উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

করোনা-উত্তর সময়ে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ

প্রফেসর ড. এম এ মান্নান: আমরা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো বিশ্বে যত বড় বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান দেখি, এগুলো মূলত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ধনী লোকদের জন্য। বড় দেশগুলোর ধনী ব্যক্তি, ধনী নেতারা তাদের দেশের গরিব লোকদের টাকা এনে গরিব দেশগুলোর ধনী লোকদের দিচ্ছে। যেমন- বিশ্বব্যাংকের বড় শেয়ারহোল্ডার হলো আমেরিকা। এই শেয়ারের টাকা দেশটির করদাতা জনগণের। নানা কৌশলে ধনীদের চেয়ে গরিবদের কাছ থেকেই কিন্তু বেশি কর আদায় করা হয়। আবার এই টাকা দেয়া হয় গরিব দেশগুলোর ধনী লোকদের। ফলে আজো গরিব দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন হয়নি। এতে শুধু সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। এই দৃশ্য ধনী-দরিদ্র সব দেশেই অভিন্ন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিশ্বের ১ শতাংশ মানুষের হাতে বাকি বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষের সমান সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। আজ সভ্যতা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে মানুষ আর মানুষকে চেনে না। কিভাবে এক মানুষ আরেক মানুষকে ধ্বংস করবে সেই চেষ্টা চলছে অবিরত। এগুলো করে কোনো লাভ হয়নি। আজ করোনাভাইরাসের কাছে বড় বড় শক্তিকে অসহায় মনে হচ্ছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাস গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে মানবকল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়ার। করোনাভাইরাস-উত্তর পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা মোকাবেলার জন্যও এখন থেকে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু সেই সম্পদ কোথায়?

আসলে এ রকম কোনো বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই আমি বহুদিন ধরে আমাদের সমাজের আনাচে-কানাচে উপেক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবক খাতের সম্পদগুলো কাজে লাগানো কথা বলে আসছি। সেই সম্পদগুলো সঠিক চিন্তাধারার ভিত্তিতে কাজে লাগানো গেলে তা শুধু আমাদেরই নয়, সারা বিশ্বের দরিদ্র জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখাতে পারত। আজ করোনাভাইরাস আমাদের আঘাত করেছে। ভবিষ্যতে এর চেয়েও গুরুতর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে আঘাত হানবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখাতে আমার ভাবনার একটি অন্যতম মডেল হলো ‘বিশ্ব সামাজিক ব্যাংক’ বা ‘সোস্যাল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক’। আমাদের মুসলিম সমাজে ওয়াক্্ফ বলতে যে অনুশীলন রয়েছে সেখান থেকেই মূলত বিশ্ব সামাজিক ব্যাংকের ধারণাটি এসেছে।

মুসলিম সমাজে ওয়াক্্ফ শব্দটি সবাই বুঝে। ইসলামের ইতিহাসে ওয়াক্্ফ ও সাদাকায়ে জারিয়ার মূল্য কারো অজানা নয়। কোনো মুসলমান জাকাত আদায় করুক বা না করুক, কিন্তু তার কাছে জাকাত পরিভাষাটি এবং এটি কেন দেয়া হয় তা অজানা নয়। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ওয়াক্ফের ধারণাটি সুপ্রতিষ্ঠিত। ইসলাম বিস্তারের পর ওয়াক্্ফ ধারণা বিস্তার লাভ করলে তখন মূলত ভূ-সম্পত্তি ওয়াক্ফ করার রীতি ছিল। মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে তুর্কি সাম্রাজ্যেই সবচেয়ে বেশি ওয়াক্্ফ সম্পত্তি ছিল। সেখানে ওয়াক্ফের এমন বিস্তার ঘটে যে, একসময় দেখা গেল সাম্র্রাজ্যের কৃষি-সম্পত্তির তিন-চতুর্থাংশই ওয়াক্্ফ সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে মানুষ যখন ওয়াক্্ফ করার জন্য আর জমি পাচ্ছিল না, তখন এর বিকল্প ভাবতে শুরু করে। এরই প্রেক্ষাপটে ক্যাশ ওয়াক্্ফ ধারণার উদ্ভব। তখন আলেমরা বললেনÑ হ্যাঁ, নগদ অর্থ (ক্যাশ) ওয়াক্্ফ হতে পারে। কিন্তু কিছু শরিয়াহ সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের সুরাহা না হওয়ায় তখন বিষয়টি বিতর্কের মধ্যে আটকে যায় এবং ‘ক্যাশ ওয়াক্্ফ’ও আর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।

এভাবে প্রায় ৫০০ বছর চলতে থাকে। মজার বিষয় হলোÑ আমি যখন আইডিবির রিসার্চ সেন্টারের দায়িত্বে ছিলাম, তখন ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আমাকে ইসলামী বিশ্বে ওয়াক্্ফের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে বলেন। তখন আমার এক সহকর্মী ছিলেন তুরস্কের মারমারা ইউনিভার্সিটির ভিসি। আমরা যখন ওয়াক্ফ নিয়ে আলোচনা করছিলাম, তখন তিনি অটোম্যান আর্কাইভের কথা উল্লেখ করেন। আমি তুর্কি ভাষা বুঝি না। তাই তাকে ক্যাশ ওয়াক্্ফ সম্পর্কে অটোম্যান পণ্ডিতদের বক্তব্য জানতে অনুরোধ করি। এরপর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও লোক পাঠাই ওয়াক্্ফ সম্পর্কে জানার জন্য। তবে বাংলাদেশে ওয়াক্্ফের অবস্থা কী তা নিয়ে গবেষণা করা ছিল আমার টার্গেট। অটোম্যান আর্কাইভে ক্যাশ ওয়াক্্ফ সম্পর্কে লিটারেচারের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। এর অনেক কিছু আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে নেই। তখন আমার মনে ক্যাশ ওয়াক্্ফকে ইসলামী অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসার ভাবনা উদয় হয়। আমি দেখি, ক্যাশ ওয়াক্্ফকে যদি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বন্ড বা সার্টিফিকেট আকারে ছাড়া যায় তা হলে সেটা কার্যকর হতে পারে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে ইসলামী বিধান বা শরিয়াহগত যেসব প্রশ্ন ছিল, সেগুলো সমাধানের পথ তালাশ করি। ওয়াক্ফকৃত অর্থ জনকল্যাণে (ওয়াক্ফ নির্ধারিত খাতে) ব্যয় করবে ব্যাংক। তবে মূলধন অক্ষত রেখে।

আমি যখন ক্যাশ ওয়াক্ফ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করি, ততদিনে বিশ্বের অনেক দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইডিবি তো আছেই। ১৯৯৮ সালে আমার উদ্যোগে সোস্যাল ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে আমি ক্যাশ ওয়াক্্ফ প্রবর্তন করি। ওই সময়ে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইসলামিক ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যেন তাদের একটি সেমিনারে গিয়ে ক্যাশ ওয়াক্ফের ধারণাটি ব্যাখ্যা করি। আমি সেখানে গিয়ে এ নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেই। মূলত এর পরই এ ধারণা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে অনেক দেশের ইসলামিক স্কলাররা ছিলেন। আমি দেশে ফেরার পর এ ব্যাপারে আরো জানার জন্য ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি সেগুলোতে যোগ দিয়ে ক্যাশ ওয়াক্ফের ধারণাটি আরো বিস্তৃত পরিসরে তুলে করি।

একসময় ওয়াক্্ফ খাতে ধনীদের প্রাধান্য ছিল। মূলত ওয়াক্ফ করা হতো ভূ-সম্পত্তি। আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ মসজিদ ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু গরিবদের এই খাতে অংশগ্রহণ ছিল না। আর এখন তো ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা আরো বেশি। তা হলে ইসলামের এই কল্যাণময় ক্ষেত্রটির বিকাশ কি থেমে যাবে? এই প্রশ্নের সমাধান হলো ক্যাশ ওয়াক্ফ। কোনো বাড়ির মনিব যেমন ক্যাশ ওয়াক্ফ করতে পারেন, তার গৃহকর্মীর এটা করতে পারেন। ফলে এটা হতে পারে একটি গণ-আন্দোলন। ক্যাশ ওয়াক্্ফ ধারণায় বলে এখানে কেউ চাইলে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে যত খুশি ওয়াক্্ফ করতে পারেন। শেয়ার সার্টিফিকেটের মতো এটা কেনা যেতে পারে। সোস্যাল ইসলামিক ব্যাংকে প্রথমে এক হাজার টাকা ইউনিট করা হয়। পরে সেটা করা হয় ১০০ টাকা ইউনিট। এখন তো বাংলাদেশের প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকে এই ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট চালু করা হয়েছে এবং চিরন্তন এই তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো যেমন উপকৃত হচ্ছে, তেমনি জনকল্যাণেও তারা কাজ করতে পারছে। এটি করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা হলো- মানুষ এ ধরনের দানের ক্ষেত্রে সাড়া দেয়। আজ ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ১০০ কোটি টাকার এই তহবিল রয়েছে। সোস্যাল ইসলামিক ব্যাংকেরও রয়েছে প্রায় ২৫-৩০ কোটি টাকার তহবিল।

ছোট বা বড় যেকোনো কমিউনিটিভিত্তিক ক্যাশ ওয়াক্ফ তহবিল গঠন করা যেতে পারে। গ্রাম, মহল্লা, এমনকি মসজিদভিত্তিক ক্যাশ ওয়াক্ফ তহবিল গঠন করা যেতে পারে। এগুলো হবে একেকটি ইউনিট এবং এই ইউনিটগুলোই ‘বিশ্ব সামাজিক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করবে। মুসলিম বিশ্বে অনেক সংগঠন, সংস্থা রয়েছে। তারা যদি তাদের আওতাধীন এলাকায় প্রতি মুসলমানদের কাছ থেকে মাত্র এক ডলার করেও ক্যাশ ওয়াক্্ফ সংগ্রহ করে, তা হলেও সারা বিশ্ব থেকে কত শত বিলিয়ন ডলার সংগৃহীত হতে পারে? আমরা এখানে রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণ চাচ্ছি না এ কারণে যে, এতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। সেবার বদলে অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় এবং পরিশেষে বিশ্বব্যাংকের মতো তহবিল ধনী মানুষের কুক্ষিগত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

এই মডেলের আলোকে বাংলাদেশে সামাজিক তহবিল গঠন করা যায়। প্রত্যেক মুসলমানের কাছ থেকে মাত্র ১০০ টাকা করেও যদি সংগ্রহ করা হয়, তা হলে কত হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা যাবে? মানুষকে যদি বোঝানো যায় যে, এটা সাদকায়ে জারিয়া, তার এই অর্থ জমা থাকবে, এর প্রমাণ হিসেবে তাকে ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট দেয়া হবে এবং তার এই অর্থ বিনিয়োগ থেকে পাওয়া মুনাফা জনকল্যাণের কাজে লাগানো হয় তা হলে কেউই মাত্র ১০০ টাকা দিতে পিছপা হবেন বলে আমার মনে হয় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সামান্য একটি আহ্বানেই এমন হাজার কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ হতে পারে।

এরই ধারাবাহিকতায় আমি যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসে মুসলিম কমিউনিটিতে ক্যাশ ওয়াক্ফ ধারণাটি প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। সেখানে আমার ছেলেসহ ১১ জন ডাক্তার একটি ক্যাশ ওয়াক্ফ ফান্ড পরিচালনা করছে। বাংলাদেশেও একটি ‘গ্লোবাল ক্যাশ ওয়াক্ফ ট্রাস্ট’ গঠন করে ধারণাটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। এটি নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ক্যাশ ওয়াক্ফ আন্দোলন এগিয়ে নিতে আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু এরই মধ্যে অসুস্থতার কারণে প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা চালানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু আজ বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস মহামারীতে বিপর্যস্ত, তখন মনে হচ্ছে এ আন্দোলনটি এগিয়ে নিতে পারলে আমাদের দেশের দরিদ্র জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে তা অনেক বেশি কাজে লাগত।
২০০০ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে এক গ্রুপ ব্যাংকার বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তারা ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংকের ধারণায় যারপরনাই চমৎকৃত হন এবং এই ব্যাংকের সদর দফতর ইন্দোনেশিয়ায় প্রতিষ্ঠার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারা ফিরে গিয়ে ক্যাশ ওয়াক্্ফ বিস্তারের উদ্যোগ নেন এবং এটি এখন সেখানে বেশ জনপ্রিয়।

২০১২ সালে ওআইসির সাবেক মহাসচিব হামিদ আল গাবিদ বাংলাদেশ সফরে এলে তার সঙ্গী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আমার সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংকের ধারণা তুলে ধরি। তিনি বেশ উৎসাহিত হন। আলগাবিদ ঢাকায় এই ব্যাংকের সদর দফতর স্থাপনের প্রস্তাব দিলে প্রধানমন্ত্রী জমি দিতেও রাজি হয়েছিলেন। তিনি আমাদের এগিয়ে যেতে বলেন। প্রধানমন্ত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত কথায় আমরা অনুপ্রাণিত হই। ভেবেছিলাম তার এই উৎসাহ হয়তো স্বাভাবিক গতিতেই বাস্তবে রূপ নেবে। আমি অন্তর থেকে চেয়েছিলাম এটা ঢাকায় হোক। ব্যক্তি উদ্যোগে এটা তো হওয়া সম্ভব নয়। এরপর ২০১৫ সালে মহাসচিবের সাথে আমেরিকায় আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংকের বিষয়টি আমি ফলোআপ করছি কি না। আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী হয়তো অন্যান্য কাজে ব্যস্ত আছেন, এ দিকে মনোযোগ দিতে পারেননি। তখন মহাসচিব প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখেন তার সাথে সাক্ষাতের সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। চিঠিটি আমার কাছে পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীকে হস্তান্তরের জন্য। আমি আমার ব্যক্তিগত সচিবের মাধ্যমে ২০১৫ সালের ২৯ জুন লেখা ওই চিঠি এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্র প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠাই।

ক্যাশ ওয়াক্ফের তহবিলও ওয়াক্ফের মতো একইভাবে শিক্ষা,. স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলাসহ মানুষের যত ধরনের বঞ্চনা আছে সেসব খাতে ব্যয় করা যায়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- জনকল্যাণের এই অর্থ শুধু মুসলমানই ভোগ করবে এমন কথা নেই। ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে ওয়াক্ফের সুফল ভোগ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পর থেকে আমরা যদি এ আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পারতাম, তা হলে আজকে এই করোনা দুর্যোগ প্রশমনে কতটা অবদান রাখা যেত তা কি ভাবা যায়? ক্যাশ ওয়াকফের মুনাফা বিনা লাভে, সামান্য সার্ভিস চার্জে, ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে বিতরণ করা যেতে পারে। কারণ এর কোনো ‘কস্ট অব ফান্ড’ নেই।

ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংকে দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো অংশগ্রহণ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য সম্প্রদায় তাদের যেসব এনডাওমেন্ট ফান্ড রয়েছে সেগুলো নিয়ে এখানে অংশগ্রহণ করতে পারে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর তহবিলে আয় তাদের কল্যাণেই ব্যয় করা হবে। তাদের তহবিল মুসলিমদের দেয়ার প্রয়োজন নেই। মানবতার কল্যাণে ক্যাশ ওয়াক্ফ ব্যয় করার মতো অসংখ্য খাত রয়ে গেছে।

শুধু মুসলিম দেশে নয়, বহু অমুসলিম দেশেও বড় বড় মুসলিম কমিউনিটি রয়েছে। তারাও ক্যাশ ওয়াক্ফ তহবিল গঠন করতে পারে। আইডিবিতে থাকাকালে আমরা মুসলিম দেশগুলোর ওয়াক্ফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার ওপর একটি সেমিনার করেছিলাম। তখন আমি অবাক হয়েছিলাম যে, অনেক অমুসলিম দেশেও বিশাল ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়ে গেছে। তাই আমি বলছি, এটি আসলে একটি সামাজিক আন্দোলন।
আজ যখন একটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানবসভ্যতা বিপন্ন হতে চলেছে তখন এ ধরনের সামাজিক আন্দোলনের খুবই প্রয়োজন ছিল। এ ভাইরাস কোনো জাতি, সম্প্রদায়, দেশ, সীমানা কিছু মানছে না। সবাইকে সমানভাবে আক্রান্ত করেছে। তাই বিভেদ দূরে রেখে ঐক্যবদ্ধভাবেই এর মোকাবেলা করতে হবে। এ ভাইরাসে পশ্চিমা দেশগুলো তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ট্রিলিয়ন ডলারের মারণাস্ত্র এ শত্রুর মোকাবেলায় কোনো কাজে আসছে না। তারা যেসব দেশকে তুচ্ছ গণ্য করেছে, এখন দেখা যায় তাদের অনেকেই বেশ সফলভাবে ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকিয়ে দিয়েছে। আমেরিকায় যখন মৃত্যুর সংখ্যা লাখ ছুঁই ছুঁই করছে তখন ভুটানে একজনও মারা যায়নি। ভিয়েতনাম যুদ্ধেও আমেরিকার এত লোক মারা যায়নি।

কোনো ধর্ম হানাহানিতে লিপ্ত হতে বলেনি। অথচ আমরা সেই শিক্ষা ভুলে গিয়ে মানবতাকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি। এখন সময় এসেছে ঐক্যের, বিভেদের নয়। হানাহানি বন্ধ করে পরস্পরের কল্যাণকামিতার। সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকগুলো, ভালো মানুষগুলো যদি পৃষ্ঠপোষকতা করে, তা হলে দারিদ্র্য দূরীকরণে এই ক্যাশ ওয়াক্ফের চেয়ে বড় কোনো আন্দোলন আর হতে পারে না।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা

[email protected]





Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *