আব্দুল কাইয়ুম অভিঃ চাকুরীর সুবাদে খুলনা শহরে আছি দীর্ঘদিন ধরে। এর আগেও অনেকবার খুলনায় গিয়েছিলাম। খুলনা শহরে দেখার মত রয়েছে অনেক কিছু, যার মধ্যে শহীদ হাদীস পার্ক অন্যতম। মূলতঃ ভাষা শহীদ শেখ হাদিসুর রহমান বাবুর নামানুসারে খুলনা মহানগরীর এই পার্কটির নামকরণ করা হয় শহীদ হাদীস পার্ক। শহীদ হাদিস পার্ক খুলনা শহরের বাবুখানা রোড, বাংলাদেশ ব্যাংক খুলনা শাখার পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত। হাদিস পার্কে রয়েছে পানির ফোয়ারা, শহীদ মিনার, বিশাল লেক ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে খুলনা শহরকে এক ঝলকে দেখে নেয়া যায়। শহীদ হাদিস পার্কটি পূর্বে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। পার্ক নির্মাণের শুরুর দিকে এটি ‘খুলনা মিউনিসিপ্যাল পার্ক’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯২৫ সালের ১৬ জুন এই পার্কে মহাত্মা গান্ধী বক্তব্য রাখেন বলে পরবর্তীতে এই পার্কের নামকরণ করা হয় গান্ধী পার্ক। দেশবিভাগের পর এই পার্কের নাম বদলে দেওয়া হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামানুসারে এই পার্কের নামকরণ করা হয় জিন্নাহ পার্ক। এভাবেই কালক্রমে নামের পরিবর্তন হতে থাকে পার্কটির। সর্বশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পার্কের নামকরণ করা হয় শহীদ হাদিস পার্ক।
বিভিন্নজনের কাছে শোনা কথা ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, হাদিসুর রহমান বাবু ১৯৪৪ সালের ২১ এপ্রিল বাগেরহাটের রণবিজয়পুরে জন্মগ্রহণ করেন। এসএসসি পাশ করে খুলনার আযমখান কমার্স কলেজে ভর্তি হন। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে পড়াশুনার পাশাপাশি যুবক হাদিস শান্তিধাম মোড়ের ‘হোয়াইট স্নো’ নামের এক লন্ড্রিতে কাজ করতেন। ১৯৬৯ সালে এদেশের ছাত্রসমাজ ও সচেতন মানুষ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। আইয়ুব খানকে প্রতিহত করার জন্য ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন শুরু করে খুলনার স্থানীয় লোকেরা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মিছিল নিয়ে সকলে মিলে মিউনিসিপ্যাল পার্কে সমবেত হবে। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারী সকাল নয়টায় মিছিল বের হলে পুলিশ হামলা চালায়, মিছিলকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে শহীদ হন হাদিসুর রহমান বাবু। সংঘর্ষের পর থেকে কারফিউ জারি করা হয়। ২২ তারিখ সকালে ঘণ্টাখানেকের জন্য কারফিউ শিথিল করা হলে মিছিলকারীরা মিউনিসিপ্যাল পার্কে সমবেত হন এবং এখান থেকে সিদ্ধান্ত হয় এই পার্কের নামকরণ করা হবে শহীদ হাদিস পার্ক। জানা যায়, এই পার্কের আধুনিকায়ণ করার জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যার প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা। একবিংশ শতকের শুরুতে শহীদ হাদিস পার্ক ছিল অন্যরকম। খুবই সাদামাটা ও সাধারণ ছিল তখন। তবে পার্কটিতে ফুল গাছ, ফল গাছ সহ মনোরম পরিবেশ বজায় ছিল। বর্তমানে এই পার্কের বিশাল লেকে প্রতিনিয়ত ঘুরতে আসে হাজারো মানুষ। আশেপাশের অনেক মানুষ বিকেলে বেড়াতে চলে আসে শহীদ হাদিস পার্কে। এই পার্কটি একটি ঐতিহ্যবাহী পার্ক। পার্কের ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে। সেই সাথে খুলনা শহরের মানুষের কাছে এটি দারুণ স্থান। হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়মের জন্যও পর্যাপ্ত জায়গা আছে এখানে। হাঁটার রাস্তার এক পাশে রয়েছে সুন্দর ও মনোরম ফুলের বাগান যা পুরো পরিবেশকে স্নিগ্ধতা দান করেছে। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফুল ফোটে এই পার্কে। বিশাল লেক পার্কটিতে অনন্য মাত্রা যোগ করে দিয়েছে। অসংখ্য মানুষ ছুটির দিনে এই পার্কে ভিড় জমায়। এছাড়া এই পার্কটির পানির ফোয়ারা দেখতে অসাধারণ। খুলনা শহরের অন্য সকল পর্যটন কেন্দ্র থেকে শহীদ হাদিস পার্ক কোনো অংশেই কম নয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমের প্রশাসনিক এলাকা খুলনা শহরের উল্লেখযোগ্য শহীদ হাদিস পার্ক দেখতে আপনিও চলে যেতে পারেন। পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে পারবেন খুলনার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে। খুলনার মনোরম ও আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলো আপনাকে নিরাশ করবে না বরং অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নতুন কিছু যোগ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
জাতিসংঘ পার্কঃ খুলনা জেলার খুলনা শহরে অবস্থিত শিশুদের জন্য একটি চমতকার বিনোদন এলাকা হলো জাতিসংঘ শিশু পার্ক। সূর্যের তাপ কমে একটু বিকেল হলেই নানা বয়সী শিশুরা ছুটে আসে এখানে। নগরীর খানজাহান আলী সড়কের পাশে অবস্থিত এ পার্কটি। নামকরণ। ১৯৯৪ সালে মহানগরী শিশু পার্ক নামে পার্কটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জাতিসংঘ পার্ক।
ঢাকা থেকে খুলনা যাওয়ার উপায়
বাসঃ ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালীর বাস স্টেশন থেকে বিভিন্ন বাস খুলনার উদ্দেশ্যে যায়। খুলনা শহরে নেমে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় বা রিকশায় চড়ে খুব সহজে যেতে পারবেন শহীদ হাদিস পার্কসহ খুলনা মহানগরীর যেকোন এলাকায়।
ট্রেনঃ ট্রেনে চড়ে খুলনা যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেস নামের দুটো ট্রেন ছাড়ে। একটি ট্রেন ছাড়ে ভোর ৬টা ২০ মিনিটে এবং আরেকটি ছাড়ে সন্ধ্যা ৭টা সাড়ে ৭ টায়। ট্রেনে চড়ে খুলনায় যেতে ভাড়া খরচ হবে ভ্যাটসহ ৫০০-৮৫০ টাকা।
ট্রেনের যাত্রা বিরতিঃ চিত্রা এক্সপ্রেস সোমবার এবং সুন্দরবন এক্সপ্রেস বুধবার যাত্রা বিরতিতে থাকে। এছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য সময় স্বাভাবিক নিয়মে ট্রেন চলে।
খুলনার কোথায় থাকবেনঃ খুলনা শহরে থাকার মতো অনেক আবাসিক হোটেল আছে। এই হোটেলের যেকোনো একটিতে থাকতে পারবেন আপনিও। আবাসিক হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো টাইগার হোটেল, হোটেল হলিডে ইন্টারন্যাশনাল, রয়েল হোটেল, ক্যাসল সালাম ইত্যাদি।
কোথায় খাবেনঃ খুলনা শহর বেশ উন্নত। এখানে সাধারণ মানের হোটেলের পাশাপাশি রয়েছে উন্নতমানের ভালো রেস্টুরেন্ট। হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্ট যেখানে খুশি সেখানে ভুরিভোজ করতে পারবেন।