে উপস্থিত করতে পেরে আল্লাহ পাকের নিকট হাজারো শোকর আদায় করি। নবীর পাশেই প্রথম শায়িত আছেন হযরত আবু বকর (রাঃ) পরের জন হলেন হযরত ওমর (রাঃ) তাদেরকেও সালাম দিতে দিতে বের হয়ে আবার ডানে ঘুরে তাহাজ্জুত নামাজ আদায়ে জানু নত করি। তছবিহ তাহলিল করতে থাকি মন ভরে।
এখন আর বাবে জিবরাঈল গেইটের মধ্য দিয়ে রওজা মোবারকে ঢুকতে দেয়া হয় না। মসজিদের নববীতে ঢুকার জন্য অনেকগুলো দরজা আছে। ফেরেশতাদের নেতা জিবরাঈল (আঃ) এর নামে বাবে জিবরাঈল নামকরণ করা হয়েছে। এ’দরজা দিয়েই হযরত জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহর নবীর (সঃ) কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। এ পূণ্যময় স্মৃতিকে চিরজাগরুক রাখার জন্যই এ’দরজার এ নামকরণ করা হয়েছে। বাবে জিবরাঈল গেইট দিয়ে ঢুকার সুযোগ পেয়ে গেলাম, ভিতরে প্রবেশ করে নফল নামাজে রত হলাম। আল্লার কাছে শোকর আদায় করি। প্রতিবন্ধী হয়েও আল্লাহ আমাকে কি সুযোগটাই না করে দিয়েছে ঐরাতে।

 রিয়াজুল জান্নাতে ঃ
রিয়াজুল জান্নাহ ! জান্নাতের বাগান ! বেহেশতের টুকরা ! পৃথিবীর ধূলিমাটিতেই রয়েছে এ’জান্নাতের বাগান। মসজিদে নববীতে গেলে যে কেউ সাক্ষাৎ পাবেন এ’বেহেশতি বাগানের। একটু অপেক্ষা করলেই প্রবেশ করতে দিল। বেহেশতের টুকরায় নামাযের রত হলাম, দু’রাকাত শেষ করে আরো দু’রাকাত তৃপ্তির সাথে পড়ার সুয়োগ পেলাম। মর্যাদার ক্রম পর্যায়ে কা’বা শরীফের পরেই মসজিদে নববী, নবীজীর মসজিদ। কিন্তু এ’বিশাল মসজিদের মধ্যে বিশেষ ক্ষুদ্র এলাকাটিই হল রিয়াজুল জান্নাহ। যেখানে হালকা সবুজ কার্পেট বিছানো রয়েছে। আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেন, “আমার ঘর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগান সমূহের একটি। আর মিম্বার আমার হাওযের উপর অবস্থিত। রিয়াজুল জান্নাহর প্রতিটি থামের সাথে মিশে আছে এক একটি বিশ্ববিশ্রুত ঘটনা, ইসলামের এক একটি হীরকোজ্জ্বল ইতিহাস। প্রতিটি থামের সাথে আমি সাক্ষাত মেলাতে পারিনি। এ’ছিল আমার হৃদয়ের এক হাহাকার।

 সুফ্ফায় আমি একাকী ঃ
আসহাবে সুফ্ফা নিয়ে কমবেশি শুনেছি। জায়গাটি দেখার জন্য মনের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। আল্লাহ মিলিয়ে দিল স্থানটিতে। এখানেও দু’রাকাত নফল নামায় পড়ে শোকর গুজার করলাম। সুফ্ফার চাতানে গিয়ে বসে দোয়ায় মশগুল হলাম, আর স্মৃতিতে ভাসছিল সেই আতœত্যাগিদের অবদানের কথা। সুফ্ফাহ শব্দের অর্থ হ’ল ছায়াদার স্থান। রাসূল (সঃ) নির্মিত মসিজদের শেষাংশে, তাঁর দরিদ্র ও ছিন্নমূল সাহাবীদের আশ্রয় স্থান। বর্তমানে স্থানটি মসজিদের মেঝের স্বাভাবিক সমতল থেকে প্রায় দেড়ফুট উঁচু, চারদিকে প্রায় দেড়ফুট উঁচু গ্রীল বেষ্টিত রয়েছে। সুফ্ফায় যারা বাস করতেন, তাঁরাই আসহাবে সুফ্ফা নামে পরিচিত। তাঁদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি ছিল না, ছিল না কোন সম্পদ। মসজিদে নববীর তৈরী সমাপ্ত হলে সকলেই আশা করেছিলেন, এবার নবী (সঃ) নিজের বাসগৃহ নির্মাণ করবেন। নির্মাণ করলেন, কিন্তু সেটি নিজের জন্য নয়। ছিন্নমূল কিছু নিরন্ন মানুষের তথা আসহাবে সুফ্ফার জন্য। চারপাশে খোলা চাতানটি তৈরী করা হয় খেজুর পাতার ছাওনি দিয়ে, মসজিদের ঠিক উত্তরে। কুরআন শিক্ষা দেয়ার তথা ইসলামের ব্যাপক ব্যাপ্তি ও প্রসার উপলক্ষে দূরদেশে দূর্গম এলাকায় এ সর্বত্যাগী আসহাবে সুফ্ফার নির্ভীক কর্মীদের প্রেরণ করতেন হুজুর (সঃ)। অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ে, কখনোবা জীবনের বিনিময়ে এ’মহামানবেরা কন্টকাকীর্ণ উষর মরুতে ইসলামের সুবাসিত ফুল ফুটানোতে রত ছিলেন।

৬) মদিনায় জিয়ারা-
 কুবা মসজিদঃ
এটা সেই মুসলিম জাহানের প্রথম মসজিদ। যাতে সাহাবীগণ সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে ও নির্ভয়ে জামায়াতে নামায পড়তে পেরেছিলেন। যা নির্মাণে নবী (সঃ) প্রথম স্বয়ং অংশ গ্রহন করেন। হাদীসে রয়েছে এ’মসজিদে দু’রাকাত নফল নামায এক ওমরা হজ্জের সমতুল্য। এ’মসজিদ সম্পর্কে আল্লাহ পাক সুরা তওবার ১০৮ নং আয়াতে বলেছেন-“নিশ্চয়ই তা এমন মসজিদ যা তাকওয়ার বুনিয়দের উপর প্রতিষ্ঠিত”। কথিত আছে কুবা থেকেই নবী পাক (সঃ) কে মদীনায় হিজরতকালে প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় এবং মদীনাবাসী এখানেই নবী পাক (সঃ) কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন।
 মসজিদে জুমুয়া ঃ
রাসুলুল্লাহ (সঃ) মদীনা শহরে আসছেন। বাতনুল ওয়াদিতে সোবাইব নামক একটি ক্ষুদ্র মসজিদে জুমুয়ার নামায আদায় করেন। সেই থেকে তা মসজিদে জুমুয়া নামে খ্যাত।
 খন্দকের ময়দানে ঃ
ঐতিহাসিক খন্দক, যা মক্কার মুশরিকদের মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনাকে চিরতরে নষ্ট করে দেয়। ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এ’খন্দকের ময়দান মুসলমানদের বীরত্ব ও রণ কৌশলের এক অন্যান্য নজির হয়ে অবস্থান করছে। আসহাবে সুফ্ফার এক সাহাবী ইরান অধিবাসী সালমান আল-ফারসীর পরামর্শ অনুযায়ী পরিখা খনন করে শত্রুর মোকাবিলা করার এমন ঘটনা ইতিপূর্বে ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত।

 মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদে ঃ
দুই কিবলার স্মরণে এ’মসজিদটি। নামাজরত অবস্থায় কিবলা পরিবর্তনের ঘোষনা আসে। সুরা বাকারার ১৪৪ ও ১৫০ নং আয়াতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে জানা যায়, নবীকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ পাক বলেছেন,”তোমার বার বার আকাশের দিকে ফিরে তাকানোকে আমরা দেখছি, এখন তোমার মুখ আমরা সে কিবলার দিকেই ফিরিয়ে দিচ্ছি, যা তুমি পছন্দ কর। এখন মসজিদে হারামের দিকে মুখ ফিরাও, অতঃপর তুমি যেখানেই থাকনা কেন, ঐ দিকেই মুখ করে নামায পড়তে থাকবে।” ইতোপূর্বে বায়তুল মাকদিস এর দিকে মুখ বা কেবলা করে নামাজ আদায় করা হত। উক্ত আয়াতদ্বয়ের তাৎপর্য ও মহিমা বিশাল।

 মদীনা মুনাওয়ারার অন্যান্য মসজিদে ঃ
মসজিদে নববীর পাশে অবস্থিত অনেক মসজিদ। মদীনায় অবস্থানকালে এদের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) মসজিদ, মসজিদে গামামা পরিদর্শন করি। উল্লেখ্য যে, এসব মসজিদগুলো এক সময় উপরোক্ত সাহাবিদের আবাস স্থল ছিল। এসব মসজিদে বর্তমানে কোন জামাত হয় না।

 খেজুর বাগান পরিদর্শন ঃ
সৌদি গেলাম কিন্তু খেজুর বাগানে দেখলাম না- তাতো হয় না । বীরে ওসমানের পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি খেজুর বাগান পরিদর্শনে যাই। সেখানেই জানতে পারি আজওয়া খেজুরের মহাত্ব। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত জনৈক ছাত্র, অগাত জ্ঞানের পন্ডিত প্রমান হয় তাঁর নেতৃত্বে মদিনার জিয়ারার স্থানসমূহ পরিদর্শনে। পরিদর্শনের স্থানসমূহের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ইতিহাস-ঐতিহ্য এমনভাবে বর্ণনা করছিলেন আমরা দর্শনার্থীরা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।

১) খানায়ে কা’বায়ে আপ্যায়ন-
কা’বা শরীফের ভেতর অর্থাৎ মাতাফ এলকায় ও তার আশে পাশে এবং চত্বরে সুহৃদজনেরা যে যেভাবে পারছে আল্লার অতিথীদের বিভিন্ন্ ভাবে আপ্যায়নে ব্যস্ত। আল্লাহর অতিথিদের আপ্যায়নের মাঝ দিয়ে আল্লাহকে পেতে চায় তারা। আল্লাহর মোহসিন বান্দা ৯.৫ বছরের ছোট যুবাইর। ওর কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। বলল সে ”আব্বা, আমরা কি কা’বা-গৃহে অন্যান্যদের ন্যায় খঊঢটঝ ইরংপঁরঃং ও লজেন্স বিতরণ করতে পারি না”? হ্যা, ভালো প্রস্তাব। খঊঢটঝ ইরংপঁরঃং, ঋধংপরধষ ঞরংংঁব ও লজেন্স বিতরণ করে খানায়ে কা’বার আপ্যায়নকারীদের দলভূক্ত হলাম স্বল্প পরিসরে হলেও। আল্লাহর কাছে এ’বিষয়ে কবুলিয়াতের দরখাস্ত করি। আল্লাহর অতিথিদের আপ্যায়ন করলে সরাসরি প্রতিদান পাওয়া যায়। তার একটি বাস্তব দৃশ্য উপস্থাপন না করে পারছি না। ০৬/০৩/২০১৮ তারিখে আসরের নামাজের জন্য কা’বা শরীফে কিং আব্দুল আজিজ গেইট দিয়ে একটু আগে ভাগেই প্রবেশ করছি। দেখি সামনের চেয়ারে বসে আছেন জুব্বা পরিহিত, ব্যক্তিত্বে মার্জিত ও চুম্বকের আকর্ষন, আল্লাহর অতিথি এক হাজী সাহেব। আমি তাঁর সামনে গিয়েই সালাম দিয়ে মুছাফা করি। কুশল বিনিময়ের এক পর্যায়ে তাঁকে খঊঢটঝ ইরংপঁরঃং, ঋধংপরধষ ঞরংংঁব দিয়ে আপ্যায়ন করলাম। তিনি উজবেকিস্থান থেকে হজ্জে এসেছেন। ঈমাম বোখারীকে চিনি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। ভাষার জটিলতার কারণে আপালচারিতা বেশি দুর এগুতে পারি নাই। বিদায় বেলায় উক্ত হাজী সাহেবের প্রতিনিধি অতি গোপনে একশত রিয়াল আমাকে মুছাফার ছলে ডান হাতে গুজে দিলেন। আমি তা ডিনাই করলাম। তিনি বললেন, এটা হুজুর আপনাকে হাদিয়া স্বরুপ দিয়েছেন। যারপর নাই নিতে বাধ্য হলাম।
২) ওমরাহ ও পরের কার্যক্রম-
যেহেতু এক অপার্থিব উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য হজ্জে যাওয়া হয়েছিল, সেকারণে হজ্জের পূর্বে যদি শরীয়তের পরিপন্থী কোন কাজ অভ্যাসে পরিনত হয়ে থাকে, অবশ্যই তা পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা কা’বার কালো গেলাফ ধরে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে গোনাহ মাফের আরযু পেশ করা হয়েছে, সে গুনাহসমূহ করা আর কি করে সম্ভব? তা’হলেতো আপনার আমার শ্রম-সাধনা-অর্থ-কষ্ট সবই যে ভেস্তে যাবে। আমাদের কারো কামনা সেটা নয়। আল্লাহ আমদেরকে পূর্বের সকল ত্রুটি মাফ করে পরবর্তি সকল কার্যক্রম আল্লাহ মনোনিত পন্থায় করার তৌফিক দান করুন এবং সেই মন্জিলে পৌছায়ে দিক যেখানে মানব-আতœারা প্রশান্তি চিত্তে প্রবেশ করবে।

৩) বিভিন্ন দেশের গ্রুপ ভিত্তিতে হজ্জ করতে আসা হাজীদের দৃশ্যমানতা দেখে ভাল লেগেছিল। ভাল লেগেছিল এক দল নারী প্রতিবন্ধীদের হজ্জ করতে দেখে। দেখে ছিলাম ছোট শিশু, খর্বাকৃতি ব্যক্তি, হুইল-চেয়ার ইউজার, নিউরো সমস্যাগ্রস্থ সহ বিভিন্ন ধরণের নারী-পুরূষ প্রতিবন্ধী, ছোট হাফেজ শিশুর দল ওমরা হজ্জে এসেছে।

৪) খানায়ে কাবা ও মসজিদে নববীতে ওয়াকফ –
আমিও এ’মহৎ কাজে উদ্বুদ্ধ হলাম। হারাম শরীফে যাতায়াত পথে ছোট ছোট ট্রলিতে কোরান-শরীফ বিক্রি হচ্ছে। একটু লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম ব্যক্তি বিশেষ ঐ বিক্রেতার কাছ থেকে কোরান-শরীফ কিনে কা’বা শরীফে ওয়াকফ করছে। দুটি কোরান-শরীফ ৩০ রিয়াল দিয়ে কিনে একটি কা’বা শরীফে ওয়াকফ করলাম আর একটি ঢাকায় নিয়ে এলাম। ঠিক মসজিদে নববীর গেইট নং ১৮ এ একই দৃশ্য। মসজিদে নববীতেও একটি ওয়াকফ করলাম। হে গফুরুর রহীম, আমার এ’কাজগুলো কবুল ও মঞ্জুর করে নাজাতের অছিলা বানিয়ে দিও ।

৫) কেনা কাটা-
কেনা কাটায় তেমন মনোনিবেশ করি নাই। আমার নিজের তেমন কোন আগ্রহও ছিল না। তবে আমর বেগম, সরল প্রাণা নারীমন, বাচ্ছাসহ অন্যান্যদের জন্য কিছু হাদিয়া দেয়ার মানসে যৎসামান্য কেনা কাটা করেছিল। মক্কার ক’াবা-গৃহে আসা-যাওয়ার পথে তেমন একটা কেনা কাটা না করলেও মসজিদে নববীতে আসা যাওয়ার পথে এবং কিছু সময় বের করে কিছু ক্রয় করা হয়েছিল। কেনা-কাটায় মক্কার তুলনায় মদিনাতে স্বাচ্ছন্দ্যতা ফিল করেছি। আর একটু চিন্তাভাবনা করে কেনা কাটা করলে আতœীয়-স্বজন ও কলিগদের সন্তুষ্ট কার যেত। তবে কেনা-কাটায় মনোনিবেশ করলে মূল উদ্দেশ্যে ব্যাঘাত ঘটতো তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আল্লাহ পাক আমাদেরকে অনেকাংশে রক্ষা করেছেন সকল দিক দিয়ে। সৌদি থেকে যে সমস্ত জিনিস কেনা হয়েছিল তা ঢাকাতে তেমন একটা পাওয়া যায় না। অন্য দিকে মূল্যও বেশি। সব মিলে কস্টিং ও গুণত দিক থেকে মদিনাই শ্রেয় ছিল।

৬) দাওয়াত খাওয়া –
জিগাতলার নিঝুম আবাসিকের কর্মচারী জনাব ইদ্রিসের ছাট জামাই-মেয়ে মদিনায় মসজিদে নববীর মোটামুটি কাছে থাকেন। জামাই সময় না পাওয়ার কারণে আমাদের সাথে সাক্ষাত করতে না পেরে শেষের দিন(মার্চ ১১, ২০১৮ইং) হোটেলে এলো। আর চীলের মত ছোঁ মেরে নিজে ড্রাইভ করে তার প্রাইভেট কারে বাসায় নিয়ে দুপুরে দাওয়াত খাওয়ালো। আপ্যায়নে কোন ত্রুটি ছিল না, দেশীয় আর আরবীয় খাবারের সংমিশ্রণ ছিল চমৎকার। বিদেশ ভুইঁয়ে দেশীয় খাবারের স্বাদ আমদেরকে আপ্লুত করে তুলে ছিল। আল্লার মেহমান আর দেশী লোক পেয়ে তারাও আনন্দে মাতোয়ারা। আছরের নামাজের আগে মসজিদে নববীতে পৌছিয়ে দিল জামাই নিজাম উদ্দীন। মদিনা থেকে বিদায় বেলায় রাতে হেটেলে এসে ল্যাগেজ ব্যাগেজগুলো গুছিয়ে আমাদেরকে কৃতার্থ করেছিল।
যেহেতু আরব উষœ প্রধাণ এলাকা, সেহেতু তরল ও লাবাঙ্গ জাতীয় পানীয় পানের প্রতি যতœশীল হতে হবে। চা/ কফি পানে আমাদের সতেজতা ফিরবে এবং আপনি নির্দিষ্ট কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন। যেটাতে আমরা ফল পেয়েছি।

১) ভাষা না জানার বিড়ম্বনা-
ভাষা না জানলে কত বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বিদেশ-ভূইঁেয় গিয়ে তা উপলব্ধি করা যায়। আমাদের উচিৎ ছিল নূন্যতম কিছু আরবি ভাষায় কিছু বিষয় জেনে যাওয়া। মক্কায় ও মদিনায় কিছু কিছু স্থানে বাংলা ভাষাভাষি লোক পাওয়াতে সুবিধা হয়েছিল, আল-হামদুলিল্লাহ। আরবী ভাষার পাশাপাশি হিন্দি ও উর্দু ভাষা জানা থাকলে অনেকাংশে সুবিধা হত। এ’ক্ষেত্রে আমাদের তুলনায় যুবাইর অগ্রে ছিল, কারণ সে হিন্দি অল্প হলেও বলতে পেরে মনের ভাব বিনিময় করতে পেরেছে। নিদেন পক্ষে অল্প হলেও কিছু বিষয়ে অরবী ভাষা জেনে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছি। ভাটির ব-দ্বীপ থেকে হজ্জে যাওয়ার প্রবনতা এত বেশি যার কারণে সৌদি দোকানীদের অনেকে খুব সামান্য হলেও বাংল বুঝে বা ভাংগা ভাংগা বলতে পারে। বাংলাতে অনেক ধর্মীয় পাবলিকেশনও ফ্রি-তে বিলিয়েছে সৌদি সংস্থারা।
২) সংগ্রহ-
ছোটবেলা থেকেই বই-পুস্তক সংগ্রহ করা আমার অভ্যাস। হজ্জে গিয়েও তা থেকে পিছু ছিলাম না। ছাফা মারওয়া পাহাড়ের শুরুতে ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঈবহঃবৎ, আয়শা মসজিদ, হযরত মোহাম্মদ সা. এর বাড়ীস্থ লাইব্রেরী এবং মসজিদুল হারামের বিভিন্ন ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঈবহঃবৎ থেকে বাংলায় অনুদিত তাফসির ও অন্যান্য ধর্মীয় পুস্তক সংগ্রহ করেছি। সময় সংকুলান এবং অন্যান্য কারণে মসজিদে নববী থেকে কোন তথ্য সংগ্রহ না করতে পারার বেদনা নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে। আল্লাহ আমায় আবারো যাওয়ার তৌফিক দিও। দিও কাফনের কাপড় পরিধানের পূর্বে হইরামের কাপড় পরিধান করায়ে।

৩) আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগীতা করা Ñ
যারা ভালো কাজ করতে যাচ্ছেন, তাদেরকে আর্থিক বা অন্যান্য সহযোগিতা করা হলে অংশি নেয়ার সুযোগ থাকে এ’সমস্থ মুহুর্তগুলোতে। তবে এ’কাজটি হতে হবে স্বপ্রনোদিত হয়ে। ডাঃ মোঃ শফি উল্লাহ এ’ধরণের কাজ নিজ উদ্যোগে করে থাকে বরাবরই। আমার এ’যাত্রাতেও তার ব্যাতয় ঘটেনি। আর আল্লাহর শাহী দরবারে এদের নাম দো’য়ার দরখাস্তে করার সময়ে থাকে অগ্রভাগে। হারাম শরীফে ও মসজিদে নববীতে দে’ায়ার আসরে আবেগ আপ্লুত অবস্থায়ও উচ্চারণে নাম ধরে ধরে ডাকার ক্ষেত্রে বাদ পড়েনি। কারণ বাংলাদেশ থেকে বিদায়ের সময় হাতে দিয়েছিল ১০০০ সৌদি রিয়াল, রাতের দাওয়াত খাওয়ানো ও মসজিদে নববীর কোথায় কোথায় দো’য়া কবুলের স্থান- তা ছবিতে দেখিয়ে দেয়ার দৃশ্যাবলী মানসপটে ভেসে উঠেছিল, আর এ’সমস্ত কারণে আমাদের কাজগুলো অনেক সহজ ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল।
যে সমস্ত মুসলিম অস্বচ্ছল ভাই ও বোনেরা, যাদের মন একান্ত ওমরাহ হজ্জে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব, সামান্য আর্থিক বা সহযোগীতা পেলে তাদের মনো-কামনা পূরণ হতো। এমন ব্যক্তিবর্গের জন্য সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। পাঠককুল বিষয়টি একটু ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ রইল। শ্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্খায় মাতোয়ারা সৃষ্টজীবকে সহযোগীতা করা অসাধারণ বা অতুলনীয় নয়কি?

৪) এ’সফরের সাথে অন্যান্য সফরের তুলনা-
এ’সফর আল্লাহর অতিথি হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এ’সফর করার শরীয় বিধান রয়েছে। এ’এক আধ্যাতিœক ও রুহানী সফর। যেখানে গেলে আতœার খরভব ঞরসব জব-পযধৎমব হয়ে থাকে। হবে সে সম্মানিত ও মহিমান্বিত ইহ-পরো উভয় জগতে। ধর্মীয় জ্ঞানের স্ফুরণ বাড়তে থাকবে। হয়ে উঠবে সহনশীল, দরদী, পরোপকারী, বিনয়ী আর কুরআন-সুন্নাহকে আকড়ে ধরবে। পাশাপাশি অন্য সফরগুলো হবে পার্থিব ও ভোগবাদীতে ভর্তি। পার্থিব প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হওয়ার তীব্র বাসনায় মত্ত হওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠবে। হয়তো আতœ-গ্লানী, নয়তো আতœম্ভরীতায় পার্থিব শান-শওকোতের নেশায় মরিয়া হয়ে উঠবে।

৫) অনুভূতিসমূহ আমায় ভাবান্তরে নিয়ে যায় –
ড় কেন ইতোপূর্বে যাই নাই – এ’আমার আতœগ্লানী ও কস্টবোধ, যা বয়ে বেড়াচ্ছি
ড় নবী আমার দ্বীন প্রচারে কত কষ্ট, ত্যাগ তিথিক্ষা, অত্যাচার আর নির্যাতন সয়েছেন – তা সেখানে পরিদর্শন না করলে অনেকের পক্ষে হৃদয়াঙ্গম করা কঠিন। নবীকে চেনা সহজ হয়ে উঠে।
ড় কা’বা-শরীফ-কে দেখে মনে হয়েছে আমি যেন আল্লাহ-কে দেখছি তার রহমত বর্ষণের মধ্য দিয়ে
ড় কা’বা-কে যত দেখি তৃপ্তি যেন শেষ হয় না
ড় কা’বা এবং মসজিদে নববী যেন হৃদয়ে গেঁথে থাকবে আমৃত্যু
ড় বার বার মনে চাইছে আবার যেন ছুটে যেতে কা’বা ও মসজিদে নববী পানে
ড় কা’বা গৃহ ও মসজিদে নববীতে যারা সার্ভিস দিচ্ছে তারা কতইনা সৌভাগ্যবান। আমি সহ আমার বংশের প্রজন্ম থেকে কাউকে না কাউকে খাদেম হিসেবে কবুল করেন
ড় সৃষ্টির পর থেকে এক মুহুর্তের জন্য কা’বা-গৃহ প্রদক্ষিণ যেন বন্ধ নাই- এ’যেন এক আল্লাহর অপূর্ব ও অনুপম নিদর্শন
ড় শত কষ্ট হলেও প্রত্যেক মুসলিমের সেখানে যাওয়া উচিৎ
ড় খানায়ে কা’বা, মসজিদে নববী, বায়তুল মোকাদ্দাস সহ মুসলিম স্থাপনাগুলোকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আল্লাহ রক্ষা করুন- এ’ছিল অন্তরের আকুতি আর মিনতি।
ড় হাতে আরো সময় নিয়ে(নূন্যতম ৩০ দিন) যাওয়া হলে ইসলামের অনেক ইতিহাস, স্থাপনা ও কালের সাক্ষীসমূহ দেখে আসা যেত। নিজেকে ধন্য মনে হত। হত জ্ঞানের পরিধি শানিত।
ড় হৃদয় নিঙ্গড়ানো ভালোবাসার বস্তু রেখে এলাম, অব্যক্ত বেদনা আর পরবর্তিতে আরো পাওয়ার জন্য অতৃপ্ত-অশান্ত হৃদয় নিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হলাম।
৬) কি করলে এ’সফর আরো সুন্দর হত-
প্রতিটি কাজ বা প্রগ্রাম হাতে নেয়ার পর উক্ত কাজ নিয়ে ব্রেইন র্স্ট্রমিং করে প্রগাম সিডিউল তৈরী করা প্রয়োজন। ব্যর্থতা আমারই, কেননা এ্যজেন্সির উপর নির্ভর করা ঠিক হয়নি। কা’বা-গৃহের কোথায় কোন স্থাপনা, দো’য়া কবুলের জায়গাসমূহ জেনে নেয়া। কোন কোন সময় চাপ বা ভীড় কম থাকে, কীভাবে আগালে হযরে আসওয়াদ চুম্বন করা সহজ হবে। ঢাকা টু মক্কা, না ঢাকা টু মদিনা রুটে গেলে ভালো হত-জানা প্রয়োজন ছিল। যেহেতু বাংলাদেশ থেকে ইহরামের কাপড় পরে যেতে হচ্ছে তাই আমি প্রতিবন্ধীর জন্য মদিনায় প্রথমে গিয়ে সেখান থেকে ইহরাম বেঁধে মক্কায় আসলে পবিত্রতা শতভাগ নিশ্চিত হতো বলে আমার মনে হয়েছে। মসজিদে নববীর ভিতরের স্থাপনা ডাঃ শফি উল্লাহ বুঝিয়ে দিয়েছিল বলে বেশ সুবিধা হয়েছিল এবং আয়েশি করে বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলাম। শোকর আল্লার দরবারে, প্রতিবন্ধী হয়েও আল্লাহ আমাকে তার মনোনীত স্থানে নিয়ে গেছেন। সৌদি সীম দুটি কিনলে ভালো হত- ফলে হারিয়ে গেলে বা কোথাও কোন কাজে লিপ্ত থাকলে জানিয়ে দেয়া সম্ভব হত। এতে সময় ক্ষেপন কম হত। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও। ২/১টি হজ্জ এ্যজেন্সির সাথে আলাপ করলে ব্যয়-ভার কমের সাথে সাথে মুয়াল্লেমের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যেত। সিডিউল করে কেনা-কাটা করা যেত। কোন কোন স্থানে যিয়ারা হবে তা আগে জানিয়ে দিলে সে সম্পর্কে পূর্ব জ্ঞান লাভ করে বিচরণ করলে বিষয়গুলো আরো প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠতে পারতো।

৭) আমার করনীয় ও বর্জনীয় –
যেটি জীবনের জন্য একবার, সেটি কেমন হওয়া উচিৎ-তা ভাববার বিষয়। এ’মহতি প্রগ্রাম ফলপ্রসু করে বাস্তবায়ন করতে হলে পূর্বেই ব্রেইন-স্টর্মিং করে আগানো উচিৎ ছিল। এ’সংক্রান্ত পুস্তকাদি উত্তমভাবে পড়ে হৃদয়াঙ্গ করা প্রয়োজন। চধংং-ঢ়ড়ৎঃ এর ফটোকপি, ঞড়ঁৎং ্ ঞৎধাবষষং থেকে প্রাপ্ত ঝপযবফঁষব ও ঈড়হংঁষঃধহঃ এর চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র একটি চষধংঃরপ ঋরষব-এ সংরক্ষণ করে সর্বদা হাতের কাছে রাখা উচিত। নিজে তৈরীকৃত প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করা। অমবহপু থেকে সব কিছু হাতে কলমে বুঝে নেয়া। ফ্রি সিম না দিলে সময় ক্ষেপন না করে কিনে নেয়াই ছিল উত্তম।

অমবহপু এর কথা ও কাজে গরমিল থাকে। এই ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত। হারাম শরিফের মধ্যে বিতর্কে লিপ্ত না হওয়া। অধিক গল্প বা সময়ের অপব্যবহার না করা। ইসলামী পোশাকের পরিপন্থি পোশাক না পরা। ফটো এবং সেলফিতে সময় ব্যয় না করা।

৮) শিক্ষনীয় –
ক্স গ্রুপভিত্তিক থাকলে এবং পোশাকের/হ্যান্ড ব্যাগের রং নির্দিষ্ট থাকলে হারানোর ভয় থাকে না।
ক্স প্রতিটি মুহুর্ত ধ্যানে মগ্ন থাকা
ক্স আল্লাহর সৃষ্টিসমূহ অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখার চেষ্টা এবং সেইগুলো নিয়ে ব্রেইন স্ট্রর্মিং করা।
ক্স যেসমস্ত স্থানে বিশেষ ফজিলত রয়েছে তা যেনে বাস্তবায়ন করার চেষ্টায় থাকা
ক্স যিয়ারার স্থানসমূহের বিষয়ে তথ্য উপাত্ত ও ইতিহাস পূর্ব থেকেই আত্বস্থ করা
ক্স পরোপকারে লাগা এবং সবর করা
ক্স নবী, রাসুল ও সাহাবীদের জীবন চরিত জানা ও মানা

৯) প্রতিবন্ধীদের সুবিধা অসুবিধা-
প্রতিবন্ধকতা আছে বলেই আমরা প্রতিবন্ধী। আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী- এই দৃষ্টি ভঙ্গির প্রতিফলন রয়েছে বহুলাংশে। ওমরাহ হজ্জে প্রতিবন্ধীদের তেমন অসুবিধা আছে বলে মনে হয়নি যদি একটু কেয়ার নেয়া হয় পূর্ব থেকেই। বায়তুল্লাহ ও মসজিদে নববীতে হুইল-চেয়ার গমনাগমন অনেক সহজ। হয়তঃ বিশেষ কোন কারণে খানায়ে কা’বার মূল চত্তরে হুইল-চেয়ার ইউজারদের যেতে দেয়া হয় না। এতে আমার মনোকষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। তবে আমি যেতে সক্ষম হয়েছিলাম বার তিনেক, আল-হামদুলিল্লাহ। মোটামুটি সবাই সবখানে হুইল-চেয়ারধারীকে সহযোগীতা করে থাকে এবং আমাকেও করেছে।

মক্কা পাহাড়ী এলাকা- তাই উচুঁ নিচু বিধায় যৎসামান্য কষ্ট হয়েছিল। প্রত্যেকটা হোটেলে র‌্যাম্প রয়েছে। হোটেল নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ’দিকটা খেয়াল রাখা উচিৎ। মক্কার বানোনাহ হোটেল বিল্ডিংটি ছোট, বাথ রুম আয়াতনে ছোট হলেও সব মিলে মার্জিত এবং সামান্য উঁচু পাহাড়ে এর অবস্থান ছিল। আমরা তিন শর্য্যাবিষ্ট বানোনা হোটেলের ৩০৮নং কক্ষে ২৬/০২/২০১৮ থেকে ০৭/০৩/২০১৮ সকাল ৮.০০টা পর্যন্ত বেশ ছিলাম। হোটেল থেকে ৩/৪ মিনিট দুরত্বে হারাম শরীফ। অন্য দিকে মসজিদে নববীর সাত নং গেটের কাছের গোল্ডেন ওয়াছেল হোটেলটির বিল্ডিংটি ছিল বড়। তিন শর্য্যা বিশিস্ট ৮১১নং কক্ষ আয়তনে ছোট ছিল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন তদারকি পরিলক্ষিত হয়নি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদি হুইল-চেয়ার ইউজার হয়ে থাকেন তবে পবিত্রতা রক্ষার্থে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে মদিনা, পরে মদিনা থেকে মক্কায় গেলে ইহরামের কাপড় পড়ে পবিত্র থাকাটা সহজ হয়ে যায়। এটা আমার একান্ত ফিলিংস। বাথরুমে হুইল-চেয়ার নেয়ার প্রয়োজন হলে তেমন স্পেসের হতে হবে- বিধায় বিষয়টি ট্রাভেলিং এ্যাজেন্সিকে বলে পূর্বেই নিশ্চিত করেতে হবে।

১০) অতিরিক্ত বই-পুস্তক সাথে করে নেয়া ভালো মনে হয়েছে, যা নিন্মরূপ-
 যে কোরআন-শরীফটি আপনি সবসময় পড়তেন
 সকাল সন্ধ্যায় যে দো’য়ার বইটি পড়তেন
 হজ্জ সংক্রান্ত বই
 কা’বা গৃহ ও মসজিদে নববীর (বিভিন্ন অংশের) ডিজাইন সম্বলিত পুস্তিকা
 আরবে সাহাবায়ে কেরামদের জীবনী ও মুসলিম যুগের ইতিহাস ইত্যাদি

যেহেতু হজ্জের ফরজিয়াত জীবনে একবার মাত্র পালন করতে হয়। এটি যেন সেই মান সম্মত হয়। তার কামনা বাসনা আর বাস্তবায়নের জন্য যা যা প্রয়োজন তার করতে হবে হজ্জগামী সকলকে। তাই হজ্জ বিষায়ক যাবতীয় বিষয়াবলী জেনে নেয়া নিতান্ত প্রয়োজন। আগে ভাগে জেনে নিলে হজ্জ গমনে বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যাবলী সম্পাদনের সময় মজা পাবেন, হৃদয়াঙ্গম করবেন সেই রকম স্প্রীট নিয়ে। অতৃপ্ত আতœা অনাবিল তৃপ্ততায় ভরে দিবে এক অপার্থীব শান্তি। হজ্জের প্রশিক্ষণ নেয়ার সাথে সাথে নিন্মোক্ত বইগুলো বার কয়েক পড়ার আকুল আবেদন জানাচ্ছি Ñ
ক) আর রাহীকুল মাকদুম – ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল-কুরআন একাডেমী, লন্ডন)
খ) আল কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে হজ্জ ও উমরাহ – আমির জামান ও নাজমা জামান
গ) আল্লাহর অতিথি – নাজমা ফেরদৌসি
ঘ) মন যে আমার কাবার পথে – অধ্যাপক জিয়াউল হক

১১) উপসংহার-
আমল এর পূর্বে ইলম জানা অত্যাবশ্যক। তা না হলে আমল করতে গেলে অনেকাংশে গুনাহ হয়ে যেতে পারে। এ’প্রথম যাত্রায় কতটুকু পেরেছি বা পারি নাই অর্থাৎ সফলতা অথবা ব্যর্থতার হিসাব একমাত্র আল্লাহ-ই ভালো জানেন। তবে পরিদর্শনের পূর্বে কা’বাকে যেভারে জেনে ছিলাম, সরেজমিনে দেখার ফলে কা’বা আমার হৃদয়ে তার চেয়ে বহুগুনে ভালবাসার জায়গাটুকুতে দখল করে নিয়েছে। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এ’পাওয়া যেন সর্বোত্তম পাওয়া। কা’বা ঘর তওয়াফের মাধ্যমে একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালকের কাছে আহাজারির পাশাপাশি মদিনায় শায়িত খাতামুন নাবিয়ীন, সাইয়্যেদুল মুরসালিন নবীকুলের সর্দার হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা মুবারক জিয়ারতের মাধ্যমে এক অনুপম আতœতৃপ্তি বোধ আহোরিত হয়েছিল। সাথে সাথে তাঁর সাফায়াত লাভের আকুতি-মিনতির মাধ্যমে দো’য়া কবুলিয়াতের স্থানসমূহে ফরিয়াদের সুযোগ সন্ধানে থাকাই ছিল আমাদের একমাত্র ব্রত। মহান আল্লাহ সুবহানু তা’য়ালা আমাদের সে আশা বহুলাংশে পূরণ করেছেন। সহ¯্রকোটি শোকর একমাত্র তাঁরই দরবারে। কা’বা ঘর তওয়াফ ও হযরত মুাহাম্মদ (সা.) এর রওজা মুবারক জিয়ারত-ই প্রত্যেক মুসলিমের মনের একান্ত আরাধ্য বিষয় হওয়া উচিত। আর তা যৌবন বয়সে হওয়া উচিৎ। এ’কামনা রইল সকল বিশ্বাসী ও মুসলিম ব্যক্তি বিশেষের কাছে।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *