স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে দীর্ঘদিন রক্তক্ষয়ী লড়াই করা জাতির মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম হলো ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের মরো মুসলিমরা। এই অঞ্চলে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অধিবাসীদের ইসলাম গ্রহণের সময়ই এখানকার মানুষ ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। কয়েকশ’ বছর ধরে মুসলমানরা ফিলিপাইনের এই দক্ষিণাঞ্চলে স্বাধীন ছিল। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমেরিকানরা ফিলিপাইনে কলোনি গড়ে তোলে। সংস্কৃতির সাথে ভিন্নতা থাকায় খ্রিষ্টানদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় মুসলমানরা। এই সুযোগে শাসকদের আনুকূল্য পেয়ে মিন্দানাও, সুলু দ্বীপে বাড়তে থাকে খ্রিস্টান বসতি। ৪০’র দশকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানচিত্র পবিবর্তনের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার খ্রিস্টানকে নানা সুবিধা দিয়ে ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলে পাঠানো হয়। শুরুতে বড় কোনো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে না পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে তরুণ নুর মিশৌরির নেতৃত্বে মুসলমান তরুণরা সশস্ত্র যুদ্ধে নামে প্রতিবাদ হিসেবে। তাদের সংগ্রাম ছয় বছরের মধ্যেই আংশিক সফল হয়। তৎকালীন সামরিক সরকার বাধ্য হন তাদের সাথে আলোচনায় বসতে এবং স্বায়ত্তশাসন দাবির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিতে।
স্বায়ত্ত্বশাসন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ফিলিপাইনের অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান রাজনীতিক ও আমলাদের ছিল মুসলিমদের প্রতি অবহেলা, সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের ছিল সুযোগের অভাব, ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব। শিক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগের অভাব এবং অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা এই অঞ্চলের মানুষকে বেশি করে স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। মুরাদ ইব্রাহিমের মরো ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট (এমএনএলএফ), নুর মিশৌরির ‘মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট’ (এমআইএলএফ), বাংসামরো ইসলামিক ফ্রিডম ফাইটারস (বিআইএফএফ), আবু সাইয়াফ উপগোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আগ্রহী করেছে তরুণ ও যুবকদের। এই সুযোগে এই অঞ্চলে চরমপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটও (আইএস) ঢুকে পড়ে। সরকারি বাহিনীর সাথে প্রায়ই সংঘর্ষ হতো মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর। ফলে সৃষ্টি হয় অস্থিতিশীলতা। এ কারণে এই অঞ্চলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নও হয়নি। উপরন্তু এই অঞ্চলের মাটির নিচে রয়েছে মূল্যবান খনিজ সম্পদ। সংঘাত চলতে থাকায় এসব আহরণের ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল না। সবিশেষ রদ্রিগো দুতার্তে সরকারের ইতিবাচক উপলব্ধির কারণেই স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়।
বাংসামরো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (বাংসামরো অটোনোমাস রিজিয়ন) নামে প্রথম একটি প্রস্তাব ফিলিপাইনের ১৬তম কংগ্রেসে উত্থাপন করা হয় কিন্তু পাস হয়নি। এরপর ১৭তম কংগ্রেসে উঠে এবং দেশটির সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে ২০১৮ সালের ২৩ ও ২৪ জুলাই পাস হয়। পরে বিলটি ২৬ জুলাই প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে স্বাক্ষর করে চূড়ান্ত রূপ দেন। এটা ২০১৪ সালে ফিলিপাইন সরকার ও মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের (এমআইএলএফ) মধ্যে স্বাক্ষরিত সম্মতিপত্রের ফলস্বরূপ। এরপর ৯০’র দশকে গঠিত মুসলিম মিন্দানাওয়ের স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলের (এআরএমএম) ৫টি প্রদেশ, চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি এবং লানাও ডেল নর্তে প্রদেশের ৬টি পৌরসভা ও যেসব অঞ্চলের মানুষ বাংসামরোতে যোগ দিতে চায় সেখানে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ভোট হয়। এটা এআরএমএম’কে বিলুপ্ত করে বাংসামরো স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ভোট।
আবার ২০১৫ সালের ১২ জুলাই ফিলিপাইনের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ বাংসামরো স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলে মুসলিমদের জন্য শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের অনুমতি দিয়েছে। অমুসলিমদের জন্য শরিয়াহ আইন প্রয়োগ করা যাবে না অনুমোদনপত্রে তাও উল্লেখ করে দেয়া হয়। আইনটি পাস করা খুব সহজও ছিল না। প্রবল বিরোধিতা করেছে মিন্দানাওয়ের ক্যাথলিকসহ অন্যান্য খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী। খ্রিস্টানরা মিন্দানাওয়ের বড় বড় শহরে বিক্ষোভ করে বাংসামরো অঞ্চল করার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট দুতার্তের সরকার দীর্ঘদিনের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে আইনটি পাস করেন।
মুসলমানরা শিক্ষায় অনগ্রসর
সরকার প্রদত্ত তথ্য অনুসারেই এই অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি পরিবার জাতীয়ভাবে ২১.৬ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি দরিদ্র। জাতীয় পরিসংখ্যানের সাথে তুলনা করলে দারিদ্র্যতা এই অঞ্চলটিতে বেশ প্রকট। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ফিলিপাইনের মাধ্যমিক স্কুলে তালিকাভুক্তির হার ৬৮ শতাংশ। মিন্দানাওয়ের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চলটিতে মাধ্যমিক স্কুলে সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া ছিল তার চেয়েও বেশি। মিন্দানাওয়ের মুসলিমদের মধ্যে প্রতি তিনজনে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পাস করতে পারতো না।
স্বায়ত্ত্বশাসনের আওতায় বাংসামরো কর্তৃপক্ষ আইন, নির্বাহী ক্ষমতা এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডের এখতিয়ার পাচ্ছে কিন্তু প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করবে কেন্দ্রীয় সরকার। বাংসামরো কর্তৃপক্ষ ২০২২ পর্যন্ত ৮০টি আসনের একটি আইনসভার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। তারা নিজেরা একজন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করতে পারবেন। স্বায়ত্ত্বশাসনের বিনিময়ে এমআইএলএফ গেরিলাদের ৪০ হাজার অস্ত্র জমা দিতে হয়েছে এবং গেরিলা তৎপরতা ভেঙে দিতে হয়েছে।
যে সব অঞ্চল বাংসামরোর অন্তর্ভুক্ত হবে ৬ লাখ ৫০ হাজার ২৪৪ জন রেজিস্টার্ড ভোটারের মেগোইন্দানাও, ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫৫২ জন রেজিস্টার্ড ভোটারের লানাও ডেল সুর, ২ লাখ ৯ হাজার ৬৬৯ জন ভোটারের এলাকা তাভি তাভি, ১ লাখ ৯০ হাজার ৮৬১ রেজিসটার্ড ভোটারের এলাকা বেসিলান, ১৯ লাখ ৮০ হাজার ৪৪১ জন ভোটারের এলাকা অটোনোমাস রিজিয়ন অব মুসলিম মিন্দানাও (এআরএমএম), ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৫১ জন ভোটারের এলাকা কোটাবাটো শহর, ৭১ হাজার ১২৪ জন ভোটারের এলাকা ইসাবেলা শহর। এই এলাকাগুলো মোট রেজিস্টার্ড ভোটার ২১ লাখ ৬৫ হাজার ৩১৬ জন।
চুক্তির পর মিন্দানাওয়ে দারিদ্র্য নেমে এসেছে ৩৭ শতাংশে মিন্দানাওয়ের মুসলিমদের মধ্যে চরম দারিদ্র্য রয়েছে। চুক্তির পর স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (ফার্স্ট কোয়ার্টার) এ ধরনের দারিদ্র্য নেমে এসেছে ৩৭ শতাংশে। গত ১৮ জুনের সেল্ফ রেটেড পোভার্টি রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে (২০ জুন মিন্দা নিউজ)। মিন্দা নিউজের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, গত এক দশকে দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়ার এটাই সর্বোচ্চ হার। ২০১৮’র শেষ প্রান্তিকে মিন্দানাওয়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৯ শতাংশ। সেখান থেকে ১২ শতাংশ কমে ৩৭ শতাংশে পৌঁছেছে ১৮ জুন। অবশ্য ২০১১ সালে মিন্দানাওয়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ১৮ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত জরিপ অনুসারে, পুরো ফিলিপাইনে জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার (সেল্ফ রেটেড পোভার্টি) ৩৮ শতাংশ। সংখ্যায় ৯৫ লাখ পরিবার। জাতীয়ভাবে ২০১৮ সালের শেষ প্রান্তিকে এ ধরনের দারিদ্র্যে নিমজ্জিতের হার ছিল ৫০ শতাংশ।
দুতার্তের আগ্রহ কেন?
৭০ দশকের পর ফিলিপাইনের সাবেক সরকারগুলো মিন্দানাওয়ের মুসলিমদের স্বায়ত্ত্বশাসন দিতে রাজি থাকলেও ছিল আন্তরিকতার অভাব। চেয়েছেন এ কারণে যে ফিলিপাইনে অস্থিতিশীলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছিল না, উন্নয়ন হচ্ছিল না। কিন্তু ব্যতিক্রম বর্তমান প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। প্রকৃতপক্ষে তিনি মিন্দানাও থেকে আসা ফিলিপাইনের প্রথম প্রেসিডেন্ট। সেখানে বড় হয়েছেন। মিন্দানাওয়ের সম্ভাবনা ও বাধা দেখেছেন ছোটবেলা থেকেই। দুতার্তের এই মনোভাবই তাকে মিন্দানাওয়ের সংঘাত দূর করে স্থায়ী একটি সমাধানে পৌঁছতে সহায়তা করেছে। দুতার্তের পূর্বসূরি কোরাজন একিইনুর পুত্র প্রেসিডেন্ট বেনিগনো একিইনু শান্তি প্রক্রিয়ায় রাজি ছিলেন কিন্তু তিনি প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে পারেননি। দুতার্তে সংঘাতমুখর দাবাও শহরের মেয়র থাকাকালে কার্যত আইনশৃঙ্খলার অবনতির মধ্যেও দাবাওকে একটি বাণিজ্যিক শহরে পরিণত করেন। এটাই তার প্রথম সাফল্য। এরপর থেকে ফিলিপাইনে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। দুতার্তের সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতৃবৃন্দের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল শুরু থেকেই। তিনি প্রায়ই বলতেন যে তার দাদী বাংসামরোদের প্রতিবেশী ছিলেন। তাদের সাথে ছিল ভালো সম্পর্ক।
এর আগেও সামরিক এক নায়ক ফার্দিনান্দ মার্কোস করেছিলেন ‘রিজিয়নাল অটোনোমাস গভর্নমেন্ট এবং তারপরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কোরাজন একিইনুর ‘অটোনোমাস রিজিয়ন ইন মুসলিম মিন্দানাও’ ঘোষণা করেও বাস্তবায়ন করতে পারেননি বাজেটের অভাবে। একিইনুর সময় ১.২ পেসো বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল কিন্তু এই অর্থের ছাড় হয়নি। দুতার্তের সরকার ৩২ বিলিয়ন পেসো বিএআরএমএম কর্তৃপক্ষের জন্য শিগগির ছাড় দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
দুতার্তের বক্তব্যের জবাবে বিএআরএমএম’র অন্তর্বর্তীকালীন মুখ্যমন্ত্রী আহদ বালাওয়াগ ইব্রাহিম (মেরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মুরাদ ইব্রাহিম) তার উদ্বোধনী বক্তব্যে ‘দারিদ্র্য, অভাব ও অবহেলার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন।’
সংঘাতের শুরু যেভাবে
ফিলিপাইন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপিন্সের মুসলিম অঞ্চলকে মরোল্যান্ড বলে স্বীকৃতি দেয়। মরোল্যান্ড পরে ব্যুরো অব নন ক্রিশ্চিয়ান ট্রাইবসের অধীন চলে যায়।
১৯৪৬ সালে ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা পায়। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটির উত্তরাঞ্চল থেকে খ্রিস্টানদের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পাঠাতে শুরু করে জনসংখ্যার মানচিত্র বদলে দেয়ার উদ্দেশে। ১৯১৮ সালে কাপাটাগান এলাকায় ২৪ খ্রিস্টান বসতি ছিল। কিন্তু ১৯৪১ সালে একই এলাকায় খ্রিস্টান বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজারে এবং ১৯৬০ সালের মধ্যে কাপাটাগান এলাকায় খ্রিস্টানদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ হাজারে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্য মিন্দানাওয়ের জনসংখ্যা চিত্র পরিবর্তনের উদ্দেশে পরিকল্পিতভাবেই বাড়ানো হয় খ্রিস্টান বসতির সংখ্যা। ১৯৪৮ সালে মধ্য মিন্দানাওয়ে খ্রিস্টান ছিল সাত লাখ কিন্তু ১৯৭০ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ২৩ লাখে। মিন্দানাওয়ে খ্রিস্টান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের চেয়ে বেশি ছিল ২২৯ শতাংশ (বুরলে, টি এম ১৯৭৩ দ্য ফিলিপিন্স : এন ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল জিওগ্রাফি)।
১৯৩৫ সাল উত্তর থেকে আসা খ্রিস্টানদের আদি বসতি মুসলিমদের থেকে বেশি সহায়তা ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। সরকারি চাকরিতেও মুসলিমদের সুযোগ ছিল খুব কম। মিন্দানাওয়ের সমস্ত অনিবন্ধিত জমিকে সরকারি সম্পত্তি অথবা সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। মুসলিমদের শিক্ষার হার কম থাকায় তারা নিবন্ধনের বিষয়টা বুঝতো না। পদ্ধতির সাথে পরিচিত না থাকায় অথবা ভূমির মালিক হওয়ার জন্য মুসলিমরা সরকারি ফি দিতে পারেনি অথবা কর পরিশোধ বাধ্যতামূলক করায় অনেক মুসলিম ভূমির অধিকার হারিয়েছে। ভূমি পাওয়ার জন্য আবেদনও করতে পারেননি অথবা তারা মামলাও করেননি। ব্যুরো অব ল্যান্ডের খ্রিস্টান (অধিকাংশ) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুসলিমদের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার মানসিকতা থাকায় মুসলিমরা যে ভূমি পুরুষানুক্রমে ভোগ করে এসেছে, তা তাদের বেদখল হয়ে যায়। বিপরীতক্রমে খ্রিস্টান বসতিকারীরা পেয়েছে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা। তারা সরকারি ঋণসহ এবং সরকারি সহযোগিতা পেয়েছে। নতুন খ্রিস্টান সম্প্রদায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা পেয়েছে। মুসলিমরা ছিল বিচ্ছিন্ন, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষাহীন, জটিল ভূমি আইন তাদের জানা ছিল না। পরিণতিতে হয়েছে বঞ্চিত।
ব্যুরো অব ল্যান্ড খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দাবি করা সম্পত্তির স্বীকৃতি ও অধিকার দিয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা দখলে থাকলেও ভূমির দাবি না করায় তাদের নিজ ভূমি হতেই উচ্ছেদ হতে হয়েছে। দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুসলিমদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক বের করে দেয়া হয়েছে সামান্য অর্থ দিয়ে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা এমনিতেই মেনে নিতে হয়েছে এবং ভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। কেউ পূর্বপুরুষের ভূমি ছেড়ে চলে যেতে না চাইলে তাকে বাধ্য করা হয়েছে শক্তি প্রয়োগ করে। জমি দখলে খ্রিস্টানদের অস্ত্র দিয়ে শক্তি জুগিয়েছে ‘ফিলিপিন কন্সটালবুলারি (ফিলিপিনের পুলিশ স্টেশন)। এসব কারণে ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্যের সৃষ্টি হয় (মুসলিম ফিলিপিনুস : হেরিটেজ অ্যান্ড হরাইজন নচ পিটার জি গোয়িং)।
সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ
খ্রিস্টান প্রশাসনের এমন আচরণের প্রতিবাদে ১৯৭১ সালে নুর মিশৌরির নেতৃত্বে গঠিত হয় মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এমএনএলএফ)। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট মার্কোস ফিলিপাইনে সামরিক আইন জারি করলে এমএনএলএফ স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সরকারি বাহিনীর দলন-পীড়নে এমএনএলএফ’র এক লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। এর ফলে মিন্দানাওয়ে দশ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে যায় এবং এক লাখ মুসলিম মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যায়। চার ভাগের তিন ভাগ ফিলিপাইনের আর্মিকে মিন্দানাওয়ে মোতায়েন করা হয় তখন। এরই মধ্যে এমএনএলএফ ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সমর্থন পায়। আরব দেশগুলো ফিলিপাইনে তেল সরবরাহ না করার হুমকি দেয়। ফিলিপাইন সরকার মুসলমানদের অধিকারের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে তেল অবরোধ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়।
মার্কোস শেষ পর্যন্ত মরো মুসলিম সমস্যা সমাধানে রাজি হয় এবং তিনি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। তিনি ম্যানিলায় একটি বড় মসজিদ স্থাপন করেন এবং মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। মার্কোস ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন, মুসলিম ‘পারসোনাল ল’ অনুমোদন করেন, কিন্তু চালু করেননি।
১৯৭৬ সালে লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির মধ্যস্থতায় ত্রিপোলিতে ফিলিপাইন সরকারের প্রতিনিধি ও এমএনএলফ’র মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। দক্ষিণ মিন্দানাওয়ে মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসন দিতে রাজি হয় মার্কোস সরকার। মার্কোস সরকার লিবিয়ার মধ্যস্থতায় স্বাক্ষর করে ‘ত্রিপোলি এগ্রিমেন্ট’। এতে মধ্য মিন্দানাও ও সুলু অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু এটা বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলেন না।
এরপর কোরাজন একিইনু, ফিদেল রামোস, জোসেফ এস্ত্রাদা, অরোইয়্যা ম্যাকাপাগাল এবং কোরাজন একিইনুর পুত্র প্রেসিডেন্ট বেনিগনো একিইনুর শাসনকালে চেষ্টা করা হয়েছে স্বায়ত্ত্বশাসন বাস্তবায়ন করতে কিন্তু সফলতা আসেনি। অটনোমাস এরিয়া অব মুসলিম মিন্দানাও (এআরএমএম) গঠন করে দেয়া হলেও তা কাজ করেনি। শান্তি ফিরে আসেনি। আবার সেই যুদ্ধে যেতে হয়েছে, লোক ক্ষয় হয়েছে। সবিশেষ অনেক বেশি সফলতার সাথে স্বায়ত্তশাসনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট দুতার্তে।
লেখাঃ হামিম উল কবির
ফিলিপাইনের বাংসামরোয় নির্বাহী ক্ষমতা এখন মুসলমানদের
HimalayJul 10, 2021অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক, ধর্ম0
Previous Postআত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
Next Postওয়াজ মাহফিল : ইসলাম প্রচারের একটি মাধ্যম
Related articles
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত পরিবর্তন নেই স্টাফ রিপোর্টার (১০ মিনিট আগে) ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪ অপরাহ্ন mzamin facebook sharing button twitter sharing button skype sharing button telegram sharing button messenger sharing button viber sharing button whatsapp sharing button প্রবল আপত্তির মধ্যেই সম্প্রতি আলোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে সম্পাদক পরিষদ। এর মাধ্যমে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজন এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন আইনে শাস্তি কিছুটা কমানো এবং কিছু ধারার সংস্কার করা হয়েছে। তাই শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এ আইনে রয়েই গেছে। বুধবার পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতি করবে বলে সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, বরং তা আগের মতোই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে ধারা দুটি বাতিলের আহ্বান করা হয়েছিল। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে তল্লাশি, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভারসহ সবকিছু জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে পুলিশ। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন আইনের চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে। সাইবার-সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের জেল ও কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ চায়, ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা সন্নিবেশিত থাকায় এই আইন কার্যকর হলে পূর্বের ন্যায় তা আবারও সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নিবর্তনমূলক আইন বলা ছাড়া নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সম্পাদক পরিষদ।
HimalaySep 20, 2023