মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদঃ ডেড সী, এক রহস্যেঘেরা সাগর। মহান আল্লাহ এই রহস্যেঘেরা সাগরে যে কত বিস্ময় রেখে দিয়েছেন, তা শুধু তিনিই জানেন। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত একে নিয়ে তাই জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। ইতিহাস থেকে জানা যায়, গ্রিক লেখকরাই প্রথম এর নামকরণ করেছিলেন ডেড সী। আরব লেখকরা এর নাম দিয়েছিলেন পুতিময় গন্ধ সাগর। আর আমরা যারা বাংলাভাষী তারা একে বলি মৃত সাগর। জেনে রাখা ভালো, এটি একটি হ্রদ যা জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে অবস্থিত। প্রায় ৪৮ মাইল দীর্ঘ ও ৩ থেকে ১১ মাইল প্রস্থের এই মরু সাগর পৃথিবীর নিম্নতম জলভাগ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ মিটার নিচে এর অবস্থান। এই সমুদ্রের দক্ষিণাংশ একেবারে অগভীর কিন্তু উত্তরাংশের গভীরতা প্রায় ৪০০ মিটার।
মৃত সাগর অঞ্চলের আবহাওয়া শুকনো। সারাবছর প্রচণ্ড রোদ। বাষ্পীভবনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বিপুল খনিজ পদার্থ যেমন, লবণ, পটাশ, ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড ও ব্রোমিন দ্রবীভূত অবস্থায় এর পানিতে থেকে যাচ্ছে। ডেড সীর পানির স্তর দু’ভাগে বিভক্ত। নিচের অংশকে বলা হয় ফসিল ওয়াটার বা জীবাশ্ম পানি। এ স্তরের বয়স হাজার হাজার বছর। ভূপৃষ্ঠ থেকে লবণ ও নানা রকম খনিজ পদার্থ এ সমুদ্রে এসে পড়ে। পশ্চিমে জুডিন পর্বতমালা আর পূর্বে শেয়ার পর্বতমালা যেন দুই প্রাচীর। প্রাচীর দুটি পেরিয়ে বর্ষা ও মেঘ এ অঞ্চলে আসতে পারে না। এলেও কদাচিত। ফলে এখানে বৃষ্টি নেই বললেই চলে। গড় বৃষ্টিপাত ৫০ থেকে ৭০ মিলিমিটার।
সারাবছর দৈনিক তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রীষ্মে কখনো কখনো সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৫৪ ডিগ্রি। আরেকটি বিস্ময় হলো স্বাভাবিক সাগরের পানিতে যেখানে লবণের পরিমান শতকরা ৪ থেকে ৬ ভাগ, সেখানে ডেড সীতে লবণের পরিমাণ ২৩ থেকে ২৫ ভাগ। তাই এর পানি পান করলে শুধু লবণাক্ততার জন্যই ক্ষতি হবে না, বরং ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইডের কারণেও অসুস্থ করে ফেলতে পারে। পৃথিবীর সবচেয়ে লবণাক্ত জলাধার হলো এই মরু সাগর। ডেড সীতে বেশি পরিমাণ লবন থাকায় জীব বিজ্ঞনীরা ধরেই নিয়েছিলেন এখানে কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। সমুদ্রের পানি থেকে এর লবণাক্ততা ছয়গুন বেশি। বহু প্রকার ও প্রচুর পরিমাণ খনিজ পদার্থ এর পানিতে ঘনীভূত থাকার কারণে ডুবে মরারর ভয় নেই। ঘাড়, মাথা সারাক্ষণ ভেসে থাকবে পানির ওপর। এসব খনিজ দ্রব্য খুবই মূল্যবান। হিসাব করে দেখা গেছে বিশ লাখ টন পটাশ এই পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় রয়েছে। যা কৃত্রিম সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জীবনের কোনো অস্তিত্ব নেই ভেবেই এর নামকরণ করা হয়েছিলো ডেড সী বা মৃত সাগর। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে, ডেড সীতেও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। বিজ্ঞনীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, ডেড সীর পানিতে এমন এক ধরনের জীবাণু উৎপাদন করা যাবে যা ধাতু নিস্কাশনে কাজে লাগবে। কাজে লাগানো হবে সৌরশক্তি ব্যবহারেও।
আসলে ডেড সী এক অবর্ণনীয় চমক মানুষের জন্য। যারা কখনো ডেড সীতে গোসল করেনি তারা এর আশ্চর্য অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করতে পারবে না কোনোদিন। ১৯৩৯-৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ এলাকার আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের অনুসন্ধানী দল পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু তারা তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে ১৯৪৬-৪৭ সালে ডেড সীর পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে হিব্রু ও আরাকানা ভাষার শিলালিপি ও বাইবেলের কিছু পাণ্ডুলিপির খোঁজ পাওয়া গেছে। কিছুকাল আগেও জরিপের কাজ চালাতে গিয়ে ডেড সীর দক্ষিণাংশের অগভীর পানির নিচে বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন সভ্যতার নির্দশন পাওয়া গেছে। যা সারা বিশ্বে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ভবিষ্যতে ডেড সী যাতে মানুষের মঙ্গল বয়ে আনে বিজ্ঞানীরা সে জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভ্রমণ পিয়াসু মানুষও মৃত সাগরের রহস্য সম্পর্কে আরও জানার অপেক্ষায়।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি