উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

প্রফেসর শাইখ ড. মুহাম্মাদ আব্দুস সামাদ

আল্লাহ তা’আলা মানুষদেরকে একজন সত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন, এবং তাঁ থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং এ দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করে পৃথিবীতে মানব গোষ্ঠীর প্রজন্মের পর প্রজন্মের ধারা কিয়ামাত পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছেন, [আন্-নিসা: ১]। একজন পুরুষ ও নারী থেকে মানব জাতিকে সৃষ্টি করলেও তাদেরকে আবার পরস্পরের পরিচিতির জন্য বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছেন। এসব মৌলিক কারণেই মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের একজনের প্রতি আরেকজন যেমন রয়েছে অধিকার, তেমনি রয়েছে পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই কোনো মানুষই তার অধিকার ও কর্তব্য থেকে মুক্ত নয়। যেটা একজন মানুষের পাবার অধিকার, তাই অপর মানুষের জন্য আবার দায়িত্ব-কর্তব্য। ইসলাম সৃষ্টির সেরা মানব জাতির পরস্পর পরস্পরের প্রতি অধিকার সংরক্ষণ ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারে ভীষণ সোচ্চার। মানুষের অধিকার ও কর্তব্যের বিষয়টি ইসলামের অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ‘অধিকার’ নামক বিষয়টিকে দু’টো বড়ভাগে ভাগ করেছে। একটি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অধিকার, আরেকটি বান্দার অধিকার; যা ‘হাক্কুল্লাহ’ ও ‘হাক্কুল’ ‘ইবাদ’ নামে পরিচিত। ইসলামের সাধারণ নীতি হচ্ছে, ‘যার যা আধিকার আছে, তা তাকে পরিপূর্ণভাবে দিয়ে দাও। হাদীসে আছে, ‘প্রত্যেক হকদারকে তার হক দিয়ে দাও’, [সাহীহুল বুখারী, নং ১৯৬৮, ৬১৩৯]। ইসলামী পরিভাষায় অধিকার ও কর্তব্য দু’টোই মানুষের যিম্মায় আমানাত। এই আমানাত তার প্রাপক ও মালিকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার সাধারণ নির্দেশনা ইসলাম দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানাত তার হকদারদের কাছে ফিরিয়ে দিতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে’, [আন-নিসা : ৫৮]। মানুষের অসংখ্য অধিকারের মধ্যে ‘আত্মীয়’ ও ‘প্রতিবেশী’ এর অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীগত অধিকার। এ সম্পর্কে আল-কুরআন ও সাহীহ সুন্নাতে অসংখ্য দলীল-প্রমাণ আছে। তাছাড়াও রয়েছে বিশ্বমানবতার উত্তম আদর্শ এবং মানবতার মহান শিক্ষক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাস্তব জীবনে তা পরিপালনের উদাহরণ। মানুষের মধ্যে বিদ্যমান অনেক সম্পর্ক রয়েছে, যে সম্পর্কগুলোর মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরকে বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে; যেমন, আত্মীয়তার সম্পর্ক, বংশ ও বৈবাহিক সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, প্রতিবেশীর সম্পর্ক, ইত্যাদি সম্পর্কের মাধ্যমে সমাজের ভিত্তি শক্তিশালী ও সুদৃঢ় হয়। যেটা আল্লাহর ভাষার অর্থে ‘শিষা ঢালা প্রাচীরের মতো’ সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষায় যা ‘মানুষের পরস্পরের সম্পর্ক একটি ‘ইমারাত’ বা একটি ‘শরীর’ সদৃশ, যার এক অংশ আরেক অংশকে শক্তি যোগায়, সুদৃঢ় রাখে, [সাহীহুল বুখারী৩/১২৯, নং ২৪৪৬, সাহীহ মুসলিম ৪/১৯৯৯, নং ২৮৬]। আল- কুরআন ও হাদীসে আত্মীয় ও প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে প্রচুর নির্দেশনা রয়েছে। আমরা প্রথমে আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে কুরআন, হাদীস এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লামের নিকট এর গুরুত্ব ও ভূমিকা তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

আত্মীয়ের হক আদায় সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন’, [আন- নাহল- ১৬: ৯০]। আল্লাহ সুবহানাহু অন্য আয়াতে দশটি হকের কথা বলতে গিয়ে সেখানেও আত্মীয়ের হকের কথা গুরুত্ব সহকারে বলেছেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর ‘ইবাদাত করো ও কোনো কিছুকে তাঁর শরীক করো না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত নিকট প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভূক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করো’, [আন- নিসা- ৪: ৩৬]।

আসমানী সকল রিসালাত, যে রিসালাতসহ আল্লাহ তা‘আলা নাবী ও রাসূলগণকে সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, সকলই এ নির্দেশনাই দিয়েছেন। মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ করো, যখন আমরা ইসরাঈল-সন্তানদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদাত করবে না, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও দরিদ্রদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদাচরণ করবে’, [আল- বাকারা: ৮৩]। দয়াময় আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর আত্মীয়-স্বজনকে তার প্রাপ্য দাও এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদেরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না’, [বনী ইসরাঈল: ২৬]।

সকল ধরনের আত্মীয়ের অধিকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন, ‘তারা কি ব্যয় করবে সে সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন! যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন এবং মুসাফিরদের জন্য। উত্তম কাজের যা কিছুই তোমরা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত’, [আল বাকারা : ২১৫]। এ আয়াতের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহর পথে ব্যয় করার প্রথম হকদার হচ্ছে, পিতা-মাতা, নিকট আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরগণ। সামর্থ অনুযায়ী তাদের জন্য যতটুকু ব্যয় করা হয়, তা সম্পর্কে মহান আল্লাহ সম্যক অবহিত আছেন। তিনি তার প্রতিদান দেবেন।

ওসিয়্যতেও আত্মীয়দের হক সংরক্ষিত, এমন নির্দেশনা দিয়ে মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কারো মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে সে যদি ধন-সম্পত্তি রেখে যায় তবে প্রচলিত ন্যায়-নীতি অনুযায়ী তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য ওসিয়্যাত করার বিধান তোমাদেরকে দেয়া হলো। এটা মুত্তাকীদের উপর কর্তব্য’, [আল বাকারা : ১৮০]। উপর্যুক্ত আয়াতে আল্লাহ ‘খাইর’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞগণ বলেন, মানুষেরা স্বল্প ধন-সম্পদকে ‘খাইর’ বা অনেক সম্পদ বুঝায় না। বরং ‘খাইর’ শব্দটি সাধারণতঃ প্রচুর সম্পদ বুঝানোর অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এখানে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ওসিয়্যাতের ক্ষেত্রে তারাই কেবল প্রযোজ্য, যারা মৃত ব্যক্তির ওয়ারিস হবে না। যেমন কারো যদি খ্রিষ্টান বা ইহুদি (আহল কিতাব) মাতা কিংবা নিকট আত্মীয় থাকে তাহলে সে তো মৃত ব্যক্তির ওয়ারিস হয় না, তাই তাদের জন্য ওসিয়্যত করা, এটা তাদের হক। মুত্তাকী ব্যক্তিদের ন্যায় সঙ্গতভাবে এ হক আদায় করা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে এ বিষয়টিও জোরালভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে, যেসব নাতী-নাতনী তাদের দাদা ও নানার জীবদ্দশায় তাদের পিতা ও মাতা মৃত্যুবরণ করেছে। এ কারণে তাদের চাচা ও মামারা তাদেরকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে। তাই তারা তাদের দাদা ও নানার ওসিয়্যতের হকদার হবে। অর্থাৎ বর্ণিত ক্ষেত্রে দাদা ও নানাদের জন্য অপরিহার্য যে, তারা তাদের নাতী ও নাতনীদেরকে তাদের পিতা ও মাতার ওয়ারিস সূত্রে প্রাপ্য সম অংশ ওসিয়্যতের মাধ্যমে প্রদান করবে, তবে ওসিয়্যাতের অংশ যেন দাদা বা নানার সমস্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের অতিরিক্ত না হয়, এমনটি অনেক সমসাময়িক বিশেষজ্ঞ আলিমগণ বলেছেন। তবে কারো কারো মতে দাদা-নানাদের জন্য তাদের ওয়ারিস বঞ্চিত নাতী-নাতনীদের ওসিয়্যত করা জায়িয, অপরিহার্য নয়। এ প্রকারের নাতী-নাতনীদের প্রতি ওসিয়্যাত করার বিষয়টি উত্তরাধিকার বঞ্চিত আত্মীয় হিসেবেও তারা হকদার। আল-কুরআন এ বিষয়টির প্রতিও গুরুত্বারোপ করেছে। করুণাময় আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন, আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে আত্মীয়তার সৌহার্দ ছাড়া অন্য কেনো প্রতিদান চাই না’, [আশ্ শূরা-৪২: ২৩]। আত্মীয়তার সম্পর্কের মধ্যে সব ধরনের পাওনা এ আয়াত দ্বারা সংরক্ষিত। বিশেষ করে তাদের রিজিকের উৎস ওসিয়্যতে নির্ধারিত সম্পদ তাদের দেয়া। এর মাধ্যমে যেসব নাতী ও নাতনীদের বাবা ও মা মারা গেছে তাদের ক্ষেত্রে একদিকে ইয়াতীম হওয়া অপরদিকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়া, এমন দু’টি নেতিবাচক অবস্থা তাদের মধ্যে একত্রিত হবে না। অন্য আরেকটি আয়াত দ্বারাও এ কথাটি শক্তিশালী হয়। মহান আল্লাহ মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ তার ওয়ারিসদের মধ্যে বন্টন করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আর সম্পত্তি বন্টনকালে আত্মীয়, ইয়াতীম এবং অভাবগ্রস্ত লোক উপস্থিত থাকলে তাদেরকে তা থেকে কিছ রিযক হিসেবে দেবে এবং সাথে সদালাপ করবে’, [আন্- নিসা- ৪: ৮]। এ আয়াতেও যেসব নাতী ও নাতনীদের প্রতি দাদা ও নানাদের ওসিয়্যতের অপরিহার্যতাকে তাকীদ করে। কারণ তারা অতীব নিকট আত্মীয় এবং মৃত দাদার পরিত্যক্ত সম্পদ বন্টনের সময় তারা উপস্থিত থাকেই। পিতা ও মাতার মৃত্যুর কারণে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করা অবশ্যই কর্তব্য। তাই দাদা ও নানা তার সম্পদের এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ সম্পদ এসব নাতী ও নাতনীদের জন্য ওসিয়্যত করা অত্মীয়ের হকের মধ্যে অবশ্যই পড়ে।

মুসলিমগণ তো অবশ্যই তাদের আত্মীয়দের হক আদায় করবে। তবে এক্ষেত্রে অন্যদের হক নষ্ট করে তাদের যেন দেয়া না হয়। কারণ সর্বদা ন্যায় ও ইনসাফ করতে হবে, অন্যায় ও যুলম পরিহার করতে হবে। কারণ যেসব পাপাচার ও অন্যায়কারীগণ আল্লাহ তা‘আলার লা’নাত ও ভ্রষ্টতার উপযুক্ত হবে, তাদের কয়েকটি মারাত্মক খারাপ কর্মের কথা কুরআনে বলা হয়েছে। যেমন, (১) প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করা (২) আল্লাহ তা‘আলা যেসব সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলো ছিন্ন করা; যেমন, আত্মীয়তা ও মুসলিমদের সাথে ঈমানী সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং (৩) সমাজ ও দেশে বিপর্যয় ও অনাচার সৃষ্টি করা। (আল্-বাকারা: ২৭, আর- রা’দ: ২৫]।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও ছিন্ন করা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আর তাকওয়া অবলম্বন করো রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক’, [আন-নিসা: ১]। ইবন ‘আব্বাস (রা) তাফসীর অনুযায়ী এর অর্থ হচ্ছে, আত্মীয়তা; তা পিতার দিক থেকেই হোক, বা মায়ের দিক থেকেই হোক, তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাক, আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখ এবং তা আদায়ের যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন কর, [ইবনে জারীর, তাফসীরুত তাবারী]। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, ‘সুতরাং অবাধ্য হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলে সম্ভবত তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা’নাত করেছেন, ফলে তিনি তাদের বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন’, [মুহাম্মদ : ২২-২৩]।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব এবং সম্পর্ক ছিন্ন করার হুঁশিয়ারী হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীসে কুদসীতে বলেন, ‘আল্লাহ তা’আলা বলেন, যে ব্যক্তি আত্মীয়তা বজায় রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে নৈকট্য দান করবেন এবং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ছিন্ন করবেন’, [সাহীহুল বুখারী ৮/৬, নং ৫৯৮৮, সাহীহ মুসলিম ৪/১৯৮০, নং ২৫৫৪]। আরেকটি হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকাল দিবসের প্রতি ঈমান পোষণ করে সে যেন অবশ্যই আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’, [সাহীহুল বুখারী ৮/৩২, নং ৬১৩৮]। অন্য আরেকটি হাদীসে আছে যে, ‘আল্লাহ তা’আলা যেসব গুনাহের শাস্তি দুনিয়াতেও দেন এবং আখিরাতেও দেন, সেগুলোর মধ্যে নির্যাতন ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার সমান কোনো গুনাহ নেই’, [সুনান ইবন মাজাহ, নং ৪২১১]। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি আয়ূ বৃদ্ধি ও রুযী রোযগারে বারকত কামনা করে সে যেন আত্মীয়তার সাথে সহৃদয় ব্যবহার করে’, [সাহীহুল বুখারী ৩/৫৬, নং ২০৬৭, ৫৯৮৫, সাহীহ মুসলিম৪/১৯৮২, নছ ২৫৫৭]। সাহীহ হাদীস থেকে আরো জানা যায় যে, আত্মীয়তার অধিকারের ক্ষেত্রে অপরপক্ষ থেকে সদ্ব্যবহার আশা করা উচিত নয়। যদি অপরপক্ষ সম্পর্ক ছিন্ন ও অসৌজন্যমূলক ব্যবহারও করে, তবুও তার সাথে সদ্ব্যবহার করা উচিত। সাহীহুল বুখারীতে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, ‘সে ব্যক্তি আত্মীয়ের সাথে সদ্ব্যবহারকারী নয়, যে কোনো প্রতিদানের সমান সদ্ব্যবহার করে; বরং সেই সদ্ব্যবহারকারী, যে অপরপক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সদ্ব্যবহার অব্যাহত রাখে’, [সাহীহুল বুখারী ৮/৬, নং ৫৯৯১]।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনন্য চরিত্রের একটি দিক ছিল, তিনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এমনকি নাবুওয়াত লাভের পূর্বেই যেসব মানব ও সমাজসেবার কাজ করতেন, সেগুলোর মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা অন্যতম। উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা রাদি আল্লাহু ‘আনহা বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়। প্রথম ওহী প্রাপ্ত হয়ে রাসূল যখন ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বাড়িতে ফিরে স্ত্রীর কাছে নিজের জীবনের আশংকার কথা প্রকাশ করলেন। তখন বুদ্ধিমতি ও অভিজ্ঞ স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতার সাথে বলেন, ‘কক্ষোণও নয়, আল্লাহ আপনাকে অপদস্ত করবেন না, কেননা আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন…’, [সাহীহুল বুখারী১/৭, নং ৩]।

রাসূলুল্লাহর আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, আত্মীয়দেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আয়াত নাজিল হলো যে, ‘আর আপনি আপনার নিকটতম গোষ্ঠীকে ভীতি প্রদর্শন করুন’ [আশ্-শুআ’রা: ২১৪], তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে বললেন, হে কা’আব ইবনে লুআইয়ের গোত্র, হে হাশিম গোত্র! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো। হে ‘আব্দ মুনাফের পুত্রগণ! তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেদেরকে বাঁচাও! হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো। কেননা নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর কাছে কোনো কিছুর মালিক নই। তবে তোমাদের সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে, তা আমি বজায় রাখবো’, [সাহীহ মুসলিম ১/১৯২, নং ২০৪, সুনানুত তিরমিযী ৫/১৯২, নং ৩১৮৫]। আরেকটি বর্ণনায় আছে যে, তিনি নাম ধরে আরো বলেছেন, হে ‘আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র ‘আব্বাস! আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য কোনো উপকারে আসবো না। হে রাসূলুল্লাহর ফুফু সাফিয়্যাহ! আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য কোনো উপকারে আসবো না’, [সাহীহুল বুখারী ৪/৬, নং ২৭৫৩, সাহীহ মুসলিম ১/৯২, নং ২০৬]।

রাসূলুল্লাহ তাদের জন্য দোয়া করতেন, তাদেরকে কল্যাণের নির্দেশ দিতেন, তাঁদের প্রশংসা করতেন এবং তাঁদের কারো ব্যাথায় ব্যথিত হতেন। যায়দ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে আমার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি’, কথাটি তিনবার বলেন, [সাহীহ মুসলিম৪/১৮৭৩, নং ২৪০৮]। ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হে মানব সকল! যে ব্যক্তি ‘আব্বাসকে কষ্ট দেয় সে আমাকে কষ্ট দেয়। কেননা কোনো ব্যক্তির চাচা হলো তার বাপ সদৃশ’, [সুনানুত তিরমিযী ৬/১১০, নং ৩৭৫৮]। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাসের জন্য তাফসীর ও দীনের গভীর জ্ঞান লাভের জন্য দু‘আ করেন, [আত্- তাবরানী, আল- মু‘জামুল কাবীর ১০/২৩৮, নং ১০৫৮৭, আল- মুস্তাদরাক ৩/৬১৭, নং ৬২৮৭]। সা‘দ ইবন আবি ওক্কাস (রা) যাহরাহ গোত্রের লোক ছিলেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মা আমিনাও যাহরাহ গোত্রের মহিলা ছিলেন; তাই তিনি তাঁকে বলেন, ‘ইনি আমার মামা’, [সুনানুত তিরমিযী ৬/১০৫, নং ৩৭৫২]। আয্- যুবাইর ইবনুল ‘আউওয়াম (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফাতো ভাই ছিলেন, তিনি তার প্রশংসা করে বলেছেন, ‘প্রত্যেক নাবীর একজন সাহায্যকারী ছিল আর আমার সাহায্যকারী হলেন, আয্- যুবাইর’, [সাহীহুল বুখারী ৫/১১১, নং ৪১১৩, সাহীহ মুসলি ৪/১৮৭৯, নং ২৪১৫]।

অনেক মানুষ আছে, যারা আত্মীয়দের হক আদায়ের ক্ষেত্রে চরম উদাসীন। তারা আত্মীয়দের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখেনা, না সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা-পয়সা দিয়ে, না নিজের মান- সম্মান, পদ-পদবি দিয়ে আত্মীয়ের কোন উপকার করে। এমন কি উত্তম আচার-আচরণ ও ব্যবহার দিয়েও সম্পর্ক বজায় রাখে না। মাস ও বছর পার হয়ে যায়, তাদের সাথে না আছে কোনো যোগাযোগ আর না আছে কোনো খোঁজ-খবর, না আছে কোনো কিছু উপহার হিসেবে তাঁদের কাছে পাঠানো। এমনকি তাঁদের বিপদ-আপদে বা অসুখ-বিসুখেও পাশে দাঁড়ায় না। বরং কেউ কেউ তো এমনও আছে, আত্মীয়দের প্রতি খারাপ কথা বলে, খারাপ আচরণ প্রকাশ করে বা কথা ও আচরণ দু’টোর মাধ্যমেই অসৌজন্য আচরণ করে থাকে। স্বীয় আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দুরের মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তাদেরকে আত্মীয় বানায়। তাদের সাথে উঠা-বসা, যাতায়াত, দাওয়াত-জিয়াফত, উপহার দেয়া নেয়া করে ইত্যাদি সদ্ভাব বজায় রাখে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অন্য কোনো উপকারিতা যদি নাও থাকে, এই উপকারিতাই যথেষ্ট যে, মহান করুণাময় আল্লাহ ঐ ব্যক্তির সাথে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্পর্ক বজায় রাখবেন, যে আত্মীয়তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে। তাকে দুনিয়া ও পরকালে তার রহমত দিয়ে সাহায্য করবেন। সকল কাজ-কর্ম সহজ করে দেবেন, স্বচ্ছলতা দান করবেন এবং বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট ও যাবতীয় সংকট দুর করবেন এবং সকল সমস্যার সহজ সমাধান করে দেবেন। এতদ সত্ত্বেও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং কাছাকাছি থাকা, পরস্পরের ভালোবাসা ও হৃদ্দতা পোষণ করা এবং সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, খোশ হালে এবং দুরাবস্থায় একে অন্যের পাশে থাকার মধ্যে অনেক তৃপ্তি, স্বস্তি ও মানসিক সুখ শান্তির অনাবিল আমেজ ও প্রবাহের সৃষ্টি হয়। যা কোনো অর্থ-সম্পদ ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বস্তু দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। এর অনিবার্য ফল হিসেবে শান্তি ও নিরাপত্তার সমাজ তৈরি হয়। যা মানব জীবনের একান্ত কাম্য।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *