মোঃ রাজিব হোসেনঃ ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘরে আছে দেখার মত অনেক কিছু। তবে সবুজ মাঠে সাজানো সারি সারি বিমান দেখে বিস্ময়ে ছানাবড়া হবে আপনার চোখ। হিটলু, জাহিদ ও আমি রাজিব ৩ বন্ধু মিলে কয়েকদিন আগে ঘুরে এলাম বিমান বাহিনী জাদুঘর। চারদিকের মনোরম পরিবেশ আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। এবার নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার যাওয়া।
বিমান বাহিনী জাদুঘর হঠাৎ করে দেখে মনে হতে পারে, কোন রানওয়ে। আবার এয়ারপোর্ট বলেও অনেকে ভুল করতে পারেন। আসলে এর কোনটিই নয়। এটি আসলে বিমানের জাদুঘর। বিমান বাহিনীর উদ্যোগে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় আইডিবি ভবনের বিপরীতে এ জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর রয়েছে এক গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জাদুঘরে গর্বের সাথে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় অহংকার ও স্মৃতি বিজড়িত বিমানসমূহ। ১৯৭১ সালের উত্তাল সেই দিনগুলোতে স্বল্প সম্পদ আর জনবল নিয়ে ডিমাপুরে সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। অকুতোভয় কয়েকজন বৈমানিক আর নির্ভিক কিছু বিমান সেনার অদম্য সাহস মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে করেছিল প্রকম্পিত ও বিজয়কে করেছিল ত্বরান্বিত। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এই গৌরবময় ঐতিহ্যের ইতিহাস, সাফল্য ও উন্নয়নের ক্রমবিকাশকে সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াসে ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বেগম রোকেয়া সরণী সংলগ্ন তেজগাঁও বিমানবন্দর রানওয়ের পশ্চিম পাশে মনোরম পরিবেশে যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘর। তবে এর আগে ১৯৮৭ সালের ১৭ জুন এর প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। জাদুঘরটির ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে এক বিশাল চত্বর। পুরো চত্বর জুড়েই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গৌরবের সাক্ষী হয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গি বিমান, হেলিকপ্টার ও রাডার। জাদুঘরে রয়েছে মোট ১৯টি বিমান এবং ৩টি রাডার। এরমধ্যে ৩টি বিমান বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনী ব্যবহার করে।বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম বিমান বলাকাও রয়েছে এই জাদুঘরে। বলাকায় দর্শনার্থীদের প্রবেশের সুবিধাও রয়েছে। বলাকা ছাড়া আরো তিনটি বিমানে দর্শনার্থীদের প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। বিমানগুলোতে প্রবেশের জন্য টিকিট মূল্য ৩০ টাকা। তবে শুধু প্রবেশের সুযোগই নয়, বিমানগুলোতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ওপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্রও প্রদর্শিত হয়। জাদুঘরে দর্শনার্থীদের পানাহারের জন্য প্রাঙ্গণের দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করা হয়েছে একটি ফুড কোর্ট। এছাড়া বিমান বাহিনীর বিভিন্ন দ্রব্যাদি দিয়ে সজ্জিত হয়েছে স্যুভেনির শপ ‘নীলাদ্রি’। শিশুদের মনোরঞ্জন ও উত্সাহ বৃদ্ধির জন্য শিশু পার্কের পাশাপাশি ফুটপাথের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে জিরাফ, শিম্পাঞ্জি, হরিণ ইত্যাদি নানা রকম পশু-পাখির প্রতিকৃতি। এটার নাম দেয়া হয়েছে ‘চিলড্রেন হেভেন’। রয়েছে পানির ফোয়ারাও। এছাড়া পাহাড়ের আদলে তৈরি হচ্ছে ‘থিম পার্ক’। এটি অবশ্য জাদুঘরের নতুন প্রকল্প। কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। দ্রুত শেষ হবে বলে জানা গেছে। জাদুঘরটি সোম থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শুক্র ও শনিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ এবং প্রবেশ মূল্য সর্বসাধারণদের জন্য ৫০ টাকা, তবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য ২৫ টাকা।
বিমান জাদুঘরে প্রদর্শিত বিমানসমূহ
হান্টার বিমান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় এই বিমানটির অংশগ্রহণ ও অবদানের জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে বিমানটি উপহার হিসাবে দেয়। বিমানটি ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় বিমান বাহিনীতে আকাশ রক্ষার কাজে ব্যবহূত হয়। তত্কালীন সময় এটি খুবই শক্তিশালী এবং নির্ভরশীল বিমান ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এটি ভূমি আক্রমণ এবং আকাশ প্রতিরক্ষায় সফল উড্ডয়ন করে।
এফটি-৭ বিমান: বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ১৯৮৯ সালে চীনের তৈরি এই যুদ্ধ বিমানটি প্রথম সংযোজিত হয়। এফ-৭ বিমানটি প্রশিক্ষণ বিমান হিসাবে ব্যবহূত হয়।
এন-২৪ বিমান: রাশিয়ার তৈরি এই বিমানটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ১৯৭৩ সালে বলাকা নামে সংযোজিত হয়। বিমানটি সরকারিভাবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ব্যবহার করতেন। এই বিমানে করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন রাষ্ট্র সফর করেছেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্রীয় সমর্থন আদায় করেছেন। বিমানটির যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৪৪ জন।
এফ-৮৬ যুদ্ধবিমান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই বিমানটি ব্যবহার করে। যুদ্ধে পাকবাহিনী বিমানটিকে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রকৌশলী কর্মকর্তা ও টেকনিশিয়ানরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টার মাধ্যমে বিমানটি মেরামত করেন এবং ১৯৭২ সালে সফলভাবে উড্ডয়ন করান। বিমানটি ১৯৪৭ সালে তৈরি।
এ-৫ বিমান: বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে চীনের তৈরি এই যুদ্ধ বিমানটি ১৯৮৬ সালে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই বিমানটি ১৫০০ কেজি ওজনের সমরাস্ত্র ও আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য মিসাইল বহন করতে সক্ষম।
প্রথম বিমান বলাকা: বাংলাদেশের প্রথম যাত্রীবাহী বিমান বলাকা। রাশিয়ার তৈরি এই বিমানটি বাংলাদেশে আসে প্রথম ১৯৫৮ সালে। বর্তমানে এটা জাদুঘরে রাখা হয়েছে।
পিটি-৬ বিমান: চীনের তৈরি এই বিমানটি বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে যুক্ত হয় ১৯৮৫ সালে। জাদুঘরে ঘুরতে ঘুরতে দেখা পেয়ে যেতে পারেন লাল সাদা এই বিমানটির।
ফুগাসি এম-১৭০ বিমান: ফ্রান্সে ১৯৬০ সালে তৈরি করা হয় বিমানটি। অতঃপর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় ১৯৯৭ সালে।
গ্লাইডার বিমান: বিমান বাহিনীর আকাশ অভিজ্ঞতার জন্য জার্মানির দেয়া এই বিমানটি ১৯৮২ সালে দেশে আনা হয়। বিমানটি পশ্চিম জার্মানির তৈরি। একই বছরের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এর প্রথম উড্ডয়ন হয়।
এয়ারটেক কানাডিয়ান ডিএইচ বিমান:কানাডার তৈরি এই বোমারু বিমানটি ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে সফল অভিযান পরিচালনা করে। এখন অবশ্য পুরনো হয়ে যাওয়ায় এটিকে রাখা হয়েছে প্রদর্শনীতে।
এফটি-৫ বিমান: চীনের তৈরি এই প্রশিক্ষণ বিমানটি বাংলাদেশে আসে ১৯৮৬ সালে। এই প্রশিক্ষণ বিমানটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জঙ্গি বৈমানিক উড্ডয়ন পারদর্শিতা অর্জনে ব্যবহূত হয়।
মিগ-২১ বিমান: রাশিয়া উপহার স্বরূপ এই বড়সড় প্রশিক্ষণ বিমানটি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে উপহার দেয়।
অটার-৭২১ বিমান: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বৈমানিকগণ কানাডায় নির্মিত এই বিমানটি দ্বারা ১৯৭১ সালে ৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটিতে আঘাত হানে। যাত্রী বহনসহ বিভিন্ন কাজে বিমানটি ১৯৭১ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়।
এলিউট হেলিকপ্টার: ফ্রান্সে তৈরি এই হেলিকপ্টার নিয়ে আমাদের বৈমানিকগণ হানাদার বাহিনীর সেনানিবাসে আঘাত হানে। যাত্রী বহনসহ বিভিন্ন কাজে এটি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ব্যবহূত হয়।
মিগ-২১ এফ এল বিমান: ১৯৬৩ সালে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এখনও এর উড্ডয়ন অব্যাহত আছে। বিমানটি প্রধানত আকাশ প্রতিরক্ষা ও ভূমি প্রহরার জন্য ব্যবহূত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই বিমানটি আকাশ প্রতিরক্ষা ও আকাশ থেকে ভূমিতে আক্রমণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
ন্যাট-৯১৬ বিমান: জঙ্গি বিমানগুলোর মধ্যে ন্যাট সর্বাধিক হালকা এবং আয়তনে ছোট। ১৯৫০ সালে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে এটি অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ব্যবহূত হয়। তত্কালীন সময়ে ন্যাট বিমান আকাশ যুদ্ধ কৌশলে অত্যন্ত চৌকস বিমান হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনটি ন্যাট বিমান পাকিস্তানের তিনটি স্যাবর জেট (এফ-৮৬) ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর বগুড়ায় আকাশ যুদ্ধে এই বিমানটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
সূত্রঃ বিমান বাহিনী জাদুঘর