উল্লেখযোগ্য খবর
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।

উদীয়মান মুসলিম রাষ্ট্র কাজাকিস্তান

শাহ আব্দুল হান্নান: সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম’ নামে গত শতাব্দীর সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে আমি একটি বই লেখি। সম্প্রতি বইটির ইংরেজি সংস্করণ বেরিয়েছে। সেটি বর্তমানে আমার Law Economics and History বইয়ের History অংশে সংযুক্ত আছে। সে বইতে কাজাকিস্তানের কথাও উল্লেখ আছে। গত ২ থেকে ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে কাজাকিস্তান যাই। আইডিবির ২৮তম এই সম্মেলন কাজাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমি মোটামুটি জানতাম কাজাকিস্তান বিশ্বের নবম বৃহত্তম দেশ। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত এরপর কাজাকিস্তান। রাশিয়া ১৮৭০ থেকে ৭৬ এর মধ্যে কাজাকিস্তান দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ১৯১৭ সনে রাশিয়ার জারের পতন ঘটায় ক্রেমনোস্কির নেতৃত্বে ডেমোক্রেটরা। কিন্তু তাদের ক্ষমতা সংহত হওয়ার আগেই পুনরায় বিপ্লব হয় সে বৎসরই। জারের অধীনে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কাজাকিস্তান ছিল। এরপর কমিউনিজমের অধীনে ছিল ১৯৯১ সালের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত। তাদের কিছু তেল শিল্প ছাড়া তেমন কোনো ইন্ডাস্ট্রি নেই। সেখানে গমের উৎপাদন ভালো। বাকি সবই তারা আমদানী করে।
কাজাকিস্তানে জমি অনেক, মানুষ কম। সেখানে কৃষির সম্ভাবনা খুব ভালো। সেখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগ মুসলিম, বাকি ৩০ ভাগ রাশিয়ান নন মুসলিম। জনসংখ্যার ৬০ ভাগই কাজাক। রাশিয়ান বসতকারী ৩০ ভাগ আর অন্যান্য ছোটখাট গোষ্ঠী মিলে ১০ ভাগ।
আসতানা এয়ার লাইন্সের পুরানা এয়ারক্রাপ্টে করে আমরা দুবাই থেকে আলমাতি যাই। প্লেনের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বিমান বন্দর থেকে ল্যান্ড করার পর যখন বেরিয়ে আসলাম তখন পথে কোনো মসজিদ দেখতে পেলাম না। পরে জানতে পারলাম সেই শহরে মোট ১৫টি মসজিদ আছে। আর গোটা কাজাকিস্তানে আছে ১৫০০ মতো মসজিদ। এই কথা আমাকে আলমাতি শহরের চিফ ইমাম জানালেন। আলমাতি শহরের প্রধান ইমামকে তারা বলে ‘ইমামে শহর’। সেই ইমামের বয়স পয়ত্রিশের মতো। মুখে কোনো দাড়ি নেই। ইয়াং ম্যান। মাথায় বিরাট পাগড়ি। মুসলমানদের মুখে দাড়ি বেশি দেখা যায় সাধারণত আরব বিশ্বের কিছু এলাকায় এবং আমাদের সাবকন্টিনেন্টে। আরব বিশ্বের মধ্যে আবার সৌদি আরব, কুয়েত, ইয়েমেন এসব এলাকায় বেশি। সে তুলনায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া কিংবা উত্তর আফ্রিকায় দাড়ি কম দেখা যায়।
এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত যেতে যেতে কাজাকিস্তানে যে ইসলাম আছে তার কিছুই দেখতে পেলাম না। এটা আমার কাউকে নিরাশ করার জন্যে বলা নয়, এটাই হচ্ছে বাস্তব অবস্থাটা। ইসলাম কোথাও আছে কি না তা বুঝার জন্য আমরা লক্ষ্য করি সেখানে মসজিদ আছে কি না, লোকজনের মুখে দাড়ি আছে কি না অথবা মেয়েরা হিজাব পড়ে আছে কি না। যে কেউ বাংলাদেশে এসে এসব দেখতে পাবে। এসব দেখেই তারা ইসলামী দেশ বলে আমাদেরকে সনাক্ত করে। সেখানে আমি মেয়েদের পশ্চিমা পোশাকে দেখেছি। তবে এটা ঠিক আলমাতি শহরের অর্ধেক রাশিয়ান। ছুটির দিন থাকায় রাস্তায় কম লোক ছিল। এর মধ্য যে কয়জন মেয়ে চোখে পড়ল তাতে বলা যায় প্রতি একশ জনের মধ্যে মাত্র দুই-তিন জন মেয়ের মাথায় স্কার্ফ আছে। মেয়েরা শার্ট প্যান্ট পড়া, ওড়না ছাড়া, বুকে অতিরিক্ত কাভার ছাড়া। সেখানে আমি ওড়না, হিজাব, দাড়ি, টুপি কিংবা লম্বা কাপড়ও দেখলাম না। এর দ্বারা আমি যে সেই সোসাইটি ইসলামিক কি আন-ইসলামিক তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। বরং আমার মন বলল এখানে ইসলাম খুব দুর্বল।
আমি যে হোটেলে ছিলাম তার নাম হোটেল রিজেন্ট আলমাতি। এখানেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেশ সুন্দর হোটেল। সেখানকার জনগণের সাথে আমার আলাপ হয়। আমার একটা বইতে আমি লিখেছিলাম, ১৮৯৯ সালে কাজাক পপুলেশন ৩০ ভাগ হয়ে গেছে। এটা কমতে কমতে হয়েছে। কিন্তু গত দশ বছরের কাজাক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে হোক আর রাশিয়ানদের চলে যাওয়ার কারণেই হোক আজকে কাজাক ৭০ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসার পর জানতে পারলাম সেখানে মোটামুটি ২০ ভাগ মানুষ নামাজ পড়ে। রোজা আরো বেশি সংখ্যক লোক রাখে। এটা শুনে আমার কাছে সংখ্যাটা খুব একটা খারাপ বলে মনে হলো না। এসব দেখে একজন ইসলামিস্ট হিসাবে আমার মাথা তখন ঘুরছে এই ভেবে যে, এই দেশে ইসলামের কাজ কিভাবে করা যায়? আমি প্রথম নিশ্চিত হলাম কাজাকিস্তান অচিরেই ইসলামের পিলার হবে এরকম কোনো আশা নেই। পঞ্চাশ একশ বছর পর গিয়ে ইতিহাসের আলোকে বলা যায় এখানে হয়ত ইসলামের প্রচার-প্রসার হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে কাজাকিস্তানের পক্ষে ইসলামের জন্য রোল প্লেকরা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ হলো কমিউনিস্টরা গত একশ বছরে সেখানে এত বেশি ডি-ইসলামাইজড করে ফেলেছে যে তা থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের অনেক সময় লাগবে।
আমি সেই সাথে আরেকটি জিনিস ভাবছিলাম। যদি এখানে ইসলামের জন্য কাজ করতে হয় তাহলে তার জন্য কি করতে হবে? আমি ভাবছিলাম, এরপর আমি সেখানকার কিছু কাজাক পুরুষ ও নারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেদেশের মানুষ ইসলামকে ভালোবাসে কি না? কেননা আমার মন বলল, যদি তারা ইসলামকে ভালোবাসে তাহলে ইসলামের জন্য কাজ করার ও ইসলামের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু আশা আছে। আর যদি ভালো নাই বাসে তাহলে তো আশাই নাই। তারা মোটামুটি জানাল, তাদের প্রাকটিস যাই হোক, তারা ইসলামকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তারা তাদের আইডেন্টিটির ব্যাপারে সচেতন। তাদের বরং এই বিষয়ে অহমিকা যে রাশিয়ানরা গুড ফর নাথিং। তারা অনেক সুপিরিয়র। এই ধরনের মানসিকতা তাদের আছে। জাতীয়তা আছে। তাদের ভিতর কাজাক ও মুসলিম ফিলিংস আছে। স্বাধীনচেতা মনোভাবও আমি তাদের মধ্যে লক্ষ্য করলাম। তখন আমার মনে একটা আশা জাগল যে, সেখানে কাজ করার অন্তত একটা ভিত্তি আছে।
আমি ডেলিগেট হিসেবে আসা অন্যান্য দেশের বন্ধুদের সাথে সেখানে কিভাবে কাজ শুরু করা যায় সে ব্যাপারে আলাপ করলাম। আমি জানি এখানে নামাজ পড়ার কথা বলে কাজ শুরু করা যাবে না। আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি স্বীকার করে সামনে আগাতে হবে। আমার মনে কোনো সাহসই নাই যে, আমি তাদের হিজাব তো দূরের কথা নামাজের কথা বলব, তোমরা নামাজ পড়। তা করাও আমার কাছে কঠিন বলে মনে হলো। তবে আমার মন একটি বিষয় নিয়ে দাওয়াত শুরু করার কথা বলল। যেই কাজ করুক না কেন, অন্তত এটা বলতে পারে, তোমরা নিজেদেরকে যে মুসলিম বল এবং ইসলাম নিয়ে গর্ব কর, তাহলে অন্ততপক্ষে কোরআন শরীফ তোমরা পড়ে ফেল। এতে যদি শতকরা মাত্র একজনও সাড়া দেয় তাহলেও এই এক ভাগই ভিত্তি হবে যারা বাকি ৯৯ জন মানুষকে আস্তেআস্তে ইসলামের কথা বলবে। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এখানে তাৎক্ষণিক ফলাফলের কোনো অবকাশই নাই। আমাদের দেশের মানুষ কত রকম দাবি করে বসে কিন্তু আমরা ভাবতেই পারি না পরিস্থিতির কারণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কি রকম পরিবর্তন হয়ে যায়। মালয়েশিয়ায় মুসলিম অমুসলিমদের যেরকম সহ অবস্থান দেখেছি – সেখানে মুসলিমরা হিজাব পড়ছে অমুসলিমরা ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়ছে, তাতে আমি বুঝেছিলাম যে জোর করে কোথাও ইসলাম করা যাবে না। এই কথাটিই কাজাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখানে জোর করে ইসলাম করার আর কোনো অবকাশ নাই। মানুষকে ডেমোক্রেসির অধীনে রাখতে হবে। সবাইকে স্বাধীনতা দিতে হবে। সেখানে মূল কাজ হবে শিক্ষা ও দাওয়াত। এর জন্য কারা এগিয়ে আসবে আর কারা আসবে না তার জন্য আসল বিচারক আল্লাহ তায়ালা তো আছেনই। সব কিছুর বিচার তো দুনিয়াতে হবে না। কিন্তু আমরা কেন দুনিয়াতে সব কিছুর বিচার চাই? আল্লাহ তায়ালা আখেরাত তো এজন্যই রেখেছেন যে, যারা অন্যায় করবে সেখানে তাদের শাস্তি দেবেন। মালয়েশিয়া থেকে আসার পর আমার মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হল যে, জোর করে ইসলাম করার কোনো সুযোগই নেই। আর কাজাকিস্তান সফরে এসে বুঝলাম, সেখানে এর কোনো সম্ভাবনাও নেই, যদি না আল্লাহ কোনো সুযোগ সেখানে দান করেন তা ব্যতীত।
এটা আমার জীবনের একটা নতুন শিক্ষা ছিল। ইসলাম সম্পর্কে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা এই অঞ্চলে আমরা যেরকম ভাবছি তা সব দেশের জন্য স্ট্রাটেজি নাও হতে পারে। স্ট্রাটেজি আমেরিকার জন্যও এক হতে পারে না। আমরা পড়েছি, strategy and policy cannot be same. পরিস্থিতি বুঝে স্ট্রাটেজি এবং পলিসি পরিবর্তিত হবে। সেখানে কাজাকিস্তানের পলিসি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে। সেখানে বাংলাদেশের মতো পলিসি গ্রহণ করা যাবে না। সেখানে বেশ কিছু ইসলামিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আছে। কিন্তু তাদের সেভাবে কাজ করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তাদেরকে মসজিদের বাইরে কাজ করতে দেয়া হয় না। নানা ধরনের বাঁধা সেখানে আছে। এর থেকে উজবেকিস্তানের অবস্থা অনেক ভালো। তবে এটা একটা বিপ্লব যে, যে দেশে ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে কোনো একটা সম্মেলন হয়নি, সেখানে আল্লাহ তায়ালা নাম দিয়ে প্রথমবারের মতো আইডিবি’র সম্মেলন শুরু হয়েছে। তারাও আজ ওআইসির সদস্য। প্রশ্ন হলো, তাদের ভিতর কোনো না কোনো চেতনা কাজ না করলে তারা ওআইসিতে আসবে কেন? তার রেজাল্ট হিসাবে এবারের ২০০৩ সালের আইডিবি সম্মেলন হয়েছে আলমাতিতে এবং প্রত্যেকটি সেশন কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে শুরু হয়েছে। গত সত্তর বছর যা হয়নি তাই এবার হয়েছে। আরো লক্ষণীয় ছিল, যিনি সেই দেশের প্রেসিডেন্ট তিনিও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে বক্তৃতা শুরু করেছেন, যিনি একজন প্রাক্তন মার্কসিস্ট এবং প্রাক্তন কমিউনিস্ট। তিনি আগেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এখনও প্রেসিডেন্ট। তিনিও তার বক্তৃতায় মুসলিম উম্মাহর কথা বলেছেন। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দরকার বলেছেন।
কাজাকিস্তানের অবস্থা দেখে আমার মন খুব খারাপ ছিল। না খেতে পারছি, না দাঁড়াতে পারছি। পরিস্থিতির এতটা কল্পনা করিনি। মন অস্থির হয়ে আছে। সেখানে একটা কাজাক মেয়েকে পেলাম যে সম্পূর্ণ হিজাবে আবৃত ছিল। ভাগ্যক্রমে আমার পাশেই এসে সেই ইয়ং মেয়েটি বসল। ইনভেস্টমেন্টের উপর সেমিনার হচ্ছিল। আমি সুযোগ পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার মতো কয়টা মেয়ে হিজাব পড়ে। সে নিজেই মাত্র এক বছর আগে হিজাব শুরু করেছে বলে জানাল। মেয়েটি ইংরেজি জানে। তবে ভালো ইংরেজি জানে না। সে জানাল আস্তে আস্তে হচ্ছে। সে আরো জানাল সেখানে ইসলাম নিষিদ্ধ ছিল। সে দেশে হঠাৎ করে ইসলাম আসবে না, ধীরে ধীরে হবে।
ড. গুলিরা নাজার বায়েক নামে এক মহিলার সাথে দেখা হয়। আমি আমার Social Laws of Islam বইটির পাঁচটি কপি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই বইয়ের চারটা কপিই বিলি হয়ে যায়। পঞ্চম কপিটি সেখানকার এক রিসিপশনিস্ট মেয়েকে দেব বলে ঠিক করেছিলাম, তার নাম নাজ গুল। আমি সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে চা খাচ্ছিলাম। বইটি আমার হাতে দেখে সেই মহিলা ড. গুলিরা সরাসরি বইটি চেয়েই বসলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বইটি আমি কোথায় পেয়েছি? আমি যেই বললাম, বইটি আমার লেখা, তখন তিনি বললেন বইটি আমাকে দিয়ে দিন। পঞ্চম কপিটি তাকে দিলাম। চিন্তা অনুযায়ী সেই মেয়েটিকে আর দিতে পারলাম না। সেখানে আমি বই নিয়ে যাওয়ার যে কি বেনিফিট তা বুঝতে পারি।
ইসলামের কাজে দাওয়াতের জন্য প্রচন্ড মন থাকতে হয়। সেটা আসলে আমাদের অনেকের মধ্যে নেই। আমরা এটা বুঝতে পারি না যে একটা শক্তিশালী বোধ ও কার্যকরী দাওয়াতী মন আমাদের নেই। আমি ইচ্ছা করে পাঁচটি কপি নিয়েছিলাম, বেশি নিলে যদি সেখানকার কাস্টমস ধরে সে ভয় আমার ছিল। যাওয়ার পথে দুবাই এয়ারপোর্টে ১২ ঘন্টা থাকতে হয়। সেখানে এক আফ্রিকান যুবকের সাথে দেখা হয়। সে সোমালিয়ার ছেলে। ইংল্যান্ডে জন্ম হওয়ায় সোমালিয়া সম্পর্কে ভালো করে বলতে পারবে না বলে আমাকে জানালো। তার ঈমান বেশ মজবুত বলে লক্ষ্য করলাম। সে ইসলামকে সাংঘাতিক ভালোবাসে। কিন্তু সে ইসলামের বই পড়েনি। সাইয়্যেদ কুতুব, হাসান আল বান্নার নামও জানে না, যদিও তার জানার কথা ছিল। তাকে আমি ইসলাম, মুসলমান সম্পর্কে বললাম এবং ওয়াদা করালাম ইসলামের উপর পড়াশুনা ও কাজ করার জন্য। তাকে অনুপ্রেরণা দিলাম খুব। সে বলল, ইনশাআল্লাহ আমি করব, আমি আপনার কাছে ওয়াদা করছি। আমি তাকে আমার বইয়ের প্রথম কপিটি দিলাম। এর জন্য আমি আবার বলি আমাদের একটা প্রচন্ড দাওয়াতী মন থাকতে হবে। সেটা কিন্তু বাস্তবে আমাদের নেই। আমরা ইসলামের জন্য খুব কম কাজ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াতকে আমার জীবনের সাথে মিশিয়ে ফেলেছি। ফলে দাওয়াতের জন্য আমাকে আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হয় না। এটা আমার জীবনেরই একটা অংশ। আমার সাথে একটা ফাইল সব সময়ই থাকে। যেখানেই সুযোগ পাই তার ভিতর থেকে অবস্থা বুঝে কাগজ-পত্র বিতরণ করি। আমাদের দাওয়াতী মানসিকতা থাকতে হবে। কোনটা ভালো মেটেরিয়াল, কোনটা ভালো নয় সে পার্থক্য করার বোধ আমাদের থাকতে হবে।
মস্কোতে থাকেন এমন একজন আজারবাইজানি মুসলিম ব্যাংক অফিসারও জানালেন সেখানে ইসলাম নিষিদ্ধ ছিল। অগ্রগতির জন্য সময় লাগবে। কাজাকিস্তান সফরে গিয়ে আমি প্রথমে শক্ড হয়েছি। কাজাকিস্তান যে এতটা ডি-ইসলামাইজড তা আগে বুঝিনি। কোনো মুসলিম কান্ট্রি এতটা ডি-ইসলামাইজড তা আগে দেখিনি। আমি বাংলাদেশকে ইসলামের আলোকে খারাপ মনে করি। কিন্তু কাজাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশকে জান্নাতুল ফেরদৌস বলতে হবে। এ জন্য পরিপ্রেক্ষিতের (পারসপেকটিভ)বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন অবস্থান থেকে আমি দেখছি তা গুরুত্বপূর্ণ। কাজাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ দেখলে মনে হবে বাংলাদেশ জান্নাতুল ফেরদৌস। আর রাসূলের সময়ের মদিনা থেকে দেখলে মনে হবে এখানে দুষ্টুতে ভরা। এজন্য আমরা আমাদের জাজমেন্ট কোত্থেকে করছি তা বুঝার বোধও আমাদের মধ্যে থাকতে হবে। তাই কাজাকিস্তানে কয়েক পারসেন্ট মেয়ে যদি হিজাব পরে তাহলে আমরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবো না। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে আমরা যেন বাস্তববাদী হই। আমরা যেন বুঝতে শিখি। আমরা সব কিছুকে যেন খারাপ না বলি আবার সব কিছুকে যেন ভালো না বলি। বাংলাদেশের সব খারাপ এটা আমাদের বলা উচিত নয়। আবার কাজাকিস্তানের সব খারাপ তাও বলা ঠিক না। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদের ঈমান দেখবেন। কমিউনিস্ট ডিক্টেটরের অধীনে তারা যে তাদের ঈমানকে টিকিয়ে রেখেছে তাই তো অনেক। আমরা বাইরের দিক দেখে বিচার করে অভ্যস্ত। আমি তাদের হিজাবকে দেখেছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের জাজমেন্ট অনেক গভীর হতে হবে।
সেজন্য কাজকিস্তানে ইসলামের জন্য কাজ করতে প্রত্যেক মুসলিম দেশের দূতাবাস সেখানে খোলা উচিত। আমি জানি একটা এম্বেসি খোলা যথেষ্ট খরচের ব্যাপার। কিন্তু সে খরচও খুব বেশি নয়, বড়জোর বছরে দুই কোটি টাকা। সেখানে বাংলাদেশেরও দূতাবাস খোলা উচিত। পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব সেখানে দূতাবাস খুলেছে। সেই সাথে আমাদের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের বলব তাদের সে দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাওয়া উচিত। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করা একদম ফ্রি। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ রয়েছে। সেখানে ব্যবসায়ীরা গেলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে। আমাদের দেশে যেমন সূফি, ব্যবসায়ীরা ইসলাম প্রচার করেছে সেখানেও সে দেশের ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যবসায়ীরা দায়িত্ব নিতে পারে। ব্যবসার জন্য উম্মুক্ত বলে একজন ব্যবসায়ী সেখানে একটা অফিস খুললে সেটা সে দেশের মুসলমান জনগণের অগ্রগতিতে সহায়ক হবে। পারস্পরিক পরিচয়ের মাধ্যমেই কাজ আগাবে। সেখানে তাড়াহুড়োর কোনো অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশেও আমাদের অধৈর্য হওয়া ঠিক নয়। আমাদের কাজ বেশি করতে হবে এবং হিকমত প্রয়োগ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করতে গেলেই সব খারাপ হয়ে যাবে। তার মানে এই না যে, অযোগ্যতার কারণে আমরা দেরি করি। তার জন্য যোগ্যতা বৃদ্ধি করে আমাদের আউটপুট বাড়ানোর দরকার।
কাজাকিস্তানে পারমাণবিক প্রকল্প আছে কিন্তু তা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। টুডে অর টুমরো বিশ্বে নিউক্লিয়ার পাওয়ার থাকবে না। সে হিসাবে কাজাকিস্তানে সেই পারমানবিক প্রকল্প তাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সমস্যা নেই। সেখানে রাশিয়ান এবং কাজাকদের মধ্যে একরকম টেনশন কাজ করে। সরকারি কাজ কাজাকরা পায়, রাশিয়ানরা পায় না। প্রাইভেট সেক্টরে আবার রাশিয়ানরা বেশি যোগ্য হওয়ায় বেশি সুযোগ পায়। আমার যতটুকু মনে হয়েছে, কাজাকরা রাশিয়ানদের সাথে একটা সম্পর্ক রেখেই চলতে চায়। একে তো জনসংখ্যার ৩০ ভাগ রাশিয়ান, আবার রাশিয়া প্রতিবেশি।
সেখানে যে সমস্ত ইসলামিক প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়ার সুযোগ আমার হয়নি। কাজাকিস্তানে ইসলামের কাজ এগিয়ে নিতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিভিন্ন মুসলিম দেশে কাজাক স্টুডেন্টদেরকে স্কলারশিপ দিতে হবে। এর মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার অনেক সুযোগ আছে।
শাহ আব্দুল হান্নান: সাবেক সচিব বাংলাদেশ সরকার




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *