উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

কল্যাণের একমাত্র পথ: নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত

ডা. গাজী মো. নজরুল ইসলাম
সব প্রশংসা আল্ল­াহ তা’য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীন। দুরুদ ও সালাম রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল­াম এর প্রতি যিনি রহমাতুলি­ল আলামিন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল­াহু আনহুম) এবং সালেহীন (রঃ)-গণের প্রতি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। আমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দাহ ও রাসূল। নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।
পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য: আল্লাহ তা’য়ালা মানব জাতিকে দুনিয়ায় তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। মানব জাতি সৃষ্টির সুচনা লগ্নে ফিরিশতাদের সংগে আলোচনাকালে তিনি ঘোষণা করেন :
(স্মরণ করুন!) যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলীফা সৃষ্টি করছি….। (সূরা বাকারা : ৩০)
খিলাফত: পৃথিবীতে আল্ল­াহর খিলাফত হলো পার্থিব বিষয়ে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব এবং দুনিয়ার সমগ্র মাখলুকের ওপর মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব। আল্লাহর খলিফা হিসাবে মানব জাতির দায়িত্ব হল আল­াহর বিধান মোতাবেক সব কিছু পরিচালনা করা, নিজের মতে নয়, যা মূলত ইবাদাতেরই অংশ।
আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির পর আল­াহর হুকুমে ফিরিশতাদের সাথে সমগ্র মাখলুক হযরত আদম (আঃ)-কে সিজদা (বশ্যতা স্বীকার) করে মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব (খিলাফাত)- এর স্বীকৃতি প্রদান করে। আল্লাহ বলেন :
(স্মরণ করুন!) যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা করো, এরপর ইবলীস ছাড়া তারা সকলেই সিজদা করল। ইবলীস অবাধ্য হল, অহঙ্কার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।- (বাকারা : ৩৪)
ইবাদাত: পৃথিবীতে মানবজাতির একমাত্র কাজ হলো-সকল প্রকার তাগুতকে অমান্য করে কেবলমাত্র আল­াহর ইবাদাত করা এবং তাঁর সাথে কোন কিছু শরিক না করা। আল্ল­াহ তা’য়ালার সন্তোষ অর্জনের লক্ষ্যে মানবজীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আল্ল­াহর বিধান ও রসূলুল্ল­াহ্ সল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম এর ছুন্নাহ মোতাবেক অতিবাহিত করাকে ইবাদত বলা হয়। আল্ল­াহ তা’য়ালা বলেন:
আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি (সূরা যারিয়াত : ৫৬)।
গোলামের নিজের কোনো মত বা পছন্দ থাকে না, বরং তার প্রভুর মত ও পছন্দই গোলামের কাজ- এটাই ইবাদতের মুল শিক্ষা। সুতরাং দুনিয়ার বুকে মানব জাতির একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো-খিলাফতের মর্যাদায় মহান প্রভু আল্ল­াহ তায়ালার ইবাদত।
খিলাফত ও ইবাদতের সূচনা: খিলাফত ও ইবাদতের মহান পরিকল্পনায় আল্ল­াহ তা’য়ালা মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি সাল্লাম এবং তাঁর সংগী হিসাবে হযরত হাওয়া আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সৃষ্টি করেন। উভয়কেই জান্নাতে বসবাসের নির্দেশ দেন। অতঃপর একদা হযরত আদম (আঃ)- এর সাথে তার বংশধর সমগ্র মানব জাতির রূহকে একত্রিত করে তাদের নিকট আল্ল­াহ তা’য়ালা তাঁর প্রভুত্বের স্বীকৃতি আদায় করেন। আল্ল­াহ তা’য়ালা বলেন:
স্মরণ করুন! যখন আপনার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করলেন এবং তাদের নিকট থেকে তাদের নিজেদের সম্পর্কে সাক্ষ্য গ্রহণ করলেন এবং বললেন: আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল: হ্যাঁ, (অবশ্যই আপনি আমাদের প্রতিপালক) এবং আমরা সাক্ষী রইলাম। এই স্বীকারোক্তি ও সাক্ষ্য এ কারণে যে, কিয়ামাতের দিন যেন তোমরা বলতে না পার- ‘আমরা তো এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না।’ (সূরা আ’রাফ : ১৭২)
দুনিয়ায় প্রেরণের পূর্বে আল্ল­াহ তা’য়ালা হযরত আদম (আঃ)-কে সব কিছু শিক্ষা দেন। শয়তান তাদের বংশধরদের কীভাবে বিপথগামী করতে পারে জান্নাতের মাঝে উভয়কে তার বাস্তব প্রশিক্ষণ দেন। আল্ল­াহ তা’য়ালা বলেন: (১২১) এরপর শয়তান তাঁকে মন্দ পরামর্শ দিল। সে বলল: হে আদম! আমি কি আপনাকে চিরস্থায়ী জীবনদাতা গাছের এবং অনন্ত রাজ্যের সন্ধান দিব? (১২১) এরপর আদম ও হাওয়া সেই গাছের ফল খেয়ে ফেললো। তখন তাদের গোপন অঙ্গ তাদের পরস্পরের নিকট প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তাঁরা জান্নাতের গাছের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে ঢেকে ফেলতে লাগল। আদম তাঁর প্রভুর হুকুম ভুলে গেল, ফলে সে ভুলের মধ্যে পড়ে গেল। -(সূরা ত্বা-হা: ১২০-১২১)
অতঃপর হযরত আদম (আঃ)-কে নবুয়্যত ও হিদায়াত প্রদান করে দুনিয়ায় তাঁর খলিফা হিসাবে তাঁরই গোলামী করার জন্য পাঠালেন। তিনি বলেন : (সূরা ত্বা-হা: ১২২) এরপর তাঁর প্রভু তাঁকে (আদম) নবী হিসেবে মনোনীত করলেন এবং তাঁকে সঠিক পথে পরিচালিত করলেন। (১২৩) তিনি বললেন: তোমরা (মানব এবং শয়তান) উভয়ে একসাথে পরস্পরের শত্রু হিসাবে জান্নাত থেকে নেমে যাও পরে আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে সঠিক পথের কোনো নির্দেশনা আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং কোনো দুঃখ-কষ্টও পাবে না। (১২৪) আর যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, তার জীবন-জীবিকা সংকুচিত করা হবে আর হাশরের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাবো। (১২৫) সে বলবে: হে আমার প্রভু! আমাকে কেন অন্ধ করে উঠালেন? আমি তো দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ছিলাম! (১২৬) তিনি বলবেন: ‘আমার আয়াতসমূহ তোমার কাছে এসেছিল, যেভাবে তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে সেভাবেই আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হয়েছে। (১২৭) যে বাড়াবাড়ি করে ও তার প্রভুর আয়াতসমূহে ঈমান আনে না, আমি এভাবেই তার প্রতিফল দেই। আর আখিরাতের শাস্তি অত্যন্ত কঠিন এবং চিরস্থায়ী। -(সূরা ত্বা-হা : ১২২-১২৬)
মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থতার পরিণাম: দুনিয়ার বুকে মানুষের মধ্যে যারা তাদের সৃষ্টি ও দুনিয়ায় প্রেরণের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তারা মনুষত্ব্যহীন। তাদের নিকৃষ্ট পাশবিকতার কারনে আল্ল­াহ তাদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলে ঘোষণা করেছেন, তাদের পরিণতি হল জাহান্নাম। এ প্রসংগে মহান আল­াহ তা’য়ালা বলেন: আর আমি বহু জ্বিন এবং মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে না, তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখার চেষ্টা করে না, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনার চেষ্টা করে না। তারা পশুর মত অথবা পশুর চেয়েও বেশি পথভ্রষ্ট। বস্তুত তারাই বিভ্রান্ত। – (সূরা আরাফ : ১৭৯)
দুনিয়ার বুকে নবুয়্যতী মিশনের সূচনা:
নবুয়্যতী মিশনের সূচনা: হযরত আদম আলাইহি সাল্লাম দুনিয়ার বুকে আল্ল­াহ তা’য়ালার সর্বোত্তম সৃষ্টি, আল­াহর বান্দা, আল্ল­াহর খলিফা এবং মানব জাতির আদি পিতা। আল্ল­াহ তা’য়ালা হযরত আদম (আঃ) এর বংশধর ভবিষ্যৎ মানব মন্ডলীর জন্য তাকে সর্বপ্রথম নবী হিসাবে মনোনীত করেন। তিনি বলেন: এরপর তাঁর প্রভু তাঁকে (আদম) নবী হিসেবে মনোনীত করলেন এবং তাঁকে সঠিক পথে পরিচালিত করলেন। (সূরা ত্বা-হা : ১২২)
নবুয়্যতী মিশনের কেন্দ্র হলো মসজিদ: দুনিয়ায় এসে হযরত আদম (আঃ) নবুয়্যতী মিশন পরিচালনা ও আল্ল­াহ তা’য়ালার ইবাদতের জন্য সর্বপ্রথম একখানা ঘরের প্রয়োজন বোধ করলেন। আল্ল­াহ তা’য়ালা তাঁর অন্তরের আকুতি পূরণের জন্য বায়তুল মামুর বরাবর দুনিয়ার বুকে একখানা ইবাদত-গৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা করে দিলেন। এ ঘরই হচ্ছে বর্তমান কা’বাগৃহ যা আল্ল­াহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় মানব জাতির জন্য প্রথম ঘর, বায়তুল্ল­াহ বা মসজিদ।
খিলাফত সভ্যতার কেন্দ্র হলো মসজিদ: ধীরে ধীরে হযরত আদম (আঃ)-এর বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে। এ ঘরকে কেন্দ্র করে মানবসমাজ গঠিত হয়। এভাবে আল্ল­াহর ঘরকে কেন্দ্র করে মানব জাতি তার ভবিষ্যৎ অভিযাত্রা শুরু করে। আর আল্ল­াহর সর্বপ্রথম নবী ও খলিফা হিসাবে হযরত আদম আলাইহি সাল্লাম এ মসজিদকে কেন্দ্র করে দুনিয়ার বুকে এক হাজার বছর আল্ল­াহ তা’য়ালার হুকুমে নবুয়্যত ও কল্যাণময় খিলাফত প্রশাসন পরিচালনা করেন। অতঃপর তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকে আল­াহর মনোনীত নবী (আঃ)-গণ দুনিয়ার বুকে মানব সভ্যতায় আরও প্রায় এক হাজার বছর এ মহান দায়িত্ব পালন করেন।
নবুয়্যতী মিশনের আহ্বান ও বিরোধিতার পরিণাম:
আল্ল­াহর মনোনীত সব নবী-রাসূল (আঃ)-গণ দুনিয়ার বুকে সকল তাগুতসমূহ পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্ল­াহ তা’য়ালার ইবাদাতের দিকে মানবজাতিকে আহ্বান করেছেন। যারা তাঁদের ডাকে সাড়া দেয়নি তারা দুনিয়া থেকে নির্মূল হয়ে যায়। পবিত্র কুরআন থেকে এর কতিপয় উপমা তুলে ধরা হলো।
হযরত নূহ আলাইহি সাল্লাম এর বিবরণ: হযরত আদম আলাইহি সাল্লাম এর ইন্তিকালের প্রায় এক হাজার বছর পর তাঁর বংশধরদের মাঝে যখন র্শিক দেখা দেয় তখন আল্ল­াহ তা’য়ালা হযরত নুহ আলাইহি সাল্লাম-কে তাদের মাঝে রিসালাত ও হিদায়াতসহ প্রেরণ করেন। আল্ল­াহ তা’য়ালা বলেন: আমি নূহকে তাঁর জাতির নিকট প্রেরণ করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন: হে আমার জাতি! তোমরা আল্ল­াহর ইবাদাত করো। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য ভয়ঙ্কর দিনের শাস্তির ভয় করছি। (আরাফ : ৫৯)
হযরত নূহ (আঃ) মানুষদের আল্ল­াহ তা’য়ালার ইবাদতের দিকে ৯৫০ বছর দাওয়াত দেন। মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠী তাঁর এ মহান দাওয়াত কবুল করে। অবশেষে আল্ল­াহ তা’য়ালা সমগ্র অবিশ্বাসীদের মহাপ্ল­াবনের মাধ্যমে দুনিয়ার বুক থেকে মুছে ফেলেন। আল্ল­াহ তা’য়ালা তাদের পরিণতি প্রসংগে বলেন: অতঃপর তারা নূহকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করল। তখন আমি তাঁকে এবং তাঁর সাথে যারা নৌকায় ছিল তাদেরকে রক্ষা করি, আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা মনে করেছিল তাদেরকে ডুবিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তারা তো ছিল এক অন্ধ জাতি। (সূরা আরাফ : ৬৪)
হযরত নূহ আলাইহি সাল্লাম এর মুষ্টিমেয় অনুসারী, যাদেরকে তিনি জাহাজে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাদের বংশধরদের মাধ্যমে আল্ল­াহ তা’য়ালা পুনরায় সমগ্র দুনিয়া আবাদ করেন। নবীর অনুসরণের মধ্যেই যে কল্যাণ নিহিত এবং নবীর বিরোধিতায় ধ্বংস অবধারিত এ মহাপ্ল­াবন ছিল ভবিষ্যৎ মানব জাতির জন্য তার শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। হযরত নূহ আলাইহি সাল্লাম তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দুনিয়ায় পূণরায় মসজিদকে কেন্দ্র করে আল্ল­াহর খিলাফত কায়েম করেন।
হযরত হুদ আলাইহি সাল্লাম এর বিবরণ: হযরত নূহ (আ)-এর পর তাঁর বংশধরগণ বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। তাদের অন্যতম শক্তিশালী কওম আদ জাতির কাছে আল্ল­াহ হযরত হুদ (আ)-কে প্রেরণ করেন। আল্ল­াহ তাঁর দাওয়াত ও কওমের পরিণতি প্রসংগে বলেন- আদ জাতির নিকট আমি তাদের ভাই হুদকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন- হে আমার জাতি! তোমরা আল্ল­াহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। তারপরও কি তোমরা মুত্তাকী হবে না? (সূরা আরাফ : ৬৫)
অধিকাংশ লোক যারা নবীর আহ্বানে সাড়া দেয়নি তাদেরও আল্ল­াহ নূহ (আ) এর কওমের ন্যায় দুনিয়ার বুক থেকে নির্মূল করেন। তিনি বলেন- এরপর আমি হুদ ও তাঁর অনুসারীদের আমার অনুগ্রহে রক্ষা করি আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা মনে করেছিল, আর যারা মুমিন হয়নি তাদেরকে নির্মূল করি।-(সূরা আরাফ : ৭২)
হযরত সালেহ আলাইহি সাল্লাম এর বিবরণ: হযরত হুদ (আ) এর কওমের ধ্বংসের পর দুনিয়ার অন্যতম শক্তিশালী কওম ছামূদ জাতির কাছে আল­াহ তা’য়ালা হযরত সালেহ (আঃ)-কে প্রেরণ করেন। আল্ল­াহ তা’য়ালা তাঁর দাওয়াত ও কওমের পরিণতি প্রসংগে বলেন: ছামূদ জাতির নিকট তাদের ভাই সালেহ্কে প্রেরণ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন- হে আমার জাতি! তোমরা আল্ল­াহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই…….. (সূরা আরাফ : ৭৩)
অধিকাংশ লোক যারা নবীর আহ্বানে সাড়া দেয়নি তাদেরও আল্ল­াহ আদ জাতির ন্যায় দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে নির্মুল করেন। তিনি বলেন- অতঃপর তাদের আক্রমণ করল প্রবল ভূমিকম্প, ফলে তারা তাদের ঘরের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে থাকল। এরপর সালেহ তাদের নিকট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন: হে আমার জাতি! আমি তো আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছিলাম এবং তোমাদেরকে উত্তম উপদেশ দিয়েছিলাম কিন্তু তোমরা উত্তম উপদেশদানকারীকে ভালবাস না। -(সূরা আরাফ : ৭৮-৭৯)
হযরত শোয়াইব আলাইহি সাল্লাম এর বিবরণ: মাদায়েনবাসীদের কাছে আল্ল­াহ তা’য়ালা হযরত শোয়াইব আলাইহি সাল্লাম-কে প্রেরণ করেন। আল্ল­াহ তা’য়ালা তাঁর দাওয়াত ও কওমের পরিণতি প্রসংগে বলেন- মাদায়েনবাসীদের নিকট আমি তাদের ভাই শোয়াইবকে প্রেরণ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন- হে আমার জাতি! তোমরা আল্ল­াহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই…. (সূরা আরাফ : ৮৫)
অধিকাংশ লোক যারা নবীর আহ্বানে সাড়া দেয়নি তাদেরও আল্ল­াহ ছামূদ জাতির ন্যায় দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে নির্মূল করেন। তিনি বলেন- এরপর তারা ভূমিকম্পে আক্রান্ত হলো, ফলে তাদের ভোর হল নিজেদের ঘরে উপুড় হওয়া অবস্থায়। যারা শোয়াইব (আঃ)-কে মিথ্যাবাদী বলেছিল, মনে হল তারা যেন কখনো এখানে বসবাসই করেনি। বস্তুত যারা শোয়াইব (আঃ)-কে মিথ্যাবাদী মনে করেছিল তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। (সূরা আরাফ : ৯১-৯২)
সভ্যতার ক্রমবিকাশে সব জনপদে নবুয়্যতী মিশন: মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে মানব সমাজ দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যায়। ধীরে ধীরে ভুলে যায় তাদের আত্মপরিচয়। শয়তানের ধোকায় পড়ে আল্ল­াহকে ভুলে গিয়ে তাগুতের (নাফ্স, দাইয়ুস, ভন্ড ধর্মনেতা, সমাজপতি, স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক-বিধায়ক-বিচারক, বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি ও মূর্তি) গোলামীতে নিমজ্জিত হয়। নবী-রাসূলগণের কল্যাণময় পথ-নির্দেশিকা ভুলে গিয়ে শুরু হয় সেচ্ছাচারিতা, পূর্ব পুরুষদের প্রচলিত রসম, মূর্তিপুজা, জাহিলিয়াত বা মূর্খতা, মানব রচিত তন্ত্র-মন্ত্র ও বিধি-বিধানের অন্ধ অনুসরণ। এহেন দুরাবস্থায় দয়াময় প্রভু তাদের হেদায়াতের জন্য সর্বযুগে সব জনপদে অসংখ্য নবী-রাসূল (আঃ) সঠিক পথ-নির্দেশনাসহ প্রেরণ করেছেন, যারা সবাই নিজ নিজ কওমকে তাগুতসমুহ পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র আল্ল­াহর ইবাদত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রসংগে মহান আল্ল­াহ তা’য়ালা বলেন- নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক উম্মাতের নিকট এ মর্মে রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা একমাত্র আল্ল­াহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে অমান্য করো।-(সূরা নহল : ৩৬)
মানব সভ্যতায় বিভিন্ন জাতির ধ্বংসের কারণ: নবী-রাসূল (আঃ) ও সতর্ককারী না পাঠিয়ে আল্ল­াহ দুনিয়ায় কোনো জাতিকে ধ্বংস করেন নাই। আল্ল­াহ বলেন- সতর্ককারী না পাঠিয়ে আমি কোনো জনপদ ধ্বংস করিনি। আমি সতর্ককারী পাঠিয়েছিলাম জনপদের অধিবাসীদের মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। কেননা আমি জালিম নই। (সূরা শুআ’রা : ২০৮ -২০৯)
নবী-রাসুল (আঃ)-গণের ডাকে যারা সাড়া দেয়নি তারা দুনিয়ার বুক থেকে কওমে নূহ, আদ, সামুদ, নমরূদ আর ফিরআউনের ন্যায় চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। অতঃপর নবী-রাসূল (আঃ)-গণ তাদের মুষ্টিমেয় নিষ্ঠাবান অনুসারীদের নিয়ে মসজিদকে কেন্দ্র করে পুণরায় আল্ল­াহর খিলাফত কায়েম করেন। সারা দুনিয়ায় ছড়ানো-ছিটানো বিভিন্ন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ এরই সাক্ষ্য বহন করছে।
নবুয়্যতী ছিলছিলার শেষলগ্নে বিশ্ব নবীর আগমন:
ভাষা নির্বিশেষে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত ভবিষ্যতের বিশ্ববাসী সমগ্র জনপদের জন্য তিনিই সর্বশেষ ও একমাত্র নবী। কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত ভবিষ্যতের সমগ্র মানব জাতির মুক্তি ও কল্যাণের একমাত্র পথ হলো তাঁর উপর অবতীর্ণ সর্বশেষ পথ-নির্দেশিকা আল-কুরআন ও তাঁর ছুন্নাহ অনুসরণ। আল্ল­াহ তা’য়ালা বলেন: (হে রাসূল!) বলুন! হে মানব জাতি! অবশ্যই আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্ল­াহর রসূল, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি জীবিত করেন, তিনিই মৃত্যু দান করেন। কাজেই তোমরা আল্ল­াহ এবং তাঁর রাসূল নিরক্ষর নবীর প্রতি ঈমান আন, যিনি আল্ল­াহ ও তাঁর বাণীর প্রতি ঈমান রাখেন এবং তা মেনে চলেন, তাহলেই তোমরা হিদায়াত প্রাপ্ত (সঠিক পথপ্রাপ্ত) হবে। (সূরা আরাফ : ১৫৮) তিনি আরও বলেন: আমি আপনাকে বিশ্ববাসী সমস্ত মানুষের জন্য সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী করে প্রেরণ করেছি, অথচ অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। -(সূরা সাবা : ২৮)
যেভাবে আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট রাসূল পাঠিয়েছি, যিনি আমার আয়াতসমূহ তোমাদের নিকট তিলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, তোমাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত এবং তোমাদের শিক্ষা দেন সে সকল বিষয়, যা তোমরা জানতে না। অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, অকৃতজ্ঞ (কাফির) হয়ো না। -(সূরা বাকারা : ১৫১-১৫২) তিনি আরও বলেন:
মুমিনদের প্রতি আল্ল­াহ নিঃসন্দেহে অনুগ্রহ করেছেন, তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকট একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত। যদিও আগে তারা সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যেই ছিল। (আলে ইমরান : ১৬৪)
সূরা আহযাবের ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে নবী! নিশ্চয় আপনাকে আমি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। (৪৬) আপনাকে প্রেরণ করেছি আল্ল­াহর অনুমতিক্রমে আল্ল­াহর দিকে আহ্বানকারী এবং (হিদায়াতের) উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে। আর আপনি মুমিনদের এ সুসংবাদ দিন যে, নিশ্চয়ই তাদের জন্য আল্ল­াহর নিকট বিরাট নিয়ামত রয়েছে। আহযাব:৪৭ এ তিনি আরও বলেন : (হে রাসূল!) নিশ্চয় আমি আপনাকে সত্যসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। জাহান্নামের অধিবাসীদের সম্পর্কে আপনি জিজ্ঞাসিত হবেন না। -(সূরা বাকারা : ১১৯)
মানব জাতির প্রতি রসূলুল­াহ (সাঃ)-এর আহ্বান: মানবজাতির প্রতি রাসূলুল্ল­াহ (সাঃ)-এর দাওয়াত ও নসিহত প্রসংগে পবিত্র কুরআনে বহু আয়াত বর্ণিত রয়েছে। নমুনা স্বরূপ কয়েকটি উল্লে­খ করা হলো। যেমন, আল্ল­াহ বলেন:
(২১) হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করো, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের আগের লোকদেরও, তাহলে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে। (২২) যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ করেছেন, আকাশসমূহ হতে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন। কাজেই তোমরা জেনে শুনে কাউকে তাঁর সমকক্ষ সাব্যস্ত কর না। (বাকারা : ২১-২২)
নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু হচ্ছেন আল্ল­াহ, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি সকল কাজ পরিচালনা করেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই তোমাদের আল্ল­াহ, তোমাদের প্রভু। সুতরাং তোমরা তাঁরই ইবাদাত করো। এরপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? – (সূরা ইউনূস : ৩)
তোমরা কীভাবে আল্ল­াহর সাথে কুফরি করতে পার? অথচ তোমরা প্রাণহীন ছিলে, তিনি তোমাদের জীবিত করেছেন। এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন তারপর তিনিই তোমাদেরকে জীবিত করবেন অতঃপর তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। তিনিই (আল্ল­াহ) যিনি তোমাদের (কল্যাণের) জন্য পৃথিবীর সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি আকাশসমূহের প্রতি মনোযোগ দিলেন এবং আকাশসমূহকে সাতটি স্তরে বিন্যস্ত করলেন। আর তিনি প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে মহাজ্ঞানী।- (সূরা বাকারা : ২৮-২৯) তিনি আরও বলেন: হে মানুষ! একটি উদাহরণ দেয়া হচ্ছে। মনোযোগের সাথে উদাহরণটি শোন। তোমরা আল্ল­াহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত করো তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারে না, এমনকি তারা সকলেও যদি এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের নিকট থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তারা মাছির নিকট থেকে তাও উদ্ধার করতে পারে না। পূজারী এবং যাদের পূজা করা হয় তারা উভয়েই কত দুর্বল! (সূরা হজ্জ : ৭১)
আল্লাহ ত’য়ালা আরও বলেন, আপনি বলুন- তোমরা আল্ল­াহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক, তাদের ব্যাপারে ভেবে দেখেছো কি? দেখাওতো, পৃথিবীতে তারা কী সৃষ্টি করেছে বা আকাশ সৃষ্টিতে তাদের কোনো অংশীদারিত্ব আছে কি? যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে আমার কাছে পূর্বের কোনো কিতাব বা পরম্পরাগত কোনো জ্ঞান উপস্থিত কর। সে ব্যক্তির চেয়ে বেশি বিভ্রান্ত আর কে, যে ব্যক্তি আল্ল­াহকে বাদ দিয়ে এমন কিছুকে ডাকে যারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের ডাকে কোনো সাড়া দেবে না, এমনকি তাদের ডাকা সম্পর্কেও অবহিত নয়! -(সূরা আহকাফ : ৪-৫)
হে রাসূল! আপনার প্রভুর নিকট থেকে আপনার প্রতি যা নাজিল হয়েছে তা প্রচার করুন। আপনি যদি প্রচার না করেন তাহলে আপনি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন না। আল্ল­াহ আপনাকে মানুষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্ল­াহ কাফিরদের সুপথে পরিচালিত করেন না।
– (মায়েদা : ৬৭)
(হে রাসূল!) আপনি বলুন, এটাই আমার পথ। আমি প্রমাণের ওপর অধিষ্ঠিত থেকে মানুষকে আল্ল­াহর প্রতি আহŸান করি। আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করে তারাও। আর আল্ল­াহ মহাপবিত্র। যারা আল্ল­াহর শরিক করে আমি তাদের দলভুক্ত নই। – (সূরা ইউসুফ : ১০৮)
(হে রাসূল!) আপনি বলুন, তোমরা আল্ল­াহর দিকে অগ্রসর হও। নিশ্চয় আমি হলাম তোমাদের প্রতি আল্ল­াহ প্রেরিত সুস্পষ্ট সতর্ককারী। তোমরা আল্ল­াহর সাথে অন্য কোনো ইলাহ সাব্যস্ত করো না। নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি আল্ল­াহ প্রেরিত সুস্পষ্ট সতর্ককারী।-(সূরা যারিয়াত : ৫০-৫১)
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আরও বলেন, আমি ইচ্ছা করলে প্রতিটি জনপদে একজন করে রাসূলকে সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করতে পারতাম (কিন্তু বিশ্বজনীন পূর্ণাঙ্গ দ্বীনসহ প্রেরণ করার পর তার প্রয়োজন হয়নি।) । অতএব আপনি কাফিরদের অনুসরণ করবেন না বরং তাদের সাথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুন। -(সূরা ফুরকান : ৫১-৫২)
রাসূলুল­াহ (সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম) মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রায় ২৩ বছর যাবত নবুয়্যতী মিশনের এ মহান দায়িত্ব পালন করেন।
উম্মাতে মুহাম্মাদীর ওপর নবুয়্যতী মিশনের দায়িত্ব: নবুয়্যতী ছিলছিলা সমাপ্ত হলেও কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত মানুষের কাছে সঠিক হিদায়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য আল্ল­াহ তা’য়ালা নবুয়্যতী মিশনের এ মহান দায়িত্ব পালনের জন্য উম্মাতে মুহাম্মাদীকে মনোনীত করেছেন। আল্ল­াহ বলেন: তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান, তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্ল­াহর উপর বিশ্বাসী থাকবে (আলে ইমরান : ১১০)। তিনি আরও বলেন- তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা প্রয়োজন যারা (মানুষকে) কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে। এরাই সফলকাম। (আলে ইমরান : ১০৪)
তিনি আরও বলেন- এরূপে আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যমপন্থী উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করেছি, এজন্য যে, তোমরা হবে সমগ্র মানবজাতির সাক্ষী আর তোমাদের সাক্ষী হবেন স্বয়ং রাসূল। (সূরা বাকারা : ১৪৩)
তিনি আরও বলেন- আমি তোমাদের আগে অনেক মানব জাতিকে ধ্বংস করেছি, যখন তারা সীমালংঘন করেছিল। তাদের নিকট সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নিয়ে তাদের রাসূলগণ এসেছিলেন। কিন্তু তারা ঈমান আনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এভাবেই আমি সীমালংঘনকরীদের প্রতিফল দিয়ে থাকি। অতঃপর তোমরা কীভাবে কাজ করো, কেমন কাজ করো তা দেখার জন্য আমি তাদের পরে তোমাদের দুনিয়ায় খলিফা বানিয়েছি। (সূরা ইউনুস : ১৩-১৪)
তিনি আরও বলেন- তাদের প্রত্যেক বড় দল থেকে একটি অংশ কেন বের হয় না, যারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করবে এবং নিজ নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের ভয় প্রদর্শন করবে, যাতে তারা বাঁচতে পারে -(সূরা তাওবা : ১২২)।
নবুয়্যতী মিশনের দায়িত্ব হলো-দাওয়াত ও তাবলিগ, তা’লীম ও তারবিয়াত, তাযকিয়ায়ে নাফ্স, সামাজিক কল্যাণ এবং বিশ্ব মানবতার কল্যাণে আল্ল­াহর পথে সর্বাত্মক সাধনা। রাসূলুল্ল­াহ রাসূলুল্ল­াহ্ সল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম এর ওয়ারিস হিসাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হলে উল্লে­খিত সবগুলো কর্মসূচি নিয়ে রাসূলুল্ল­াহ্ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম ও সাহাবাগণের (রাঃ)-এর নমুনায় প্রয়াস চালাতে হবে এবং নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে মসজিদ কেন্দ্রিক আদর্শ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে।
শুধু কিয়াম, তিলাওয়াত, শুধু রুকু বা সিজদা যেমন সলাত হিসাবে গণ্য হয় না বরং সবগুলো মিলে হয় সলাত, তেমনি উল্লে­খিত সকল কর্মসূচির সামষ্টিক রূপ হচ্ছে উম্মাহর ওপর অর্পিত সত্যিকার নবুয়্যতী মিশনের দায়িত্ব, যার জন্য আল্ল­াহ তা’য়ালা নবুয়্যতী ছিলছিলা সমাপ্ত করে উম্মাতি মুহাম্মাদীকে কিয়ামত পর্যন্ত নবুয়্যতী মিশনের এ মহান দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত করেছেন।

মানব জাতির হিদায়াতের লক্ষ্যে নবুয়্যতের প্রথম যুগে রাসূলুল্ল­াহ্ সাল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম হযরত আরকাম (রাঃ)-এর ঘরে তা’লীমুল কুরআন কায়েম করে নবুওয়াতের দায়িত্বসমূহ পালন করেছেন। তাঁর এ মক্তব শুধু তাজবীদ নয়, বরং পরিপূর্ণ দ্বীন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, আমলে বাস্তবায়ন তথা সামগ্রিক নবুয়্যতী মিশনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল।
মদীনায় হিজরতের পর ইসলাম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কায়েম হওয়ার পরও মসজিদে নববীতে রাসূলুল্ল­াহ্ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম এর মক্তব ভিত্তিক নবুয়্যতী মিশনের কার্যক্রমসমূহ জারি ছিল। এর নিয়মিত ছাত্র ছিলেন আহলে সুফ্ফা ও মদীনার অধিবাসীগণ এবং অনিয়মিত ছাত্র ছিলেন দূর-দূরান্তের অন্যান্য সাহাবাগণ। তিনি মক্তব ভিত্তিক নবুয়্যতী মিশনের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মদীনায় একটি কল্যাণময় আদর্শ সমাজ গড়ে তুলেছিলেন।
রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম বলেন: নিশ্চয়ই আলেমগণ হচ্ছেন নবীগণের ওয়ারিস (তিরমিযী)। সুতরাং রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম যে দায়িত্ব নিয়ে সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন, ওয়ারিস হিসাবে সে দায়িত্ব জ্ঞানী মুসলিমগণকে নিজ কওমের মাঝে পালন করতে হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মসজিদ কেন্দ্রিক মহল্ল­াকে যদি একটি কওম ধরা হয়, তাহলে রাসুলুল্ল­াহ (সঃ)-এর ওয়ারিস হিসাবে নবুয়্যতের নমুনায় আদর্শ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ঐ মসজিদকেন্দ্রিক মক্তবের ওপর ভিত্তি করে মহল্ল­াবাসীদের মাঝে দাওয়াত ও তাবলিগ, তা-লীম ও তারবিয়াত, তাজকিয়ায়ে নাফস, পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণ এবং বিশ্ব মানবতার কল্যাণে আল্ল­াহর পথে সর্বাত্মক সাধনা সম্মিলিতভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে উম্মাহর ওপর অর্পিত নবুয়্যতের জিম্মাদারী সঠিকভাবে পালিত হতে পারে, অন্য কোনো পন্থায় নয়।
নবুয়্যতের অবর্তমানে নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত:
রাসূলুল্ল­াহ সল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম-এর পর খুলাফায়ে রাশিদীন (রাঃ) তাঁর খলিফা হিসেবে তাঁরই পদাংক অনুসরণ করে মাসজিদকে কেন্দ্র করে প্রায় অর্ধ দুনিয়ায় নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত প্রশাসন গড়ে তোলেন এবং ভবিষ্যৎ মুসলিম উম্মাহর জন্য এর বাস্তব মডেল রেখে গেছেন।
খিলাফত হচ্ছে আল্ল­াহর নির্দেশিত মসজিদ কেন্দ্রিক কল্যাণময় প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যার জন্য আল্ল­াহ তা’য়ালা যুগে যুগে নবী-রাসুল (আঃ)-গণকে মনোনীত করেছেন, যার মাঝে নিহিত আছে মানব জাতির ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ।
রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম বলেন: তোমাদের ওপর ওয়াজিব হচ্ছে আমার সুুন্নত ও হিদায়াত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নত। অতএব সেগুলোকে শক্তভাবে আকড়ে ধর (আহমাদ)। সুতরাং বিশ্ববাসীর কল্যাণ ও নাজাতের জন্য আল­াহর মনোনীত ও রাসূলুল্ল­াহ্ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম প্রদর্শিত একমাত্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা হলো নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত।
তাই আল্ল­াহ তা’য়ালার সন্তোষ অর্জন এবং বিশ্ব মানবতার ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণের লক্ষ্যে রাসূলুল্ল­াহ সল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম ও খুলাফায়ে রাশিদীন (রাঃ)-গণের আদর্শে মদীনাতুর রাসূল এর নমুনায় মসজিদ কেন্দ্রিক কল্যাণময় খিলাফত প্রশাসন কায়েম করে তার ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করা সমগ্র উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য অপরিহার্য ফরজ। উম্মতে মুহাম্মাদীকে বিশ্ব-মানবতার কল্যাণে এ ফরজ আদায়ে অবশ্যই আল্ল­াহর পথে সর্বাত্মক সাধনা করতে হবে।
রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম এর ওয়ারিস হিসাবে উম্মতে মুহাম্মদী যখন নবুয়্যতের নমুনায় সাহাবা (রাঃ)-গণের ন্যায় মসজিদ কেন্দ্রিক মক্তব ভিত্তিক নবুওয়াতী মিশনের কার্যক্রম নিয়ে মহল্ল­াবাসীর কাছে এগিয়ে যাবেন, মহল্ল­ার জনগণ তখন মাসজিদকেই আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক তৎপরতার কেন্দ্র হিসাবে গ্রহণ করবে। তারা নামাজের জামাতে সামিল হবে, তা’লীম ও তারবিয়াতে অংশ নেবে, পারিবারিক তা’লীমের ব্যবস্থা করবে, দুঃখ-শোকে ও বিপদ-আপদে পরস্পর সহযোগীতার মানসিকতা সৃষ্টি হবে, সমাজে তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। পারস্পরিক বিরোধে তারা আপস-নিস্পত্তির চেষ্টা করবে এবং আল্ল­াহর দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জান-মাল উৎসর্গ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হবে।
হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত হবে ঈমানের আলো, ঘরে ঘরে বিকশিত হবে সততার প্ল­াবন, সমাজে গড়ে উঠবে শান্তিপূর্ণ সামাজিক আন্দোলন, ফলে সূচিত হবে কাঙ্খিত সামাজিক পরিবর্তন। এভাবেই তৈরি হবে মদীনাতুর রাসূল (সাঃ)-এর নমুনায় খুলাফায়ে রাশিদীন (রাঃ)-গণের আদর্শে একটি কল্যাণময় আদর্শ খিলাফত সমাজ।
কল্যাণের একমাত্র পথ নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত:
খিলাফত ব্যবস্থার অবর্তমানে বিশ্ব জুড়ে মুসলিম উম্মাহ আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। রাসুলুল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম ও সাহাবায়ে কিরাম বিশেষত খুলাফায়ে রাশিদীন (রাঃ)-গণের পদাংক অনুসরণ করে পরিপূর্ণভাবে কুরআন ও ছুন্নাহকে আকড়ে ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় আল্ল­াহর রহমত ও সাহায্য বঞ্চিত বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর ওপর নেমে এসেছে চরম জুলুম, নির্যাতন, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, শয়তানী ষড়যন্ত্র আর তাগুতী শক্তির আধিপত্য। মুসলিম দেশসমুহের প্রায় সর্বত্র চলছে রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম এর আদর্শের পরিবর্তে মানবরচিত জাহেলি আদর্শ ও তাগুতী শক্তির সাথে আপসমূলক কর্মকাণ্ড।
নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফতের পরিবর্তে মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রচলিত পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং মানব রচিত অন্যান্য মতবাদ, সংবিধান, আইন-নীতিমালা, বিধি-বিধান, শাসন ও বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি সুস্পষ্ট গোমরাহী, যার পরিণতি হলো জাহান্নাম।
এ প্রসংগে রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম বলেন- তোমরা দ্বীনের ভেতর নতুন পন্থা সংযোজনের ব্যাপারে সাবধান থেকো, প্রতিটি নতুন সংযোজনই হচ্ছে বিদয়াত, আর প্রতিটি বিদয়াতই হচ্ছে গোমরাহী, আর প্রতিটি গোমরাহীর ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। (আবু দাউদ, তিরমিযী : হাসান ও সহীহ)
