মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদঃ ২০০৬ সালের মে মাসে পিস এডুকেশন কারিকুলাম ডেভেলমেন্ট শীর্ষক এক ওয়ার্কশপে অংশ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছিলাম। বিশ্বের ৩০ টি দেশের প্রতিনিধিরা এখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০০৬ সালের ১৪ মে থেকে ১৯ মে ওয়ার্কশপটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওয়ার্কশপ শেষে প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যের অপুরুপ লিলাভূমি নায়াগ্রা জলপ্রপাদ দেখতে গিয়াছিলাম। নায়াগ্রা নদীটি প্রায় ১২০০ বছর পুরনো হলেও আরো অনেক আগে প্রায় ১৮০০ বছর পূর্বে ওন্টারিওর দক্ষিণে প্রায় ২ থেকে ৩ কিলোমিটার বরফে ঢাকা ছিলো। সমস্ত এলাক জুড়ে বরফ এমন ভাবে ছিলো যেনো দেখলে মনে হতো শুভ্র সাদা কোন কাগজ হয়তো ভাঁজ করে রাখা হয়েছে। গ্রীষ্পমন্ডলীয় পরিবর্তনের ফলে গলতে শুরু করে বরফ আর ফ্রেট লেকস বেসিনে প্রচুর পানি জমতে শুরু করে আর লেক ঈরি, নায়াগ্রা নদী আর লেক ওন্টারিও থেকে আসা পানি মিলে এক বিশাল জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। যা, বর্তমানে আমরা নায়াগ্রা’র জলপ্রপাত বলে থাকি। নায়াগ্রা জলপ্রপাত এর ইংরেজী নাম Niagra Falls । এটি উত্তর আমেরিকার নায়াগ্রা নামক নদীর উপর অবস্থিত বলে এর নাম “নায়াগ্রা” হয় বলে স্থানীয়দের ধারনা। কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত। মূলত তিনটি পাশাপাশি অবস্থিত ভিন্ন জলপ্রপাত নিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাত গঠিত। এই তিনটি জলপ্রপাতের নাম: হর্স্শু ফল্স বা কানাডা ফল্স, আমেরিকান ফল্স এবং ব্রাইডাল ভিল ফল্স। প্রতিদিন প্রতিমিনিটে নায়াগ্রা জলপ্রপাত ৬০ লক্ষ ঘনফুট মাত্রাধিক জল প্রবাহিত করে। যার গড় পরিমান হলো ৪০ লক্ষ ঘনফুট। নায়াগ্রা সমগ্র নিউইয়র্ক ও ওন্টারিও’র জলবিদ্যুৎ শক্তির এক অন্যতম উৎস। এতে বুঝা যায়, জলপ্রপাতটি দেশের শিল্প ও বাণিজ্যে যেমন সাহায্য করছে তেমনি এখানে ঘুরতে আশা পর্যটন শিল্প দ্বারা দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত কিন্তু শুধু একটি জলপ্রপাত নয়। মোট তিনটি জলপ্রপাত নিয়ে এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত গঠিত। নামগুলো যথাক্রমেঃ হর্সশু ফলস বা Canadian Falls, American Falls, ব্রাইডাল ভিল ফলস।
প্রকৃতির অপার বিস্ময় নায়াগ্রা জলপ্রপাতঃ একবার ১৯৪৮ সালের দিকে বরফ জমে প্রায় ৪০ থেকে ৪২ ঘন্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায় পানির স্রোত। তারপর বিপাকে পড়ে যায় দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। কারন, নায়াগ্রার জলবিদ্যুৎ এর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। এই অবস্থা মোকাবেলার জন্য পরবর্তিতে ১৯৫০ সালে নায়াগ্রা চুক্তি’র মাধ্যমে জলপ্রপাতের জল নিয়ন্ত্রন করা শুরু করা হয়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতটি শুধু যে সৌন্দর্য বহন করে তাও না। অনেক দুঃসাহসী মানুষ এই নায়াগ্রা পাড়ি দিতে চেয়েছে। অনেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেয়ে প্রাণ হারিয়েছে। অনেকে আবার এর উপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন নিচে। অনেকে আবার উপর দিয়ে দড়ি বেঁয়ে চলে গেছে অপর প্রান্তে। অনেক দুঃসাহসী ভ্রমন পিপাসু আছে যাদের উদ্দেশ্য শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করা না। তাকে জয় করাও।
দু:সাহসী অভিযাত্রীদের নায়াগ্রা জলপ্রপাত অতিক্রমঃ ১৮২৯ সালের অক্টোবরের দিকে স্যাম পেচ নামক এর দুঃসাহসী অভিযাত্রী ঝাঁপ দিয়েছিলেন নায়াগ্রায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, স্যাম পেচ সেই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলো। স্যামের এই কান্ড দেখে আরো অনেকে এই দুঃসাহসী কাজ করার সাহস পায় এবং তারা স্যামের দেখানো পথ অবলম্বন করে। অনেকে সফল হয়েছিলো, কিন্তু অনেককে এর মাশুল গুনতে হয়েছিলো নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে। কেউ দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে, কেও আবার নিজেকে ব্যারেলে(ড্রাম জাতীয় কিছু) ভরে নিয়ে ভেসে গিয়েছেন উত্তাল এই জলপ্রপাত এর মধ্যে। কেওবা ব্যারেল শুদ্ধ আছড়ে পরেছে নায়াগ্রা’র ১৭৩ ফুট উচ্চতা থেকে। যারা এইসব করতো, তাদের নাম দেয়া হয়েছিলো “ফানামবুলিস্ট”।
যারা দড়ির উপর দিয়ে নায়াগ্রা পার হয়েছেন তাদের মধ্যে সব থেকে সেরা ছিলো “জাঁ ফ্রাঁসোয়া গ্রাভলো বা দ্যা গ্রেট ব্লঁদ্যা”। এই সাহসী অভিযাত্রী ১৮৫৯ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে মোট ২৩ বার নায়াগ্রা পার করেছেন। তবে ২০১২ সালের ১৫ জুন, নিক ওয়ালান্ডা নামক এক মার্কিন যুবক দুই ইঞ্চি তারের উপর দিয়ে হেঁটে নায়াগ্রা পার করে আলোচনার তুঙ্গে ছিলেন। তাছাড়া সিগনর ফেরিনি, হেনরি বেলেনি, জেমস হার্ডিয়া এবং একমাত্র নারী মিসেস টেইলর ছাড়াও আরো অনেক দুঃসাহসী অভিযাত্রী এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত অতিক্রম করে ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি