হিমালয় রিপোর্টঃ সুযোগ পেলেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাই বাংলার প্রকৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির কাছে মায়ার টানে। এবারের ঈদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাসা থেকে বিকেলে বের হয়ে গেলাম মা’কে রথ মেলায় যাচ্ছি বলে। যদিও রথ মেলায় সত্যি যাচ্ছি। কিন্তু রথ মেলার পরে কোথায় যাবো তা তো আর মাকে বলে আসিনি। আর বলব বা কি করে আমি নিজেই তো জানিনা কোথায় যাবো আজ রাতে। তবে পালাবো যে সেটা আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। রথ মেলা ঘুরে রিক্সা নিয়ে আসলাম সুরমা নদীর ক্বিন ব্রিজ এর নিচে। অনেকক্ষণ বসে চা খেলাম। সন্ধ্যা প্রায় এলো এলো। তোপখানা ঘাট দিয়ে নৌকায় চরে নদী পার হয়ে রেল কলনি ধরে পায়ে হেটে চলে এলাম সিলেট রেল স্টেশন। স্টেশন একেবারেই ফাকা। ঢাকা চট্টগ্রাম গামি রেল দুটি অলস দাঁড়িয়ে আছে লাইনে। টিকেট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আজ কি চট্টগ্রাম গামী ট্রেন ছাড়বে। উনি জানালেন আজ ঢাকা চট্টগ্রাম গামী কোন ট্রেন ছাড়বেনা।
কী আর করার, দুই চার মিনিট পায়ে হেটে চলে গেলাম বাস স্টেশন। বাস স্টেশন ঘুয়ে দেখি তেমন একটা গাড়ি নেই। একেবারে যে নেই তা কিন্তু না। অল্প কিছু সংখ্যক গাড়ি দাঁড়ানো আছে। ফুটপাতে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে ভাবলাম কোথায় যাওয়া যায়। চোখ বুজে কল্পনা করতে লাগলাম। বারবার চোখে ফেইসবুকের তিলোত্তমা হাতিয়া গ্রুপটা ভেসে উঠছে। গ্রুপের ছবি গুলিও চোখে ভেসে উঠছে একে বারে স্পষ্ট। জোয়ার ভাটার, সারিসারি তালগাছ, ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন ডিজাইনের নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ, বিশাল মেঘনা নদী, মাছ ধরার দৃশ্য আরো কতো কি?
হাতিয়া সিলেট থেকে অনেক দূর। কিন্তু আমার ছুটি ঈদের দিন সহ মাত্র তিন দিন। আজ তো এক দিন চলেই গেল। আর মাত্র দুই দিন ছুটি আছে। খুব টেনশনে পরে গেলাম। টেনশন দূর করে দিলো আমার পুরাতন একটা অভিজ্ঞতা। আজ থেকে চার বছর আগে কুরবানীর ঈদে ঠিক এই রকম তিন দিনের ছুটি নিয়ে এক দিনে ঘুরে এসেছিলাম সিলেট থেকে চট্টগ্রাম – কক্সবাজার – চট্টগ্রাম – ঢাকা – কিশোরগঞ্জ হয়ে সিলেট। যদিও সেবার রুটিন মাফিক শুধু নির্ধারিত জায়গা গুলি ঘুরে ছিলাম। তবে এবার কেন পারবোনা। নির্ভয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম তিলোত্তমা হাতিয়া দ্বীপ যাওয়ার। ইচ্ছেই তো শক্তি আর সাহস।
চায়ের দোকানে চা সিগারেট খেতে খেতে ইন্টারনেটে দেখে নিলাম কি ভাবে হাতিয়া যেতে হয়। হাতিয়া যেতে হলে আগে নোয়াখালি যেতে হবে। নোয়াখালি আমার খুব চেনা জেলা শহর। অনেকবার ঘুরতে গিয়েছি ঐ জেলাতে। তাই আর কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
সিলেট থেকে নোয়াখালী যায় একমাত্র বাস বিআরটিসি। তাই কদমতলী বিআরটিসি কাউন্টারে গেলাম। না রাতে নোয়াখলিতে কোন বাস যায়না বলে জানালেন বিআরটিসি কাউন্টারের ম্যানেজার। আমার জানা মতে আরেকটা বাস আছে ইউনাইটেড। যেটা সিলেট থেকে লক্ষিপুর যায় নোয়াখালির চৌরাস্তার উপর দিয়ে। ভাবলাম ইউনাইটেডে দিয়েই চৌরাস্তা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। পুরো বাসষ্টেশন জুড়ে খুজতে লাগলাম ইউনাইটেড বাস। কিন্তু না কোথাও খুজে পেলাম না ইউনাইটেড বাস বা বাসের কাউন্টার। শেষ সব শেষ। আর ঘুরা হচ্ছেনা তিলোত্তমা হাতিয়া। মনটা পুরাই ভেঙ্গে গেল।
খুব হতাশা গ্রস্ত হয়ে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি আর ভাবছি এখন কি করবো? হাতিয়া তো যাওয়া হচ্ছেনা তবে কোথায় যাবো? খুব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলাম। চায়ে চুমুক দিচ্ছি। হটাৎ কানে ভেবে আসলো একজন বাস হেল্পারের “কুমিল্লা কুমিল্লা” বলে চিল্লানোর শব্দ। শুনা মাত্রই আমি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম পেয়েছি পেয়েছি। চায়ের দোকানি সহ আশে পাশের সবাই কেপে উঠলেন আমার চিৎকারে। সবাই এক সাথে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কি পেয়েছেন। আমি বিষন লজ্জা পেলুম। লজ্জা পেয়ে বললাম না তেমন কিছুনা। চায়ের দোকানের বিল পরিশোধ করে চলে এলাম কুমিল্লা টান্সপোর্ট নামক বাস কাউন্টারে। বাসের লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম গাড়িটা রাত আটটায় ছাড়বে কুমিল্লার উদ্যেশে। আমার এখন অনেক আনন্দ লাগতে লাগলো। কে আর ঠেকায় এখন আমার তিলোত্তমা হাতিয়া যাওয়া। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম কুমিল্লা হয়েই নোয়খালি যাবো। নোয়াখালীর মতো কুমিল্লাও আমার খুব চেনা শহর। কুমিল্লা শহরেও অনেক ঘুরেছি আমি। কুমিল্লাতেও কোন সমস্যা হবার কথা নয়।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক কুমিল্লা টান্সপোর্ট এর টিকেট কাটলাম কুমিল্লার উদ্যেশে। রাত আটটার দুই এক মিনিট পরে বাস ছেড়ে দিল কুলিল্লার উদ্যেশে। বিদায় নিলাম সিলেট থেকে। সিলেট থেকে নোয়াখালি তিলোত্তমা হাতিয়া দ্বীপ এর উদ্যেশে রাত দুইটার দিকে কুমিল্লা পৌছে গেলাম। তারপর কুমিল্লা বাস স্টেশন থেকে পায়ে হেটে কুমিল্লা রেল স্টেশন যাওয়ার পথে পুলিশ আটকালো আমায়। চেকিং করার জন্য ডাক দিলো। আমি পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আসলে পুলিশ চেকিং এ আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই আর আমার ভিতর পুলিশিং ভয়বীথি কাজ করেনা। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে চেহারা দিয়েছেন তা তো পুলিশের নজর কারবেই। পুলিশের দোষই বা কিসে তাতে? ভুলেও আমার চেহারা পুলিশের নজর এড়ায় না আমি জানি। এখন পর্যন্ত এমন কোন পুলিশ চেক পোস্ট নেই যেখানে পুলিশ আমাকে ডাকেনি বা চেকিং করেনি।
যাই হোক পুলিশ আমায় চেক করে আর আমার সাথে কথা বলে জানতে পারলেন আমি হাতিয়া যাচ্ছি ঘুরতে। উনি হাত মিলিয়ে সাবধানে যেতে উপদেশ দিলেন আমায়। আমিও সেই উপদেশ নিয়ে পৌছে গেলাম কুমিল্লা রেল স্টেশন। ষ্টেশনে বসে বসে কয়েকটা চা গিললাম। ঘন্টা দুয়েক পরেই একটা ট্রেন আসলো চট্টগ্রাম গামি। বিনা টিকেটে উঠে পরলাম ট্রেনে। ট্রেনের ভিতর তিল ধারনের জায়গা নেই। আমি মনে হয় তিলের চেয়েও ছোট আকৃতির মানুষ তাই কোন রকম দাঁড়িয়ে থেকে বিশ পঁচিশ মিনিটে পৌছে গেলাম লাকসাম জংশনে। স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় একজন মুরব্বি দাড়িওয়ালা চাচা টিকেট চেক করছিলেন। আমার কাছে টিকেট চাইলেন। আমি তো টিকেট না কেটেই আসছি তাই চাচাকে বললাম চাচা আমি আসি নাই তো গাড়ি খুজছি নোয়াখালী যাবার জন্য। চাচা আর আটকালেন না আমায়। সোজা চলে আসলাম লাকসাম জংশন মেইন রোডে। ছয়টা বিশ মিনিটের দিকে কুমিল্লা থেকে নোয়াখালী গামি উপকূল নামক বাস ছেড়ে এসে লাকসাম জংশন মেইন রোডে থামলো। আমি উঠে পরলাম উপকূল বাসে নোয়াখালীর সোনাপুর বাস স্টেশন যাবার উদ্যেশে।
নোয়খালী সোনাপুর পৌছে মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম, সাতটা চল্লিশ বাজছে। নাস্তা করার উদ্যেশে পিছন দিকে জিরো পয়েন্টের দিকে আসলাম। নাস্তা সেরে আবার চলে গেলাম সোনাপুর বাস স্টেশন। বাস স্টেশন এসে দেখি অনেক গুলি বাস লাইনে দাঁড়ানো হাতিয়া মুখি চেয়ারম্যান ঘাট যাওয়ার জন্য। আমার এখন যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাট। সব গুলি গাড়ির সামনের গ্লাসে লেখা আছে সোনাপুর টু চেয়ারম্যান ঘাট। সবার আগে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে উঠে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি হাতিয়ার দিকে যাবে। উনি বললেন আপনি পিচনের কাউন্টারে যান। পিছনে এসে দেখি এই গাড়ির গ্লাসেও একী লেখা সোনাপুর টু চেয়ারম্যান ঘাট। একটু অবাক হলাম একি রোডের গাড়ি তবুও সার্ভিস আলাদা। যাই হোক কাউন্টার থেকে সত্তর টাকা দিয়ে চেয়ারম্যান ঘাট এর টিকেট কেটে গাড়ির সামন দিকে বসলাম। সামনের দিকে বসার উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়িতে বসে বসে প্রকৃতি দেখা, গ্রামের সহজ সরল মানুষ গুলিকে দেখা, গ্রামের মানুষের জীবন যাপন দেখা, গ্রামের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া মেটো পথ গুলি দেখা, দূর আকাশে ঝাক বেধে উড়ে যাওয়া বকের পাল দেখা, দিঘির জলে শিশুদের দুরন্তপনা আর সাতার কাটা দেখা। গাড়ি রওয়ানা দিল সোনাপুর থেকে চেয়ারম্যান ঘাট এর পথের দিকে। গাড়ি ছুটছে আর আমি তাকিয়ে দেখছি বাংলার অপরূপ মায়া মাখা রুপ।
রাস্তার দু-ধারে সারিসারি গাছ গাছালি। কতো রকম গাছ তা নাম বলে বা গুনে বলা সম্ভব নয়। যদিও আমি তেমন গাছের নাম জানীনা। সকালে বেলা পাখির কিচির মিচির শব্দ কতো মধুর তা কেউ নিজের কানে না শুনলে বুঝতে পারবেননা। এই পাখির কিচির মিচির শব্দ গুলি সবচেয়ে বেশী ভাল লাগবে তাদের যাদের প্রতি সকালে কাকের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। অর্থাৎ ঢাকা বাসির। তাই বলে যে অন্যদের খারাপ লাগবে তা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। গাড়ি যতোই এগিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি ততোই সুন্দর হচ্ছে। চর জব্বর থানার পরেই প্রকৃতির আসল রুপ চোখে পরে। আমি নিশ্চিত কেউ চোখ সরাতে পারবেন না। প্রকৃতি প্রেমিদের খিদা মিঠানোর উপযুক্ত স্থান নোয়াখালীর চর জব্বর থানার সুবর্ণচর উপজেলা।
চলতি পথেই একটা বাজারের সাইন বোর্ডে লেখা দেখলাম হাতিয়া বাজার। আমি তো চমকে গেলাম। আরে হাতিয়া তো মেঘনা নদী মাঝখানে। গাড়ি তো কোন নদী বা ফেরী পার হয়নি। তবে হাতিয়া চলে এলাম কি করে। আমি গুগল ম্যাপে দেখেছি হাতিয়া মেঘনা নদীর ঠিক মাঝখানে। কিন্তু একী হলো মেঘনা পার না হয়েই হাতিয়া চলে এলাম কি করে? কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না এই অঘটনটা। খুব চিন্তায় পরে গেলাম। চিন্তারত অবস্থাতেই গাড়ির হেল্পার চেয়ারম্যান ঘাট নামেন বলে চিল্লাতে লাগলেন। আমি গাড়ি থেকে নেমে দেখি পিচ ঢালা রাস্থা এখানেই শেষ। এর পর থেকে ইট সলিং রাস্তা শুরু। ইট সলিং রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে দেখি বিশাল বড় বড় মাছ ধরার নৌকা একটা খালের কাদার মধ্যে আটকে আছে। একটুও পানি নেই খালের মধ্যে। খুব অবাক হলাম এই দৃশ্য দেখে। এই ভরা বর্ষার মৌসুমে খালে এক ফোটা পানি নেই। একটুও মেনে নিতে পারছিলাম না এমন বাস্তবতা। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম বালুর মাঠ। মাঠের বাম দিকে সম্ভবত পুলিশ ক্যাম্প। পুলিশ ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে গেলাম। আগেই বলেছিলাম আমার চেহারা কোন পুলিশের চোখ এড়ায় না। এবারো তাই হলো। আমি পুলিশের সাহায্য চাওয়ার আগেই একজন পুলিশ দূর থেকে আমায় জিজ্ঞেস করে ফেললেন। এখানে কি খুজচ্ছেন? আমি যতারীতি উত্তর দিলাম হাতিয়া যাব স্টিমার ঘাটটা কোন দিকে? পুলিশ ভাই আঙ্গুলের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন, বাজারের ভিতর দিয়ে বাম দিকে।
আমিও উনার কথা মতো হাটতে লাগলাম বাজারের বাম দিকে। দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম খালি চর আর চর কোন নদী নেই। মনে মনে পুলিশ বেটারে গালি দিলাম ভুল ঠিকানা দেওয়ার জন্য। একটা সিড়িতে দেখলাম অনেকজন মানুষ দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছেন। কৌতুহল বসত আমিও এগিয়ে গেলাম সিড়ির দিকে। ওমা একী এটা তো দেখি নদী। নদীর জল দেখে তো আমি অবাক। এই বর্ষাতেও নদীর জল নদীর তলানিতে। অর্থাৎ হাটু সমান। এতোই তলানিতে যে নৌকা চলা পর্যন্ত সম্ভব হচ্ছেনা। মানুষ জন পায়ে হেটে নদী পার হয়ে যাচ্ছেন ঐ পারে। সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলি মুখে কেমন হতাশার ছাপ। সবাই হতাশা মাখা মুখ নিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের চাহনি দেখে আমিও দূরের দিকে তাকালাম। তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম। ঐ তো সেই মেঘনা নদী দেখা যায়। যেটা আমি সিলেট থেকে খুজতে আসছি বাসা পালিয়ে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে। আমার মনের মধ্যে এক অচেনা অজানা অপরিচিত আনন্দ বইতে লাগলো। কিন্তু স্থানীয় মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মুখটা আবার মলিন হয়ে গেল। কৌতুহল বসত একজন লোককে জিজ্ঞেস করে ফেললাম কি হয়েছে আপনাদের? আপনাদের এমন দেখাচ্ছে কেন? উনার উত্তর আমাকে খুব চমকে দিল। উনি বললেন নদীতে জোয়ার নেই তাই নৌকা ট্রলার চলতে পারছেনা বলে উনারা বাড়ি যেতে পারছেন না। এখন আমি বুঝতে পেরেছি বিশাল বড় বড় মাছ ধরা নৌকা আর ট্রলার গুলি কেন খালের কাদার মধ্যে আটকে আছে। আমার আর বোঝতে বাকী রইলনা এখানকার মানুষ জোয়ার নির্ভর। নদীতে আমি কোন দিন জোয়ার দেখিনি। তাই জোয়ার দেখার ইচ্ছা নিয়ে অনেকক্ষণ সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু না জোয়ারের কোন সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছিনা। দাঁড়িয়ে না থাকতে পেরে অবশেষে সিড়িতে বসে পরলাম। স্থানীয় মানুষ জন আমার বসে পরাতে দেখলাম অনেকটা অবাক হলেন। হয়তো এটা উনাদের কল্পনাকে হার মানিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে এমন কিছু মনে হয়নি। উনারা হয়তো ভেবেছেন শহরের মানুষ জন এভাবে বসতে পারেনা বা জানেনা বা বসেনা।
অনেকক্ষণ বসে থেকেও জোয়ারের কোন সম্ভবনা নেই। অনেক খিদা লেগেছে। তাই পিছনে ফিরে এসে একটা সাধারন রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম । আসলে এখানের সব গুলি রেস্টুরেন্ট খুব সাধারন। পর্যটকদের জন্য কোন সুবিধা নেই এই অঞ্চলে। থাকা খাওয়া ঘুরার জন্য সরকারী বেসরকারী কোন সুবিধা এখানে নেই। যদিও এখানে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা।
যাই হোক, রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুইটা সিঙ্গারা আর এক কাপ চা খেয়ে আবার সিড়ির দিকে গেলাম। না এখনো জোয়ারের কোন সম্ভবনা নেই। জোয়ারের অপেক্ষায় থেকে খুব বিরক্ত লাগছিল। তাই ভাবলাম একটু ঘুরে আসি অন্য পাশে। বাজার থেকে দেখেছি একটা রাস্তা নদীর দিকে মেঘনা নদীর দিক গেছে। দেখি গিয়ে ঐ রাস্তা দিয়ে মেঘনার তীরে যাওয়া যায় কিনা। যেই ভাবা সেই কাজ। হাটতে লাগলাম ইট সলিং পথ ধরে। পথের শুরুতে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এই রাস্তা দিয়ে কি মেঘনা নদীর ধারে যাওয়া যায়? উনি উত্তর দিলেন, জি যাওয়া যায়। আমি আবার জিজ্ঞেস করলা্ কতক্ষণ লাগবে যেতে? উনি বললেন, মাত্র দশ মিনিট পায়ে হাটলেই পৌছে যেতে পারবেন। আমি উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাটতে লাগলাম। আর দুপাশের গাছ গাছালি পুকুর খাল ঘাস ফুল দেখতে লাগলাম। পথের মাঝে গ্রাম্য বাচচাদের দুরন্তপনা আমাকেও দুরন্ত হতে শেখাচ্ছে। কিন্তু তবুও পারছিনা। কারন শহরের আলসেমিটা তো আর এক দিনে চলে যায়না।
দশ মিনিট হেটে চলে এলাম নদীর ধারে। ওমা একি এটা নদী, নাকী সাগর। মেঘনা তো আমি ভৈরবে দেখেছি। এর চেয়ে কত্ত ছোট। কিন্তু এখানে তো মেঘনাকে মেঘনা মনে হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে আরেকটা বঙ্গোপসাগর। এই অঞ্চলে নদী যেমন চর জাগিয়েছে আগে। এখন ঠিক সেই ভাবেই ভাংছে তার নিজের হাতে গড়া চর। অনেক গুলি বড় বড় গাছ নদীতে চলে গেছে। গাছের গোড়া গুলি কোন রকমে টিকে আছে মাটিকে আকড়ে ধরে। হয়তো আর কয়টা দিন পরে আর আর মাটি ধরে ঠিকে থাকতে পারবেনা। নদী অনেক গুলি মাছ ধরার ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু আবার পাড়ে বসে নদীর ডেউয়ের দোল খাচ্ছে। অনেক দূরে তাকিয়ে দেখি বড় বড় মালবাহী ড্রেজার ভেসে ভেসে গন্তব্য ছুটছে। নদীর এই পাড় থেকে ড্রেজার গুলিকে পিপড়ার মতো ছোট দেখা যাচ্ছে। যদিও বোঝা যাচ্ছে অগুলি বিশাল আকার।
নদী পাড়ের বাম দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো একটা স্টিমার থেকে অনেক যাত্রী নামছেন। যদিও এটা কোন লঞ্চ বা স্টিমার ঘাট নয়। সম্ভবত ছোট নদীতে জোয়ারের পানি আসেনি বলে ঐ ঘাটে যেতে না পেরে এখানেই যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম স্টিমারের দিকে। এতক্ষনে সব যাত্রী নামা শেষ। স্টিমার নোঙর আটকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। ঘাসের উপর বসে থাকা একজন মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম ভাই স্টিমার কি হাতিয়া যাবেনা? উনি উওর দিলেন ঘাটে তো পানি নেই তাই যাবেনা। যদি জোয়ার আসে তবে যাবে মনে হয়। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি হাতিয়া থাকেন? উনি জানালেন উনার বাড়ি হাতিয়া, কিন্তু উনি হাতিয়া থাকেননা। নয় বছর পর উনি হাতিয়া যাচ্ছেন। তবুও যাওয়া হচ্ছেনা আজ নদীতে জোয়ার নেই বলে। উনার চেহারার মধ্যে খুব অসহায়ত্যের ছাপ আমি স্পষ্ট দেখতে পারলাম। নদীর এই পাড় থেকে হাতিয়া দ্বীপ ঝাপসা ঝপসা দেখা যায়। শুধু হাতিয়া নয় অনেক গুলি দ্বীপ দেখা যায়। প্রায় ৫টা দ্বীপ।
লোক মুখে জানতে পারলাম বাম দিকের প্রথম দ্বীপটা হাতিয়া। আমি হাতিয়া দ্বীপের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা লঞ্চ আসছে এই দিকে। একটু পরেই এখানে নোঙ্গর করা স্টিমারটি চলে গেল ঐ ছোট নদীর ঘাটের দিকে। আমি জানি, এটা ঘাটে যেতে পারবেনা। কারন ওখানে নদীতে হাটু পানি। হাটু পানি দিয়ে এই স্টিমার চলতে পারবেনা। প্রায় দুই ঘন্টা নদীর পাড়ে ঘাসের উপর বসে থেকে মেঘনার ঢেউ দেখছি আর কোমল হাওয়া খাচ্ছি। বড় লঞ্চটা এই পাড়ে আসতেই আমি চিনে গেলাম লঞ্চটাকে। এই লঞ্চের ছবি আমি ফেইসবুকে অনেকবার দেখেছি তিলোত্তমা হাতিয়া নামের গ্রুপে। অনেক যাত্রী নিয়ে এসেছে লঞ্চটা। লঞ্চটা পাড়ে লাগাতে সময় লাগলো প্রায় আধা ঘন্টার উপরে। যাত্রী নামতে লাগলো আরো আধা ঘন্টার উপরে। সব যাত্রী নামার পরে আমি লঞ্চের একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম, লঞ্চটা কখন যাবে হাতিয়ার দিকে? উনি জানালেন, কাল সকালে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেন? উনি বললে্ এখন তো যাত্রী নেই। যা আছে তা খুব অল্প। এই অল্প যাত্রী নিয়ে তো আর যাওয়া যায়না। তার উপর আবার নদীতে জোয়ার নেই। জোয়ার হলে হয়তো যাত্রী হতো অনেক। আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। তবে কি আর আমার হাতিয়া যাওয়া হচ্ছেনা। মনটা পুরাই ভেঙ্গে গেল। রাগ অভিমান নিয়ে বসে রইলাম। এখানে চায়ের দোকান নেই। না হয় কয়েক কাপ চা গিলতাম। কি আর করার, ধীরে ধীরে চলে এলাম আবার চেয়ারম্যান ঘাট। সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। না নদীতে এখনো জোয়ার এলোনা। সিড়িতে এখন আর আগের মতো অপেক্ষামান মানুষ জন নেই। সম্ভবত নদীতে জোয়ার নেই বলে সবাই আবার ফিরে গেছেন।
স্থানীয় একজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, আজ আর জোয়ারের সম্ভবনা নেই। তাই আজ আর কোন স্টিমার বা লঞ্চ হাতিয়া যাবেনা। ভাঙ্গা মনটা আবার ভেঙ্গে গেল। আমি বুঝে নিলাম আজ আর আমার হাতিয়া যাওয়া হচ্ছেনা। হাতিয়া যাওয়া স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেল। তবুও চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। এদিকে দুপুর হয়ে এলো। আমার হাতের সময় প্রায় ফুরিয়ে আসছে। আজ রাতেই আবার আমাকে সিলেট রওয়ানা দিতে হবে। এই টেনশন নিয়ে নদীর দিকে তাকালাম। নদীর পাড়ে দেখলাম, একটা স্প্রিড বোড দাঁড়ানো। কাছে গিয়ে চালককে জিজ্ঞেস করলাম, হাতিয়া যাবেন কিনা? উনি বললেন, যাবেন কিন্তু শুধু যাওয়ার জন্য উনাকে দুই শত টাকা করে দশ জন যাত্রী মিলে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। আবার আসার সময় দশ জন মিলে দুই শত করে দুই হাজার টাকা। যদিও দুই শত টাকা আমার কাছে বেশী মনে হয়নি। কিন্তু দশ জন যাত্রী খোঁজা অনেক কঠিন। কারন আমার আশেপাশে একজন যাত্রীও নেই। সবাই ফিরে গেছেন, নদীতে জোয়ার নেই দেখে। আমার একার পক্ষে তো আর দুই দুই চার হাজার টাকা ভাড়া দেওয়া সম্ভব না। আর আমি এতো পয়সা ওয়ালাও নই। পুরো তিলোত্তমা হাতিয়া মিশনে আমার বাজেট মাত্র দুই হাজার টাকা। আর চেয়ারম্যান ঘাট থেকে হাতিয়ার স্প্রিড বোড ভাড়া চার হাজার টাকা। কি আর করার, মিশন ইমপসিবল। আমার হাতে আর একদিনও থাকার মতো সময় নেই। নেই হোটেল ভাড়া করে থাকা খাওয়ার টাকা। সত্যি খুব নগন্য মনে হচ্ছে নিজেকে। বুঝলাম গরিবের অভাব গরিবের স্বপ্ন ভঙ্গের প্রধান কারন। পাড়ে এসে ডুবে গেল আশার তরী। গরিবের মিশন এরকমই হয়। আমি গরিব বলে আমার আর্থিক দুর্বলতা আর সময় স্বল্পতা আমার মিশনকে সফল হতে দিলোনা। তবে পণ করেছি ঠিকই, আরেকবার আসবো এই তিলোত্তমা হাতিয়া মিশনে। সেবার আর বিফল হয়ে ফিরবোনা।
আবার সুযোগ এল হাতিয়া দ্বীপ ভ্রমণের। দেখে এলাম হাতিয়া দ্বীপের নজরকাড়া সোন্দর্য। হাতিয়া দ্বীপ হচ্ছে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এলাকার উত্তর দিকে অবস্থিত মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি দ্বীপ। এই দ্বীপটি নোয়াখালী জেলায় পড়েছে। এই দ্বীপের আয়তন ৩৭১ কিলোমিটার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ভোলা এবং মনপুরা হাতিয়া দ্বীপের দুটি উল্লেখযোগ্য উপকূলীয় দ্বীপ। সবগুলো দ্বীপই ঘনবসতিপূর্ণ। হাতিয়ার পরিষদ হচ্ছে ওছখালী বাজার এটা প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় এবং ধ্বংসাত্মক সামুদ্রিক ঢেউয়ের কবলে পড়ে থাকে। বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি উপকূলীয় দ্বীপ হাতিয়া। চারদিকে অথৈ জলের রাশি আর উত্তাল তরঙ্গের মাঝে ভাসমান ভেলাসদৃশ এ দ্বীপ এবং তার আশপাশে জেগে ওঠা ১৯টি চর নিয়ে হাতিয়া নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। ২১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত এ দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জেগে ওঠা এ দ্বীপের উত্তর ও পশ্চিম পার্শ্বে প্রবাহিত মেঘনা নদী এবং পূর্ব ও দক্ষিণ পার্শ্বে কল কল রবে বয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগর। ‘হাটিয়া’- ‘হাতি’- ‘হাইতান’- ‘হা-ইতিহ’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে নামকরণের প্রবাদ থাকলেও কালক্রমে এটি বর্তমানের ‘হাতিয়া’ নামে নামান্তরিত হয়ে সারাবিশ্বে সুপরিচিতি লাভ করেছে। হাতিয়াকে প্রধানত দু’টি কারণে পৃথিবীর মানুষ চিনেছে। প্রথমত এ মাটির সুপ্রাচীন ও সমৃদ্ধ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং অন্যটি এ দ্বীপের উপর বয়ে যাওয়া বিগত শতাব্দীর ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়সমূহ। ভেনিসিয়ান পরিব্রাজক সিজার ফ্রেডারিকের মতে, এ দ্বীপাঞ্চল ছিল পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম উর্বর ও বাসযোগ্য এলাকা। হাতিয়ার সুপরিচিতি লাভে দ্বীপের অনন্য ও বিদগ্ধ প্রতিভাবান পন্ডিতদের অবদানও কোন অংশে কম নয়।
হাতিয়া দ্বীপের প্রাচীন স্বর্ণালী ইতিহাস বর্তমানে অনেকটা ম্লান, নিভু নিভু। নদীর অব্যাহত ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়–জলোচ্ছবাস ইত্যাদি প্রকৃতির বৈরীসুলভ আচরণে আজ ক্ষত-বিক্ষত হাতিয়ার জনজীবন। বর্তমানে ‘হাতিয়ার দুঃখ’ নদীর ভাঙন। ২২০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা থেকে হাতিয়া হারিয়েছে ১০০ বর্গ কিলোমিটার। অথচ এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে একে আমরা সম্পূর্ণ খোদার লীলাখেলা বলে চুপ করে বসে আছি। হাতিয়া ভাঙছে, আবার গড়ে উঠছে নতুন নতুন চর। নিঝুমদ্বীপ হাতিয়ার অলঙ্কার। নিঝুমদ্বীপসহ জেগে উঠা চরাঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনার আরেক নতুন বাংলাদেশ। হাতিয়া আমাদের প্রিয়দ্বীপ। শত প্রতিকূলতার পরও হাতিয়াকে নিয়ে বহন করছি আমরা কয়েকশ’ বছরের এক উজ্জ্বল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার।
নদী ভাঙন হাতিয়ার নিত্যসঙ্গী। ১৯৬০-এর দশক হতে হাতিয়ার নদী ভাঙন সমস্যা তীব্রতর হয়ে ওঠে। ভাঙনে বিগত ৫০ বছরে হাতিয়ার প্রায় ৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ‘সাহেবানীর চর’ নামে হাতিয়ার পূর্ব পার্শ্বে একটি চর ভেঙে চোখের পলকে সম্পূর্ণরূপেই ডুবে গেছে মেঘনায়। মেঘনা হাতিয়ার উত্তরাঞ্চলের যতটুকু গ্রাস করেছে- তার পুরোটাই ছিল সমৃদ্ধ জনপদ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ, উন্নয়নের পটভূমি। ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে হাতিয়ার ঐতিহ্যবাহী শহর, বৃটিশ আমলে নির্মিত আদালত ভবন, সরকারি হাসপাতাল, ডাকবাংলো, কারুকার্যমন্ডিত প্রাচীন জামে মসজিদ, সরকারি কলেজসহ নামী-দামী বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নিলক্ষী, সাগরদী, হরণী-চান্দী সম্পূর্ণরূপেই নদীগর্ভে। সুখচর নলচিরারও প্রায় অংশ বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে দ্বীপের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র তমরদ্দি বাজার। হুমকির মুখে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদসহ সমৃদ্ধ জনপদ আফাজিয়া। ভাঙনের কবলে চরঈশ্বরের পূর্বাঞ্চল, চরকিং-এর পশ্চিমাঞ্চল, তমরদ্দি ও সোনাদিয়া ইউনিয়নের কিয়দঞ্চল।
অব্যাহত নদী ভাঙনে ভিটেমাটি ও সহায়সম্বল হারিয়ে হাতিয়ার দু’লাখেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তুর মত মানবেতর জীবন যাপন করছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাতিয়ায় গড়ে প্রতি বছর ১২০০ থেকে ১৫০০ পরিবার সর্বস্ব হারাচ্ছে। ভূমিহীন এ মানুষগুলো বেড়ির পার্শ্বে খালের পাড়, খাস জমি, নিঝুমদ্বীপ, ঢালচর, মৌলভীরচর, বয়ারচর, নঙ্গলিয়া, নলেরচর, কেরিংচর ইত্যাদি এলাকায় মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ এবং মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। হাতিয়ার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারগুলো এক সময়ের ‘স্বপ্নের দ্বীপ’ ছেড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি জমাচ্ছে। ভাঙনই তার একমাত্র কারণ, অন্য কিছু নয়।
নৌ-পথই হাতিয়ার সাথে মূল ভূখন্ডের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। হাতিয়া হতে নোয়াখালী জেলা সদরে যাতায়াতের জন্য বিআইডব্লিউটিসি’র দু’টি সি-ট্রাক রয়েছে। এর মধ্যে যে কোন একটি প্রায়ই অচল থাকে। অন্যটিতে তখন যাত্রীদের বসা দূরের কথা দাঁড়ানোরও জায়গা থাকে না। এ সময় বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে ট্রলারে নদী পারাপার হতে হয়। হাতিয়া নোয়াখালী রুটে রয়েছে যাত্রীবাহী অবৈধ ট্রলারের দৌরাত্ম্য। ফিটনেসবিহীন ট্রলারে যাতায়াত করতে যাত্রী সাধারণকে বিভিন্ন কৌশলে বাধ্য করা হয়। এ যাবত অনেকগুলো ট্রলার দুর্ঘটনায় ব্যাপক যানমালের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরও উন্নত জলযানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এ পথে। জোয়ারভাটার উপর নির্ভরশীলতা হাতিয়ায় যাত্রীদের দুঃখ। ডুবোচরে সি-ট্রাক ট্রলার আটকে গিয়ে ভোগান্তি এখনও পূর্বের মতই রয়ে গেছে।
বর্ষাকালে হাতিয়ার নদী থাকে অশান্ত আর উত্তাল ঢেউ। একটু বাতাস হলে পাহাড়সম ঢেউ আছড়ে পড়ে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সঙ্গত কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। কালোবাজারি ও একশ্রেণীর সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী তখন দ্রব্যসামগ্রীর দাম দ্বিগুণ-ত্রিগুণ করে ফেলে। যাতায়াত সমস্যায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায় জটিল রোগী এবং প্রসূতি মায়েরা। ষাটের দশকে হাতিয়াতে হেলিকপ্টার সার্ভিস ছিল। বেসরকারি পর্যায়ে হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু করলে তা অবশ্যই লাভজনক হবে। জরুরি এবং জটিল রোগীদের জন্য তা আশীর্বাদ বয়ে আনবে। বেসরকারি পর্যায়ে উন্নত জলযান এনে এ পথে যাত্রী সাধারণের ভোগান্তি দূর করা যায়। পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
হাতিয়া নৌ-ঘাটগুলোতে পল্টুন নেই। অথচ পল্টুনের নামে চাঁদা আদায় হচ্ছে। হাতিয়ার অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটের উন্নতি হলেও নৌ-পথে নিঝুমদ্বীপ, ঢালচর, মৌলভীর চর, রামগতি, নলেরচর ইত্যাদিতে ফিটনেসবিহীন নৌকা এবং ট্রলারই একমাত্র মাধ্যম। নিঝুম দ্বীপের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। হাতিয়ার সাথে দেশের সরকারি ডাক যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হলেও গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, এয়ারটেল টেলিকমন কোম্পানিগুলো টাওয়ার নির্মাণ করে হাতিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।
বিদ্যুৎ শক্তির দুর্বলতার কারণে এখানকার মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানের সহজলভ্য সুবিধাবলী হতে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। এ দ্বীপে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত হলে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতি আসবে। ছোটখাট শিল্পকারখানা স্থাপন করে বেকারত্বের হার কমানো যাবে। বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা পাবে হাতিয়ার মানুষ। সর্বোপরি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়নে এ দ্বীপ অনেকদূর এগিয়ে যাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম লি: এবং ভারতের উষার এগ্রো লি: যৌথভাবে ৫ মেঘাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অত্যাধুনিক বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন কাজ হাতে নিয়েছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পুরো হাতিয়ার ৬ লাখ মানুষ সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। এ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের বিনামূল্যে কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করবেন। দ্বীপের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের জন্য প্রয়োজন ১ হাজার ৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ। ১৯৯১ সালে এ ঘাটতি পূরণ করার জন্য সরকার ১২শ’ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি অত্যাধুনিক জেনারেটর স্থাপন করে। বর্তমানে এর ২টি ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে আছে। বাকি ২টির মধ্যে ১টি বিকল হওয়ার পথে।
হাতিয়া দ্বীপের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নান্দনিক বিশাল অবকাঠামো যেন উপহাসের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ দ্বীপের বেশিরভাগ গরিব মানুষগুলো আদিমকালের মানুষের মতো ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। শুধুমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে জটিল রোগীদের মধ্যে বছরে ৫০০ রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বিশেষজ্ঞ এবং এমবিবিএস ডাক্তার সঙ্কট হাতিয়ার চিকিৎসা সেবার অন্যতম সঙ্কট। এ দ্বপপের ৬ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ০৪ (চার) জন এমবিবিএস ডাক্তার। হাতিয়াতে ডাক্তার আসতে চান না-থাকতে চান না। হাতিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সমস্যা চিকিৎসা সেবার অন্যতম অন্তরায়। শুধু ডাক্তার সংকট নয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিভিন্ন টেকনিশিয়ান পদে জনবলের অভাব, নার্স, সুইপার, আয়া পদেও শূন্যতা রয়েছে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতী, এম্বুলেন্স এবং জেনারেটরগুলোও অকেজো থাকে।
নদী ভাঙ্গনে হাতিয়ার বিশাল এলাকা বিলীন হলেও হাতিয়ার চতুর্দিকে অনেকগুলো চর জেগে উঠেছে। জেগে ওঠা চরাঞ্চল নিয়ে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হলেও চরের সমস্যাও কম নয়। নোয়াখালী সদর, রামগতি ও ভোলা জেলার সাথে রয়েছে সীমানা বিরোধ। স্বত্ব নিয়ে ঢালচর এবং মৌলভীর চরেও চলছে টানাটানি। ভূমিদস্যু-বনদস্যুদের চাঁদাবাজি, ভূমিগ্রাসীদের ভূমিদখল ইত্যাদি কারণে ভূমিহীনরা শোষণ আর নির্যাতনে নিঃস্ব থেকে হচ্ছে আরো নিঃস্ব। ভূমিহীনদের নেই চূড়ান্ত তালিকা। পুনর্বাসনের নেই সুব্যবস্থা। ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী আইন, সংস্কার এবং সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে এ সমস্যা সুন্দরভাবে সমাধা করা যায়।
ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাতিয়ার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দুর্যোগ হাতিয়াকে বিশ্ববাসীর নিকট সুপরিচিত করে তুলেছে। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছবাসের মতো দুর্যোগে অনেক বারই ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে হাতিয়া। লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি টাকার। গবাদিপশু মারা যায় বেশুমারে। চিরসবুজ বন বনানী পরিণত হয় মরুভূমিতে। রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, বসতবাড়ি, বেড়িবাঁধসহ সব ধরনের অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
বিগত ১০০ বছরের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় ১৯১৯, ১৯৫৬, ১৯৬০, ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৭ ইং সালে হাতিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন প্রকৃতির ঝড় জলোচ্ছবাস এবং সাইক্লোন আঘাত হানে। দুর্যোগে মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎসগুলো তাৎক্ষণিকভাবে থমকে দাঁড়ায়। জরুরি অবস্থায় বাইরের ত্রাণ সহায়তা ছাড়া বেঁচে থাকার বিকল্প অবলম্বন থাকে না। নানান রোগব্যাধির শিকার হয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে হয়ে পড়ে। হাতিয়ার উপকূল দেশের অন্যতম মৎস্যচারণ ক্ষেত্র। হাতিয়ার উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণরত ট্রলারগুলো যে পরিমাণ মৎস্য আহরণ করে তা গোটা দেশের আহরিত মৎস্যের ১৭ ভাগ। বঙ্গোপসাগরে যে পরিমাণ মৎস্যসম্পদ রয়েছে তা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তবে দেশের সমৃদ্ধির চেহারা অনেকদূর এগিয়ে যেতো। এদেশের মৎস্য সম্পদ অন্যান্য দেশের জেলেরা চুরি করে এবং জোর করে নিয়ে যায়। মৎস্য আহরণের জন্য পর্যাপ্ত এবং আধুনিক মানসম্মত ট্রলারের অভাব রয়েছে। মৎস্য আহরণ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন করা গেলে দেশীয় চাহিদা পূরণ করার পরও ৩০ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য রফতানি করা সম্ভব হতো। চিংড়ী পোনা ধরা এবং ঝাটকা নিধন হাতিয়ার মৎস্য সম্পদকে দিন দিন দুর্বল করে দিচ্ছে। মৎস্য হ্যাচারী এবং বরফ কলের সমস্যার হাতিয়ার মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অনেক কমিয়ে দিচ্ছে। জেলা শহর নোয়াখালী থেকে বরফ এনে হাতিয়ার মৎস্য বাহিরে নেয়া হয়। সরকারিভাবে হাতিয়ায় একটি বরফকল প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
বঙ্গোপসাগর এবং হাতিয়ার উপকূলজুড়ে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং খনিজ সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তৈল গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের জরিপ কার্য সম্পাদন করে অত্র অঞ্চলে গ্যাস থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এখনও অনুসন্ধান ও গবেষণার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকার মাটি খোড়া এবং নলকূপ বসানোর সময় যেভাবে গ্যাস দেখা যাচ্ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে এ অঞ্চলে দেশের বৃহত্তম তৈল গ্যাস খনি আবিষ্কৃত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
হাতিয়ার মাটি অত্যন্ত উর্বর। যা কৃষিকাজের জন্য খুবই উপযোগী। এ দ্বীপে বার্ষিক খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন। খাদ্যশস্যের চাহিদা হচ্ছে ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের পরিমাণ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এ দ্বীপের ধান ও অন্যান্য রবিশস্যের পাশাপাশি প্রচুর বাদাম, গোলআলু ও তরমুজ উৎপাদিত হয়। হাইব্রিড বীজ এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করলে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের মাত্রা আরো অধিকহারে বাড়ানো যায়। হাতিয়ার কৃষি এবং কৃষকের সমস্যাগুলো হলো : উন্নত বীজের অভাব; সার ও কীটনাশকের অভাব; পোকার আক্রমণ; কৃষি ঋণের সমস্যা; অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি; জোয়ার ও জলোচ্ছবাসে ফসলহানি; লবণাক্ততা ইত্যাদি। কৃষি এবং কৃষকের সমস্যাসমূহ দূর করা গেলে হাতিয়া সত্যিই সুজলা-সফলা শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠবে।
হাতিয়া ক্রমাগত ভাঙছে। ১৯৬৮ সাল হতে বিগত ৪০ বছরে প্রায় ৬০ বর্গ কিলোমিটার জনপথ মেঘনা গ্রাস করে নিয়েছে। হাতিয়ার ‘দুঃখ’ নদী ভাঙন হলেও হাতিয়াকে ঘিরে জেগে উঠা চরসমূহ দ্বীপবাসীকে আশার আলো দেখাচ্ছে। বয়ারচর, নঙ্গলিয়া, নলেরচর, কেরিং চর এবং পূর্ব দিকে উড়িরচর পর্যন্ত যে বিশাল এলাকা ইতোমধ্যে জেগে উঠেছে তা ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে হাতিয়াকে ছুঁই ছুঁই করেছে। এ চরাঞ্চল মূল হাতিয়ার চেয়ে বড় দীর্ঘতম ভূখন্ডের ইশারা দিচ্ছে বাংলাদেশকে। হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণাংশে জেগে উঠছে অনেকগুলো চর। নিঝুমদ্বীপের আশপাশের চরগুলো যেভাবে পলিবাহিত হয়ে জেগে উঠছে তা অব্যাহত থাকলে নোয়াখালী জেলার চেয়েও বড় আয়তনের ভূখন্ডের আত্মপ্রকাশ ঘটবে নিঃসন্দেহে। নিঝুম দ্বীপ সম্পর্কে বায়তুশ শরফের পীর আল্লামা শাহ মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জববার (রাহ.) কোন এক সময় বলেছিলেন যে, ‘নিঝুম দ্বীপের কূল ঘেঁষে যেভাবে চর ওঠা আরম্ভ করেছে অদূর ভবিষ্যতে এটা বাংলাদেশের সমান আরেক বাংলাদেশ হতে পারে।’’ বর্তমানে ভূখন্ড দেখে পীর সাহেবের সেই কথা মনে পড়ে।
হাতিয়াকে ঘিরে বিশাল বিশাল আয়তনের চরগুলো জেগে উঠার বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে এবং নদী ও ভূ-বিশেষজ্ঞ দ্বারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাতিয়ার ভাঙনে মাত্রা কমানো গেলে নিকট ভবিষ্যতে গোটা বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বিশাল এক ভূখন্ড সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ১৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের নিঝুমদ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে বন বিভাগের সৃজিত বাগান, সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গোলপাতা, কেশড়ী ইত্যাদি নানাবিধ বৃক্ষ ও গুল্মে সবুজাব নিঝুমদ্বীপ। এখানে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে। অসৎ বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহযোগিতায় সংঘটিত বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা গেলে এবং দ্বীপের আশপাশে জেগে উঠা চরে বনায়ন করে এখানে অনায়াসে গড়ে তোলা যায় সুন্দরবনের মত আরেক সবুজ প্রান্তর। অপরূপ নৈসর্গিক শোভামন্ডিত দ্বীপ নিঝুম দ্বীপ। এ দ্বীপের লোকসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার হলেও চিত্রল হরিণের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ যে দ্বীপে মানুষের চেয়েও হরিণ বেশি। সেই ১৯৭৮ইং সালের হাতিয়া দ্বীপের কৃতি সন্তান সাবেক বন ও ক্রীড়ামন্ত্রী মরহুম আমিরুল ইসলাম কালাম সাহেবের স্বহস্তে ছেড়ে দেয়া চার জোড়া চিত্রা হরিণ থেকে আজকের এই হরিণ বন্যা। চোখ ফেরালেই দেখা মেলে এখানে মায়াবী হরিণের। দ্বীপের বনে, ফসলের মাঠে, রাস্তা-ঘাটের পাশাপাশি লোকালয়েও ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায় হরিণের পাল। এরই মধ্যে আশা জেগেছে হরিণ রফতানির। বন কর্মকর্তাদের হিসেবে নিঝুম দ্বীপ থেকে ২০ হাজার হরিণ রফতানি করা সম্ভব। তাছাড়া হরিণ রফতানি করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ হরিণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে গিয়ে দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বৃক্ষ নিধন হওয়ার কারণে হরিণের খাদ্য চরম আকার ধারণ করেছে। লবণাক্ত পানির কারণে হরিণগুলোর দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রোগব্যাধি। দ্বীপের ৬০ হাজার হরিণের জন্য মিঠা পানির ১টি পুকুরের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে পানি না থাকায়, পানির সন্ধানে বনের হরিণগুলো প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসে। তাছাড়া খাদ্যের অভাব, রোগাক্রান্ত, বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত, কুকুরের আক্রমণ ও প্রভাবশালীদের হরিণ শিকারের কারণে দ্বীপের বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এসব হরিণ হুমকির মুখে রয়েছে। এসব হরিণের চিকিৎসা নেয়ার জন্য বন বিভাগের কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। নেই কোন পশু হাসপাতাল। দুর্যোগ মুহূর্তে হরিণের আশ্রয় নেবার জন্য কোনো কিল্লা বা উঁচু জায়গার ব্যবস্থা নেই। যার ফলে গত ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে প্রায় ১০ হাজার হরিণ মৃত্যুবরণ করে। অপরদিকে বর্তমানে বনে থাকা প্রায় ৬০ হাজার হরিণের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে মাত্র ৭-৮ জন বন প্রহরী। ফলে বন কর্মকর্তারা হরিণ নিয়ে আছেন মহাবিপদে।
নিঝুম দ্বীপের একটি মা হরিণ বছরে দু’বার কমপক্ষে দু’টি করে মোট ৪টি বাচ্চা প্রদান করে থাকে। এ দ্বীপে প্রায় ২০ হাজারের মতো মা হরিণ রয়েছে। এ হিসেবে প্রতি বছর ৮০ হাজারের মতো হরিণের বাচ্চা জন্মানোর কথা। এর এক-চতুর্থাংশ বেঁচে থাকলেও বছরে বৃদ্ধি পায় ২০ হাজার হরিণ। হরিণের সংখ্যা খুব বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপে হরিণের বিচরণ ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে প্রায় হরিণ লোকালয়ে চলে আসে এবং কুকুর, শৃগাল ও শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে। নিঝুম দ্বীপ থেকে অতিরিক্ত হরিণ সরিয়ে অন্য কোনো দ্বীপ বা বনে স্থানান্তর না করা গেলে দ্বীপের ভারসাম্য ও হরিণের জীবন রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। ধর্মীয় দিক থেকে দ্বীপবাসী আবহমানকাল থেকে দুই ধারায় বিভক্ত মুসলমান এবং হিন্দু। সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আলাদা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ দ্বীপে গড়ে উঠেনি। তবে সংখ্যাগুরু মুসলিম অধিবাসীদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনে এই দ্বীপে গড়ে উঠেছে বহু মাদরাসা-মক্তব। এই দ্বীপে স্কুল ভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা এবং মাদরাসা ভিত্তিক ইসলামী শিক্ষার গোড়াপত্তন ঘটে ১৯১২ খৃস্টাব্দে। দ্বীপের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠা হলো হাতিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় এবং হরণী ইসলামিয়া জুনিয়ার মাদরাসা। হাতিয়ার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও শিক্ষার প্রতি অনুরাগী।
হাতিয়ায় ১টি সরকারি কলেজ, ৩টি বেসরকারি কলেজ, ১টি কামিল মাদরাসা, ১৬টি আলিম-ফাজিল মাদরাসা, ২৯টি উচ্চ বিদ্যালয়, ২১১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬৫টি এবতেদায়ী মাদরাসা। ৮৯টি মক্তব, ৪০টি নূরানী মাদরাসা আছে। ১৯১২ খৃস্টাব্দে এই দ্বীপে শিক্ষার যেই ক্ষীণ প্রাতিষ্ঠানিক ধারার সূচনা হয়েছিল, তা আজ এক শতাব্দীর পরিসরে দ্বীপের সর্বত্র বিস্তৃতি লাভ করেছে। দ্বীপের হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর চলমান জীবন ধারার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত মাদরাসা ও স্কুল শিক্ষার ধারাটি বয়ে চলবে কাল থেকে কালান্তরে।
হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপকে বিভক্তকারী ১২৫০ মিটার দূরত্বের অগভীর মুক্তারিয়া খালের ওপর একটি ক্রসড্যাম নির্মাণের দাবি হাতিয়াবাসীর দীর্ঘদিনের। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিতভাবে ক্রসড্যাম প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিঝুম দ্বীপের পাশে ৩০ লাখ একর জুমি জেগে উঠবে। জাহাজমারা নিঝুম দ্বীপের মধ্যে ক্রসড্যাম নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিরূপণকল্পে নেদারল্যান্ড সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ দল স্থানীয় ভূমি পুনঃউদ্ধার বিভাগের সহায়তায় দুইবার হাতিয়া-জাহাজমারা নিঝুম দ্বীপের অবস্থান ও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর উক্ত স্থানে ক্রসড্যাম নির্মাণ করা যেতে পারে বলে জরিপ দলের রিপোর্টে উল্লেখ করেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আজও কোন সরকারি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের ফাইলটি দীর্ঘদিন যাবৎ মন্ত্রণালয়ে ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে আছে। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, মাত্র ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের মাধ্যমে নদী ভাঙন রোধসহ বিশাল ভূমি জেগে উঠলে এতদাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। ক্রসড্যামের ফলে প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি নিঝুম দ্বীপে ব্যাপক হারে পর্যটক ভ্রমণ করতে পারবে যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আশা করছি, বাংলাদেশ সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থে সম্ভাবনার আরেক নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।