করিম চৌধুরী
১৯৯৭ সাল, নিউ ইয়র্কে একটা অপ্রত্যাশিত চিঠি পেয়েছিলাম। আমি থাকতাম নিউ ইয়র্ক সিটিতে, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ম্যানহাটন। এয়ারমেইল খামের বাঁ দিকে প্রেরকের নাম লেখা-
রানু
চন্দ্রঘোনা
আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউ কোনো কালেই চন্দ্রঘোনা ছিলো না। নিজের আত্নীয় হোক আর অপরিচিত কেউ হোক, কারো চিঠি পেলে আমি সঙ্গে সঙ্গে চিঠি খোলতাম না। আমেরিকায় আমাদের অন্যতম একটা কাজ ছিলো, প্রতিদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে রুমে ঢুকার আগেই লেটার বক্স খোলা। ওই দেশের বিভিন্ন কোম্পানি থেকে চিঠি আসে। ক্রেডিট কার্ডের বিল আসে।
লেটার বক্স থেকে চিঠি নিয়ে আগে ১০/১৫ মিনিট ভাবতাম। কী হতে পারে চিঠির ভেতরের বিষয় বস্তু? আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম ওই চিঠি পেয়ে। আমেরিকায় ওই সময় দেশ থেকে আমার কাছে যতো চিঠি যেতো, সব চিঠির শেষে টাকা পাঠানোর অনুরোধ থাকতো। কাউকেই বিমুখ করতাম না। গত পরশু আমার রেইস কোর্সের বড় আপার দ্বিতীয় ছেলে মানে আমার ভাগিনা রাশেদকে কথা প্রসঙ্গে কাকে কতো টাকা দিয়েছিলাম তার একটা খসড়া হিসেব দিয়েছিলাম। আত্নীয় অনাত্মীয় মিলে প্রায় সাত (৭) লাখ টাকা দিয়েছিলাম সবাইকে। সবই সম্প্রদান কারকে, মানে ফেরতযোগ্য নয়। ওই সময়ের ৭ লাখ টাকা এখন কয়েক কোটি টাকা। আমার চরিত্রের সবচেয়ে বড় দোষ আমি কাউকে ‘না’ করতে পারি না। এদের অনেকেই এখন কোটিপতি। আমার সঙ্গে কথাও বলে না। আমার এখন আর পর্যাপ্ত টাকা নেই। যদি ওদের কাছে টাকা ধার চাই, তাই অনেকেই আমাকে দেখলে এভোয়েড করে! ধুর বেটা, করিম চৌধুরী যাকে কিছু দেয় তা ফেরত পাওয়ার আশায় দেয় না। অনেকের পেটেই আমার টাকার ভাত আছে। অনেকেই বিএ, এমএ পাশ করেছে আমার টাকায়। আমি জীবনকে যেভাবে উপভোগ করেছ, তোমরা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েও তা পারবা না। কোথায় দিনাজপুর আর কোথায় সিঙ্গাপুর!
এনি ওয়ে, ওই চিঠি খুলে পড়লাম। একটা মেয়ে লিখেছে সেই চিঠি। তার চিঠির প্রথম লাইনটি আজো মনে আছে।
“প্রিয় করিম,
Friendship is much more tragic than love because it lasts longer- Oscar Wilde.
চিঠির বিষয় বস্তুঃ যায় যায় দিনে আমার লেখা পড়ে তার খুব ভালো লেগেছে। তাই আমাকে চিঠি লিখেছে। চিঠিতে সে আমার বন্ধু হবার আকুতি জানিয়েছে। আমি তাকে ছোট করে উত্তর দিলাম এবং জানতে চাইলাম, আমার ঠিকানা সে কোথায় পেয়েছে? ফিরতি চিঠিতে সে জানালো, আমার লেখা পরে সে চন্দ্রঘোনা থেকে যায়যায়দিন সম্পাদককে চিঠি লিখে আমার ঠিকানা চেয়েছে। তখন যায়যায়দিনের গবেষণা সহকারী সজীব ওনাসিস তাকে আমার ঠিকানা পাঠিয়েছে। সজীবের নিজ হাতে লেখা আমার ঠিকানাটাও সে চিঠির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলো। বিশ্বাস যোগ্যতার জন্য।
প্রতি সপ্তাহে রানু আমাকে একটা চিঠি লিখবেই। চিঠিতে তার পারিবারিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছিলো। তারা দু’বোন, সে ছোট। ওই সময়ই সে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলো। তার ভালো নাম ফাতেমা ইয়াসমিন রানু। তার বড় বোনের নাম নাসরিন ফাতেমা মারজান। তাদের কোন ভাই নেই। বাবা চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে চাকরি করেন। বাবার নাম আবদুল গফুর। আমাকে সে ছবিও পাঠিয়েছিলো। আমিও তাকে অনেক ছবি পাঠিয়েছিলাম।
এই ছবি পাঠানোই আমার জন্য কাল হলো। ছবি দেখে মেয়েটি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। এরপর থেকে তার চিঠি লেখার ধরন বদলে গেলো। তার চিঠি হয়ে গেলো প্রেমের চিঠি। তার চিঠির ভাষাশৈলী অত্যন্ত চমৎকার ছিলো। রানু খুব বিনয়ী ও ভদ্র ভাষায় চিঠি লিখতে পারতো। আমি কোন জেলার সে জানতো না তখনো। একদিন এক চিঠিতে সে লিখলো,
”আমার গ্রামের বাড়ি ফেনি জেলার দাগনভুঁইয়া উপজেলায়। তোমার গ্রামের বাড়ি কোন জেলায় করিম?” আগে নিজের বাড়ির পরিচয় দিয়ে আমার বাড়ি কোথায় জানতে চেয়েছে। চমৎকার ভদ্রতা! এখন ওয়াশিংটন ডিসিতে আছেন শিরিন আপা, এই আপার বাসায় আমার নিয়মিত যাওয়া আসা ছিলো। আপাও জানতেন রানুর কথা। কতো যে খেয়েছি আপার বাসায়। শিরিন আপা তখন নিউ ইয়র্ক ছিলেন। আমার প্যান্ট শার্টের বুতাম ছুটে গেলে আপা লাগিয়ে দিতেন। দুষ্টুমি করে বলতেন, দেশে গেলে রানুই জামাকাপড় ঠিক করে রাখবে। আপার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। আপাকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে “ফোনবোন” গল্পও লিখেছিলাম যায়যায়দিনে। আর জানতেন জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ স্টৃটে অবস্থিত “অনন্যা” লাইব্রেরির মালিক শহিদ ভাই। রোববার সারাদিন আমার আড্ডা ছিলো ওই লাইব্রেরিতে।
১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে রানু আমাকে একটা চিঠি লিখতো। প্রতি ঈদে রানু পার্সেল করে আমার জন্য বাংলাদেশ থেকে পাঞ্জাবি, টুপি, কলম পাঠাতো। চিঠিতে লিখে দিতো, পরের লেখাটা যেন ওর পাঠানো কলম দিয়ে লিখি।
আমি নিষেধ করলেও সে শুনতো না। একদিন আমি লিখলাম, তোমার কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে জানিও। উত্তরে সে লিখলো, আমার কিছুই লাগবে না। আমি বরাবরই স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। এক পর্যায়ে সে আমাকে বিয়ে করার আগ্রহ জানালো। আমি তাকে লিখলাম, আমি বয়সে তোমার চেয়ে অনেক বড়। এমন অসম বিয়ে আমার পছন্দ নয়। তাছাড়া আমি কবে দেশে ফিরি তার কোনো ঠিক নেই। আর আমি কিছুটা পাগল টাইপের মানুষ।
সে লিখলো, পুরুষের আবার বয়স কিসের? আমি তোমাকে আমার করে চাই। তুমি দেশে চলে এসো। তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। আমার সঙ্গে থাকবে। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসবো। আমিই তোমাকে খাওয়াবো, পড়াবো। আমাদের যে এসেট আছে তাতে তোমার কোনো অভাব হবে না। আর লেখকরা একটু পাগল টাইপেরই হয়, আমি জানি। আমি এমন পাগলই ভালোবাসি।
১৯৯৯ সালের শেষ দিকে আমি ফ্লোরিডায় মুভ করি। আগের মতোই সে আমাকে চিঠি লিখে। ফ্লোরিডায় আমার বন্ধু কবি্ ইমতিয়াজ, নোয়াখালীর দিদার ভুঁইয়া, বাবু, ময়মনসিংয়ের লিটু ভাই, লিটু ভাইয়ের ওয়াইফ বহ্নি ভাবীও জানতেন। বহ্নি ভাবী খুব গল্প উপন্যাস পড়তেন। আমার কাছ থেকে যায়যায়দিন নিয়ে আমার সব লেখা পড়তেন। এমন রুচিশীল, মার্জিত, সংস্কৃতিমনা, শান্ত, ভদ্রমহিলা আমি জীবনে কম দেখেছি। আমি বয়সে বড় হলেও আমাকে আদর করতেন। মন্টু ভাই ডাকতেন। সিলেটের খাইরুল, দিনাজপুরের অমিয়, আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু সোহেল সবাই এই কাহিনী জানতো।
একদিন অমিয় বললো, আচ্ছা মন্টু ভাই, রানুকে বিয়ে করার পর যদি দেখেন রাতে ঘুমালে রানুর লোল পরে মানে ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে লালা পরে তখন আপনি কি করবেন? আমি একটা লাঠি নিয়ে অমিয়কে দৌঁড়ানি দিয়েছিলাম এই বলে যে, তুমি আর কোনো দোষ পাওনি? সেক্স করার সময় যদি রানু চিল্লাচিল্লি করে তখন কি করবো, এটা বলতে পারলা না?
দিদার, বাবু নোয়াখালীর বলে তাদের বলতাম, দেখো, আমি কিন্তু গ্রেটার নোয়াখালীর জামাই হতে যাচ্ছি। দেখলেই সালাম দিবা। ডোন্ট ডু বেয়াদবি উইথ মি ।
২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ আমি দেশে ফিরে আসি। দেশে এসে আমি আমার প্রিয় ছোট আপা ফরিদার গাংচরের ‘আনোয়ার লজ’র বাসায় উঠি। আমার তালতো ভাই সবগুলোই ‘পাগল’। আপা এবং ইকবাল ভাইকে বললাম এই কাহিনী। তালতো ভাই ইকবাল আমার বড়। এখন বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্যালিফোর্নিইয়ায় আছেন। তিনি বললেন, যাও না একবার দেখে আসো। আমেরিকা ফেরত পাত্র। এই সুযোগে শত শত মেয়ে তুমি দেখতে পারবা। হেলায় সুযোগ নষ্ট করবা না। বিয়েতো করবা একটাই।
ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ আমি চট্টগ্রাম গেলাম। উঠলাম নিজাম রোডের হোটেল পেনিনসোলায়। এটি ফাইভ স্টার হোটেল। কিন্তু চন্দ্রঘোনায় যাবো কিভাবে? পরদিন সকালে একটা ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ করলাম। চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে যাবো। এক ঘন্টা থাকবো। তুমি ওয়েট করবা। আবার তোমাকে নিয়েই এই হোটেলে ফিরে আসবো। কতো নিবা ভাড়া? সে দুই হাজার টাকা চাইলো।
সেই প্রথম আমার চন্দ্রঘোনায় যাওয়া। পেপার মিলে গিয়ে খোঁজে রানুদের বাসা বের করলাম। বাসায় ঢুকতেই রানু আমাকে চিনে ফেলেছে। সে মা বোনের সামনেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। যেন আমি তার হাজবেন্ড! আমি লজ্জা পেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে সে আরো শক্ত করে বুকে চেপে ধরে। রানুর গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও চেহারা খুব মিস্টি, স্লিম ফিগার। এরপর আমি রানুর মায়ের পায়ে ধরে সালাম করলাম। তিনিও বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার ছেলে নাই বাবা। তুমিই আমার ছেলে।
বসার পরে আমাকে মিস্টি আর দধি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন, খেলাম। কিছুক্ষণ গল্প করে বিদায় নিলাম। রানুর সঙ্গে সেই প্রথম এবং শেষ দেখা।
একদিন রানু আমার কুমিল্লার বাসায় টিএন্ডটি ফোনে কল করে। ধরেছিলেন জেমিমার মা। রানু তার পরিচয় জেনে আমাকে ফোনটা দিতে বলে। আমি তখন টবে ফুল গাছ লাগাচ্ছিলাম। হাত ধুয়ে এসে ফোনটা ধরতেই রানু ‘করিম’ বলে হাউমাউ করে কেঁদে বলেছিলো, তুমি আমাকে বিয়ে করবা এমন কথা দাওনি। কিন্তু তোমার বিয়ের খবরটাও আমাকে জানালে না করিম!
পরে রানু আমাকে ফোনে বলেছিলো, তারা বাসা বদল করে মাটিরাঙ্গা লিচু বাগানের কাছে বাসা নিয়েছে। ঠিকানাটা জানলে একবার যেতাম। কেমন আছে রানু এখন? কোথায় যেন আছে? হয়তবা বিয়ে করে স্বামী সন্তান নিয়ে ব্যস্ত।