হযরত আব্দুল্ল­াহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্র্ণিত। রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম বলেন- বানী-ইসরাইলীগণ বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে তিয়াত্তর দলে, সকলেই জাহান্নামে যাবে কিন্তু একটি মাত্র দল জান্নাতে যাবে। সাহাবাগণ (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন- এই দল কারা? রাসূলুল্ল­াহ (সাঃ) বললেন- যারা আমার ও আমার সাহাবাগণের আদর্শের ওপর কায়েম থাকবে (তিরমিযী-২৫৭৮ : হাসান, আবু দাউদ, সহীহ তারগীব-৪৮)।
সুতরাং জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও বিশ্বব্যাপী কল্যাণ ফিরে পেতে হলে বিপর্যস্থ উম্মতকে আবার নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফাতের দিকে ফিরে আসতে হবে। এ কাজেই আল্ল­াহ বিশ্ববাসীর জন্য উম্মতে মুহাম্মদীকে মনোনীত করেছেন।
মুসলিম উম্মাহ আজ দিশেহারা, বিভ্রান্ত, হতাশাগ্রস্ত, আদর্শহীন ও কাণ্ডারীবিহীন। এহেন বিপর্যয় থেকে মুক্তি পেতে হলে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় কোনো একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বা কোনো বিশেষ ভাষার মুসলিম জনপদকে নিয়ে ভাবলে চলবে না বরং সমগ্র উম্মতকে নিয়ে ভাবতে হবে এবং বিপর্যস্থ মুসলিম উম্মাহকে সম্মিলিতভাবে রাসুলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম ও সাহাবা (রাঃ)-গণের আদর্শে পুণরায় নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত ব্যবস্থা কায়েমে উদ্যোগী হতে হবে।
খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে ছুন্নাহ ভিত্তিক ইসলাহ:
আত্মসংশোধন: নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফাত কায়েম করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন হলো- আত্মসংশোধন। সাহাবা (রাঃ)-গণের নমুনায় জীবনের সবক্ষেত্র যখন আল্ল­াহর কাছে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ইসলাহ বা সংশোধন হবে, খিলাফতের আমানত বহনের উপযোগী বলে বিবেচিত হবে, তখনই তিনি ঐ বান্দার ওপর খিলাফতের আমানত অর্পণ করবেন। আল্ল­াহ এমন বান্দার কাছে খিলাফত প্রদানের জন্য ওয়াদাবদ্ধ। আল্ল­াহ তা’য়ালা বলেন:
আল্ল­াহ তাদের ওয়াদা দিচ্ছেন, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে এবং নেক কাজ করবে, তিনি তাদের দুনিয়ার বুকে অবশ্যই খিলাফত দান করবেন, যেমন তিনি পূর্ববর্তীদের খিলাফত দান করেছেন। (সূরা নূর : ৫৫)
যারা আল্ল­াহর কুরআন ও রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম এর ছুন্নাহ মোতাবেক দুনিয়ার বুকে খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম করতে চান তাদেরকে রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম এর প্রতিনিধিত্বশীল খাঁটি ঈমানদার ও তাকওয়াবান মুয়াল্লি­ম হতে হবে, উম্মাহর মাঝে সাহাবায়ে কিরাম, বিশেষত খুলাফায়ে রাশিদীন (রাঃ)-গণের ন্যায় নিজেদেরকে কুরআন ও ছুন্নাহর মডেল হিসাবে উপস্থাপন করতে হবে। যাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্ল­াহ বলেন:
মুহাম্মাদ আল্ল­াহর রাসূল এবং তাঁর সাহাবাগণ কাফেরদের প্রতি খুবই কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আপনি তাঁদের দেখতে পাবেন আল্ল­াহর অনুগ্রহ ও সন্তোষ কামনায় রুকু ও সিজদারত। তাঁদের মুখমণ্ডলে রয়েছে সিজদার চিহ্ন‎….. (সূরা ফাতহ : ২৯)।
উক্ত বৈশিষ্ট্য অর্জনের সাথে সাথে উম্মাহর মাঝে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-গণের ন্যায় মসজিদ কেন্দ্রিক খিলাফত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা যেমন একটি মহাদেশ গড়ে তোলে, তেমনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাসজিদ কেন্দ্রিক আদর্শ খিলাফাত সমাজের সমন্বয়ে দেশজুড়ে এবং ক্রমান্বয়ে সমগ্র উম্মাহর মাঝে পুণরায় নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম হতে পারে।
কর্মসূচির সংশোধন: খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে হিকমতের নামে নতুন কোনো কর্মসুচি অবলম্বনের সুযোগ নেই। পাশ্চাত্য গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, শ্রেনী সংগ্রাম, সন্ত্রাসী-বোমাবাজী, সামরিক কৌশল অথবা কোনো মনগড়া বুদ্ধিবৃত্তিক উপায় বা পন্থায় খিলাফাত কায়েম সম্ভব নয়, বরং খিলাফতের নিজস্ব পন্থায় অর্থাৎ নবী-রাসূল (সাঃ) ও খুলাফায়ে রাশিদীন (রাঃ)-গণের অনুসৃত পন্থায় মদীনাতুর রাসূল (সাঃ)-এর অনুকরণে কায়েম করতে হবে। আল্ল­াহ তা’য়ালা বলেন: (হে নবী) বলুন, তোমরা যদি আল্ল­াহর ভালবাসা পেতে চাও তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্ল­াহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দেবেন, নিশ্চয়ই আল্ল­াহ খুবই ক্ষমাশীল ও অতিশয় দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান : ৩১)
রাসূলুল্ল­াহ সল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম বলেন- তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তাদেরকে আকড়ে ধরো তবে কখনোই গোমরাহ হবে না। তা হচ্ছে আল্ল­াহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নত। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
ইমাম মালিক মালিক (রঃ) বলেন- এ উম্মতের আখিরী যুগ সংস্কারমÐিত হতে পারবে না সে পন্থা ব্যতীত যে পন্থায় হয়েছিল এ উম্মতের প্রথম যুগ।
তাই দুনিয়ার বুকে খিলাফত কায়েমের জন্য যুগে যুগে নবী-রসূলগণ (আঃ), রাসূলুল্ল­াহ সল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম ও সাহাবাগণ (রাঃ), তাবিঈন, তাবে-তাবিঈন, আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন, মুজাদ্দিদীন ও সলফে সালিহীনগণ (রঃ) যে কল্যাণময় পন্থা অনুসরণ করেছেন সে পথেই এগিয়ে যেতে হবে।
কর্মকৌশলের সংশোধন: খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্ল­াহর কিতাব, রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম এর সুন্নত, হিদায়াত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীন (রাঃ)-গণের ছুন্নাত আর সাহাবাগণের বিশেষত মুহাজির ও আনসার (রাঃ)-গণের কৌশল অনুসরণ করতে হবে। আল্ল­াহ বলেন- মুহাজির ও আনসারদের অগ্রগামী দল, আর যারা সৎভাবে তাঁদের অনুসরণ করছে, আল্ল­াহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্ল­াহর প্রতি সন্তুষ্ট……..। (সূরা তাওবা : ১০০)
সুতরাং খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে কুরআন ও ছুন্নাহর আলোকে প্রচলিত সব কর্ম কৌশলের সংশোধন করতে হবে। যুগের চাহিদার দোহাই দিয়ে মোবাহের নামে মনগড়া কোনো কৌশল অবলম্বন করা যাবে না। বরং সবাইকে ছুন্নাহের সেই সীমারেখার মধ্যে ফিরে আসতে হবে যার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে কুরআন ভিত্তিক ইত্তিহাদ:
খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম-এর ওয়ারিস হিসাবে যারা সাধনা করছেন, তারা উম্মাহর সামনে কুরআন ও ছুন্নাহর পরিপূর্ণ মডেল হিসেবে নিজেদের পেশ করতে পারছেন না। ফলে মানুষ তাদের দেখে ইসলামকে সেভাবে শেখার সুযোগ পায় না, যেভাবে রাসূলুল্ল­াহ সল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম-কে দেখে সাহাবা (রাদিয়াল­াহু আনহুম)-গণ ইসলাম শিখতে পেরেছিলেন। তাই সবাইকে কুরআন ও ছুন্নাহর জীবন্ত মডেল হিসাবে গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
এছাড়া দ্বীনের পথে নিবেদিত ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নবুয়্যতী দায়িত্বের সবগুলো কর্মসূচির সম্মিলিত অনুশীলনেরও অভাব দেখা যায়। ফলে শুধু দায়্যতকে প্রাধান্য দিয়ে তাবলিগ, তা’লীম ও তারবিয়াতকে প্রাধান্য দিয়ে মাদ্রাসা, তাজকিয়ায়ে নাফসকে প্রাধান্য দিয়ে খানকা, সমাজ কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে এনজিও এবং জিহাদ ফি-সাবিলিল্ল­াহকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন দল সৃষ্টি হয়েছে। আবার এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের মতবিরোধ। ফলে সমগ্র উম্মাহ বিভ্রান্তির শিকার হয়ে বিভিন্ন ফিরকা, দল ও উপদলে বিভক্ত। প্রত্যেক ফিরকা ও দল নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মতৎপরতাকে একমাত্র সহীহ নবীওয়ালা কাজ হিসাবে মনে করছে।
এমতাবস্থায় প্রয়োজন হলো নবুয়্যতী মিশনের সবগুলো কার্যক্রমের সম্মিলিত অনুশীলন, সবার দ্বীনি কাজকে নিজের কাজ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান, নিজেদের দ্বীনের মডেল হিসাবে উপস্থাপন, ছুন্নাহ ভিত্তিক ইসলাহ বা সংশোধন ও কুরআন ভিত্তিক সর্বজনীন ইত্তিহাদ।
আল্ল­াহ তা’য়ালা যাবতীয় মর্যাদা ও সম্মান কুরআনের সাথে সংযুক্ত করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ রাত হলো লাইলাতুল কদর, কারণ এ রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ মাস হলো রমজান, কারণ এ মাসে কুরআন অবতীর্ন হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো সালাত, কারণ এ সালাতের মাঝে কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হল ঐ ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়। সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ হলো ঐ উম্মাহ, যাদের জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং কুরআনকে আঁকড়ে ধরে সর্বশ্রেষ্ঠ রাত, সর্বশ্রেষ্ঠ মাস এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের ন্যায় মুসলিম উম্মাহ আবার বিশ্বের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে পারে।
সমগ্র উম্মাহর মাঝে ইসলাহ ও ইত্তিহাদের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে দল-মত নির্বিশেষে সমগ্র উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সমগ্র উম্মাহকে কেবলমাত্র আল-কুরআনের উপর ভিত্তি করেই ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব, কারণ বিভিন্ন মাজহাব, ফিরকা, দল ও উপদলের মধ্যে এই কুরআন নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। আল্ল­াহ পবিত্র কুরআনে এই হাবলিল্ল­াহ (কুরআন)-কে সম্মিলিতভাবে আঁকড়ে ধরতে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হতে কঠোর ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন।
আমাদের দায়িত্ব: বিশ্বমানবতার সামগ্রিক কল্যাণ ও পরকালীন সফলতার লক্ষ্যে দল-মত নির্বিশেষে আসুন! আমরা সবাই মিলে আল-কুরআনকে আকড়ে ধরি। মোবাহের নামে মনগড়া হিকমত পরিহার করে সুন্নাহ মোতাবেক আমাদের যাবতীয় কার্যক্রমকে সংশোধন করি। নবুয়্যতের নমুনায় আদর্শ খিলাফত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে রাসূলুল্ল­াহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম-এর নমুনায় মসজিদে-মসজিদে মহল্ল­ায়-মহল্ল­ায় কুরআনের মক্তব গড়ে তুলি। বিশ্ব জুড়ে নবুয়্যতের নমুনায় খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে সাধ্যমত সাধনা করি।
আল্ল­াহ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর মনোনীত দ্বীন ইসলামের খেদমতের জন্য কবুল করুন! রাসূলুল্লাহ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম ও সাহাবা (রাদিয়াল­াহু আনহুম)-গণের মহান আদর্শের উপর সর্বদা কায়েম রাখুন এবং তাঁদের বরকতময় জামায়াতের সংগে আমাদের হাশর করুন। আ-মী-ন!




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *