সালমা আনজুম লতা: উপহার পেলে খুশী হয়না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। আমিও খুশী হই। জন্ম থেকে এ পর্যন্ত বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী সবার কাছ থেকে কোন না কোন সময় কিছু না কিছু উপহার পেয়েছি। বুদ্ধি হবার পর থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত যা পেয়েছি, তার কথা খুব একটা মনে নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে কাউকে উপহার দেয়ার গুরুত্ব , নিজে উপহার পাওয়া বুঝতে শিখেছি এবং মনেও রেখেছি। তখন জন্মদিনে, ঈদে, ১লা বৈশাখে বা ১লা জানুয়ারীতে সামান্য কিছু পেলেও খুব ভাল লাগতো। খুশী হতাম। জন্মদিনে বন্ধুদের কাছ থেকে ছোট্ট কানের দুল, কাঁচের চুড়ি, চাবীর রিং, গানের ক্যাসেট, ডায়েরী কিংবা বই পেলে অনেক খুশী হতাম। আমিও দিতাম এমনই কিছু। তখন কাউকে দামী কিছু দেয়ার সামর্থ্য আমাদের ছিলনা।আমার অনার্স পরীক্ষার ফলাফলের পর আমার ভাই (মাসুদ ভাই) আমাকে একটা ছোট্ট লাল ফিলিপস রেডিও কিনে দিয়েছিলেন। আমি খুব খুশী হয়েছিলাম। তখন ওটার দাম কতই বা হবে ? বড়জোড় ২০০ টাকা। এই রেডিওটার কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। বিয়ের পরপর আমার বেটার হাফ মেজর (অবঃ) মহিউদ্দিন সাহেব রাঙ্গামাটি থেকে আমাকে এক জোড়া হাতীর দাঁতের পলা এনে দিয়েছিলেন।বিয়ের অনেক আগে থেকেই আমার খুব সখ ছিল এই পলার। কাউকে কোনদিন সেকথা বলিনি। মেজর মহিউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে এই উপহার পেয়ে সেদিন খুশীর চাইতে অবাক হয়েছিলাম অনেক বেশী। উনি কী করে জানলেন, আমার মনের খবর ? বিয়ের পর প্রথম জন্মদিনে আমাকে বেশ দামী একটা হাতঘড়ি দিয়েছিলেন। যেটা ওনার সাধ্যের বাইরেই ছিল। বউকে খুশী করার জন্যই হয়তো কিনেছিলেন। জীবনের প্রথম মোবাইলটাও (নকিয়া, এখনো আছে) মেজর সাহেবের কাছ থেকে কোন এক জন্মদিনে রাত ১২ টায় উপহার হিসেবে পেয়ে চমকে গিয়েছিলাম। আরো একটা উপহারের কথা না বল্লেই নয়। আমার বিবাহবার্ষিকীতে আমার অত্যন্ত প্রিয় Calvin Klein-এর একটা পারফিউম দিয়েছিলেন। ওটা স্মৃতি হিসেবেই থাকবে আরো অনেকদিন। ৩৫ বছর ধরে আমার খাওয়া পড়ার সমস্ত দায়িত্ব উনি সুন্দরভাবে পালন করে যাচ্ছেন। সেটা ওনার কর্তব্য । তার পাশাপাশি মাঝেমাঝে এই অসামান্য উপহার গুলো পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি। হচ্ছি।
বিয়ের পর জন্মদিনে মায়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে একটা দেয়াল ঘড়ি কিনেছিলাম। সেটা মূল্যবান উপহার হিসেবে এখনো সযত্নে রেখেছি। মা অনেক আগেই চলে গেছেন। দেয়ালে ঘড়িটা আজো সচল আছে। সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস উপহার হিসেবে পেয়েছি বোন রত্নার কাছ থেকে। ও জানতো আমার কখন, কী লাগবে। সেসব জিনিস জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর উসিলায় কিনে দিতো। এখনো দেয়। ২০০০ সালে চল্লিশতম জন্মদিনে একসাথে অনেকগুলো উপহার পেয়ে বাচ্চাদের মত খুশী হয়েছিলাম। আমার বোন রত্নার স্বামী সানাভাই আমাকে একটা সোনার চেইন দিয়েছিলেন। ওটা আমাকে বারবার একথাই মনে করিয়ে দেয় সানাভাই আমাকে কখনই শালী মনে করতেন না। আমাকে নিজের বোনের চাইতেও বেশী ভালবাসতেন।
আমার পঞ্চাশতম জন্মদিনে আমার বড়’দা আমাকে দিয়েছিলেন অসাধারণ বেশ কিছু গানের ৫০টা সিডিসহ একটা সিডি প্লেয়ার। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। উনি আমার থেকে কুড়ি বছরের বড়। ভাবতে অবাক
কেমন করে জানলেন আমার প্রিয় গানগুলোর কথা? আর এখন? হাজারবার নিষেধ করা সত্বেও বুড়ো বয়সে বন্ধুবান্ধবরা সবাই উপহার দিয়েই যাচ্ছে। উপহার পেলে আমি এখন আগের মত খুশী হইনা। বরং বোঝা মনে হয়। বয়সের জন্যই হয়তো।
বাবামা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারের চেয়ে সন্তানের কাছ থেকে উপহার পাওয়াটা বোধ হয় সবচেয়ে বেশী আনন্দের, সবচেয়ে বেশী সম্মানের। কারণ এর সাথে মিশে থাকে অন্য এক অনুভুতি, অন্যরকম আবেগ। প্রায় সব মায়েরাই আমার সাথে একমত হবেন। বাচ্চারা যখন ছোট থাকে তখন ওদের জমানো টাকা থেকেই কিছু কিনে বাবা মাকে উপহার দেয়। আবার কেউ কেউ লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি করে বা অন্য কিছু করে আয় করে। সেই টাকা থেকে বাবা মাকে কিছু কিনে দেয়। সেটা যেমন আনন্দের, আবার লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী করে আয় করে যখন কিছু উপহার দেয় সেটাও আনন্দের। সন্তানের কাছ থেকে কিছু পাওয়াটাই অনেক অনেক আনন্দের।
আমার তিন ছেলেই ছোট বেলা থেকে ক্রিকেট খেলতো। ক্রিকেট খেলে তুলনামূলকভাবে ওরা খুব কম বয়সেই আয় করতে শুরু করে। জাতীয় দলে খেলার সুযোগ না পেলেও অনূর্ধ ১৩ , ১৫ , ১৭ , ১৯ দলে খেলার সুযোগ পেয়েছিল আমার ছোট দুই ছেলে। সবচাইতে মজার ব্যাপার বড় ছেলে শাহরিয়ার নাফীসের (জাতীয় ক্রিকেটার) আগেই মেঝ ছেলে ইফতেখার নাঈম আহমেদ আদীব অনূর্ধ ১৩ ক্রিকেট টূর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিল ভারতের শিলিগুড়ি। তখন ওর বয়স মাত্র ১১ বছর। ১১ বছর বয়স হলেও দেখতে আরো ছোট মনে হতো। আমাকে ছাড়া দেশের বাইরে গিয়ে বেশ কয়েকদিন ছিল। টূর্নামেন্ট শেষে দেশে ফিরে আসার পর ওকে আনতে গিয়েছিলাম জাতীয় স্টেডিয়ামে (পুরোন)। এতদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা। গাড়িতে উঠেই আমার ছেলের প্রথম প্রশ্ন;
আম্মু, তুমি কয় হাত শাড়ি পড়ো?
(অবাক হয়ে) কেন বাবা?
আমি তোমার জন্য একটা ১২ হাত শাড়ি এনেছি।
মানে?
আমি শিলিগুড়ি থেকে তোমার জন্য একটা ১২ হাত শাড়ি কিনে এনেছি।
ওকে বুকে জড়িয়ে আদর করলাম। ওইটুকুন ছেলে দোকানে গিয়ে কিভাবে শাড়ি কিনলো? কে বুদ্ধি দিলো?
প্রশ্ন করলাম, তুমি কিভাবে কিনলে?
আম্মু, দোকানদার বলেছে এটা ১২ হাত শাড়ি। এটার দাম ১৭৫ রুপী। আমি বললাম, ১৭০ রুপীতে দেয়া যাবে? তারপর দিয়ে দিলো।
সেদিন আনন্দে আমার চোখ ভিজে গিয়েছিল। সেই বছর ঈদে আমার মেঝ ছেলের দেয়া ১৭০ রুপী দামের সূতী হাল্কা ফিরোজা রংয়ের ছাপা শাড়িটা পড়ে সবার বাসায় বেড়াতে গেলাম। সাথে ম্যাচিং ফিরোজা গহনা। খুব গর্ব করে সবাইকে বললাম, দেখো আমার ১১ বছরের ছেলের আয়ের কেনা প্রথম উপহার।
আমার তিন ছেলেই দেশের বাইরে খেলতে গেলে কিছু না কিছু উপহার আনতো। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো , বড় ছেলে শ্রীলংকা খেলতে গিয়ে আমাদের দুই বোনের জন্য শাড়ি এনেছিল। আর ছোট ছেলে আকীব নেপালে গিয়েছিল অনূর্ধ ১৭ ক্রিকেট টূর্নামেন্ট খেলতে। সেখান থেকে আমার জন্য সুন্দর একটা শাল এনেছিল। তবে মেঝ ছেলে আদিবের দেয়া অনেক উপহার আমার অন্তরে গেঁথে আছে। ওর দেয়া মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ট্যাব যখন ব্যবহার করি; অন্তর থেকেই দু’আ চলে আসে। ওর দেয়া
আমার তিন ছেলেই দেশের বাইরে খেলতে গেলে কিছু না কিছু উপহার আনতো। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো , বড় ছেলে শ্রীলংকা খেলতে গিয়ে আমাদের দুই বোনের জন্য শাড়ি এনেছিল। আর ছোট ছেলে আকীব নেপালে গিয়েছিল অনূর্ধ ১৭ ক্রিকেট টূর্নামেন্ট খেলতে। সেখান থেকে আমার জন্য সুন্দর একটা শাল এনেছিল। তবে মেঝ ছেলে আদিবের দেয়া অনেক উপহার আমার অন্তরে গেঁথে আছে। ওর দেয়া মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ট্যাব যখন ব্যবহার করি; অন্তর থেকেই দু’আ চলে আসে। ওর দেয়া শিলিগুড়ি থেকে আনা প্রথম শাড়িটা আমি স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি। রাখবো যতদিন বেঁচে থাকি। এটা যে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার । অ্যারিজোনা থেকে, ১২/১২/২০১৯।
লেখিকা: বাংলাদেশ টি ২০ ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক শাহরিয়ার নাফিসের মা এবং এনলিস্টেড শিল্পী, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার।