শুরুটা হয়েছিল প্রাণিবিদ্যার ক্লাসে। লেকচার হলে নামের আদ্যক্ষর অনুসারে সারি হয়ে বসেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ২১ বছর বয়সী জন হেন্ডারসনের ঠিক সামনের আসনেই বসেছিলেন শারলট কার্টিস। ২০ বছর বয়সী লাজুক চেহারার শারলটকে পেছন থেকে দেখতে বেশ ভালো লাগছিল হেন্ডারসনের। সামনে বসে থাকলেও বিষয়টি ঠিকই টের পাচ্ছিলেন শারলট।
এক জোড়া চোখ পেছন থেকে তাঁকে অনুসরণ করে চলেছে, সেটা বুঝতে পেরে কী ভাবছিলেন শারলট? নাহ, তিনি তেমন কিছুই ভাবেননি। হেন্ডারসনকে একজন সহপাঠী ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। তাই কাঁধের পাশ দিয়ে তাঁর দিকে হেন্ডারসনের তাকিয়ে থাকা নিয়ে কিছুই মনে করেননি তিনি।
যে সময়ের স্মৃতিচারণা হচ্ছে, সেটা ৮৫ বছর আগের ঘটনা। বিবাহের ৮০ বছর বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে তাঁদের প্রথম দিনের দেখা হওয়ার ঘটনা নিয়ে লোকজনের কৌতূহলের শেষ নেই। আর কৌতূহল না থাকারও কারণ নেই। কারণ হেন্ডারসন-শারলট সবচেয়ে প্রবীণ জীবিত দম্পতির স্বীকৃতি পেয়েছেন। একসঙ্গে দীর্ঘ সময়ের ভালোবাসার এই পথচলা স্থান পেয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এই পথচলা, প্রথম পরিচয়, বিয়ে, সংসার নিয়ে কথা বলেছেন হেন্ডারসন-শারলট। হেন্ডারসনের বয়স এখন ১০৬ আর শারলটের ১০৫ বছর।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অন্যতম বৃহত্তম শহর ফোর্ট ওয়ার্থে ১৯১২ সালে জন্ম জন হেন্ডারসনের। প্রথমবার রেডিও শোনার অভিজ্ঞতার কথা তিনি বলেছেন সাক্ষাৎকারে। এক প্রতিবেশীর বাসায় আনা হয়েছিল রেডিও। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র আট বছর। ওই দিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি লম্বা অ্যান্টেনার কথা। একটি অনুষ্ঠান শোনার জন্য তাঁরা বাড়ির সামনে পেছনের উঠানে রেডিওর অ্যান্টেনা তুলে দিয়ে ছুটোছুটি করছিলেন।’
১৯৩০ সালে হেন্ডারসন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য টেক্সাসের রাজধানী অস্টিনে চলে যান। সেখানে তিনি একটি ফুটবল দলের গার্ড হিসেবে ছিলেন। ওই সময় অস্টিনে ৫৩ হাজার লোকের বাস ছিল। এখন সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করে।
গ্রেগরি জিমের আশপাশে একটি কক্ষ ভাড়া করে ছিলেন হেন্ডারসন। শহুরে ক্যাম্পাসের যে কয়টি ঐতিহাসিক ভবন অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলোর একটি হচ্ছে গ্রেগরি জিম।
জন হেন্ডারসন বলেন, ‘আমার পাশের বাড়ির লোকজনের গরু ও মুরগি ছিল। গ্রেগরির সড়কে এখন কারও গরু ও মুরগি থাকার কথা কল্পনা করা যায়! এখন ক্যাম্পাস এত বড় যে কিছু চেনাও কঠিন।’
শারলট আইওয়া অঙ্গরাজ্যে জন্ম নেন। তাঁর যখন ২০ বছর বয়স, তখন তাঁর বোনের স্বামী সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা যান। তাঁর বোনের স্বামী টেক্সাসে নিযুক্ত ছিলেন। বোনকে সাহায্য করতে শারলটের পুরো পরিবার আইওয়া থেকে চলে আসে টেক্সাসে। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে (ইউটি) ভর্তি হন। ওই বছরই হেন্ডারসনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। ওই সময় বিখ্যাত ইউটি টাওয়ারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তাঁরা গ্র্যাজুয়েট হওয়া পর্যন্ত টাওয়ার নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি। ওই সময় টেক্সাস ক্যাপিটলের চেয়ে উঁচু ভবন নির্মাণে বিধিনিষেধ ছিল। এখন সেখানে আকাশছোঁয়া ভবনের ভিড়ে টেক্সাস ক্যাপিটলের গম্বুজ আর উঁকি দেয় না।
প্রেমের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে হাসতে হাসতে হেন্ডারসন বলেন, ‘বিয়েতে রাজি হতে শারলটের পাঁচ বছর সময় লেগেছিল।’ তাঁরা সংসার গড়ার আগে কিছু অর্থ উপার্জন করতে চেয়েছিলেন। তাই শারলট হিউসটন এলাকায় শিক্ষকতা শুরু করেন। আর হেন্ডারসন টেক্সাসের পোর্ট আর্থারে ফুটবল ও বাস্কেটবল দলের কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯৩৯ সালের ২২ ডিসেম্বর খুব ছোট্ট একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে করেন জন হেন্ডারসন ও শারলট। তাঁদের অতিথি ছিলেন মাত্র দুজন। তাঁরা সান অ্যান্টোনিওতে মধুচন্দ্রিমা যাপন করেন। হোটেলের প্রতিদিনের ভাড়া ছিল সাত ডলার।
তবে সম্পর্কের ৮৫ বছর হলেও তাঁদের বিবাহিত জীবন ৮০ বছরের। এ কারণে তাঁরা সবচেয়ে দীর্ঘ বিয়ের রেকর্ডটি এখনো ছুঁতে পারেননি। ওই রেকর্ডটি রয়েছে জেলমাইরা ও হেরবার্ট ফিশার দম্পতির। ২০১১ সালে হেরবার্টের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁদের ৮৬ বছর ২৯০ দিনের বিবাহিত জীবন ছিল।
হেন্ডারসন দম্পতি টেক্সাসের বেটাউনে সংসার পাতেন। শারলট শিক্ষকতা পেশাতেই ছিলেন। আর হেন্ডারসন দীর্ঘ সময় ধরে যুক্ত থাকেন হাম্বেল ওয়েল অ্যান্ড রিফাইনিং কোম্পানিতে। তিনি ১৯৭২ সালে অবসর নেন।
জীবনে অনেক কিছুই প্রথম দেখার বিষয়টি হেন্ডারসনকে আনন্দ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সাক্ষাৎকারে। জেট ইঞ্জিনের পাশাপাশি তেমন এক আবিষ্কার হলো টেলিভিশন। পঞ্চাশের দশকে নিউইয়র্কে ঘুরতে গিয়ে কাচ ঘেরা দোকানের বাইরে থেকে টেলিভিশন দেখেছিলেন প্রথম। এর কয়েক বছরের মধ্যে নিজেও কিনেছিলেন টেলিভিশন।
এই দীর্ঘায়ুর রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে এই দম্পতির জবাব, সংযমের মধ্যে বসবাস। তাঁরা বলেন, তাঁরা পরিমিত খাবার খান, তেমন মদ্যপান করেন না, হেন্ডারসন এখনো এলাকার জিমে নিয়মিত ব্যায়াম করেন। কানে কিছু কম শোনা ছাড়া তাঁদের আর কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। তাঁরা বেশ সুস্থ আছেন।
এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। জন হেন্ডারসন কৌতুক করে বলেন, ‘এ নিয়ে অনেকেই বলেন, এই কারণেই আমরা এত দীর্ঘ সময় বেঁচে আছি!’
বিয়ের ৮০ বছর তো কেটে গেল, এখনো কি ঝগড়াঝাঁটি, তর্কাতর্কি করেন? জন হেন্ডারসন জানালেন, তাঁরা তা করেন না।
তবে বিবাহিত জীবনকে শান্তিপূর্ণ রাখতে নিজেদের ফর্মুলা টুকে রাখার পরামর্শ দিয়ে বলেন, তাঁরা কখনোই সেভাবে ঝগড়া করতেন না, এবং কোনো সমস্যা হলে তা অবশ্যই সেদিনের মতো মিটিয়ে ফেলতেন।