কয়েক দশক ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কাজের সূত্রে যাতায়াত এ দেশের মানুষের। ভিসাসংক্রান্ত জটিলতায় সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা ভাটা পড়লেও মধ্যপ্রাচ্য মানেই এখনো এখানকার মানুষ বোঝেন দুবাই। কর্মসূত্রে মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশ কিংবা শহরে যান না কেন, প্রতিবেশীদের কাছে তিনি ‘দুবাইওয়ালা’ নামে পরিচিতি পান। তবে দুবাই কেবল টাকা আয়ের জন্য নয়, বেড়ানোর জন্যও মনোমুগ্ধকর একটি স্থান। সেখানে আছে বেড়ানোর নানা জায়গা।
মিরাকেল গার্ডেন: গাড়ি থেকে নামতেই নাকে আসে ফুলের সৌরভ। যেন কাছে কোথাও সুগন্ধির কারখানা আছে। সুগন্ধের উৎস ধরে এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে একটি সুদৃশ্য ফটক। ফুল দিয়ে সাজানো ফটকটির পাশে লেখা দুবাই মিরাকেল গার্ডেন। ফটক দিয়ে ঢুকে পড়বেন মনোরম এই বাগানে। সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে শত বিস্ময়।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই মিরাকেল গার্ডেন। দুবাই ল্যান্ডের কাছে অবস্থিত এই ফুলের বাগানে রয়েছে ৫০ মিলিয়ন তাজা ফুল। গাছেই ফুটেছে। ফুল দিয়ে তৈরি হয়েছে নানান কার্টুন, মানব অবয়বসহ আরও কত-কী। ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই বাগানের উদ্বোধন করা হয়। ৭২ হাজার বর্গমিটারের বাগানটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক ফুলের বাগান বলা হয়। প্রবেশমূল্য ৫৪ দিরহাম।
৩০ নভেম্বর বিকেলে বাগানটিতে পা রাখতেই এক ভালো লাগার আবেশে মনটা ভরে উঠল। কখনো ফুল দিয়ে তৈরি মিকি মাউস, কখনোবা নারী অবয়ব আপনাকে কাছে টানবে। আবার গাছসহ ফুলের অবয়ব ঘুরছে হেলেদুলে। হাজার হাজার মুঠোফোনের ক্যামেরা ক্লিক করে উঠছে বারবার। চলছে অবিরাম ভিডিও।
আকাশপানে তাকিয়ে থাকা ফুলে ঢাকা নারী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়-জাগানিয়া চোখ দেশ-বিদেশের হাজারো দর্শনার্থীর। আমিরাত এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটিও কি কম টানবে! আস্ত একটি বিমান দাঁড়িয়ে আছে। রয়েছে প্রপেলারও। মনে হচ্ছে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ছাড়া কেটলিসহ চায়ের কাপ, হাতি, ফুলের তৈরি ঘরবাড়ি, মিকি মাউসসহ নানা স্থাপনায় চোখ আটকে যাচ্ছে। পাঁচ-ছয় রকম ফুল দিয়ে এসব স্থাপনা তৈরি। এর মধ্যে রয়েছে সূর্যমুখীও।
বাগানে সময় যে কখন কেটে যাচ্ছে, টের পাওয়া মুশকিল। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে যাবেন অনেক বাংলাদেশি। কর্মসূত্রে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা কিংবা বেড়তে যাওয়া বাঙালির অভাব নেই। আর মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দুবাই থেকে মিরাকেল পার্ক না দেখা মানে মরুর একটি সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হওয়া। এ যেমন রাস আল খাইমা থেকে মিরাকেল গার্ডেনে ছুটে আসেন কে এম তারেকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কর্মসূত্রে অনেক বছর এখানে আছি। এর আগেও এই পার্কে এসেছি। আবার এলাম। কারণ, প্রতিবার নতুন নতুন ঢং ও রূপে দেখা যায় পার্কটিকে। একই ধরনের স্থাপনা বেশি দিন থাকে না।’
ডেজার্ট সাফারি: সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাবেন অথচ মরুভূমিতে যাবেন না, তা কি হয়! সোনালি বালুচর আপনাকে হাতছানি দেবে। বিশেষ করে শীতের শুরু থেকে এখানে ডেজার্ট সাফারি করা হয়। এ সময় দুবাই শারজাসহ বিভিন্ন মরুভূমিতে পর্যটকদের ভিড় নামে। ডেজার্ট সাফারি, বালুর মধ্যে গাড়িতে চড়ার এক অন্য রকম অনুভূতি। উঁচু-নিচু জায়গায় দ্রুতগতিতে ছুটে চলা ফোর হুইল গাড়িতে চড়তে চড়তে অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি একটু ভয় ভয়ও লাগতে পারে। বেলা তিনটার দিক থেকে ডেজার্ট সাফারিতে যাওয়া শুরু হয়।
১০ থেকে ১৫ মিনিট চলার পর মরুভূমির মাঝখানে একটি জায়গায় থামবে গাড়ি। সেখানে উটের পিঠে চড়া কিংবা টয় মোটরগাড়ি চালানোর ব্যবস্থা থাকে। মরুর বুকে বালু উড়িয়ে ছুটে চলা ফোর হুইল গাড়িগুলো দেখতে ভালোই লাগে। এরপর একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আস্তে আস্তে পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে ওঠে। আর ধীরে ধীরে মরুর সোনালি বালুচরে ডুবে যায় সূর্য। গোধূলিবেলার ছবি ধরে রাখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন দর্শনার্থীরা।
ডেজার্টে আগত ব্যক্তিদের জন্য থাকে নাচগানের ব্যবস্থাও। তার আগে পাগড়ি মাথায় আরবের প্রথাগত পোশাক পরিহিত ছবি তুলতে ভুলবেন না। সব ব্যবস্থা সেখানে থাকে। মঞ্চের চারদিকে গোল করে দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা বসেন। সেখানে থাকে চা-কফিসহ রাতের খাবারের আয়োজন। খাওয়াদাওয়াসহ পুরো সাফারি ২৫ থেকে ৩০ দিরহামের প্যাকেজ।
খেতে খেতে মঞ্চে চলে বেইলি ড্যান্স, আগুন নিয়ে নৃত্য কিংবা আরবের ট্র্যাডিশনাল নৃত্য। এসব দেখতে দেখতে সময় হয়ে যায় ফেরার। আবার তাদের গাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় প্রধান সড়কে।
বুর্জ আল খলিফার জলনৃত্য: বুর্জ আল খলিফাকে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন বলা হয়। গগনচুম্বী এই অট্টালিকা বুর্জ দুবাই নামেও পরিচিত ছিল। দুবাই শহরের দুবাই মল লাগোয়া এই ভবনে আবাসিক বাসা, হোটেল, সুইমিং পুল রয়েছে। ২০১০ সালে উদ্বোধন হওয়া ৮২৮ মিটার উচ্চতার এই ভবনের পাশে করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। সন্ধ্যা থেকে এই ফোয়ারার জলনৃত্য বা ওয়াটার ড্যান্স দেখার জন্য হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করেন।
ইংরেজি, হিন্দিসহ বিভিন্ন ভাষার গানের সঙ্গে ফোয়ারার নাচ মনোমুগ্ধকর। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর এই ওয়াটার ড্যান্স শুরু হয়। এ সময় বুর্জ খলিফার গায়ে নানা আলোকসজ্জায় ভেসে ওঠে দুবাই মলের নাম। দুবাই মলের বিশাল অ্যাকুয়ারিয়ামও নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের। আর কেনাকাটা তো আছেই।
অন্যান্য: সমুদ্র ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলছে আমিরাত সরকার। আটলান্টিস দ্য পাম হোটেল তারই একটি। দুবাই পাম জুমাইরায় অবস্থিত এই হোটেলকে প্রথম দ্বীপে তৈরি হোটেলও বলা হয়। অনেক দূর থেকে এই হোটেলের সদর ফটকটি দেখা যায়। বিদেশি পর্যটকেরা এই হোটেলের স্থাপত্যশৈলী এবং হোটেলের বিভিন্ন দিক থেকে সমুদ্র দেখতে ছুটে যান এখানে। হোটেলের সামনে সমুদ্রভ্রমণের সুযোগও থাকে স্পিডবোটযোগে। এ ছাড়া হেলিকপ্টার থেকে সমুদ্র দেখা যায়।
আর জুমেইরা বিচের পাশে সমুদ্রের মধ্যে বুর্জ আল আরব হোটেল। তীর থেকে সমুদ্রের ২৮০ মিটার ভেতরে এর অবস্থান। হোটেলটির স্থাপত্যশৈলী পুরোনো পালতোলা জাহাজের মতো। রাতে এই হোটেলের আলোকসজ্জা এসে পড়ে সমুদ্রের শান্ত পানিতে। রাতে নীল, সাদা, গোলাপি, লাল—কত রকম রং বদলায় হোটেলটি। আর বালুচরে বসে তা উপভোগ করেন পর্যটকেরা।