রাফিয়া আলম: আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন খেতে না চাইলে কত না মজা করে খাওয়ানো হতো আমাদের! সাধারণ খাবার, কিন্তু অসাধারণ খাওয়ানোর উপায়। খাবারটুকু ছোট ছোট ভাগ করে এটা এর নামে, ওটা তার নামে—এভাবে চটপট খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা। কিংবা এই একটা বাগানে একটা গাছ (আসলে এক টুকরা ফুলকপি, যা শিশুমনও বুঝতে পারছে অনায়াসে), এই সামান্য উপস্থাপন হয়তো ‘অসামান্য’ কিছু ছিল আমাদের কাছে। ‘একটা ছোট মাছ আমি খাই, একটা আমার সোনামণি খাবে’—এভাবে মায়েরা একটু একটু করে খাইয়েই না সঠিক খাদ্যাভ্যাসের দিকে শিশুকে নিয়ে আসেন।
আজকাল হয়েছে এক বায়নাক্কা। ডিজিটাল শিশুদের ডিজিটাল অভিভাবক আমরা। এত ‘ঢং’ করে শিশুকে খাওয়ানোর সময় নেই আমাদের! সামনে চালাতে থাকো ডিজিটাল ছবি। ছবি ঘুরবে, আর খাবার চালান হতে থাকবে শিশুর পাকস্থলীতে। নইলে শিশুকে খাওয়ানো যেন এক বিরাট ঝক্কি। ‘আমার বাচ্চাটা কিছুই খায় না’—বেশির ভাগ মায়ের এই এক অভিযোগ। শিশু ঠিকমতো খাবার খেল কি না, পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে কি না, সঠিকভাবে বড় হচ্ছে কি না, মায়ের চিন্তার কি আর শেষ আছে? এত সব নিয়ে মা ভোগেন দুশ্চিন্তায়। আর এরপর শিশুর ওপর শুরু হয় তোড়জোড়, ‘বাবু এটা খাও, বাবু ওটা খাও, বাবু আর একটাবার মুখে নাও।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলে শিশুর একসময় খাবারের প্রতি অনীহা চলে আসতে পারে। শিশু খাবারকে শত্রু মনে করতে পারে। তাই কোনো অবস্থাতেই শিশুকে জোর করা যাবে না। শিশু একটু বড় হলে বরং শিশুকে খাবারের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা যেতে পারে। তার পছন্দ-অপছন্দ বুঝে খাবার দিতে হবে।
চাই বৈচিত্র্য
একটানা অনেক দিন ধরে একই ধরনের খাবার খেলে শিশু খাবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। পুষ্টিকর খাবার তো দেবেনই, আর তা মজাদার উপায়ে তৈরি করে দিন ঘরে। শুধু খিচুড়িই নয়, শিশুকে ভাত, ডাল, সবজি, মাছ, মাংস সবই দিন। বাড়ির বড়রা যা খাচ্ছেন, সেগুলো খেতেই অভ্যস্ত করুন ধীরে ধীরে। ছয় থেকে আট মাস বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন তিন বেলা ঘরে তৈরি খাবার দিন। আট মাস বয়স থেকে এর পাশাপাশি দুই বেলা নাশতা দিতে হবে। এক বেলা টাটকা মৌসুমি ফল দিতে পারেন। অন্য বেলা হয়তো ঘরে তৈরি কোনো নাশতা। একেক দিন একেক রকম খাবার দিতে চেষ্টা করুন।
খাওয়ায় আগ্রহী করতে আরও যা
শিশুকে নিজে নিজে খাবার খেতে অভ্যস্ত করে তুলুন। পরিবারের সবার সঙ্গে শিশুকে বসিয়ে খাওয়ান। শিশুর খাবারে অতিরিক্ত ঝালও দেবেন না, আবার একেবারে ঝাল ছাড়া রান্না করারও প্রয়োজন নেই। খাবারটা মজা করে পরিবেশন করার কিংবা মজার গল্পের সঙ্গে পরিবেশন করার চেষ্টা করতে পারেন। খেলার ছলেই খাইয়ে দিন শিশুকে।
জেনে নিন
● এক বছর বয়স পর্যন্ত প্রথমে বুকের দুধ খাইয়ে এরপর ঘরে তৈরি বাড়তি খাবারটা শিশুকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
● এক বছর পার হলে দুই বছর বয়স পর্যন্ত খাওয়ানোর সময় প্রথমে ঘরের খাবার খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে দিয়ে এরপর মায়ের দুধ দিন।
● টেলিভিশন, মুঠোফোন, কার্টুন প্রভৃতি দেখিয়ে খাওয়ানো যাবে না।
● ১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে একবারের খাবার নিয়ে বসে থাকা যাবে না। শিশুকে ১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে খাওয়ার কথা বলবেন না। খেতে বসেও খুব ধীরভাবে খেতে দেবেন না। খুব ধীরে খেলে খাবারের গুণ নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তী খাবারের জন্য ক্ষুধাও কমে আসে।
● ছয় মাস অন্তর নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওজন দেখার জন্য শিশুকে নিয়ে যেতে পারেন। সেখানে থাকা তালিকা (বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী শিশুর ওজনের নির্দেশক চার্ট) দেখে বোঝা যাবে, আপনার শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কি না। প্রয়োজনে এক মাস অন্তর ওজন মাপাতে পারেন। মাপার পর চার্টে মিলিয়ে দেখতে হবে।