আশরাফুল ইসলামঃ আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা ব্যাংকে ধরনা দিচ্ছেন। তারা কোনো ঋণখেলাপি হয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করছেন। কেউবা ঋণ পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত হচ্ছেন। সোনালী ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংকে তিন ডজনেরও বেশি প্রার্থী ঋণ নবায়নের জন্য এসেছেন। তাদের নাম পরিচয় না জানানোর শর্তে ওই কর্মকর্তা জানান, যারা ব্যাংকে আসছেন, বেশির ভাগই ব্যাংকের খাতায় ঋণখেলাপি। এরা এখন ঋণখেলাপিমুক্ত হতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছেন।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত দশম জাতীয় নির্বাচন ছিল অনেকটা একতরফা। একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না হওয়ায় ওই সময় দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। এর ফলে ১৫৩টি আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ভোট ছাড়াই। এ একতরফা নির্বাচনের আগে কোনো ঋণখেলাপি ব্যাংকের সাথে তেমন যোগাযোগ করেননি। ব্যাংকাররা জানান, গত ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে যে পরিমাণ ঋণখেলাপি তাদের ঋণ নবায়ন করেছিলেন, ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার শতকরা ২ ভাগও ঋণ নবায়ন করেননি। এ কারণে তারা (ব্যাংকাররা) তখন হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনকেন্দ্রিক ঋণ নবায়নের চিত্র পাল্টে গেছে। এখন অনেকটা জাতীয় নির্বাচনের আমেজ মনে হচ্ছে ব্যাংকারদের কাছে। অনেকেই ঋণ নবায়ন করতে আসছেন।
গতকাল অগ্রণী ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তারা পুরোপুরি নিরাশ হয়েছিলেন। ওই সময় বড় কোনো নেতা বা বড় অঙ্কের কোনো ঋণখেলাপির ঋণ নবায়ন হয়নি। কেউ ব্যাংকে পর্যন্ত যোগাযোগ করেননি। অথচ বিগত বছরগুলোতে খেলাপি ঋণের বড় একটি অংশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আদায় হতো।
জনতা ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গত ২০০১ সালের নির্বাচনে ৩৩৯ জন ঋণখেলাপি নির্বাচন উপলক্ষে তাদের খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছিলেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনেও একটি উল্লেখযোগ্য ঋণখেলাপি ঋণ নবায়ন করেছিলেন। কিন্তু গত ২০১৩ সালে হাতেগোনা ১০ জন ঋণখেলাপি তাদের ঋণ নবায়ন করেছিলেন। এবার নির্বাচনকে ঘিরে ছোটবড় অনেকেই বিশাল অঙ্কের ঋণ নবায়ন করছেন। যেমনÑ চট্টগ্রাম অঞ্চলে আওয়ামী লীগের একজন এমপির মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের নামে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল। তা তিনি নবায়ন করে নিয়েছেন। সাবেক মন্ত্রী ও সাম্যবাদী দলের এক নেতার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি ছিল। তিনি এরই মধ্যে তা নবায়ন করেছেন।
ব্যাংক কোম্পানি আইনানুযায়ী, কোনো প্রার্থী ঋণখেলাপি হলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। এ কারণে খেলাপিমুক্ত হতে ব্যাংকে আসেন প্রার্থীরা। খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে হলে ১৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট অর্থাৎ ১০০ টাকা খেলাপি হলে ১৫ টাকা নগদ ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এরপর তার ঋণ নিয়মিত হয়, অর্থাৎ খেলাপিমুক্ত হয়।
তবে সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ঋণ নবায়নের জন্য অনেকেই আসছেন। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বেশির ভাগই ডাউন পেমেন্ট না দিয়ে নবায়ন করতে চাচ্ছেন। এ কারণে অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।
সোনালী ব্যাংকের ওই সূত্র জানিয়েছে, বিরোধীদলীয় নেতাদের মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনেই তাদের ঋণ নবায়ন করছেন। যেমনÑ বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও মুন্নু গ্রুপের কর্ণধার মরহুম হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে আফরোজা খানম রিতা বিএনপির পে মানিকগঞ্জ থেকে প্রার্থী হতে পারেন। তাদের প্রতিষ্ঠান মুন্নু ফেব্রিক্স সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৩০ কোটি টাকা। গ্রুপের প থেকে এরই মধ্যে এই ঋণ নবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঋণ নবায়নের জন্য এককালীন ডাউন পেমেন্ট বাবদ ১১ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে। বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী মোর্শেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকমের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গ্রুপের প থেকে ঋণ নবায়নের বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। তারা বিদেশী উদ্যোক্তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে ঋণ শোধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
কয়েকটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, নির্বাচন যত সামনে আসছে ততই ঋণখেলাপিদের ব্যাংকে আনাগোনা বাড়ছে। ফলে এবার নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আদায় করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।